প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতির খুঁটিনাটি কয়েকটি বিষয় নিয়ে দীর্ঘ একমাস ধরে আমরা আলোচনা করছি। এই পর্বটি শেষ পর্ব। আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু প্রাথমিক শিক্ষা। আগের পর্বটিতে আমরা আলোচনা করেছি পাঠ্যপুস্তক বিষয়ে। ছুঁয়ে গেছি তিন বছর বয়স থেকে শিক্ষা ও শিশুদের পুষ্টি, স্বাস্থ্য এবং দারিদ্রের সমাধান নিয়ে দুটি প্রশ্নও। এই কিস্তিটিতে আমরা মনোনিবেশ করব শিক্ষণ, মূল্যায়নে এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণে।
বিভাগ খ) শিক্ষণ সম্পর্কিতঃ
প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতিতে ক্রিয়াকলাপ-ভিত্তিক (activity-based) এবং পারস্পরিক ও পরিপূরক (interactive) লার্নিং-এর প্রসঙ্গ আনা হয়েছে। এই ধরণের পদ্ধতি শিশুদের আকর্ষণ করে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ক্রিয়াকলাপগুলি যেহেতু শিশুকে ব্যস্ত রাখে তাই মস্তিস্ক সক্রিয় থাকে, থাকে স্বাধীন ভাবে ও দলগত ভাবে কাজ করার আনন্দ। ফলত, শিশুটি দায়িত্ব নিতে উৎসাহিত হবে এবং দলগত কাজ করতে করতে তার সামাজিক দক্ষতা গড়ে উঠবে। বৃদ্ধি পাবে আত্মবিশ্বাস, যা শিশুর সামাজিক বিকাশে সহায়তা করবে, সুতরাং, এই পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরণের পদ্ধতি পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হলে তাকে মানদণ্ডের নিরিখে ঢেলে সাজাতে হবে। পরবর্তীকালে সুযোগ থাকলে আমি বিভিন্ন বিষয়ের জন্য নির্দিষ্ট পৃথক কৌশল নিয়ে আলোচনা করতে পারি। এই মুহূর্তে, আমরা আবার প্রশ্নমালায় ফিরে যাই। অ্যাক্টিভিটি-ভিত্তিক লার্নিং এবং ইন্টারেক্টিভ ক্লাসরুম ছাড়াও আমি প্রশ্ন রেখেছিলাম প্রাইভেট এডুকেশন এবং কোয়ালিটি এডুকেশন নিয়েও।
অ্যাক্টিভিটি-ভিত্তিক লার্নিং এবং ইন্টারেক্টিভ ক্লাসরুম কী? কী করে তার সংস্থান হবে? কে করবে, কবে হবে? কী ভাবে হবে?
নব্যেন্দুবিকাশ দাস
শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাদানে লেকচার মেথড সব সময় কাজে আসে না। বর্তমানে পাঠ্যবিষয়টিকে নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটি করানোর পদ্ধতিটি খুব জনপ্রিয় হয়েছে। অ্যাক্টিভিটি ভিত্তিক লার্নিং একটি ভালো মেথড। তার জন্য ক্লাসরুমটিকে সেই ভাবে তৈরি করতে হবে। বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটি করার মত কিছু উপকরণ ক্লাসরুমেই মজুদ রাখতে হবে। এই ধরণের ক্লাস রুমকেই বলা হয় ইন্টারেক্টিভ ক্লাস রুম। ইন্টারেক্টিভ ক্লাসরুমে বিদ্যুৎ সংযোগ, ইন্টারনেট সংযোগ, ডিজিটাল বোর্ড এবং সাউন্ড সিস্টেম অবশ্যই থাকতে হবে। এই ধরণের একটি ক্লাস রুম তৈরি করতে খরচ কম নয়। সরকার বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে এই ধরণের বিষয়গুলো স্পন্সর হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এই পরিকাঠামো সরকারকেই তৈরি করে দিতে হবে এবং তৈরি করতে বেশ কিছু সময় ও লাগবে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে যে ধরণের প্রতিষ্ঠানগুলো ইন্টারনেট পরিষেবা দেয়, ডিসপ্লে বোর্ড, সাউন্ড সিস্টেম তৈরি করে, তাদেরকে স্পন্সর হিসেবে ব্যবহার করে এই ধরণের ক্লাসরুম তৈরি করা খুব কঠিন হবে না।
