‘কলকাতার ছেলে’ ছিলাম না এই সেদিন অবধি। শিলিগুড়ি, বাগডোগরা, বিন্নাগুড়ি ইত্যাদি উত্তরবঙ্গের আধা-গ্রাম, আধা-মফস্সল এবং শহরের আদল প্রায় গোটাটাই অনুকরণ করতে শেখা জনপদগুলিতে আধুনিকতা বলতে ছিল মাথার ওপর দিয়ে বিমানের আনাগোনা, ‘সভ্যতার’ সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী দার্জিলিং মেইল এবং রোববারের সন্ধেয় টেলিভিশনের সিনেমা। খবরের কাগজ পৌঁছোত একদিন পরে। বাসি খবরের তাৎপর্য, বা খবরকে বাসি, তামাদি, অর্থাৎ স্মৃতি থেকে মুছে ফেলার, নানাধরনের সংবাদকে ইতিহাস থেকে ছেঁটে দেওয়ার রাজনীতি নিয়েও রোমাঞ্চিত বোধ করেছি হালে। আকাশপথের ওপর যুদ্ধবিমানের, এবং কেবল যুদ্ধবিমানেরই, নৈতিক অধিকার নিয়ে কথাবার্তা প্রথম কানে এল এই সেদিন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্টস ফ্যাকাল্টির সামনে ডিনের ঘরের পাশে কাঠগোলাপ গাছতলায় আড্ডা মারার ফাঁকে। ব্রিটেন এবং গ্রানাদার মধ্যে লড়াইয়ে এসে ঠেকল আলোচনা, এবং দুটি বড়োলোক দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধানোর ভুল ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বা নয়া চিন—তা নকশালরা যতই চেঁচাক না কেন—কখনোই আর করবে না, সে নিয়েই কথা হচ্ছিল।
আলোচনার শুরু বোধহয় পোখরানে পারমাণবিক বোমার সফল বিস্ফোরণ নিয়ে—একটা জিনিস খামোখা ফেটে গেলে সেটাকে সাফল্যের অভিধায় কেন ভূষিত করতে হবে এই ছিল বেসিক প্রশ্ন। মানববাবু বললেন, “এখন সেটাই স্মার্ট—তুমি তো দেখছি কোনো খবরই রাখো না।” মানববাবু আমার কিছুই প্রায় না-জানাটাকে মেনে নিয়েছিলেন প্রথম ক-টা ক্লাস গড়াতে না গড়াতেই—এরকম ছাত্রও থাকবে, এটাই জীবন। “ঋত্বিক দেখনি? তুমি নাকি বাঙালদের নিয়ে গলা ফাটাও লবিতে?” তারপর জেমস জয়েস, ফকনার, মার্কেজ, মান, হাসেকের স্বাইক—“ভাইদা দেখেছ? আন্দ্রে ভাইদা? ওয়েডিং দেখনি?”
কিছুতেই পরীক্ষার পড়া করব না বলাতে চাপ দেননি একবারও। পড়াতে শুরু করলেন একেবারে অন্য তরিকায়। একদিন বললেন, “ফিনেগানস্ ওয়েক না পড়েই জয়েসকে নিয়ে চালিয়াতি মারার চেষ্টা করছ। তুমি তো দেখছি পাক্কা সিপিএম, তোমার উন্নতি কেউ ঠেকাতে পারবে না।” চালিয়াতি মারার চেষ্টা যে করিনি তা নয়—বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন্ ছাত্রই বা করে না! তবে সিপিএম ধরে উন্নতি করতে হবে এই কথাটায় হেবি আঁতে লেগেছিল, কারণ প্রথমেই যে-কটা ‘উন্নতিশীলেষুর’ মুখ ভেসে উঠল, প্রত্যেকটা সমান বদমাইশ। ধাঁ করে পড়ে ফেললাম আগাগোড়া বইখানা। তার আগে ইউলিসিস পড়া হয়েছে। খানিকটা হাওয়ায় ভেসেই মানববাবুর ঘরে দেখা করতে গেলাম। ভয়ানক বিস্ময়ের ভান করে বললেন, “কোত্থেকে পড়লে?” আমি জেনুইন অবাক। বললাম, “কেন, গোড়া থেকে শেষ অবধি!” ঠোঁটের কোনায় সিগারেট এবং তাচ্ছিল্লের হাসি ঝুলিয়ে বললেন, “শেষ পাতা থেকে শুরু করবে, প্রথম পাতায় এসে শেষ হবে পড়া।”
