ফুচকা ও ফুচকাওয়ালা
ফুচকা…আহা, গোল ওই কুরমুরে বস্তুটি আলুমাখা ঠেসে যখন তেঁতুল জলে ডুব দেয় তখনই আমার মন গেয়ে ওঠে,
“মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরতরে কেন পাইনা”…
আসলে “দেখা”র জায়গায় একটু কষ্ট করে “খেতে” পড়ে দেখুন, কি এক আশ্চর্য ভালোলাগা আপনাকে মুহুর্তে ঘিরে ধরবে।
বহুল নামে প্রচলিত এই সুস্বাদু বস্তুটিতে আমার ভালোবাসা জন্মাল সেই স্কুলবেলাতেই। হ্যাঁ, তখনই এক ধুতি ও ফতুয়া পরিহিত বিহারিবাবু মাথায় মস্ত ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন ছুটির সময়…ওনার বাঁধা ধরা জায়গা ছিল গেটের বাইরেই। যদিও ফুচকার সাথে আচারের গাড়ি, বনকুল, বুড়ির চুল ইত্যাদির পসরা থাকলেও বালিকারা ভিড় জমাত ফুচকাতেই। আর তখন থেকেই ফুচকার সাথে ভালোবাসা ফুচকাওয়ালাকেও…
মন তখন ভাবতে শুরু করে দিয়েছে, বেশ এক খান ফুচকাওয়ালার ঘরনী হয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দেওয়াটা কিন্তু মন্দ হবে না…যখন খুশি ফুচকা খাব, যত খুশি খাব, হিসাব থাকবে না…আর ফাউয়ের পর ফাউ…কি উল্লাস!
সেই ফুচকাওয়ালাও আমাদের সাথে রসিয়ে গল্প করতেন। একদিন গল্প শোনালেন, যে ওনার দোতলা বাড়ি নিকটবর্তী এলাকাতেই। আর আমাদেরও স্বপ্নে সেদিন পাখা লেগে গেল…! ইচ্ছেমত সে পাখায় রঙ ভরতাম। আর একমনে তাঁর হাতে বানানো ফুচকাও খাওয়া চলত… তিনিও খোঁজখবর রাখতেন। কেউ একজন মিসিং হলেই – কেন আসোনি, কি ব্যাপার ইত্যাদি সকল খবর তার জানা চাই।
ওনার ঝুড়ির চারিধারে গোঁজা থাকত শালপাতারা…আমরা কজন গোল হয়ে দাঁড়াতেই ওর থেকে টপাটপ কটা পাতা তুলতেন ও একটা কোণের মত করে হাতে ধরিয়ে দিতেন, যার মধ্যে দিয়ে হামেশাই গড়িয়ে যেত টক জল, আর আমরাও সুড়ূত্ করে তা টেনে নিতাম…এত বড় গোলাকার ফুচকা ততক্ষণে মুখে ঢুকে কুররর করে আওয়াজ করা শুরু করে দিয়েছে আর সাথে আলু মাখা ছোলা সহ, কাঁচালঙ্কা কুচি ও ধনেপাতাতে মুখের ভেতরে চলছে চতুর্থ পানীপথের যুদ্ধ… আহা অপূর্ব ছিল সেইসব দিন…অপূর্ব সেই স্মৃতিকথা…
একটা সময় বুঝতে পারি, জীবন যত সহজ করে দেখতাম, সে আসলে বড়ই জটিল… এ এক সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক যেন…এক ধাপে ভুল, তো হুড়মুড়িয়ে পড়বে। অতএব ফুচকাওয়ালার স্মৃতিটুকুও মলিন হতে সময় নিল না…
কলেজ গেটে যদিও এক অন্য ফুচকাওয়ালা থাকত…কিন্তু ততদিনে প্যারাশ্যুট গুটিয়ে ফেলেছি… বাসের পাদানিতে ঝুলে ঝুলে আসা ছেলে ও মেয়েরা উভয়পক্ষই সেখানে ভিড় জমাত। আগে ভাবতাম ফুচকায় এক চেটিয়া শুধু মেয়েদের অধিকার। এটাতে তাদেরই রাজত্ব। কিন্তু ছেলেদের এত বেশি ফুচকা প্রীতি ঈর্ষনীয় লাগত এবং সত্যি বলতে কি রাগও হত প্রচন্ড। তাদের সব কিছুতেই ভাগ বসানো চাই…এই একটা দিক যা খোলা ছিল, তাতেও আধিপত্য গড়তে তারা সময় নিলো না। এটুকু পড়েই হয়তো ভাবছেন ফুচকার আবার - কি ছেলে, কি মেয়ে!
