একমত
প্রত্যেকটি বক্তব্যের সঙ্গে পূর্ণ সহমত। রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে চলে আসা মুনাফা-সর্বস্ব তৃতীয় পক্ষকে আটকাতে রোগী চিকিৎসককে একজোট হতে হবে। স্বার্থটা আপাতভাবে রোগীর বলে মনে হলেও ডাক্তাররা এই পরিস্থিতিতে নিরাপদ নন।
মনে পড়ে গেলো, মেডিকেল কলেজকে কোভিড ওনলি হাসপাতাল করায় এবং সরকারি স্বাস্থ্যের বেহাল দশার বিরুদ্ধে হবু চিকিৎসকরা আন্দোলনরত। এগুলো বাদ দিয়ে সত্যি "ডক্টর'স ডে" হয় না।
পুরনো বিশ্বাসের সম্পর্কই কাম্য। নাহলে গোটা ব্যাপারটা আরো যে কোথায় যাবে কোনো ধারণা নেই। এখনই নরকদর্শন হচ্ছে। নতুন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলার জায়গাও ক্রমে সংকুচিত করে আনা হচ্ছে। কোভিডের পরিপ্রেক্ষিতে জমায়েত, মিটিং মিছিল প্রায় নিষিদ্ধ। কিন্তু রথযাত্রা হয় পুরীতে এবং ছবিছাবা দেখলেই বোঝা যায় কতো নিয়ম মানা হচ্ছে সেখানে।
এই অবস্থায় মানুষ খুব বিভ্রান্ত। কোনো সহজ সমাধান সত্যি নেই।
a-মহাশয়/য়া, লেখাটা পড়লে, সম্ভবত, বুঝতে অসুবিধে হয় না - কর্পোরেটের উদ্দেশ্য মুনাফা। দুর্নীতি যেহেতু সহজে মুনাফা বৃদ্ধি করাতে পারে, অতএব দুর্নীতি নিয়ে তাঁদের কোনো সমস্যা নেই (আগ্রহ রয়েছে)।
এখন অনিবার্যভাবেই এই দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকেন ম্যানেজমেন্টের সাথে সাথে চিকিৎসকও।
কিন্তু, কথাটা আপনার খুব অবিশ্বাস্য ঠেকলেও বাস্তবটা হল, সে দুর্নীতিতে চিকিৎসকের ভূমিকা আর বস্তি উচ্ছেদ করে কারখানা/ফ্ল্যাট বানানোর ক্ষেত্রে সরাসরিভাবে সামনে দাঁড়িয়ে বস্তি উচ্ছেদ করতে বাধ্য হচ্ছেন যে কর্পোরেট কর্মচারী, তার ভূমিকা - উভয়ের মধ্যে বিশেষ ফারাক নেই। এবং উভয়ক্ষেত্তেই, কর্পোরেটের লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ না করতে পারলে এক কর্মচারী/ডাক্তারের জায়গায় আরেকজন বসবে - কর্পোরেটের কেশাগ্রটুকুও বিচলিত হবে না।
আপনি ভাবতেই পারেন, হাসপাতালে ডাক্তারের অধিকার বা ক্ষমতা তার চাইতে অনেক বেশী। কিন্তু, সেসব এখন অতীত - আপাতত পাঁচতলা মল, পুরোটাই ব্যবসা। আগে মানুষ যেতেন অমুক ডাক্তারের কাছে, এখন যান অ্যাপোলো বা মেডিকা বা ফর্টিসের কাছে - ডাক্তার সহজেই রিপ্লেসেবল।
শুনলে হয়ত আরো আশ্চর্য হবেন, ওষুধ কোম্পানির হাত ধরে আন্তর্জাতিক গবেষণার ফসল অনুসারে মোটামুটিভাবে হাঁচিকাশির চিকিৎসা করতে গেলেও বিশ-পঁচিশটা টেস্ট না করালে আপনাকে আদালতে জবাবদিহি করতে হতে পারে।
কাজেই,,ডাক্তারের ভূমিকা বলতে যতখানি ভেবে নেওয়া হয়, তার মধ্যে অনেকখানিই অতিরঞ্জন ও অবাস্তব ধারণা। ব্যক্তিচিকিৎসকের দায়িত্ব কি কিছুই থাকে না? থাকে তো বটেই। এই অর্থকে মোক্ষ ভাবার সময়ে বেড়ে উঠে আচমকা চিকিৎসকই অপাপবিদ্ধ রয়ে যাবেন, এমন দুরাশা না করাই ভালো। কিন্তু, আবারও বলি, সামগ্রিক চিত্রটিতে ব্যক্তিচিকিৎসকের ভূমিকা খুব বেশী নয়।