উৎপল মুখোপাধ্যায়
শ্রেণি পঠনপাঠন যখন শিক্ষকের থেকে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বেশি হয় অর্থাৎ শ্রেণির কাজে শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে কাজ করার এবং আলোচনায় অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকে তখন আমরা সেই ক্লাসরুমকে অ্যাক্টিভিটি ভিত্তিক লার্নিং এবং ইন্টারেক্টিভ ক্লাসরুম বলি।এই ধরণের ক্লাসরুম পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে শিক্ষকের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দরকার।শ্রেণি পঠন-পাঠন পরিচালনার সাথেই সময়,শৃঙ্খলা এবং পাঠ এককের সামর্থ্যগুলি ম্যানেজ করে তিনি শিক্ষার্থীদের সামনে হাজির করবেন।শিক্ষা উপকরণ, কর্মপত্র ইত্যাদির দ্বারা সমগ্র ক্লাস সক্রিয় রাখবেন। এই বিষয়ে সরকারী আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা একান্ত প্রয়োজন।
প্রাইভেট এডুকেশন নিয়ে কী মত ?
নব্যেন্দুবিকাশ দাস
বিভিন্ন সমাজসেবী সংগঠন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির শিক্ষাব্যবস্থায় অংশগ্রহণের কথা শিক্ষানীতিতে পরিষ্কারভাবে বলা আছে। সরকারের ঘোষিত নীতি শিক্ষার বেসরকারিকরণ না হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে শিক্ষার বেসরকারিকরণ অনেকটাই সম্পন্ন। সমাজের তথাকথিত উচ্চ শ্রেণি র মানুষ, আর্থিক সঙ্গতিপূর্ণ মানুষ কেউই আর তাদের ছেলে মেয়েকে আজকাল সরকারি স্কুলে পড়ায় না। প্রাইভেট স্কুলে ছেলে-মেয়েকে পড়ানোটা একটা সোশ্যাল স্ট্যাটাসে পরিণত হয়েছে। এবং এই গনহুজুগ থেকে মুক্তি পাবার কোন দিশা অন্তত জাতীয় শিক্ষানীতিতে নেই। প্রাইভেট এডুকেশনকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না কারণ সব সময় কিছু শ্রেণি র মানুষ থাকবে যারা অনেক বেশি টাকা খরচ করে উন্নতশিক্ষা ক্রয় করছে বলে ভাববে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে যেভাবে দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সেটা যদি অদূর ভবিষ্যতে সফল হয় পরিকাঠামো এবং যথোপযুক্ত শিক্ষক দ্বারা সজ্জিত হয়ে তাহলে হয়তো প্রাইভেট এডুকেশন এর ফাঁস থেকে দেশের সাধারণ মানুষ মুক্তি পেতেও পারে।
উৎপল মুখোপাধ্যায়
আমার দৃষ্টিতে প্রাইভেট টিউশন আসলে শিক্ষকের নিজের কর্মকুশলতার অনুশীলনের সুযোগ। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা থাকার কারণে অনুশীলন গৌণ হয়ে গেছে। প্রাইভেট টিউশ্যানির জন্য শিক্ষক বিদ্যালয়ে তাঁর সবটুকু উজাড় করে দিতে পারেন না। একটা কথা মনে রাখতে হবে- শিক্ষক ছাত্রের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক নয়। বরং সামাজিক দায়িত্ববদ্ধ এক আদর্শ সম্পর্ক।
কোয়ালিটি এডুকেশন বলতে কী বোঝানো হচ্ছে?