আগেই বলেছি উত্তরবঙ্গের গাঁইয়া। আধুনিক সাহিত্য পড়ার ওইটাই হয়তো পদ্ধতি মনে করে পড়েও ফেললাম সেভাবে। ও-কটা দিন কেমন কেটেছিল বলতে পারব না। গোড়ার দিকে ধরতেই পারছিলাম না ব্যপারটা, গোলমাল পাকাচ্ছিল প্রতিটি বাক্য মাথার ভিতরে—তারপর একটা ধাঁচা তৈরি হল যুক্তি সাজানোর। যাই হোক, সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায় যুদ্ধজয় সেরে মশাইটির দরবারে পৌঁছোতে তিনি ফের মিটিমিটি হাসলেন। তখনই বোঝা উচিত ছিল সামথিং ইজ রং। উনি ফট করে বইটা মাঝখান থেকে খুলে বললেন, “এখান থেকে আগে পেছন দিকে এগিয়ে যাও, তারপর আবার ফিরে এসে সামনের দিকে পড়তে শুরু করবে।” ব্যপারটা একেবারে পেড়ে ফেলা যাকে বলে তাই। তবে তদ্দিনে আমার রোখ চেপে গেছে। তাই, সেভাবেও পড়ে ফেললাম—এবার ব্যপারটা সহজ মনে হল। ওঁকে সে কথা জানাতে বললেন, “এর পর থেকে প্রতিটি বই পড়ার সময় মাথার ভিতর এই যাতায়াতটা যেন তৈরি হয়। সিগারেট ফুঁকে, খালাশিটোলায় মাল খেয়ে গড়াগড়ি না দিয়ে বা লাতিন আমেরিকান সাহিত্যিকদের বই বগলে এর তার পিছনে ঘুরে না বেড়িয়ে প্রতিটি বাক্য চার-পাঁচবার নানাভাবে এগিয়ে পিছিয়ে পড়ার চেষ্টা করো।” হাতে তুলে দিলেন ‘থ্রি ট্র্যাপড টাইগার্স’। এর পর সিলেবাসে আছে এমন কোনো বই নিয়ে মানববাবু আমার সঙ্গে আর কখনও কথা বলেননি।
ওভাবে পড়ানোটা ছিল মগজে ধার দেওয়ার এক্সারসাইজ। খাটতে শেখার ব্যায়ামও বটে। সাহিত্য মানেই যে সামান্য এলিয়ে পাউডার মেখে নেকু প্রেমের কাব্যি করা নয়, বরং রীতিমতো পরিশ্রমের ব্যাপার এটা তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে বরাবরই নানাভাবে বলা হয়েছে। মানববাবু এই শিক্ষাটি নিজের জীবনযাপন দিয়ে বেশ বুঝিয়েছিলেন। আকাশে পায়রা বা স্কাইলার্ক উড়িয়ে আধুনিক সাহিত্যের পাঠ যে একেবারেই অসম্ভব, তা ওঁর রাশি রাশি কাজ এবং লেখক খুঁজে বের করা থেকেই পরিষ্কার। পাশাপাশি বলে গেছেন, “আমার কোনো ছাত্র নেই।” গুরুগিরির বা পান্ডা হওয়ার দায় অথবা রুচি ছিল না বলেই ওকথা বলতেন।
