আজকে, রথের যাত্রা
শক্তি করভৌমিক দত্তরায়
বসে আছি। দেখছি সবুজ গাছগাছালি। উঁচুনীচু অনেকটা যেন জলপাই রঙ ঘাস। মাঝখানটা দিয়ে ছুটেছে পিচরাস্তার কালো রঙ। অনেক আকাশলীনা সৌধ। নীচে মাঠে ছেলেরা ক্রিকেট আরো কি কি খেলছে রোজের মতো। একটু দূরে পার্কে শিশুরা খেলছে। আরো দূরে চলছে বাস, দু চাকা চার চাকার কতো গাড়ী।
কোনো শিশুর দল কাঁসর বাজিয়ে ছোট্ট সাজানো রথ টানছে না। ভেতরে জুবুথুবু বসে নেই সুভদ্রা ভগিনী আর বলরাম দাদাকে নিয়ে জগতেরপ্রভু বড়বড় চোখ দেবতা। শঙ্খধ্বনি হচ্ছে না। উলুধ্বনি বা জোকার?না না। কোথাও না।
মনের মধ্যে রথের চাকা গড়িয়ে চলছে। পুরীর রথ - সেতো মনে আছেই। আর সেই ছোট বেলায় মা আর পিসিমণির সঙ্গে ভাইবোন মিলে দেখতাম যে রথ।? কাঁসর ঘন্টা, লোকের ভীড়। হরিরলুঠ। উড়ছে নকুলদানা। ঝিরঝির বৃষ্টিতে ভিজছে লুঠের বাতাসা। অনেকে ছুড়ে দিচ্ছে কলা। দু একটা নারকেলও ছুঁড়ে দেয় কোন বেপরোয়া ভক্ত। রথের দিকেই লক্ষ্য তবে লুফে নেয় জনতা। সবচেয়ে বেশি ছোড়ে লুকলুকি,--একধরনের লালচে কালো গোল ছোট ছোট টক মিষ্টি ফল। ভেতরটা রক্তিম। দুই হাতের চেটোয় রেখে একটু ঘষলে নরম হয়। জানিনা আর কোনো ভালো নাম এর আছে কিনা। আরেকটি ফল জড়িয়ে আছে শৈশব আর শৈশবের দেখা রথের সঙ্গে। সেই ফলের নাম বুবি, আমরা ওই নামই বলতাম। ঘিয়ে রঙএর খোসা, ভেতরে তুলতুলে তিনটি স্বচ্ছ টক কোয়া। গোলাপী আভা, হালকা নীলাভ রেখা। কি সুন্দর। বড় হয়ে বুঝলাম এই ফলই হয়তো লটকন। জীবনানন্দের লটকন রঙের রোদ। রঙ, স্পর্শ, স্বাদে মাখা কোমল সজল রোদ। ওই ফল খেলে নাকি জ্বর হয়, হোক্। রথের ধর্মীয় অনুষঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু রথের মেলা সত্যই কার্নিভাল। তার পাঁপড়ভাজা, জিলিপি, ফুলের চারা, সব নিয়ে একবেলার উৎসব; দু'চারদিন বাদে ওই চারাতেই বনোমহোত্সব। মায়ের সমান্য সঞ্চয় থেকে আমাদের জন্য কেনা হয় সোনালী কাজ করা প্লাস্টিকের খেলনা হাঁড়ি, মাটির উনুন, তালপাতার সেপাই, বেলুন বাঁশি, সাপ বেলুন। বাড়ী ফেরার আগেই ঢাউস বেলুন ফেটে যায়। যার যায় সে কাঁদে। অন্যে হাসে। ঠাকুমা বলেন মেলার পয়সা ধূলায়। সবই তো শেষ অবধি ধূলায়। কি আর করা।
একবার আগরতলায় মাকে দেখতে কামার পুকুরের পাড় দিয়ে শর্টকাট করছি। মণিপুরীরা অপেক্ষায় আছেন - রথ আসবে, অভ্যর্থনা করবেন। ধবধবে শাদা তাঁদের উত্তরীয়। মেয়েদের ডুরে রঙিন ফানেক আর কারুকাজ করা শুভ্র চাদর --ওড়না। স্ট্রেট লম্বা অঢেল চুলে চাঁপার মালা। হাতে ঝকঝকে সাজি। তাতে নীল সাদা ফুল আর পচাপাতা নামে সুগন্ধি পাতা দিয়ে গাঁথা মালা। চাঁপা, গোলাপ আর জুঁই ফুলের অর্ঘ্য। চলায় নৃত্যের ছন্দ। বন্দনা তাঁদের "সঙ্গীতে আর ভঙ্গিতে বিরাজে"।