প্রিয় কবি তাই সেদিন বলেই দিলেন, এখনও কোথাও “ফুচকাওয়ালি” আছে বলে শোনা যায়না…ফুচকাওয়ালারাই তাদের আসর জমিয়ে বসেছে।
সেদিনের স্বপ্নভঙ্গ হওয়াতে একটা চিনচিনে ব্যথা লেগে থাকলেও ফুচকাওয়ালা দেখলে এখনও আমার মনকেমন হয়…তবে এ মনকেমন আগের চাইতে অনেক আলাদা…ফারাকটা টের পাই ও বুঝতে পারি মস্তিষ্ক ও হৃদয় এখনও ঠিকঠাক কাজ করছে।
এদিকে ফুচকা মেয়েদের নরম মনের সাথে জড়িয়ে গেছে সাহিত্যেও…কেউ কেউ গান বেঁধেছেন তাতে…লেখা হয়েছে গল্প আর কত শত কবিতাও। এই মুহুর্তে আমার একটা প্রিয় কবিতা “ফুচকা”-র কথা মনে পড়ছে। লিখছেন কবি অতনু দত্ত।
“ঢং করে তুমি পানিপুরী বল যাকে
ভালোবেসে তাকে ফুচকাই বলি আমি,
তেঁতুলের জলে চুবিয়ে রাখলে পাতে
সত্যি বলছি, জড়োয়ার চেয়ে দামি।
মুখ গহ্বরে যেইনা পুরেছো ঠুসে
কুড়মুড় করে অম্ল বিস্ফোরণ,
নয়নের কোণা আনন্দে কুঞ্চিত
স্বর্গ সুখেরও ঊর্ধ্বে তৃপ্ত মন।
মুখের ভেতর নরম আলুর পুরে
সেদ্ধ ছোলা ও দাঁত খেলে লুকোচুরি
ঝাঁঝালো মশলা মারামারি করে জিভে
তেতুলের জলে শিহরণ যেন ছুরি…”।
আবার বাংলা জনপ্রিয় ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দু-র “রিসকাওয়ালা” শুনতে গিয়ে মনে হয়, যদি ওটা “ফুচকাওয়ালা” নিয়ে হত তাহলে কেমন হত…লিরিক্স তখন হত কিছু এমনই…
“আমি যে ফুচকাওয়ালা
দিন কি এমন যাবে
বলি কি ও মাধবী
তুমি কি আমার হবে?”
হ্যাঁ, হতেই পারে…ফুচকার সাথে সেই মানুষটিতে মন দেওয়াটা খুব একটা খারাপ হত না। আবার মনে হয়, গায়ক রূপঙ্কর যদি তাঁর “ও চাঁদ” গানটায় “ভদকা”-র বদলে ফুচকা খেতেন!…
“ও চাঁদ তোর বান্ধবীদের সঙ্গে যাব
ও চাঁদ তোর জন্মদিনে ফুচকা খাব
ও চাঁদ তোর ফাদার যদি জানতে পারে
ব্রাদার সেজে বক্ষ মাঝের
ওড়না হব, ওড়না
ও চাঁদ, ও চাঁদ…”
সাহিত্যের মোলায়েম পাতায় ঘুরতে গেলে শুধুই মনকেমন হয়…তাই ওর থেকে বেরিয়ে এবার একটু খোঁজ নেওয়া যাক ফুচকার ইতিহাসে…
“ফুচকা” এক অতি জনপ্রিয় সুস্বাদু ভারতীয় উপমহাদেশের মুখরোচক খাদ্য। বাংলাদেশ ও ভারতের শহরাঞ্চলে প্রায় সর্বত্রই এর রমরমা। অঞ্চল বিশেষে তা বিভিন্ন নামে পরিচিত। গোটা বাংলাদেশে এর নাম "ফুচকা"; উত্তর ভারতে এর পরিচিতি গোলগপ্পা বা গুপচুপে আবার পশ্চিম ভারতে এই খাবারটিই পানি-পুরি।
নাম যাই হোক, ফুচকা হলো স্ট্রীট ফুডের রাজা। এখনও টিউশন ফেরত ছেলেমেয়েরা গোল করে ঘিরে ধরে ফুচকাওয়ালাদের, অফিস ফেরত লোকজনও নেমে একবার দেখে নেয় ভিড় ঠিক কতটা। তারপর চলে তাদের এন্তার কলকলানি - টক, ঝাল, ফাউ নিয়ে। বোঝা যায়, অদ্য রজনীটিও মজিয়া গিয়াছে ফুচকাতেই…
সাধারণত আটা ও সুজি দিয়ে তৈরি এক গোলাকার পাপড়ির মধ্যে মসলা মেশানো সেদ্ধ আলুর পুর ভরে তেঁতুলজল সহযোগে পরিবেশিত হয় এই ফুচকা। এছাড়াও তেঁতুল জলের পরিবর্তে কোথাও কোথাও দেওয়া হয় পুদিনা জল। আছে দই-ফুচকাও। মুম্বই শহরে আবার পুর হিসেবে ব্যবহার করা হয় মটর সিদ্ধ মানে ঘুগনি।
ফুচকা তৈরীর পদ্ধতিটাও বেশ অভিনব…
