২০১৯ এর ডিসেম্বর মাস নাগাদ চীনদেশের হুবেই প্রদেশের উহান শহরের একটি পশুপাখি কেনাবেচার বাজারে বাদুড় বা প্যাঙ্গোলিনের শরীর থেকে মানুষের শরীরে একটি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। সংক্রমণ হবার অল্প কয়েকদিনের মধ্যে , ধরা যাক সাত কি আট দিনের মাথায় যিনি সংক্রমিত হয়েছে তাঁর জ্বর দেখা দেয় , গায়ে ব্যাথা, খুশখুশে কাশি হতে থাকে, এবং কয়েকজনের ক্ষেত্রে ভয়ংকর রকমের নিউমোনিয়া বা ফুসফুসের গভীরে প্রদাহ হয়ে জল জমে, দ্রুত মারা যান। শুধু তাই নয়, রোগটি অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে , ফলে খুব কম সময়ের মধ্যে বহু মানুষ আক্রান্ত হন। যদিও শীতকাল, বছরের শেষ, বহু মানুষ এই সময় নানা দেশে বেড়াতে যান, ফলে অসুখের বহিঃপ্রকাশ হোক না হোক, ভাইরাস টিকে শরীরে বহন করে তাঁরা হুবেই থেকে অন্যত্র নিয়ে গেলেন। তখন অবধি অসুখটির খবর চীন দেশ থেকেই ডাক্তারদের সূত্রে আসছিলো , কিন্তু বছরের সময়, মানুষের ঘোরাফেরা, সব কিছু বিবেচনা করলে পৃথিবী জুড়ে একটি আশংকা ছিলই যে এ অসুখ কেবল মাত্র চীন দেশেই আবদ্ধ নাও থাকতে পারে।
ডিসেম্বর মাস ছুটির সময়, উত্তর গোলার্ধে শীতকাল, এই সময়টিতে ভাইরাস বাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব সারা পৃথিবী জুড়েই হয়, বিশেষ করে কোরোনাভাইরাস বাহিত সর্দি কাশি (common cold ) লেগেই থাকে। তবে অচিরেই বোঝা গেলো যে এ অসুখ মোটেও সাধারণ সর্দি কাশি জনিত এবং বয়স্ক মানুষের নিউমোনিয়া নয়, এ আরো ভয়ঙ্কর। তবে এ একেবারে নতুন নয়, এই গোত্রের কোরোনাভাইরাসের সংক্রমণ এর আগেও হয়েছে এবং চিকিৎসকরা আবিষ্কার করলেন এই ভাইরাসটির সঙ্গে তাদের প্রভূত মিল, আগের বার প্রতিবার মানুষ তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে, এবারে সে রূপ পরিবর্তন করে পুনরায় আত্মপ্রকাশ করেছে।
আজ থেকে ১৭ বছর আগে ২০০৩ সালে এমনি একটি ভাইরাস এই চীন দেশ থেকেই সংক্রমণ শুরু করে প্রায় ৮০০০ মানুষের মধ্যে ৩০ টি দেশে ছড়িয়ে পড়ে ও প্রায় ৮০০ মানুষের মৃত্যু হয় তাতে। শ্বাসনালিতে প্রদাহ ও শ্বাস কষ্টে ভুগে সেবারে বহু মানুষের মৃত্যু হয় ও অসুখটিকে SARS বা Severe Acute Respiratory Syndrome নাম চিহ্নিত করা হয়। এর দশ বছরের মাথায় ২০১২ সালে আরেকবার মধ্য প্রাচ্যে সৌদি আরবে এক ই রকম ভাবে উটের শরীর থেকে মানুষের শরীরে এবং এক মানুষের শরীর থেকে অন্য মানুষের শরীরে দ্রুত অসুখ ছড়াতে থাকে, সেবারও বহু মানুষ শ্বাসকষ্টে এবং শ্বাসনালীর প্রদাহে মারা যান। অসুখটিকে MERS (Middle Eastern Respiratory Syndrome ) নাম দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। প্রতিবার দেখা যায় যে অসুখটি পশু পাখি থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায়, তারপর মানুষ থেকে মানুষে। প্রতিবার দেখা যায় অসুখটির শুরুর দিকে জ্বর, কাশি, এবং অতি দ্রুত শ্বাসনালী ও ফুসফুসের গভীরে প্রবেশ করে বয়স্ক ও অসুস্থ্য মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এ কেমন জীবাণু?