নব্যেন্দুবিকাশ দাস
মুখস্থবিদ্যা ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থাকে বাতিল করে পাঠ্য বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা, সমস্যা সমাধান মূলক দৃষ্টিভঙ্গি, পঠিত শিক্ষার সঠিক ব্যবহারিক প্রয়োগ এবং সর্বোপরি শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর নীতিবোধ শক্তিশালী করে দায়িত্বপূর্ণ নাগরিক তৈরি করার পদ্ধতিকেই কোয়ালিটি এডুকেশন বলা হয়েছে। নোট বই, প্রাইভেট টিউশন এবং মুখস্থবিদ্যা নির্ভর শিক্ষা কখনো কোয়ালিটি এডুকেশন হতে পারে না।
উৎপল মুখোপাধ্যায়
কোয়ালিটি এডুকেশন এর কথা বলা হলেও কার্যত তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। সঠিকভাবে জ্ঞান গঠন এবং তার যথার্থ প্রয়োগ সমাজে প্রতিফলিত হবে তবেই বোঝা যাবে কোয়ালিটি এডুকেশন হয়েছে। বিশাল শিক্ষক সমাজের অনেকের কাছে এখনো শিক্ষা বিজ্ঞানের জ্ঞান-নির্মাণ বিষয়টি স্বচ্ছ নয়। যে শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে উপযুক্ত দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরি হতে পারে এমন উপাদানপূর্ণ শিক্ষাই হল কোয়ালিটি এডুকেশন।
বিভাগ খ) মূল্যায়ন সম্পর্কিতঃ
এবার আমরা কথা বলবো মূল্যায়ন নিয়ে। মূল্যায়নের অনেকরকম কৌশল আছে। তা হতে পারে কাগজ-পেন্সিলের, হতে পারে অলিখিত পরীক্ষা। কাগজ-পেন্সিলের পরীক্ষা আবার হতে পারে কোনো শিক্ষক/ শিক্ষিকা পরিকল্পিত প্রশ্নপত্র অথবা অনেক স্কুলের অভিজ্ঞ শিক্ষক/ শিক্ষিকা ও শিক্ষাবিদ -এর মিলিত কোন প্রমিত প্রশ্নপত্র। মূল্যায়নের কৌশল নিয়ে বিশদ আলোচনার মধ্যে আমি প্রবেশ করছিনা। একটি শিশুর কী জ্ঞান ইতিমধ্যেই রয়েছে, সে কী শিখছে এবং কী শিখল এই তিনটি ধাপই মূল্যায়নের জন্য জরুরি। মূল্যায়ন সাধারণত দুই প্রকার (Summative and Formative) হতে পারে তা আমরা সবাই জানি। এছাড়া ডায়গনিস্টিক, ইন্ট্রিম বেঞ্চমারক মূল্যায়ন পদ্ধতিও উল্লেখযোগ্য। গঠনমূলক মূল্যায়ন শিক্ষার্থীকে সাহায্য করে কীভাবে তার আরও উন্নতি করা যায় এবিষয়ে। আবার আমার প্রশ্নমালায় ফিরে আমরা শিক্ষকদের এই বিষয়ে অভিমত শুনি।
গঠনমূলক মূল্যায়ন বলতে কী বোঝানো হচ্ছে ?