মার কাছে গিয়ে দেখি অনু মিয়া গেটে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে। গাছের কলার ছড়ি আর লিচু গুলো ভালো দামে বিক্রি করে মেলা থেকে বিবির জন্য মেয়ের জন্য বাহারি কাঁচের চুড়ি আর ফিতে কিনেছে। পছন্দ হবে তো? --হবেনা আবার! গোলাপী আর সবুজে মনোমোহন।
রথযাত্রা লোকারণ্য। কতো ধুমধাম। সব আছে মনের মধ্যিখানে। ভোলা কি যায়? দেবতা কি ভুলতে দেন? দেন না। প্রার্থনা বেজেই চলে অনুভবের তারে ---
"তুঁহু জগন্নাথ জগতে কহাওসি/ দয়া জনু ন ছোড়বি মোয় "।
রথের মেলার গল্প
সৃজিতা সান্যাল শূর
আমি জানি আমাদের সমস্যাটা জিনঘটিত। কোনোভাবেই এড়াতে পারি না। নেশার মত টানে। কি? আরে মেলা, মেলা। আমার দিদা, বড়মাসী, মা, আমি, আর এখন আমার মেয়েও। আমরা মেলা দেখলে স্থির থাকতে পারি না। সত্যনারায়ণের সিন্নির মতই, মেলার নাম কানে শুনলেই যেতে হয়। আমরাও মেলা শুনলেই যাই।
মেলা বললেই তো প্রথমে রথের মেলা। বারুইপুরে রাসমাঠে চৌধুরীবাড়ির রথ। সঙ্গে মেলা। তখন বড়মাসিরা থাকত মেলার কাছাকাছি একটা পাড়ায়। আমার তখন চার কি পাঁচ হবে। তো সকাল থেকে আমাদের সবার রথ উপলক্ষ্যে মাসির বাড়ি নেমন্তন্ন। বললাম না, মাসিও মেলাপ্রেমী। সকালে যাব। রথের রশিতে টান দেব। দুপুরে মাসির বাড়ি খাওয়াদাওয়া করে আবার বিকেলে মেলায় যাব।মানে ভরপুর প্রোগ্রাম যাকে বলে।এবার আমার বাবা আবির্ভূত হলেন, মূর্তিমান কালাপাহাড় রূপে। "ঐ ভীড়, গন্ধ, নিয়ম নেই, শৃঙ্খলা নেই, আমি আমার মেয়েকে অই মারাত্মক মেলায় যেতে দেব না। এই ছোটোবেলায় গিয়ে সকালে রথের রশি টানবে আমার মেয়ে? মামাবাড়ির আবদার?!" তারপর আর কি! "ছোটোরাণী আছাড় খাইয়া পড়িলেন "। কান্নাকাটি, রাগারাগি। অবশেষে রথের দিন দেখলাম সকালে রিকশায় চড়া হল।
এমনি দিনের ডবল ভাড়া। কারণ মেলা অভিমুখী রিকশা কখন পৌঁছবে আর কখন ফিরবে তার ঠিক নেই। তো আমরাও চললাম|আরো রিকশা যাচ্ছে, ভ্যান যাচ্ছে। হাজার রকমের গাছ যাচ্ছে। মাথায় কাঁঠাল নিয়ে একদল লোক। রিকশা এগোয় আর না। অমন জ্যাম দেখতে মোটেও ছোটোবেলায় অভ্যস্ত ছিলাম না। মেলার কাছাকাছি যত যাই দেখি ভীড় বাড়ছে। আর সবার পা কাদা ভর্তি। আস্তে আস্তে আমার বুক শুকিয়ে আসছিল আর বাবার চোয়াল শক্ত হচ্ছিল। এমন