তবে সত্যি বলতে কি, এসব ভাবনাচিন্তায় বড্ডো পরিশ্রম। তার চেয়ে ডাক্তারকে কশাই বা চামার ভেবে দুটো খিস্তি করতে পারলে প্রাণের আরাম হয়। আর যারই অভাব থাক, এই বিষয়ে ট্রেনে বাসে চায়ের দোকানে বিশেষজ্ঞের অভাব নেই।
তেমন একটু জ্ঞানের প্রকাশ এখানেও রাখা যেতেও পারত। লেখার সাথে সাথে টাকরায় ছোঁয়ানোর মতো চাটনি হিসেবে থাকলে জমত বেশ।
একবার অভ্যেস হয়ে গেলে চাটনি ছাড়া খাবার পানসে লাগে - এ তো জানা-ই কথা।
আমি গতবছরের একটি দীর্ঘ লেখা বিষাণের লেখার পরিপূরক হিসেবে এখানে পোস্ট করলাম। একটু ধৈর্য ধরে পড়ুন।
১লা জুলাই বর্তমান পত্রিকার উত্তরবঙ্গ সংস্করণে সাংবাদিক বন্ধু নিজস্ব শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালোবাসা থেকে ডক্টর'স ডে-তে আমাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখেছেন। সে প্রতিবেদন আমার অনুজপ্রতিম পুরুষোত্তম ওর ভালোবাসা থেকে ফেসবুকে পোস্ট করে দিয়েছে।
এত মানুষের ভালোবাসায় আমি কুণ্ঠিত, দ্রব। আমি কি এর যোগ্য? নিজেকে প্রশ্ন করছি নিরন্তর। অন্তত যোগ্যতা অর্জনের চলমান যাত্রা যেন মৃত্যু ছাড়া থেমে না যায়।
এসবের পরেও আমার বন্ধুদেরকে, যারা হৃদয়ের কোটরে বসবাস করেন, (তাদের মাঝে কেউ ডাক্তার, কেউ শিক্ষক, কেউ মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্ন্টেটিভ, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিভিন্ন পেশায় চিকিৎসাপ্রার্থী মানুষ সবাই আছেন) কয়েকটি বিষয় নতুন করে ভেবে দেখতে বলবো।
(১) ডাক্তারি পেশায় ফিজ একটা বিষয়। ব্যক্তিগতভাবে ডাক্তারদের ক্ষেত্রে স্থান, অভিরুচি, পেশার অধিকতর যোগ্যতা, কোন পরিসরে কিরকম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন ইত্যাদি অনেক কিছুই বিবেচ্য।
আমার বা অন্য আরও কিছু মুষ্টিমেয় চিকিৎসকের ফিজ কম এটা একধরনের philanthropy. স্বাস্থ্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত এবং নিবেদিত একাধিক সংগঠন এই পশ্চিমবাংলায় শুধু নয় ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে নামমাত্র টাকায় বছরের পর বছর দরিদ্র, অবহেলিত, দলিত এবং প্রান্তিক মানুষদের কাছে চিকিৎসা পৌঁছে দিচ্ছেন। সুস্থ করে তুলছেন।
এদেরকে আমার কুর্ণিশ!
(২) আমার মতো যারা তুলনামূলকভাবে কম টাকায় রোগী দেখি তারা রোগীদের সাথে কথা বলি, একটি বন্ধন তৈরি হয়। প্রসঙ্গত, আজকের মুক্তবাজার অর্থনীতির এবং কর্পোরেটতন্ত্রের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক আবহে, প্রেক্ষিতে "জীবনমশায়" বা "অগ্নীশ্বর"-দের আশা করা কুহেলিকা মাত্র। সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা মানুষের চিন্তনের গঠন করে। Social psyche তৈরি করে। আজ একজন চিকিৎসক রাত জেগে আর্ত মানুষটির পাশে বসে থাকবে, জলপটি দিয়ে দেবে - বর্তমান সময়ে কি ভাবা সম্ভব? পরিবারই যেখানে ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে! মৃতদেহকে শ্মশানে নিয়ে যাবারও লোক পাওয়া যায়না!
(৩) কি বলি আমরা তাহলে রোগী এবং তার পরিজনকে?
এটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং বর্তমান সময়ে জ্বলন্ত একটি বিষয়। বলি কি - ১৩০ কোটির দেশ ভারতে অপরিমেয় বিভিন্নতা এবং বৈষম্য নিয়ে বিরাজমান সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি philanthropy বা NGO বা বিভিন্ন সৎ স্বাস্থ্যউদ্যোগও স্বাস্থ্য ও শিক্ষা এদুটো সমস্যার সমাধান করতে পারবেনা।
বলি কি রাষ্ট্রকে স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিতে হবে?
বলি কি স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকারের তালিকাভুক্ত করতে হবে? সম্ভবত বলিনা।
আমরা সুসম্পর্ক, হাসিখুশীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি। কিন্তু সেটা দুজন মানুষের মাঝখানে চিন্তার বা বৌদ্ধিক কোন সম্পর্ক নয়। এতে অনুগামী, এমনকি স্তাবকও তৈরি হতে পারে। কিন্তু স্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মী গড়ে তোলা মুশকিল।
(৩) আমরা রোগী এবং পরিজনদের কাছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার গুরুত্ব নিয়ে সংলাপ শুরু করিনা কেন? রোগীর সাথে সংলাপ মানে আরোগ্যের সংলাপ শুধু নয়। একটি ছেদহীন সামাজিক সংলাপ।
১৯৮৩ সালে জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের সময়ে আমরা এ সংলাপ শুরু করেছিলাম। স্বাস্থ্য মানুষের অধিকার, কারো দান বা ভিক্ষা নয়। রাষ্ট্রকে এর দায়িত্ব নিতে হবে।
রাষ্ট্রের কানে নিরন্তর পৌঁছে দেবার দায়িত্ব ডাক্তারদের, স্বাস্থ্যব্যবস্থার সাথে যুক্ত সবধরনের কর্মীদের এবং, সর্বোপরি, মানুষের।
(৪) সম্প্রতি Wolters Kluwer প্রকাশনার নামী জার্নাল Journal of Family Medicine and Primary Care-এ এপ্রিল এবং জুন সংখ্যায় আমার দুটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে - "Primary care is the key to health for all" এবং "Comprehensive primary health care, not any vertical program needed for UHC".
বাংলায় শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ এবং গুরুচণ্ডালী এ বিষয়ের ওপরে গুরুত্বপূর্ণ লেখার সংকলন প্রকাশ করেছে। আমার বাংলা প্রবন্ধও সে সংকলনে আছে।
(৫) আমাকে চিকিৎসক হিসেবে ভালোবাসার যদি বাস্তব কোন কারণ থাকে তাহলে সেটা ফিজ কম, ফ্রি স্যাম্পল দেওয়া বা হাসিখুশি ব্যবহার নয়।
তাহলে সেটা হোক আপনাদের সাথে হাত ধরে, বুকের উষ্ণতা নিয়ে একসাথে থেকে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের একজন কর্মী এবং সংগঠক হিসেবে।
#স্বাস্থ্য আমার অধিকার
#স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকারের তালিকাভুক্ত করতে হবে
#সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিকল্প কিছু হয়না, কোন ইন্সিউরেন্স এর বিকল্প নয়।
#প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে সজীব করে তুলতেই হবে।
#স্বাস্থ্য চাই আমরা, পাঁচতারা স্বাস্থ্য পরিষেবা নয়।
অসাধারণ বিশ্লেণধর্মী লেখা। সবারই, বিশেষত চিকিৎসকদের এ লেখাটি পড়া উচিত। ডা বসুকে আন্তরিক শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন।
Doctors Day তে অনেক শুভেচ্ছা ভলোবাসা পেলাম। সব চিকিৎসকই যেমন পেয়ে থাকেন। এরই মধ্যে বিষাণের সুন্দর লেখাটি আমাদের সামাজিক অবস্থান এবং দায় দায়িত্ব সম্পর্কে আবার একটা জেন্টল রিমাইন্ডারের মতো এলো। ধন্যবাদ বিষাণ।
যাঁর জন্মদিনও মৃত্যুদিনকে স্মরণ করে আজ চিকিৎসক দিবস, তাঁর সরকার ১৯৪৯ ও ৫৯ এ গুলিকরে খাদ্য আন্দোলনের সাথীদের শহীদ করেছিলেন।এটুকু যেন -" আমরা ভুলে যাই/ বেদনা পাই।"
@ সৈকত, প্লাস মাসুল সমীকরণ নীতিতে সই করে "নতুন বাংলার রূপকার" বাংলার ঠিক কী সর্বনাশ করে গেছিলেন, সেই কথাটাও...