নব্যেন্দুবিকাশ দাস
মূল্যায়নের সনাতন ধারণা অনুযায়ী সারা বছর পড়াশোনা করার পর বছর শেষে একবার ফাইনাল পরীক্ষা হয় এবং সেই পরীক্ষার ফলাফলই শিক্ষার্থীর সফলতা-ব্যর্থতার নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়ায়। এই ধরণের সামেটিভ ইভালুয়েশন কখনোই শিক্ষার্থীর প্রকৃত শিক্ষার ছবি তুলে ধরতে পারে না। শুধুমাত্র পাঠ্যবই সম্পর্কিত জ্ঞানের বাইরেও শিক্ষার্থীর যে আরও নানা ধরণের গুণাবলী থাকে সেগুলির প্রকাশ এই ধরণের ইভালুয়েশন এ হয়না। এই জায়গাটিতেই নতুনভাবে এসেছে ফরমেটিভ ইভালুয়েশন। শিক্ষার্থীর বিভিন্ন গুণাবলী, যেমন প্রশ্ন করার ক্ষমতা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, নান্দনিকতা, অংশগ্রহণ করার ইচ্ছা বা ক্ষমতা, নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে তথ্য সারা বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগ্রহ করা হয় এই ফরমেটিভ ইভালুয়েশন এ। এই তথ্যাবলী শিক্ষার্থীর বছরের শেষে মূল্যায়ন এর উপর অনেক বড় প্রভাব রাখে এবং লিখিত পরীক্ষার পাশাপাশি এই সমস্ত গুণাবলীর ভিত্তিতেই শিক্ষার্থীর ফাইনাল রিপোর্ট কার্ড তৈরি হয়।
উৎপল মুখোপাধ্যায়
মূল্যায়ন যখন পাঠ্যপুস্তক এর নির্দিষ্ট গণ্ডি অতিক্রম করে শারীরিক, মানসিক, প্রাক্ষোভিক, বৌদ্ধিক বিকাশ সূচিত করতে পারে তখনই মূল্যায়ন গঠনমূলক বলা যেতে পারে। এর জন্য মূল্যায়ন নানা আঙ্গিকে হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু প্রশ্নপত্র আর নম্বরে তা আটকে আছে।
ক্রমাগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে অগ্রগতির মূল্যায়ন বলা হচ্ছে, কে করবে, কীভাবে?
নব্যেন্দুবিকাশ দাস
ক্রমাগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে অগ্রগতির মূল্যায়ন বা ফরমেটিভ ইভালুয়েশন বর্তমানে শিক্ষকরাই করছেন। কিন্তু এই সম্পর্কিত পরিকাঠামো বা চিন্তা-ভাবনা এখনো সঠিক জায়গায় পৌঁছায়নি। এখনো বেশিরভাগ স্কুলে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত সঠিক জায়গায় নেই। এই ধরণের মূল্যায়ন এর জন্য আদর্শ ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ১:৩০ বা ১:২৫ হলে সবচেয়ে ভালো হয়। কিন্তু এখনো অনেক ক্ষেত্রেই এই অনুপাতে পৌঁছানো যায়নি। আর এই অনুপাত এর চেয়ে বেশি পরিমাণ ছাত্র নিয়ে এই ধরণের মূল্যায়ন সফল হবে না। প্রতিটি শ্রেণির জন্য ফরমেটিভ ইভালুয়েশন এর ডাটা শীট শিক্ষকদের তৈরি করে দিতে হবে। সেই ডাটা নিয়মিত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার জন্য বিশেষ বিশেষ শিক্ষককে দায়িত্ব দিতে হবে। এর জন্য টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট জাতীয় পদ ও তৈরি করা যেতে পারে। প্যারা টিচারদের এই কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। আর ফরমেটিভ ইভালুয়েশন এর ডাটা ইনপুট কম্পিউটার ও ইন্টারনেট নির্ভর হতে হবে। এর ফলে এই বিপুল পরিমান ডাটা বিশ্লেষণ করা সহজ হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতির তথ্য বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে গ্ৰহণ করতে হবে। যার ফলে এই তথ্য সহজেই একটি শিক্ষার্থীর ফরমেটিভ ইভালুয়েশন এর ডাটাসিটে পাওয়া যাবে।
উৎপল মুখোপাধ্যায়
নিয়মিত মূল্যায়ন একমাত্র শিক্ষক করবেন। তিনি প্রতিদিনের শ্রেণি পরিচালনার জন্য নানান সক্রিয়তা ভিত্তিক কাজে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করবেন।শুধু তাই নয়,অংশগ্রহণের সময় শিক্ষার্থীদের প্রশ্নকরণ,ব্যাখা করার প্রবণতা পর্যবেক্ষণের সাথে সাথে শিক্ষক তাদের দুর্বলতা ও অন্তর্নিহিত গুণাবলী চিহ্নিত করে লিপিবদ্ধ রাখার ব্যবস্থা করবেন।
শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক, পড়ানো বিষয়, এবং সামগ্রিক শিক্ষার্থীর ফলাফল মূল্যায়ন নতুন কী ভাবে বলা হচ্ছে?
