স্কুলে পড়াকালীন বাড়ির বইয়ের মধ্যে একটা পাতলা বই চোখে পড়ত হানস্ মাগনুস এন্ৎসেন্সবার্গার। এমন নাম আগে শুনিনি। উচ্চারণ করতে কষ্ট হত বলেই হয়তো উলটে পালটে দেখতাম। বইয়ের মলাটে আর-একটি নাম চোখে পড়ত মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সময় নাগাদ একদিন শুনলাম বাড়িতে মানববাবু এসেছেন। উঁকিঝুঁকি মেরে (কারণ আমার মামা অনিরুদ্ধ লাহিড়ীর ঘরের বিদগ্ধ/প্রাপ্তবয়স্ক আসরে আমি একটু ব্রাত্য ছিলাম) দেখলাম ছোটো মতো একজন মানুষ সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যাচ্ছেন। তখন বুঝিনি আর ক-দিন পরেই এই মানুষটির এত কাছে যাওয়ার সুযোগ হবে।
১৯৯০ সালে তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হয়ে মানববাবুকে আমার সরাসরি ক্লাসরুমে মাস্টারমশাই হিসেবে পাই। প্রথম বছরেই উনি শুরু করেন কাফকা পড়ানো। আমি এগারো-বারো ক্লাসেই কাফকার সব ছোটো গল্প পড়ে ফেলেছিলাম, তাই সব জানি একটা গর্ব ছিল এবং ধারণা ছিল সব বুঝিও। খুব উৎসাহ নিয়ে তো ক্লাসে বসে আছি, ভাবখানা এমন যেন একটা প্রশ্ন করলেই সব বলে দিতে পারব। ওমা, কোনো প্রশ্ন তো করলেনই না, কাফকার নামও উচ্চারণ করলেন না! প্রাগ শহর সম্পর্কে অনেক কথা বললেন। কী অসাধারণ একটা বই এনে কত ছবি দেখালেন। তারপর আরও অনেক ক্লাস জুড়ে ইতিহাস জানলাম কত। উনি শেষ পর্যন্ত যখন ‘দ্য মেটামরফোসিস' পাঠটিতে এলেন আমি তখন এটুকু জেনে গেছি যে কিছুই আগে জানা হয়নি আমার। যত দূর মনে হয়, এই ছোটোগল্প পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকেই বোধহয় কাফকার উপন্যাস ‘দ্য ট্রায়াল’-ও পড়িয়ে দিয়েছিলেন। ওটা পাঠ্য ছিল না বলে পড়বার দরকার নেই এমন তো না। এ যুগের স্যারেদের মতো বেশি তথ্য দিলাম ফলে সব জমিয়ে রাখা জ্ঞানটুকু খরচ হয়ে গেল সেই ভয় ওনার ছিল না। জীবনদর্শনই ছিল জানা ও জানানোর। সিলেবাসে যা আছে, যতটা পড়ানোর কথা, তার থেকে সবসময় বেশি পড়িয়ে দিতেন। অনেক পরে দেখেছিলাম মেপে কাজ করা, মিতব্যয়িতা ও যৌক্তিকতা এইসব সামান্য খোপের মধ্যে আটকে পড়ে থাকার মতো মানুষ উনি নন।
প্রথম দিকে ক্লাসঘরে ওনার সঙ্গে কথা বলতে সাহস পেতাম না কারণ আমার সবে ইস্কুলের গণ্ডি পেরোনো পাখা না গজানো দশা। মনে নেই কার কথা শোনানোর জন্য ওনার ছাত্র-সহকর্মী শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের কয়েকজনকে ওনার বাড়িতে নিয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই ছিল হরিপদ দত্ত লেনে ওনার ছোট্ট বাসা। এরপর লেগে থাকল নিত্য যাওয়া-আসা। নিমন্ত্রণের আর কখনও দরকার হল না তো বটেই বরং শুরু হল আমাদের অত্যাচার। অনেক বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতেন প্রায়ই। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, নবারুণ ভট্টাচার্য, বিভাস চক্রবর্তী, প্রফুল্ল রায় প্রমুখ। মন ভালো না থাকলে আমি একা চলে যেতাম ওনার বাড়ি। কিছুক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করলেই উনি আমাকে গল্প পড়ে শোনাতেন। মনে পড়ে প্যাট্রিসিয়া হাইস্মিথ-এর ‘লিটল্ টেল্স অফ মিসোজিনি’ পড়তে পড়তে বলেছিলেন, “এমন গল্প আগে পড়েছ?” আমি তো নামই শুনিনি। গ্রাহাম গ্রিনও পড়ে শুনিয়েছিলেন। কবিতা শোনাতেন। মাঝে মাঝে ওনার সঙ্গে বসে টিভিও দেখতাম। কী যে ভয়ংকর সব খারাপ সিনেমা সামনে চালিয়ে রাখতেন বলবার নয়! পরে সিডি-র যুগে অনেক সাদা-কালো পুরোনো হিন্দি চলচ্চিত্র কিনেছিলেন, আমি সে সব নিয়ে আসতাম জোর করে। উনি সেগুলো হাতছাড়া করতে চাইতেন না বলে রেগে যেতেন। ছোটোবেলায় হিন্দি চলচ্চিত্র দেখার অনুমতি ছিল না, তাই আমার এসব বিষয়ে ধারণা খুব কম ছিল।
মানববাবুর কাছে আমি পেশেন্স খেলতেও শিখেছিলাম। ওনার কাজ করার ধরন ভারী অদ্ভুত ছিল। খাটের ওপর একটা পা ভাঁজ করে এক পা ছড়িয়ে বসে, তাস ধরা এক হাতে, এক হাতে সিগারেট, এদিকে উনি কিন্তু খাতাকলম নিয়ে কবিতা অনুবাদ করছেন। স্নাতকোত্তর পড়াকালীন আমার খুব পছন্দের বিষয় ছিল আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্য, যার অনেকটা অংশ মানববাবুই পড়াতেন। পাঠ্য বই ছিল উইলিয়াম ফকনার-এর ‘দ্য সাউন্ড অ্যান্ড দ্য ফিউরি’। উনি বলেছিলেন বইটা পড়ে আসতে।
পড়া হয়নি। হালকা একটু বকুনি দিলেন। বেশি শাসন করতে একেবারেই অপারগ ছিলেন। প্রথমদিন ক্লাসে ফকনার নিয়ে অনেক কিছু বলে আবার বইটা পড়ে আসতে বললেন। আমি কয়েক ছত্র পড়ে কিছুই বুঝলাম না। অন্য একটা বই পড়ে ক্লাসে চলে গেলাম। যেই বলেছেন, “ফকনার পড়েছ?” অমনি বললাম, “হ্যাঁ তো।” উনি একটু তাকাতেই বললাম, ‘সোলজ্যর্স পে’ পড়েছি। উনি জিজ্ঞাসা করলেন, “ওটা কি তোমার পাঠ্য?” আমি বললাম “ওসব কঠিন পাঠ্য আমার দ্বারা পড়া হবে না।” উনি খানিকক্ষণ তাকিয়ে আমাকে ওই ‘সোলজ্যর্স পে’ নিয়েই পড়াতে শুরু করলেন এবং বুঝিয়ে দিলেন এটার সঙ্গে ‘দ্য সাউন্ড আ্যান্ড দ্য ফিউরি’র বিষয়গত এবং আঙ্গিকগত তফাত। বলাই বাহুল্য উনি পড়ানোর পর ‘দ্য সাউন্ড অ্যান্ড দ্য ফিউরি’ বুঝতে আর অসুবিধা হয়নি। কী করে জানি না ফকনার-এর অন্য একটি উপন্যাসও ক্লাসের স্বল্প পরিসরের মধ্যেই বেশ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
আমি চিরকাল ইংরেজি মাধ্যমে পড়া মেয়ে। বাৎসরিক পরীক্ষা দিতে বসে হঠাৎ মনে হল বাংলায় উত্তর দেব। বইয়ের নাম বাংলা করে লিখব বলাতে মানববাবু খুব খুশি হলেন। উনি পরীক্ষা চলাকালীন কিছুক্ষণ বাদে আমায় কয়েকটি ইংরেজি পরিভাষার বাংলা তর্জমা করে বলে দিয়ে গেলেন। আমি তো ভয়ে অস্থির কারণ ওই শব্দগুলো যে আমি কোনো কাজেই লাগাতে পারলাম না! সেবার মনে হয়েছিল উনি উত্তেজিত হয়েছিলেন ওই পত্র কেউ বাংলায় লেখে না ভেবে।
আমি ক্লাস না করে ঘুরে-ফিরে দিব্যি বছর কাটিয়ে দিচ্ছিলাম। মানববাবু আমায় একদিন হঠাৎ খুব বকলেন, “রাত সাড়ে দশটা অবধি কোথায় ঘুরে ঘুরে বেড়াও?” আমি অবাক! উনি কী করে জানলেন আমি অত রাতে বাড়ি ফিরেছি আগের দিন। “বাড়ির লোকেদের অত চিন্তায় ফ্যাল কেন?” ল্যান্ডলাইনের যুগ। বাড়ি থেকে ফোন পেয়েছিলেন। এর কিছুদিন পরে কার কাছে খবর পেয়েছিলেন আমার জন্মদিনে বন্ধুদের আমি নিমন্ত্রণ করব। ওনাকে সে দলে আমি কখনও ফেলিনি, তাই বলিনি। খুব অভিমান করে বললেন, “সবাইকে বললে আর আমি