দুর্গম পাহাড়ে ডিসেম্বরের ভোর। হিম বাতাসের কামড় ছাপিয়ে প্রধান হয়ে ওঠে দৃষ্টি আচ্ছন্ন করা কুয়াশা নয়, নারকেল দুধের মতো ঘন সাদাটে ধোঁয়াশা। কনকনে ঠাণ্ডায় হাত-পা অবশ হয়ে আসতে চায়, চশমার কাঁচ বাষ্পাচ্ছন্ন ঘোলাটে হয়ে আসে, তখন হাত তিনেক দূরের দৃষ্টিও বুঝি অসাড়। অরণ্য সবুজের ডালপাতায় কুয়াশা জমে জমে বৃষ্টির মতো টুপটাপ ঝরে পড়ে জলকণা। ভিজিয়ে দেয় পোশাক-আশাক, ব্যাগ-ব্যাগেজ, সর্বস্ব। দূরে রাতজাগা কোনো পাখি উড়ে যেতে যেতে কর্কশ স্বরে ডেকে বলে, হুঁশিয়ার!
এরই মধ্যে রেস্ট হাউজ নামক বাঁশের তৈরি মাচাং ঘর থেকে গুটি গুটি পায়ে একাই বেরিয়ে পড়া হয়, হাতে টাইগার ড্রাইসেল টর্চ, বিদ্যুতহীন বম জনগোষ্ঠীর পাহাড়ি গ্রামে চার্জেবল টর্চে সুবিধা নাই। গেরিলা কায়দায় ‘রেকি’ করা চারপাশ, ক্ষীণ আশা-- সকালের আলোয় বগালেকের অপার বিস্ময় যদি খানিকটা ধরে পড়ে! কিন্তু টর্চের আলো ফ্যাকাশে বলে ভ্রম হয়, তখনও সকালের আলোই ফোটেনি। চারপাশের চাপ চাপ ধোঁয়াশার বিস্তার মেঘের মতো আড়াল তৈরিতে বিভ্রম জাগায়।
চামড়ার পুরনো জ্যাকেট, আর কোমর তাঁতে বোনা চাকমা সুতি মাফলারে শীত তাড়ানোর অবিরাম কসরতের অংশ হিসেবে একটি সিগারেট ধরানো হয়। তাতে ধোঁয়াশা আরেকটু বাড়ে বৈকি, শীতের আরো দাপটে রক্ত যেন জমে আসতে চায়। আবারো ফিরে আসা হয় এক কামরার মাচাং ঘরের ওমের ভেতর।
সহ-সাংবাদিক বুদ্ধজ্যোতি চাকমা তখনো রেস্ট হাউজ, কাম মাচাং ঘরের দ্বিতীয়তম সিঙ্গেল খাটে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুমের ঘোরেই অস্ফুট স্বরে নির্দেশ পাওয়া যায় শুয়ে পড়ার। আরেক সিঙ্গেল খাটে বম কম্বলে প্যাকেটজত ও আধ-শোয়া হয়ে খাটের নীচ থেকে টেনে নেওয়া হয় ছোট্ট পানীয়র বোতল, কড়া স্বাদের মারমা লিকারটির নাম-- প্রাইং। শীত ও ক্লান্তি নিবারণে ভাতের এই চোলাইটির কার্যকারিতা বিস্ময়কর। এটি দেখতে পানির মতো স্বচ্ছ, স্বাদে বেশ কড়া, অনেকটা কান্ট্রি ভদকার মতো।
কয়েক চুমুক পান করার পর বুদ্ধ তার খাট থেকেই হাত বাড়ায় বোতলটির দিকে। ও দু-এক টানেই শূন্য করে ফেলে বোতল। টর্চের লালচে আলোয় ক্রেওকাডং শিখর জয়ের পরিকল্পনা করা হয়। তার আগে বগালেক অভিযান তো অবশ্যই।
লোকালয় বিচ্ছিন্ন বান্দরবানের রুমার দূর বগালেকের পাড়ের রেস্ট হাউজ, কাম মাচাং ঘরটি প্রাচীন কোনো গুহা বলে ভ্রম হয়। যেন পথহারা দুই পর্বত অভিযাত্রী অবিরাম পরিকল্পনা করে চলেছেন উদ্ধারের আশায়। বুনো পাখির ঝাঁক প্রাতরাশ সারতে বেরিয়ে তীব্র চিৎকারে ডাকে বার বার। দ্বিপক্ষীয় আলোচনা বা দ্রব্যগুনের প্রলাপে ছেদ পড়ে।...
এমনি করে সকাল খানিকটা চড়লে নয়টা নাগাদ দেখা মেলে সুর্যদেবের। আউট অব ফোকাস থেকে আস্তে আস্তে দৃষ্টি গোচর হতে থাকে লেকপাড়ের বম পাড়া।
আড়মোড়া ভেঙে একসঙ্গে দুজনের বাইরে বেরিয়ে পড়া হয়। জগের পানিতে চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে মাইনস-সিক্স-বাইফোকাল চশমার কাঁচের ভেতর দিয়ে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে আর বাক্য সরে না। সামনে হালকা কুয়াশাচ্ছন্ন নীলাভ রঙা সুবিশাল এক প্রাকৃতিক জলাশয়– বগালেক! অশেষ বিস্ময়ের বগালেক!