কবিতা পাঠ ব্যপারটাই পালটে গেল ‘এই স্বপ্ন এই গন্তব্য’ নামক কাব্যগ্রন্থটা হাতে পেয়ে। চটকদার, চমকে দেওয়ার মতো কবিতা পড়ার পাশাপাশি হুয়ানতানামেরা শুনলাম—মানববাবু একদিন সিলিয়া ক্রুজের নাম করলেন। বললেন, “আমার কাছে নেই, পারলে শুনো।” তার অনেক বছর পর আমি ওঁকে ওমারা পোর্তুয়োন্দো শুনিয়েছিলাম, উনি সে সন্ধ্যায় একের পর এক হোসে মারতি পড়লেন। মাঝে, তখনও আমি ছাত্র, এক সন্ধ্যেয় শোনালেন ইকবাল বানো। ‘হাম দেখেঙ্গে’ মুহূর্তে জীবনের অনেকখানি পালটে দিল। ফয়েজ় পড়ালেন আর ‘ভেদ-বিভেদ’ সংকলনটির জন্য অনুবাদ করতে দিলেন কয়েকটি ছোটোগল্প। বলেছিলাম, পারব না। মাথায় ঘুরছিল শিবাজীদার অনুবাদে তৈয়ব সালির ‘ওয়াদহামিদের দৌম গাছ’ গল্পটা। “ওরকম হবে না”—স্ট্রেট বলে দিলাম মানববাবুকে। “চেষ্টা করে দ্যাখো। সমার্থ শব্দকোষ আছে? কোন্ কোন, অভিধান দেখছ? সৌরিনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে?” এক কথা থেকে আর-এক বিষয়ে টানা যাতায়াত চলত। ওর পক্ষে ব্যপারটা সহজ ছিল কারণ যে সিনেমা একবার দেখতেন, যা পড়তেন, মনে থেকে যেত—শট বাই শট বলতে পারতেন ছায়াছবির গল্প। আকাশ থেকে কোনো দেওতা এসে বর দিয়েছিল বা জাদুই ডান্ডার ছোঁয়ায় এসব হয়নি। একটানা কিছুকাল স্মৃতির চর্চা করলে এটা সম্ভব তা ঠারে ঠোরে বুঝিয়েছিলেন। তবে একেবারে অকালকুষ্মাণ্ডদের মাঝে জ্ঞান বিতরণ করলে যে কোনো লাভ হয় না, এই সরল সিধে ব্যপারটি বোঝেননি।
আখতারউজ্জামান ইলিয়াসের ওপর তথ্যচিত্র বানানোর সময় মাথায় ঘুরছিল ওঁর ঘরে বসে শোনা ইকবাল বানোর গান—ছবির শেষে গানটা লাগিয়ে দিয়েছিলাম। যাদবপুরে যেদিন দেখানো হল ছবিটা, সন্ধের পর আবার গেলাম ওঁর কাছে কী একটা কাজে। দেখা করেই পালাব এই ছিল মতলব, ইয়ারদোস্ত মিলে মাল খাওয়া আছে শিবাজীদার ডোভার লেনের বাসায়। মানববাবু মালতিদিকে চা বানাতে বললেন, সঙ্গে নাহুমের বিস্কুট এল—নাহুমের কেক-বিস্কুট খাওয়ার অভ্যাসও মানববাবুর বাড়ির সান্ধ্য আড্ডার দৌলতেই তৈরি হল। উনি কেবল পড়িয়েছেন তাই নয়, এই ছোটোখাটো স্বাদ তৈরি করে দেওয়াও যেন ওঁরই দায়িত্বের মধ্যে পড়ত। যেমন, ওকে নিয়ে চোখের ডাক্তারের কাছে গেছি কয়েকবার মিন্টোপার্কের কাছে। তখনও বই পড়া একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। বেরিয়ে আমরা নানারকম স্যান্ডউইচ ইত্যাদি খেতাম। বিদেশ থেকে ফিরলে অসাধারণ কফি খাওয়ার নেমন্তন্ন করতেন। আমার জন্য নিয়ে আসতেন ছবি আঁকার রকমারি সরঞ্জাম। লাই দিতেন এন্তার।
একবার সাত আটদিন এ ঠেক ও ঠেকে কাটিয়ে সোজা ইউনিভার্সিটি গেছি। চুল-দাড়ি জট পাকিয়ে বীভৎস দেখাচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে নামার মুখে আমাকে দেখেই খপাত করে পাকড়াও করলেন। “খালাশিটোলাতেই গড়াগড়ি খাওয়া হচ্ছিল বুঝি!” সঙ্গের বান্ধবীটিকে জিজ্ঞেস করলেন, “ওর বাপ কী করে? এত পয়সা পায় কোত্থেকে মাল খাওয়ার?” তারপর