কি করেই বা সে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে জীবন বিপন্ন করে তোলে? কাদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা চাই ও কি করলে এর উপদ্রব থেকে বাঁচা যাবে? কাকে বলে herd immunity ও সে ব্যাপার এক ক্ষেত্রে কতটা কাজে দেবে? আমরা কি করতে পারি? এই বিষয়গুলো নিয়ে কয়েকটি পর্বে আলোচনা করবো।
এই নিয়ে বহু লেখালিখি চলছে বিভিন্ন জায়গায়, তবে মোটামুটি ভাবে কতগুলো সাধারণ সূত্র বেরিয়ে আসছে সেগুলো প্রথমে নথিবদ্ধ করা যাক:
১) আপনার ব্যক্তিগত ভাবে কিছু করার আছে: যেমন দুতিন ঘন্টায় একবার বা যখন খাবেন, টেবিলে হাত দেবেন, রান্না করবেন, লিখবেন, কম্পিউটার কীবোর্ড এ হাত দেবেন, তখন বা তার আগেপরে কুড়ি সেকেন্ড ধরে গরম জলে (সাধারণ উষ্ণতার জলে হলেও চলবে), দু হাত ও দুহাতের আঙ্গুলগুলো ভালো করে ধুয়ে মুছে নেবেন । বাড়িতে হ্যান্ড sanitiser না থাকলে ক্ষতি নেই, আপনি শুধু সাবান দিয়ে ধুলেই যথেষ্ট হবে ।
২) যতদূর সম্ভব পারবেন, চোখে নাকে হাত দেবেন না । চোখ কচলানোর দরকার হলে, হাতের পিছন দিয়ে চেষ্টা করে দেখুন ।
৩) কারো সঙ্গে কথা বা আলাপচারিতার সময় হ্যান্ডশেক এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করুন, দুহাত জুড়ে নমস্কার করলে দিব্যি কাজ চলে যায়, বিদেশ বিভুঁই তে করে দেখেছি, কেউ কিছু মনে করে না ।
৪) কথা বলার সময় ছয় ফুট দূরে (দুই মিটার) মত দূরত্ত্ব বজায় রাখতে পারলে ভালো ।
৫) জামাকাপড় নিয়ম করে কাচা, রোদে শুকিয়ে নেওয়া ।
৬) ঘরবাড়ি বিশেষ করে বাথরুম পরিষ্কার করে রাখা ।
খাওয়া দাওযা পান ভোজন নিয়ে বিশেষ বিধিনিষেধ নেই, তবে বাস বা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করার সময় হাঁচি কাশি থেকে সাবধান, নিজেও কাশলে জামার হাতে কাশুন ।
কিন্তু এ ব্যাপারটা শুধু আমাদের একার ব্যাপার নয়, আমাদের সরকার, বা সমাজ ও কিছু বিধিনিষেধ বেঁধে দেয়, তার মধ্যে থেকে কিছুটা কাজ করার ব্যাপার আছে, সেটাও এক ঝলক দেখে নেয়া যাক, বিশেষ করে coronavirus সম্বন্ধে কি কি জানি তার ভিত্তিতে । একেক দেশ একেক রকম বিধিনিষেধ:
১) কিছু দেশ যেমন সুইডেন বা ইউ কে, ইশকুল বা কলেজ বা অন্যত্র বড় জমায়েত বন্ধ করতে বলছে না, তবে বাড়িতে থাকা, যদি দেখেন যে রোগএর লক্ষণ বেরিয়েছে তাহলে নিজেকে আলাদা করে নেয়া, পরীক্ষা করানো, এগুলো করতে হবে ।
২) অন্যান্য কিছু দেশ যেমন নিউ জিল্যান্ড, ইত্যাদি, অন্য দেশ থেকে কেউ এলে তাকে ১৪ দিনের জন্য নিজে নিজে আলাদা থাকার বিধি দিয়েছে, তাছাড়া বড় ধরণের জমায়েত ব্যারন করেছে, তবে এখনো স্কুল কলেজ খোলা রাখা আছে, ছোট জমায়েত চলতে পারে ।
৩) ইউরোপে এর দেশগুলোতে করা নিষেধাজ্ঞা যে কোনো রকম জমায়েত এর ওপর,
এখন ব্যাপারটা কিরকম?