সময় নামল তেড়ে বৃষ্টি । রিকশার হুড তুলে প্লাস্টিক নামানো হল। বাইরে বৃষ্টি, ভেতরে ঘাম। বাঁধ ভেঙে গেল। চিতকার করে কান্না শুরু করলাম, পায়ে পড়ি বাবা, আমি রথ দেখবো না। বাবাও শুরু, আজ তুই রথের রশি টেনে বাড়ি যাবি, আমিও এর শেষ দেখে ছাড়ব। সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা যারে কয়। যদিও এরপর মেলায় গেছিলাম কিনা আমার মনে পড়ছে না। বাবা, মা কে জিজ্ঞাসা করতে তারা দেখলাম তিরিশ বছর আগে সেদিন রথে যাওয়া ভুল ডিসিশন ছিল কিনা তাই নিয়ে ঝগড়ায় মেতে গেল।
রথের মেলায় আসত দারুণ দারুণ সব জিনিসপত্তর। চাকি-বেলুন, পিঁড়ি, টবের মাটি খোঁচানোর নিড়ানি। এরকমই এক রথের মেলা থেকে কেনা হয়েছিল একটা টেবিল। সেই সপ্তাহে বাড়িতে আসবে নতুন গ্যাস , তার জন্য চাই টেবিল। বাবার সস্তা টেবিল চাই, বাজেটে ঘাটতি আছে। রথের মেলা থেকে এল সস্তা টেবিল। তাতে গ্যাস থাকল, বেশ কয়েক বছর পরে সেটা খাবার টেবিল হয়ে গেল। এখন সেটা আমাদের কাজের দিদির মেয়ের পড়ার টেবিল। তবে মেলায় আমি যেতাম জিলিপি খেতে। অমন ধূলোমাখা গুড়ের জিলিপি রথ ছাড়া কোত্তাও পাওয়া যায় না। আর কটকটি, আর পাঁপড়ভাজা। মানে কুখাদ্য পেটে না গেলে আর মেলা কি। শুধু আজকাল একই দোকানগুলো দেখে শিউরে উঠি, কি করে বাচ্চাগুলো খাচ্ছে কে জানে?!!!!
আমার বড়মামা এরকমই এক রথের মেলা থেকে এনেছিল মিঠুকে। নর্দমার ধারে পড়ে ছিল। মামা তুলে তাকে বাড়ি নিয়ে আসে। এখন ওকে ছাড়া মামাবাড়ি ভাবা যায় না। এত্ত এত্ত কথা বলে বারান্দায় বসে বসে। চকচকে লাল ঠোঁট আর পালিশ করা সবুজ গায়ের রং। মামার পেয়ারের টিয়েপাখি।
গতবছর মেয়েকে নিয়ে গেলাম রথের মেলায়। এই মেলা একটু ছোটো। রথ মেলায় ঢোকার মুখেই। বেদম ভীড়। রথের রশি বেশ গুছিয়ে রাখা। মানে দিনের যেকোনো সময়েই গিয়ে টেনে নেওয়া যায়। একদিকে প্লাস্টিকের ফুলের দোকান, পাশে কায়দার টেরাকোটার স্টল। আমার ইচ্ছে হল না ঐ দোকানগুলোতে যেতে। আমি গেলাম একটু গেঁয়ো ,পুরোনো গন্ধের ঝুপড়িতে। কিনলাম পুজোর বারোকোশ ,পাথরের বাটি। কিনলাম কাঠের চিরুণী। জানি কোনো কাজে লাগবে না, তবুও কিনলাম। বাঁশি কিনে , জিলিপি খেয়ে , বেলুন কিনে মেয়ের আল্হাদী মুখ দেখে বুঝে গেলাম, মেলার নেশা ওরও আছে। আজ দেখলাম, দাদু দিদাদের কাছ থেকে পাওয়া মেলার পার্ব্বণীতে তার ব্যাগ ভরা। কালই ভাবছি মেলা অভিযান সেরে ফেলব। এই মওকায় বাজে পচা গুড়ের জিলিপি গোটা কয়েক জুটে গেলে মন্দ কি !!