ট্যাঁক খালি শুনে পয়সা দিয়ে পাঠালেন চুল-দাড়ি কাটতে। নিজের ঘরে বসে বই পড়ছিলেন—আমি শ্মশ্রুগুম্ফহীন হয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াতে খুব খুশি হয়ে বাড়ি গেলেন। আমাকে কোনোদিন একবারের তরেও বলেননি খালাশিটোলায় যেও না। বরং হিজলিতে চাকরি করার সময় কবি শক্তি চাটুজ্জে একবার কেমন ওঁর বুকে চেপে বসে গলা টিপে মাল খাওয়ার পয়সা আদায় করেছিলেন সে গল্প শোনাতেন রসিয়ে।
যাইহোক, অনেকটা ডিভিয়েট করে গেছি, আসল গল্পের বিষয় এটা নয়। আমি উঠব উঠব করছি, উনি বললেন, “তুমি কি শিবাজীবাবু স্যারের বাড়ি যাবে?” ঘাড় নাড়লাম। ততক্ষণে মালতিদি আর যেসব সুখাদ্য সাজিয়ে দিয়েছিল সেসব খাওয়াও প্রায় শেষ—অতএব থাকার কোনো মানেই হয় না। মানববাবু বললেন, “গিয়ে মাল খাবে, আর তো কোনো কাজ নেই। বোসো।” বসলাম। তার পরের তিন চার ঘণ্টা বসেই রইলাম চুপ করে, বুঁদ হয়ে। গোড়ায় একটানা অনেকক্ষণ ভিক্তোর হারা শুনেছিলাম, সেও জীবনে প্রথমবার—‘চিলে স্টেডিয়ামে।’ তারপর মানববাবুর কী খেয়াল হতে, সেও জীবনে প্রথমবারই, আমাকে নিজের অনুবাদ করা কবিতা পাঠ করে শুনিয়েছিলেন—মাচ্চুপিচ্চুর শিখরে। এর কাছাকাছি কোনো অভিজ্ঞতা এখনও আমার হয়নি। মানববাবুকে যারা অনুবাদ করতে দেখেছে, তারা জানে কাজটা কত সহজ মনে হত ওকে দেখলে। মাচ্চুপিচ্চুর শিখরে পড়ছিলেন যখন, তখনও আমার একই কথা কেবলই মাথায় ঘুরছিল—কত সহজে একটা শব্দের পিঠে আর-একটা শব্দ এসে জুড়ে যাচ্ছে, কেমন অমোঘ প্রতিটি শব্দের প্রয়োগ, কেমন মেদহীন ধ্বনি-কাঠামো। অমন অনুবাদ কি মানববাবুও আর কখনও করেছেন? তবে এও বেশ বুঝেছিলাম যে শব্দগুলোকে ঘাড়ে ধরে বাগে আনার, কথা শোনানোর, ধাওয়া করার যে উল্লেখ তার ভাষার রাজনীতি নিয়ে কবিতায় পাই—নাকি তা আদতে বিপ্লবের প্রস্তাবনা, কে জানে—তার গোড়ায় সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ খানিকটা ঠেকনা জোগালেও আদত ব্যপারটি বহু বছরের একটানা পরিশ্রম।
আমাদের মায়াকভস্কিও পড়াতেন—একদিন সোজা লেরমন্তভ দিয়ে শুরু করলেন আধুনিক রুশ সাহিত্যের আলোচনা। মাসখানেক পর স্তালিনকে বেশ খানিকটা গালাগাল করে যখন থামলেন, তখন একটা দেশের সত্তর আশি বছরের ইতিহাস, তলস্তয় থেকে দস্তয়েভস্কি হয়ে শেড্রিন, চেখফ, বিপ্লবের প্যামফ্লেট, ছবি, ছবি দেখার রাজনীতি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি এবং ওই সময়ে কেমন ইংরিজি লেখা হত, সাম্রাজ্যবাদের রকমসকম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুর্ব ইউরোপে কয়েকটি রাষ্ট্র কোন্ ধরনের সাংস্কৃতিক বদল ইনিশিয়েট করে যার ফলে জীবনযাত্রার