মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়—তিনি বিখ্যাত অনুবাদক হিসেবে। অনেকেই জানেন বাংলা ভাষায় ও সাহিত্যে লাতিন আমেরিকার সাহিত্য, ক্যারিবিয়ান, আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপীয় সাহিত্যের তরজমাকার হিসেবে তাঁর অবদান সম্পর্কে। গত কয়েকদিনে মানববাবুকে নিয়ে অনেক লেখাই উঠে আসছে সংবাদপত্রের পাতায়, সোশাল মিডিয়াতে, তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের স্মৃতিচারণায়। বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে অনেকেই জানতে পারছেন মানববাবুর রসবোধ সম্পর্কে, অরণ্যদেবের প্রাচীন প্রবাদের মতো মানববাবুর প্রবাদের লিস্ট লম্বা হয়ে চলছে। এই স্মৃতিমেদুরতায় আচ্ছন্ন ছাত্রী-ছাত্রদের বয়ানের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে শিক্ষক-বন্ধু মানববাবুর অনেক দিক, যে মানববাবুকে আমরা সকলেই চিনি। এই বুদ্ধিদীপ্ত প্রবাদসূচি আমরা অনেকে শুনেছি অন্য কোনো শিক্ষকের কাছে, যারা অনেকেই মানববাবুর সহকর্মী বা ছাত্র/ছাত্রী পরে সহকর্মী ছিলেন।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে পড়ার সময় পাঁচ বছর ধরে যে মানববাবুকে দেখেছি এবং পরে চিনেছি, সেই টুকরো মুহূর্তেগুলোর দিকে একবার ফিরে যেতে চাইছি।
১৯৯৫ সালে স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনার জন্য যখন বিভাগে ঢুকেছি, তখন বিষয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। ‘তুলনামূলক সাহিত্যে’র পাঠ্যসূচি সম্পর্কে কোনো কিছু না জেনেই আমরা অনেকে ঢুকেছিলাম এই বিভাগে। প্রথমদিনের আলোচনায় সব শিক্ষকরাই ছিলেন ক্লাসরুমে। সিলেবাসের সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছিলেন শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই পরিচয় প্রথম পর্যায়েই ব্যক্তিগত স্তরে মনে হয়েছিল কী করে পারব এতকিছু? সিলেবাসের অর্ধেকের বেশি লেখকের নাম সেদিন প্রথম শুনেছি—জানি না কোন্ ভাষায় লেখা হয়েছে এই সাহিত্য?
একই সঙ্গে শুনেছিলাম উত্তর লেখা যাবে বাংলা বা ইংরেজি যে-কোনো ভাষায়, যৎসামান্য স্বস্তি পেয়েছিলাম যে ইংরেজি বাধ্যতামূলক ভাষা নয়। এই স্বস্তি পরবর্তীকালে আমার ব্যক্তিমনন ও চিন্তনের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন এনেছিল, সেই পরিবর্তন যে এক বৃহত্তর সাহিত্য ও শিক্ষারাজনীতির অংশ তা বুঝে উঠতে কেটে গিয়েছিল বেশ কয়েকটা বছর।
আমরা যখন স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র, তখন মানববাবু ছিলেন বিভাগীয় প্রধান। বার্ষিক শিক্ষাক্রমের ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত যাঁরা, তাঁরা জানেন সেইসময়ে দীর্ঘদিন ধরে ফেলে ছড়িয়ে টেক্সটের গলিঘুঁজিতে ঘুরে বেড়ানো যেত। স্নাতক স্তরের পাঠ্যসূচির তৃতীয় পত্রে মানববাবু আমাদের পড়াতে শুরু করেছিলেন বিদ্যাসাগরের শকুন্তলা। ক্লাসের প্রথম দিন বলেছিলেন বিদ্যাসাগরের সীতার বনবাস ও শকুন্তলা দুই টেক্সটের প্রধান নারীচরিত্র স্বামীপরিত্যক্তা। এই উক্তির অর্থ বুঝলেও তার প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে সময় লেগেছিল। তৃতীয় বর্ষে স্নাতক পর্যায়ের পাঠক্রমে মানববাবু ফিরে এসেছিলেন আধুনিক ভারতীয় গল্পের পসরা নিয়ে। প্রেমচন্দের কফন, ইসমত চুগতাই-এর চৌথিকা জোড়া, রাজিন্দর সিংয়ের লাজবন্তী। প্যাপিরাস থেকে প্রকাশিত আধুনিক ভারতীয় গল্পের সিরিজ পড়ে ফেলেছি তার মধ্যে। যে সিরিজের সম্পাদক স্বয়ং মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়।