পাপড়ি তৈরিতে প্রথমে আটা এবং সুজি ভাল করে জল দিয়ে মেখে একটা ভেজা কাপড়ে বেশ কিছুক্ষণ জড়িয়ে রাখা হয়। তারপরে সেই মেখে রাখা আটা ও সুজি থেকে ছোট ছোট লেচি কেটে নিয়ে তা বেলে ভেজে নিলেই ফুচকার পাপড়ি তৈরি হয়ে যায়।
পুর হিসেবে সাধারণত মসলা মাখা আলুসেদ্ধ। সেদ্ধ আলুতে ধনে গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো, শুকনো লঙ্কা গুঁড়ো ও নুন মিশিয়ে তাতে কুচনো কাঁচালঙ্কা দিয়ে তৈরি হয় পুর। স্বাদ বাড়ানোর জন্য সামান্য তেঁতুলজলও দেওয়া যেতে পারে। এর সঙ্গে থাকে ভেজানো ছোলা বা মটর। আর টকজল বানাতে জলের মধ্যে তেঁতুল গুলে তাতে লেবুর রস মিশিয়ে দিলেই হলো।
এবার বানানো যখন হলো তখন খাওয়া শুরু করা যাক। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ফুচকার দোকান…আমার নিজস্ব পছন্দের ফুচকা বলতে নাগেরবাজারের ফুচকা। ইয়া বড় গোল ফুচকার পাপড়িতে বুড়ো আঙুল দিয়ে পটাস করে একটা ছোট ছিদ্র করে তার মধ্যে মশলাযুক্ত আলুর পুর ভরে দেওয়া হয়। এরপর পুর ভর্তি ফুচকা তেঁতুলজলে ডুবিয়ে সোজা শালপাতার বাটিতে। সেই তেঁতুল জল দিয়ে ভুরভুরিয়ে আসতে থাকে গন্ধরাজ লেবুর গন্ধ… আর ডুবডুব জলে তা মুখে গেলে এক স্বর্গীয় অনুভূতি, যা বলে বা লিখে বোঝানো যাবেনা।
রাস্তার আনাচে কানাচে ফুচকার দোকানে এভাবেই বিক্রি হয় ফুচকা। কিন্তু স্থায়ী দোকান বা রেস্তোরাঁয় প্লেটে পুর ভর্তি শুকনো ফুচকা দিয়ে আলাদা পাত্রে দেওয়া হয় টকজল বা চাটনি। সাধারণত একেকটি প্লেটে ছটা থেকে আটটার মত ফুচকা থাকে।
শহরাঞ্চলে চার চাকার ঠেলা গাড়ীতে করে ফুচকা বিক্রি করা হয়। এছাড়াও ফুচকাওয়ালাদের একচেটিয়া পাওয়া যায় রাস্তার ধারে বাস স্ট্যাণ্ডে, পার্কে-উদ্যানে, সমুদ্র তীরে, জনসভাস্থলে।
আমার এখানে আবার টোকেন নিতে হয় ফুচকার জন্য। দু রঙের টোকেন - একটা গোলাপি ও অন্যটা সবুজ। গোলাপি মানেই ফুচকা। মাঝে মাঝে আমিও গোলাপি টোকেন হাতে দাঁড়িয়ে পড়ি, তবে এ ফুচকার স্বাদে মন ভরেনা। এত সাহেবি কায়দায় কি আর ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া যায়!
আর আমাদের মত ফুচকাপ্রেমীদের স্বাস্থ নিয়েও অত কচকচানি নেই…বাসের বা মেট্রোর হ্যান্ডেল ঝুলে এসে দিব্যি দাঁড়িয়ে পড়তে পারি ফুচকাওয়ালার সামনে…মুখের ক্লান্তিটুকুও মিটে যায় ফুচকার আস্বাদে। আর গোনাগুনিতেও ফুচকাপ্রেমীরা খুব পাকা…একখানাও কমতি হবার উপায় নেই!
তবে এই লকডাউনে ফুচকাওয়ালাদের জীবন কাহিনী বদলে গেছে…বাইরে লোকজন নেই, দোকানেও নেই ভিড়। আর যারা দূরবর্তী গ্রাম থেকে শহরে এ জীবিকা নিয়ে এসেছিল তাদেরও ফেরত যাওয়ার পালা… সকলেই মুখ চেয়ে বসে আছে সুদিনের। লকডাউন উঠলেই ঝাঁকা মাথায় আবার বেরিয়ে পড়বেন এ গলি - ও গলি… তস্য গলি…
দশ টাকায় ছটা, ফুচকাআআআআ…
[কৃতজ্ঞতা : সার্চ ইঞ্জিন সহ কবি অতনু দত্ত-র “ফুচকা” কবিতার অংশবিশেষ ও চন্দ্রবিন্দু ও রূপঙ্করের গান দুটি]
ইশ! সাত সকালেই জিভে জল এলো।
লেখাটি কুড়মুড়ে, টকঝাল, সেরাম!
থ্যাংকিউউউউ বিপ্লব...আপনার কমেন্টস পেয়ে খুব ভালোলাগল।