এই লেক, লেক ঘেরা সুবজ পাহাড়ের দেয়াল, বম পাড়া– সবই বুদ্ধর খুব চেনা। তবু একান্ত মুগ্ধতাটুকু ওকেও স্পর্শ করে আরেকবার।
অলিম্পাস অটো-জুম ক্যামেরার শাটার টিপে ঝটপট তোলা হয় একের পর এক বগালেকের ছবি। তখনো কুয়াশায় মোড়া লেকের অপর প্রান্তে অস্পষ্ট যেন সাদা রহস্য-ঝাঁক উড়ে যায়। বুদ্ধ বলে, ওগুলো নিছক কুয়াশা নয়, বিশাল এক সাদা বকের ঝাঁক। ওরা লেকের মাছ শিকারে নেমেছে।...
এরপর লেকপাড়ের বড় বড় পাথরের বোল্ডারের একটি দখল করে বসা হয় দুজনের। পায়ের নীচে বরফ শীতল স্বচ্ছ পানিতে ভাসতে থাকে থোকা থোকা লাল শাপলা-শালুক। সেখানে ঘাই মারে ট্যাংরা-পুঁটির ঝাঁক। বুদ্ধ কোথা থেকে একটি বাঁশের কঞ্চি নিয়ে শাপলা-শালুক লতা টেনে নেয়। বলে,আমরা আজ সকালে খানিকটা সিঁদোল শুটকি দিয়ে এই লতার ঝোলের সঙ্গে গরম ভাত খাব। সঙ্গে থাকবে কচি লেবুর পাতা। তারপর বম গ্রাম প্রধান সাংলিয়ান কারবারী দা`কে গাইড বানিয়ে উঠে যাবো ক্রেওক্রাডং-এর চূড়ায়।
আরো পরে সকালের আহার শেষে ক্রেওক্রাডং-এর দীর্ঘ পথযাত্রায় একের পর এক চাড়াই-উতরাই, গিরিখাদ, ঝর্ণা ও ঝিরি পেরুতে পেরুতে সাংলিয়ান দা'র কাছে শোনা হবে বগালেক নিয়ে প্রাচীন এক বম উপকথা।
যাত্রা বিরতি হয়, নাম বিস্মৃত একটি পাহাড়ি ছড়া পাশে। শীতলতর অবাক জলপানের পর ভূপতিত মৃত গাছের গুঁড়ির ওপর বসলে সিগারেট বিরতিত কারবারি দা' খুলে বসবেন মালাকাইটের ঝাঁপি। ...
বম ভাষায় বগালেক হচ্ছে-- বগা রেলি। 'বগা' মানে অজগর, আর 'রেলি' হচ্ছে লেক। লেকের উত্তরে বাস ছিলো এক ম্রো পাড়ার। সেটি ব্রিটিশ আমলেরও আগের কথা।
একবার ম্রো' শিকারিরা পর্বতের গুহা থেকে বিশাল এক অজগর সাপ জ্যান্ত ধরে ফেলে। পাড়ার সবচেয়ে বুড়ো লোকটি অনুরোধ জানান, সাপটিকে যেন অবিলম্বে আবার বনে ছেড়ে দেওয়া হয়; কারণ এটি কোনো সাধারণ অজগর নয়, এটি হচ্ছে পাহাড় দেবতা। বুড়োর কথায় কেউ কান দেয় না।
ওই রাতে সবাই মিলে গ্রামের উঠোনে জ্বালে বড়সড় এক অগ্নিকুণ্ড। তারা সাপটিকে আগুনে ঝলসে মহা আনন্দে মদ দিয়ে খায়। সুস্বাদু সাপের মাংসর ভাগ পায় গ্রামের সকলেই। কেবল সেই বুড়ো লোকটি সাপের মাংস ছুঁয়েও দেখেন না।
সেদিনই ভোর রাতে বিরাট এক পাহাড়ি ঢল নেমে আসে ম্রো গ্রাম জুড়ে। পানির তোড়ে ভেসে যায় পুরো গ্রামটি, অজগর-পাহাড় দেবতার অভিশাপে মারা পড়েন সবাই। কিন্তু অলৌকিক আশির্বাদে বেঁচে যান একমাত্র সেই বুড়ো লোকটি।
অজগর-অভিশপ্ত ওই পানির ঢল থেকেই বগালেকটির সৃষ্টি। আর এখনো নাকি সেই ম্রো বুড়োর ভিটে আর অজগরটির গুহা অবিকল টিকে আছে।...
--
ছবি (c) : বগালেক, লেখক।--সংযুক্ত : বাঙাল বিপ্লব লংঘিল গিরি*(লেখকের "পাহাড়ে বিপন্ন জনপদ", অমর একুশে গ্রন্থমেলা, ২০১৬, ঢাকায় প্রকাশিত গ্রন্থ থেকে, পুনর্লিখিত)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।