এরপরে এসেছিল আট নম্বর পেপার, যে পেপার প্রায় সম্পূর্ণটাই আমরা পড়েছিলাম মানববাবুর কাছে। শুরু হয়েছিল ফ্রান্জ কাফকার ‘দ্য মেটামরফোসিস’ দিয়ে। একে একে উপস্থিত হয়েছিলেন ইউজেন আয়োনেস্ক, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, পাবলো নেরুদা, রায়নার মারিয়া রিলকে, মিরোস্লাভ হোলুব, পল এলুয়ার্ড, ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি, আরও অনেকে। “গ্রেগর সামসা এক সকালে উঠে দেখেছিল সে একটা ‘পোকা’তে পরিণত হয়েছে” কাফকার মেটামরফোসিসের প্রথম লাইন অথবা আয়োনেস্কর রাইনোসরাস সম্পর্কে মানববাবুর উক্তি—“তারপর সবাই গন্ডার হয়ে গেল” মনে আছে অনেকেরই। আজকের সময় দাঁড়িয়ে ভাবতে পারছি সকলে গন্ডার হয়ে যাওয়ার পরও বেরেনজার একা দাঁড়িয়ে থাকে, সে গন্ডার না হওয়ার জন্য রুখে দাঁড়ায়—সেই ঘটনার মর্ম। পাঠ্যসূচিতে প্রত্যেকটি পাঠের উপস্থিতি বা চয়নের রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে শিখেছি মানববাবুর হাত ধরে। কবে সে হাত ধরে ফেলেছি খুব স্পষ্ট করে বলতে পারব না। কিন্তু স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকমের ক্লাসে বলে উঠেছিলেন তারপর সংস্থানক বসন্তসেনার পিছু নিল, যেভাবে শক্তি কাপুর, মাধুরী দীক্ষিতকে তাড়া করে।
আজ মনে পড়ে যায় এমএ ক্লাসের আফ্রিকা এরিয়া স্টাডিজের ক্লাসে বসে বহু আলোচনা। হঠাৎ একদিন বললেন, কহো না প্যায়ার হ্যায় দেখেছ? কয়েক সপ্তাহ আগে দেখে এসেছি সেই ছবি। স্মিত হাসি নিয়ে বললেন, “সবই হল, কিন্তু যে ছেলেটি সিনেমার প্রথমে মারা গেল শেষে তাকে নিয়ে কারও খুব একটা মাথা ব্যথা ছিল না। এটা ভেবে দেখতে হবে।” ভাবা প্র্যাকটিসের আর-এক পর্যায়ে বলেছিলেন প্রাহার মেট্রো স্টেশনে এক প্রৌঢ়া মহিলাকে দেখেছিলেন তিনি মিল্স অ্যান্ড বুন হাতে। আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম, বোধোদয়ের সূত্রপাত হয়েছিল। পপুলার কালচার নিয়ে আমরা যে তত্ত্বের কথা বলি আজ, তার হাতেখড়ি হয়েছিল মানববাবুর হাত ধরে।
স্নাতকোত্তর সময়ে এরিয়া স্টাডিজের আফ্রিকা ক্লাসে আমরা পড়তে বসতাম মানববাবুর সাথে—চিনুয়া আচেবে, ওলে সোয়েঙ্কার সঙ্গে আসতেন এনগুগি ওয়া থিয়ং, আমা আটা আইডু, সেমবেন উসমান, তায়েব সালিহ।
হুয়ান রুলফো, নিকানোর পাররা, আলেহো কার্পেন্তিয়ের, পাবলো নেরুদা, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস- লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের বিভিন্ন মহারথীদের অনুবাদের জন্য মানববাবু বিখ্যাত। কিন্তু তার সঙ্গে পূর্ব ইউরোপীয় কবিদের কবিতার অনুবাদ, সাইন্স ফিকশন, শিশুসাহিত্য, তাঁর নিজের কবিতার বই, ‘অর্ধেক শিকারি’ (১৯৭৪), ‘সাপলুডো অথবা ঘরবাড়ি’ (১৯৯৯), ‘আত্মহত্যার অধিকার এবং অন্যান্য সনদ’ (২০১২) প্রবন্ধসমগ্র—এরকম অজস্র বই তাঁর সাহিত্যখিদেকে স্পষ্ট করেছে। তাঁর নিজের কথা ধরেই বলা যায়—“যখন প্রবন্ধ সংকলনের কাজে হাত দিলুম, তখনই মালুম হল আমার বেশির ভাগ লেখাই আমার