বাদ? কত বই তোমায় দেব বলে গুছিয়ে রাখলাম।” আমি বললাম, “আপনাকে বাড়ি গিয়ে খাওয়াব।” উনি বললেন, “তোমার মামাকে সঙ্গে এনো।” কথামতো গেলাম। উনি অনেক বই তো দিলেনই কিন্তু একটা আস্ত বিশাল পাটালিও দিলেন। আমি পাটালি গুড় নিয়ে কী করব বুঝতে পারছি না! উনি বললেন, “ও, পাটালি দিশি বলে বুঝি মনে ধরছে না! বিদেশি কেক না হলে তোমাদের চলে না! ওটা হাতে ভেঙে খাও।” বইগুলো মনে ধরেছিল খুব। সব ওনার অনুবাদ কিংবা সম্পাদিত ছিল। জুল ভের্ন অমনিবাস, কামাক্ষীপ্রসাদের কিশোর অমনিবাস, মরডেকাই রিচলার-এর ‘জেকব দুই-দুই’, এরিখ কেস্টনার-এর ‘উড়ো ক্লাসঘর’। আমার মামার কাছে নালিশও করেছিলেন।
চূড়ান্ত পরীক্ষার কয়েকদিন আগে ওনাকে বললাম পড়িয়ে না দিলে পাস করব না। যেন আমাদের পাস করানোর দায় এবং দায়িত্ব সবই ওনার। একদিন পড়তে গেলাম জাদুবাস্তবতাবাদ। আমাদের পাঠ্য ছিল গার্সিয়া মার্কেস-এর ‘একশো বছরের নিঃসঙ্গতা’। উনি বললেন, “তোমরা আমায় বলো জাদু কাকে বলে, আমি তোমাদের বুঝিয়ে দেব বাস্তবতাবাদ কী।”
পরীক্ষার ঠিক একদিন আগে একগুচ্ছ বিদেশি কবির কবিতা নিয়ে গিয়েছি। একে আমি কোনোদিন কবিতা ভালো বুঝতে পারি না, তায় যেসব কবিতা পাঠ্য তার কবিদের সম্পর্কে কিছুই জানি না। প্রাক-ইন্টারনেট যুগ: কোনো শর্টকাট নেই। সব কবিরাই প্রায় পূর্ব ইওরোপ বা রুশ শুধু এজরা পাউন্ড আর টি এস এলিয়েট ছাড়া। অনেক দর কষাকষির পর রফা হল মানববাবু অচেনা কবিদের পড়াবেন কিন্তু কিছুতেই পাউন্ড, এলিয়েট পড়াবেন না। ওঁদের সম্পর্কে অনেক বই পাওয়া যায়, আমাদের পড়ে নিতে হবে। অগত্যা রাজি হলাম আমি আর সহপাঠী অনিন্দিতা। হলে প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে দেখলাম শুধু পাউন্ড আর এলিয়েট। হাসি মুখে মানববাবু আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। বললেন, “প্রশ্ন তৈরি করে কি উত্তরও বলে দেব নাকি! জানতাম তো যা পড়ছ শেষ মুহূর্তে তা পরীক্ষাতে কোনো কাজেই লাগবে না।” কোনোদিন কঠিন প্রশ্ন করতেন না। ছাত্রদের অপদস্ত করার জন্য পরীক্ষার প্রশ্নে ওনার বিদ্যা জাহির করার তো দরকার ছিল না!
অচেনা মানুষের সামনে কথা বলতে পারতেন না। এমনি লাজুক ছিলেন যে ওনাকে অপ্রস্তুত হলে লজ্জায় লাল হয়ে যেতে দেখেছি। কিন্তু আড়াল সরাতে পারলে বেরিয়ে পরত আপাদমস্তক কৌতুকপ্রিয় এক মজার মানুষ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কোনো মাস্টারমশাই, সেও আবার বিভাগীয় প্রধান থাকাকালীন, অন্তত সে যুগে সাহস করে কেদিয়ু বা গুজরাতি কুর্তা পরে আসতে পারতেন বলে আমার মনে হয় না। আমরা খুব হেসেছিলাম বলে উনি সেই পোশাকের কুল জ্ঞাতি রাজনৈতিক তাৎপর্য সব আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। মানববাবুর সঙ্গে ওনার প্রিয় ছাত্রদের ঝগড়া হয়ে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হতে দেখেছি আমি। কোনো দ্বেষ বা যুক্তির দরকার ছিল না। এমনি এমনি। এমনই মানুষ ছিলেন দিতে পারতেন যে-কোনো জিনিস না চাইতেই। নিয়মিত সাক্ষাৎ-এর প্রায় সব দিনই ছিল অসম্ভব চমকপ্রদ—সবই গল্পের মতো। তবে গল্প হলেও সত্যি।