নব্যেন্দুবিকাশ দাস
নতুন শিক্ষানীতিতে শিক্ষার্থী-শিক্ষক পাঠ্যক্রম মূল্যায়ন প্রতিটি বিষয়ের আমূল পরিবর্তন করার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এখন থেকে 3 বছর বয়স হলেই প্রি স্কুল এডুকেশন পাবে। অষ্টম শ্রেণি থেকেই তারা স্বাধীনভাবে বিষয় বাছাইয়ের সুযোগ পাবে। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রেও বিষয় বাছাইয়ের এই স্বাধীনতা আছে। শিক্ষকদের জন্য চার বছরের বিএড কোর্স চালু হবে। শিক্ষকরা কর্মরত অবস্থায় নিজেদের প্রফেশনাল ডেভলপমেন্ট করার জন্য বিভিন্ন কোর্সের সুযোগ পাবে। স্থানীয় প্রতিভাবান ছেলে মেয়েরা শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার সুযোগ পাবে। পাঠ্যক্রমের আমূল পরিবর্তন হবে যেটা আগেই বলা হয়েছে। মূল্যায়ন ব্যবস্থার ও পরিবর্তন আসছে। চিরাচরিত সামেটিভ ইভালুয়েশন এর পরিবর্তে ফরমেটিভ ইভালুয়েশন হবে। বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষাগুলোর গুরুত্ব কমানো হয়েছে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হবে এখনকার তুলনায় অনেক সহজ। ছাত্র-ছাত্রীরা মাল্টিপল এন্ট্রি পয়েন্ট এবং মাল্টিপল এক্সিট পয়েন্ট এর সুযোগ পাবে পরীক্ষা দেবার ক্ষেত্রে।
উৎপল মুখোপাধ্যায়
বিগত কয়েক বছরে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। মূল্যায়ন এখন শুধু মুখস্থ নির্ভর এবং নম্বরের ভিত্তিতে হয় না। মূল্যায়ন পত্র নির্মাণ কৌশল এবং নম্বর বিভাজনে দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে।পঠন-পাঠন চলাকালীন প্রস্তুতিকালীন মূল্যায়নের ফলে শিক্ষার্থীদের বিকাশের গ্রাফ থেকে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়।
বিভাগ গ) শিক্ষক/শিক্ষিকা সম্পর্কিত ঃ
আমি এই প্রতিবেদনে পুনঃপুনঃ বলে এসেছি যে, শিক্ষক/ শিক্ষিকাই প্রাথমিক শিক্ষার মূল ভিত্তি, বিদ্যা ও জ্ঞানকে তাঁরাই শিশুদের কাছে পৌঁছে দেন, শিশুরা কোন বিমূর্ত ধারণাকে শিক্ষক/ শিক্ষিকার কাছ থেকেই অধিগত করতে শেখে। সুতরাং, একটি প্রাথমিক স্কুলের প্রতিটি শিক্ষকের বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে দৃঢ় করা প্রয়োজন। আর তারজন্য প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল শিক্ষক শিক্ষিকাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র শিক্ষাতত্ত্ব এবং শ্রেণি কক্ষে আচরণ পরিচালনাই নয়। প্রাথমিক শিক্ষার প্রকৃতি বোঝার জন্য দরকার অন্য স্কুলে গিয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষক/ শিক্ষিকা কীভাবে শ্রেণিকক্ষে পরিচালনা করছেন তা দেখা, এবং প্রাপ্তবয়স্কদের কাছ থেকে শিশুরা কীভাবে শিখতে পারে সেই প্রয়োগকৌশলগুলি বোঝা, কীভাবে ও কেন ওই শিক্ষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে তা অনুধাবন করা দরকার। এরদ্বারা পরিকল্পনা এবং পর্যালোচনা করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। দরকার নিয়মিত