হাতের কাছে নেই—সব লেখার কথা মনেও নেই।” এইসব মনে থাকা লেখার সঙ্গে ভুলে যাওয়া লেখার মধ্যে আমরা দেখেছি বাংলা ছাড়াও অন্যান্য ভারতীয় ভাষার গল্পগুচ্ছ—ভৈকম মুহম্মদ বাশির-এর গল্প, দেশভাগ নিয়ে দুটি খণ্ডে সংকলন ‘ভেদ-বিভেদ’, অন্যদিকে লাতিন আমেরিকা, পূর্ব ইউরোপ, আফ্রিকা নানা ভৌগোলিক অঞ্চল ও সাহিত্যকে। এই বিচরণ বা অনুবাদ কেবলমাত্র কাকতালীয় কোনো চয়নপ্রক্রিয়া নয়। সাহিত্য বা বিশেষত তুলনামূলক সাহিত্য পঠনপ্রক্রিয়ার মধ্যে উঠে আসছে প্রাসঙ্গিকতার রাজনীতি। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে, বিশ শতকের শেষে সাহিত্য বিভাগের পাঠ্যসূচিতে উপনিবেশিক ইতিহাসের উপস্থিতি যদি কেবলমাত্র ‘পোস্ট-কলোনিয়াল’ বলে বিবেচিত হয় তাহলে কিছুটা ‘আফ্রিকা’ কিছুটা ‘লাতিন আমেরিকার’ ‘মিক্সড’ উপস্থিতি যে গতানুগতিক ইউরো-কেন্দ্রিক চিন্তাধারার সরলীকরণ মাত্র সে কথা মানববাবু তাঁর কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই বলেছেন বারংবার।
মানববাবুর রসবোধ, তাঁর বৌদ্ধিক চর্চা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকবে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগগুলিতে, তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। যেভাবে তিনি আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের মৌখিক প্রসঙ্গ নিয়ে করতেন আলোচনা, প্রায় একইভাবে সৃষ্টি হয়েছে এবং হতে থাকবে মানববাবুর বলা প্রবাদ-প্রবচন। একইসঙ্গে মানববাবু এবং আরও অনেকের প্রশ্রয় ও আশ্রয়ে লালিত-পালিত হয়েছেন বহু ছাত্রছাত্রী, যাঁরা পরবর্তী কালে এঁদের সহকর্মী হয়েও ফিরে এসেছেন। বিভিন্ন প্রজন্মের এই মানুষদের সম ও বিষম-বয়স্ক বন্ধুত্ব কেবলমাত্র বৌদ্ধিক স্তরে সীমাবদ্ধ যে ছিল না, সে ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে বেশ কয়েক প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা। পারস্পরিক শ্রদ্ধার জন্য কখনও থেমে থাকেনি অ্যাকাডেমিক তর্কও।
স্মৃতিরোমন্থনের এই মুহূর্তে মনে আসছে তায়েব সালিহ্-র ‘A season of Migration to the North’ বা ‘উত্তরে দেশান্তরিত হবার মরশুম’ নামের ছোটো উপন্যাসটির কথা, মানববাবুর কথায়, “উত্তরে দেশান্তরিত হবার মরশুম প্রধানত সন্ধানের কাহিনি: অন্য একজন মানুষের পরিচয় খুঁজতে গিয়ে কী করে একজন শেষপর্যন্ত, নিজেকেই খুঁজে পেল।” এই উপন্যাসের শেষে উপন্যাসের কথক নদীর জলে ডুবতে গিয়েও, জীবনকে বেছে নেয়, সাহায্যের জন্য আর্তনাদ করে ওঠে।
তায়েব সালিহ্-র এই কথকের মতোই আমরা অনেকে নিজেকে খুঁজতে থাকি মানববাবুর লেখার মধ্যে। অনুবাদের জন্য যে টেক্সটকে নির্বাচন করেছেন, তার সঙ্গে আমরাও ঘুরেছি—উত্তর থেকে দক্ষিণে, কেন্দ্র থেকে প্রান্তে বা বলা যায় বিভিন্ন জানা-অজানা প্রান্তে। দেশ থেকে দেশান্তরে ঘোরার এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে, ভাষার বহুত্বকে অনুভব করলে বোঝা সম্ভব মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মকাণ্ডের স্বরূপকে। আর আমাদের অর্থাৎ পাঠকের/ছাত্রছাত্রীদের কাছে ফিরে আসে বহু স্মৃতির ও পাঠের বিভিন্ন অনুসঙ্গ, যার মাধ্যমে বার বার ফিরে আসবেন অধ্যাপক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। আমাদের মানববাবু।