মান আমূল বদলে যায়—সবটা বুঝিয়ে বলেছিলেন। তবে এ ছিল কেবল আরও গভীরে প্রবেশের সূত্রগুলি ধরিয়ে দেওয়া। তখনও বাড়িতে হঠাৎ হাজির হয়ে দেখেছি টেলিভিশনের সামনে বসে আছেন তাস, খাতা পেন এবং খাটের একপাশে দাঁড় করানো হুইস্কির বোতল সহ। পরনে হাফ প্যান্ট, ফুলকাটা গাঞ্জি। কখনও ফতুয়া। কখনও গল্প করে চলে এসেছি, কখনও পড়াশোনার আলোচনা হয়েছে। উঠব বললে জোর করে বসিয়েছেন, চা না খাইয়ে ছাড়েননি। কথা বলতে শুরু করলে কখনও মনে হয়নি একটু আগে ভয়ানক রাগ করেছেন মালতিদির ওপর বিছানা পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগ জানিয়েছে বলে।
ইলিয়াসের ওপর তথ্যচিত্রটি যে ওঁর ভালো লেগেছে, সেটি বুঝতে অসুবিধে হয়নি। ওঁর মতো করে বুঝিয়েছিলেন। ছাত্ররা সহকর্মী হবে একদিন, কাজ করবে একসঙ্গে। শিখিয়েছিলেন শব্দের গোড়ায় ফিরে গিয়ে পড়বার কায়দা। জীবনের ক্ষেত্রেও সে ফিরে দেখা বাদ দিয়ে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় মনে করতেন না। বিভগীয় প্রধানের ঘরের সামনে একদিন এক ছাত্রী হঠাৎ প্রণাম করে বসলে উনি ভয়ানক বিব্রত হয়ে পড়েন। অন্যের বোকামো-হাঁদামোয় ওঁর চাইতে বেশি লজ্জিত হতে দেখিনি কাউকে। সে যাকগে। ধাতস্থ হয়ে মানববাবু কেবল মৃদু হেসে বলেছিলেন, “এত বছর এ বিভাগে পড়ার পরেও পায়ে হাত দিলে?”
বাঙালির জীবনে যে ক-টি আইকন, সবকটাকে টেনে ভুলুণ্ঠিত করায় ওঁর জুড়ি মেলা ভার ছিল। প্রমথেশ বড়ুয়ার ওপর রাগ ছিল প্রিয় হাতিটিকে গুলি করে খুন করেছিল বলে। ওই প্রসঙ্গে কথা উঠলেই গল্পের মোড় আপনাআপনি ঘুরে পৌঁছোত প্রতিমা বড়ুয়ার গানে — তাঁর ভীষণই প্রিয় ছিল। বিশ্বনাথ, কপিলদেবকে পছন্দের তালিকা থেকে ছাঁটেননি কখনও, তবে কিরমানির ওপর অযৌক্তিক ক্ষোভ ছিল—ওর জন্য সম্বরণ জাতীয় দলে চান্স পেল না!
নিজের জীবনের গল্প কি খুব একটা বলেছেন কখনও? মনে পড়ছে না। তবে এর তাঁর কথার ফাঁকে উঠে এসেছে অনেকটাই। শিব্রামের সঙ্গে আলাপ নিয়ে গল্প বলে খুশি হতেন। আমরা খুব আড্ডা মারতাম বলরাজ সাহানির ছবি নিয়ে—ওঁর সঙ্গে কোথায় আলাপ হয়েছিল মানববাবুর সে কথাও বলেছিলেন। বোম্বাইয়ে ওঁদের বাড়িতে যাওয়া, খুব বড়ো লাইব্রেরি আর শান্তিনিকেতনে কাটানো খানিকটা সময়—খুঁটিনাটি সব মনে নেই এখন আর। সুরাইয়া, সামশাদ বেগম, জোহরাবাই আম্বালেওয়ালি আর নুরজাহানের গান নিয়ে আমি আর মানববাবু খুব উত্তেজিত হয়ে থাকতাম, কারণ উলটোদিকের শিবিরে লতার হয়ে একটানা ক্যাম্পেন চালাতেন শিবাজীদা। আশির দশকের শেষ, আমরা আনমোল ঘড়ির গান শুনেছিলাম টেপ রেকর্ডার বাজিয়ে। এর অনেক অনেক পরে সিডি এল। তদ্দিনে মানববাবু রংকলের একতলার ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন।