শুভ রথযাত্রা
নাভিদ আঞ্জুম
কদিন আগে ফেসবুকে এক পরিচিত-এর বাবার মৃত্যুর সংবাদ শুনে নির্বিকার ভাবে যন্ত্রের মত লিখলাম 'RIP',সেরকম কোনো অনুভুতি ছাড়াই।এই খুশির দিনে সেটা নিয়ে কিছু লিখবোনা।আজ ঈদ ছিল।কাল ছিল রথযাত্রা।আহা কি আনন্দ।ছোটো থেকেই রথের মেলায় যাওয়া আমার মাস্ট। রথের মেলাতেই আমার প্রথম সার্কাস দেখা। নাগরদোলা চড়াও।লালগোলায় প্রতিবার রথের মেলা বসে অনেকদিন থাকে।এবারো যাবো।আমার সাড়ে চার বছরের ছেলের এবার তৃতীয়বার রথের মেলা দেখা হবে।ও বেচারি হিন্দু-মুসলিম না বুঝলেও,লালগোলাবাসিরা জানে লালগোলার রথের মেলার মোট টার্ন আউটের অন্ত 50%মুসলিম।সকালে ঈদের ময়দানের বাইরে পাঁপড়, চপ,ঘুগনি বা খেলনার যে দোকানগুলো ছিলো তার অনেকগুলিই হিন্দুদের। এতে আমার তিন বছরের ভাইপোর কিছু এসে যায়নি। সে পাঁপড় পুরোটাই খেয়েছে।আর হ্যাঁ,অনেক অনেক হিন্দু ভাইবোনেরা 'ঈদ মুবারক' লিখেছে। আমি অবশ্য 'শুভ রথযাত্রা' লিখিনি।অনেক মুসলিমই লেখেনি। আমিতো কোনদিনই না।তাহলে এবার কি হোলো??? আজ্ঞে অনেকে জায়গায় দেখছি,অনেকে বিজ্ঞের মত সিদ্ধান্ত টানছেন "মুসলমানরা খালি নিজের পরব বোঝে। হিন্দুদের গুলো নিয়ে তাদের কোনো অনুভূতি নেই।" যদিও সরস্বতী পুজোয় অংশগ্রহণ, দূর্গাপূজোয় মণ্ডপে মণ্ডপে ঘোরা, দীপাবলির রোশনাইতে সামিল হওয়া, বিজয়া দশমীর পরের দিন হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে যাওয়া, বিশ্বকর্মায় ঘুড়ি ওড়ানো ও চিড়ের পোলাও খাওয়া এগুলো প্রচুর মুসলিমের কাছে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।এরকমটা দু দশক আগেও ছিলো। তখন ফেবু ছিলোনা, সাধারণদের কাছে মোবাইলও ছিলোনা। স্ট্যাটাস বা ইনবক্সের দেখনদারি ছিলোনা।তবে হৃদ্যতা ছিলো ষোলোআনা।আর জানা ছিলোনা মানুষের মত দেখতে গোরু-ছাগলও হয়। 'শুভ রথযাত্রা' লিখে স্ট্যাটাস দেওয়ার কোনো তাগিদই অনুভব করছিনা, তবে রথের মেলা যাবো, প্রতিবারই।আর হ্যাঁ, কেউ 'শুভ বিজয়া' বা 'ঈদ মোবারক' লিখলে আমার কোনো সমস্যা হয় না।কিন্তু 'ঈদ মোবারক', 'শুভ বিজয়া' বা 'মেরি ক্রিসমাস' এগুলোর কোনোটাই লিখে স্ট্যাটাস দেয়ার কোনো আগ্রহ আমার নেই।কিন্তু আমার কোনো 'হিন্দু বন্ধু' (হায়রে,বন্ধু শব্দের আগেও হিন্দু মুসলিম বসে গেল