কর্মশালায় (Practical workshops) এবং সেমিনারে অংশগ্রহণের, যেখানে নিজের জ্ঞানের প্রসারের জন্য সুযোগ পাওয়া যাবে শিক্ষানীতি, শিক্ষামূলক তত্ত্ব নিয়ে সমালোচনার, আলোচনা করা যাবে বর্তমান শিক্ষাগত সমস্যা নিয়ে। প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে বিবেচনা করা যাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। অতএব শিক্ষাতত্ত্ব, শ্রেণিকক্ষ অনুশীলন, শিক্ষাসম্পর্কিত বিষয়গুলি নিয়ে অন্তর্দৃষ্টি, সামাজিক সচেতনতা এবং দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব বিকাশের জন্য যথাযথ শিক্ষক প্রশিক্ষণ অত্যন্ত জরুরি এবং সহায়ক। প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষক/ শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণ নিয়ে নতুন অনেক বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। তার থেকে আমার প্রশ্নমালায় ছিল কয়েকটি প্রসঙ্গ।
শিক্ষকদের নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এবং অনুযায়ী হিসাবে প্রশিক্ষণ সম্বন্ধে কী মত?
নব্যেন্দুবিকাশ দাস
পাঠ্যক্রম মূল্যায়ন ব্যবস্থা ইত্যাদির পরিবর্তন যতই করা হোক না কেন শিক্ষকদের পরিবর্তন না করলে এই শিক্ষা নীতির প্রয়োগ সফল হতে পারেনা। যুগ অনেক এগিয়ে গেলেও এখনও অনেক শিক্ষক পুরনো যুগের মানসিকতাতেই পড়ে আছেন। অনেক শিক্ষকই আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়ে মাথা ঘামান না বা তাদের সে সম্পর্কে ধারণা ও নেই। সবচেয়ে বড় কথা অনেক শিক্ষক নতুন ধারণা গ্রহণ করতেও প্রস্তুত নন। শিক্ষক নিয়োগের আগে শিক্ষকদের যথোপযুক্ত ট্রেনিং প্রদান করে তবেই শিক্ষাদানের কাজে নিযুক্ত করতে হবে। আর এই বিষয়টা সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। কোন ব্যক্তি শিক্ষিত মানেই সে ভালো শিক্ষাদান করতে পারবে এটা ঠিক নয়।
উৎপল মুখোপাধ্যায়
শিক্ষকদের বৃত্তিগত যে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা প্রচলিত তার সুফল বিদ্যালয় স্তরে প্রতিফলিত হয় নামমাত্র। কারণ এই প্রশিক্ষণ শিক্ষকতা নয়, বিদ্যালয়ে চাকুরি পাওয়ার প্রমাণপত্র।এই প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন।
হালকা তবে শক্ত’ তদারকি ও নিয়ন্ত্রণকারী মানে কী?
উৎপল মুখোপাধ্যায়
দেশ তথা সমাজের চাহিদার সাপেক্ষে নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচি রচিত হয়। অবশ্যই তা মজবুত ও নমনীয় হওয়া প্রয়োজন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যা পরিমার্জন ও পরিবর্তন করা যায়।
পেশাদার বিকাশ, ইতিবাচক কর্মপরিবেশ কী হতে পারে?
শিক্ষকদের নির্বাচনী কাজ,সেন্সর ইত্যাদি কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের উন্নতি বা অবনতি বিষয়ে গবেষণার সুযোগ করে দিতে হবে।নিয়মিত অ্যাকশন রিসার্চ এর ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে ।
শিক্ষকদের ইসিই প্রশিক্ষণ কে দেবে, কীভাবে হবে ?