আমি এসেছিলাম ওঁর বাড়ি তৈরি দেখতে। নতুন বাড়িতেও আড্ডা মেরেছি বারকয়েক। সিগারেট খাওয়া কমাননি। লোকে বলত “দেখুন, এমনকি মালুও সিগারেট ছেড়ে দিল।” পাত্তাই দিতেন না কারওকে। আমি যদ্দিনে কলকাতার মানুষ বনেছি পুরোদস্তুর, তদ্দিনে মানববাবু এই কোলাহল ছেড়ে সরে গেছেন। একবার জাদুবাস্তবতা পড়াচ্ছেন—দেখে আসতে বলেছেন ওরোজকো, সিকেরোস আর রিভেরার ছবি। আমি ইনসার্জেন্ট মেহিকের শেষে সাধারণ জীবনের গল্প ছবির মতো একের পর এক ফিরে ফিরে আসার কথা পেড়েছিলাম। মানববাবু সেখান থেকে লাতিন আমেরিকার আদীবাসীদের মন্দিরের দেয়ালচিত্র, তার ওপর কনকিস্তাদোরদের পলেস্তরা চাপিয়ে মাতা মেরি আর খ্রিস্টের ছবি এঁকে দেওয়া—আর বহু বছর পর সেসব জায়গায় জায়গায় খশে মেরির মুখের বদলে কালো মেয়ের মুখ বেরিয়ে পড়া, জিশুর গা বেয়ে পাক দিয়ে ধরা সাপ আর অদ্ভুত সব রং-এর গাছপালার এক প্রকাণ্ড ক্যানভাসের গল্প বলতে শুরু করেন। সে গল্পের কোথাও কালো মেরি, গুয়াদালুপে, কোথাও কারাগেওর্গে ঘোড়ায় চেপে ইভো আন্দ্রিচের গল্পের পটভূমি ছেড়ে অনায়াসে তিন-চারশো বছর অতিক্রম করে লাফ দিয়ে পৌঁছোয় হাভেল আর যুদ্ধবিদ্ধস্ত পূর্ব ইউরোপে। আন্দ্রে ভাইদার গল্পের খুঁটিনাটি হঠাৎ নতুন অর্থ সহ হাজির হয় চোখের সামনে। মানববাবু কোলাহল ছেড়ে সরে দাঁড়ালেও এই ছবির ভিতরে ছবি, গল্পের ভিতরে গল্প বুনে দেওয়ার কাজটি করে যাবেন একটানা। আমি যে কলকাতার, ঢাকার, মুম্বাই, দিল্লির বাসিন্দা, সে শহরগুলোকে চিনেছি মানববাবুর শেখানো চিহ্নসংকেত পড়ার, সেগুলোকে ভেঙেচুরে নেওয়ার পদ্ধতি মারফত। ভারতীয় ছোটোগল্পের অনুবাদে, এই উপমহাদেশের আধুনিকতাকে এক নতুন রকমের আখ্যান পরিসরে টেনে দাঁড় করান, যেখানে ঘাপটি মেরে, লুকিয়ে, ‘আমি নিরপেক্ষ’ বলে সরে দাঁড়ানোর, পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। মানববাবু এই লড়াইয়ে নামিয়ে ছেড়েছেন আমাদের। মাথার ওপর আকাশে তাই নতুন রকমের যুদ্ধবিমানের ওড়াউড়ি বাধ্য করে কয়েক পা পিছিয়ে যেতে, কয়েকটা কেতাব, হিসেবের খাতা, মাঝখান থেকে খুলে সামনের দিকে, কখনও আবার পিছন দিকে উলটে পালটে পড়তে। নজর রাখি যাতে কেউ ইতিহাস বইয়ের মাঝখান থেকে কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে নিতে না পারে। ওখান থেকেই পড়া শুরু করতে হয়, ওরকমটাই অভ্যেস হয়ে গেছে।
কি চমৎকার ভাবে সময়টাকে আর ব্যক্তি মানবেন্দ্রকেএঁকেছেন অমিতাভ, কুর্ণিশ!
আমার সত্তর ও আশির দশক কেটেছে মানবেন্দ্র ও অশোক গুহের অনুবাদ পড়ে ।