শিক্ষকদের ইসিই প্রশিক্ষণ দেবেন শিক্ষকরা।এর জন্য রিসোর্স শিক্ষক তৈরি ব্যবস্থা করতে হবে।
সিপিডি ৫০ ঘন্টা কতটা বাস্তবসম্মত?
50ঘণ্টা অবাস্তব নয়। শ্রেণি পরিচালনা ছাড়া প্রত্যেক শিক্ষক দিনে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পরের দিনের পরিকল্পনা ও অ্যাকশন রিসার্চ এর বিশ্লেষণ ও ফলাফল নিরূপণ করবেন।
সকল স্টেকহোল্ডারদের -নীতিনির্ধারক, পিতামাতা, শিক্ষক একসঙ্গে কাজ করা কীভাবে সম্ভব?
নীতিনির্ধারকরা এমন নীতি প্রণয়ন করুন যেন প্রতিমাসে একদিন করে শিক্ষক-অভিভাবকরা মিলিত হওয়ার সুযোগ পান।
শিক্ষকের শূন্যপদগুলি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সময়সীমায় পূরণ করা হবে স্থানীয় শিক্ষক এবং 'প্যারা-শিক্ষক' (স্বল্প-মেয়াদী চুক্তিতে শিক্ষক) নিয়োগ নিয়ে কী মত?
শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। শুধুমাত্র নম্বরের ভিত্তিতে নয় ডাক্তারী বা নার্সিং ট্রেনিং এর মত অন্তত একবছর বিদ্যালয়ে গ্রহণযোগ্য সাম্মানিক এর ভিত্তিতে কাজে সফলতা অর্জন করলেই স্থায়ী শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করা সঠিক হবে বলে মনে করি।
ইংলন্ডে বহুদিন শিক্ষকতা করছেন রানু সাহু, উনি শিক্ষকতা শুরু করার আগে, ইংলন্ডে ২০০১ সালে বিজ্ঞানে Postgraduate Certificate in Education করেছেন। আমি প্রশ্ন রেখেছিলাম যে এই প্রশিক্ষণের সময় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাঁর কোনটি মনে হয়েছে? তিনি মন্তব্য করেন, ‘The best part of doing PGCE was to actually going to 2 different schools and have the valuable first-hand experience of being in the classroom with another member of outstanding staff and to be able to observe them teaching. I could learn a variety of teaching style which could cater all different types of learners and could engage pupils at different levels with individual learning needs of pupils to develop and give the chance to succeed, whatever their individual needs and the potential barriers to their learning may be. I have now found the balance between maintaining my own belief and values regarding a good lesson and being able to adjust my approach to different learners’.
এই শেষ পর্বটিতে আমরা আলোচনা করলাম শিক্ষণ বিষয়ে, মূল্যায়ন নিয়ে এবং শিক্ষক/শিক্ষিকা প্রশিক্ষণ নিয়ে। আমার মনে হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক শিক্ষণ নিয়ে আমাদের ব্যাপকভাবে আলোচনার প্রয়োজন। মূল্যায়ন নিয়ে গভীর চিন্তা জরুরি। নানা ধাপ এবং নানা কৌশল প্রয়োগ করা অত্যাবশ্যক। এতদিন ধরে অবহেলিত হয়ে আসা শিক্ষক/শিক্ষিকা প্রশিক্ষণ নতুন করে পরিকল্পনা করা অবশ্য করণীয়। শিক্ষক/শিক্ষিকার সুবিধার দিকে সম্যক দৃষ্টি দেওয়া দরকার। এই প্রতিবেদনে প্রথম থেকে আমি বলে আসছি যে প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতিটি ব্রিভান্তিকর, এই নীতি প্রয়োগ সহজ নয় (এর কারণ আমরা আগে ব্যখ্যা করেছি) তবুও এই নীতিতে উল্লেখিত বিষয়গুলি গুরুত্ব সহকারে বিশদে আলোচনা জরুরি। আমাদের উচিৎ অভিজ্ঞ শিক্ষক ও শিক্ষাবিদের সঙ্গে পর্যালোচনা করে কাজ শুরু করা।