কোরোনাভাইরাস এর এ পর্যন্ত কোনো ভ্যাকসিন বেরোয়নি, কোনো ওষুধও সেভাবে বেরোয়নি, যদিও দুইয়েরই চেষ্টা চলছে । এই অবস্থায় ভাইরাসটি শরীরে কি ভাবে প্রবেশ করে ও কি করে ছড়ায় তাই নিয়ে এক ঝলক দেখা যাক। করোনা ভাইরাসটি একটি RNA ভাইরাস, এর শরীরের ওপরের অংশ থেকে বেশ কয়েকটি কাঁটার মুকুটের মতো কাঁটা বেরিয়ে থেকে বলে এর নাম করোনা ভাইরাস, করোনা কথার অর্থ মুকুট, দেখুন,
এই যে শরীর থেকে কাঁটার মতন বেরিয়ে আছে, এরই সাহায্যে সে শরীরের কোষের মধ্যে প্রবেশ করে, এবং কোষকে ব্যবহার করে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে এবং কোষ ও টিস্যু ধ্বংস করতে থাকে । শরীর প্রথমে RNA থেকে প্রোটিন ইত্যাদি তৈরী করে, একসময় ফুসফুসে ভয়ঙ্কর প্রদাহ শুরু হয় আমাদের নিজেদের শরীরের ইমিউন ব্যবস্থ্যই যুদ্ধ ঘোষণা করে। জ্বর, কাশি, (শুকনো খুশখুশে কাশি) হতে থাকে ক্রমাগত, যাঁরা বৃদ্ধ ও অশক্ত বিশেষ করে তাঁদের ভারী দুঃসময় । পুরো ব্যাপারটি হতে ৪-৭ দিন সময় লাগে, এর মধ্যে সময়ানুক্রমিক ভাবে পরপর দুটি অবস্থা দেখা যাচ্ছে:
১) অসুখের প্রকাশ হয় নি, অর্থাৎ কাশি, গা ব্যাথা জ্বর এর কোনো লক্ষণ দেখা দেয় নি, ভাইরাস শরীরে বাসা বাঁধলেও এতটা বাড়েনি যে আপনার থেকে কেউ এই সময় আক্রান্ত হতে পারেন । ভাইরাস প্রাপ্তির দিন থেকে খুব সম্ভবত এই সময়টি দুই থেকে পাঁচ দিন থাকতে পারে
২) অসুখ বেরোয়নি, কিন্তু আপনার হাঁচি কাশি থেকে ভাইরাস বেরিয়ে যেতে পারে, এবং এর ফলে অন্যের শরীরে প্রবেশ করতে পারে । এটি দু-দিন (৪৮ ঘন্টা থাকবে) তার পর
৩) আপনার জ্বর, গায়ে ব্যাথা (কতটা সে নিয়ে স্পষ্ট নয়) , স্বাসকষ্ট (রোগী বিশেষে), এবং অবশ্যই কাশি দেখা দিতে পারে । এই সময় থেকে আপনি অন্য লোকেদের সংক্রমণ করতে সক্ষম, এবং নিজেও আক্রান্ত ।
এখন আমাদের মধ্যে যাঁরা সুস্থ সবল, বয়েস অল্প (অন্তত ৬৫ বছর বয়েসের কম) এবং যাঁদের সংক্রমণ খুব মারাত্মক নয়, যাঁরা বার বার কোনো বা বিভিন্ন রোগীর সংস্পর্শে আসছেন না, বা চিকিৎসা পাচ্ছেন, তাঁরা সাধারণত নিজেদের ইমিউন সিস্টেমের কারণেই সুস্থ হয়ে উঠছেন (৮০% ক্ষেত্রে), ১৪ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে বাড়াবাড়ি হচ্ছে, তার মধ্যে শ্বাসকষ্ট হার্টের অসুখ ইত্যাদি, এবং আনুমানিক ৬% ক্ষেত্রে প্রাণ সংশয়, এবং এঁদের মধ্যে বেশীর ভাগই বয়স্ক, মধুমেহ, উচ্চ রক্তচাপ আছে এমন মানুষদের মধ্যে অসুখ টি মারাত্বক আকার ধারণ করতে পারে ।
অতএব, কয়েকটি কথা বিশেষ করে মনে রাখতে হবে:
১) করোনাভাইরাস নামের এই জীবাণুটি নতুন কিছু নয়, সাধারণ সর্দি কাশির জন্য একে দায়ী করা হয়, ২০০২-২০০৩ সালে এর দেখা পাওয়া গিয়েছিল, ২০১২ সালে এর দেখা পাওয়া গিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যে, "আবার সে এসেছে ফিরিয়া" নতুন রূপে, এবার তার অন্য মূর্তি। এবারের অবতারে সে অতি দ্রুত ছড়ায়, শ্বাসনালীর গভীরে আক্রমণ শানায়, বয়স্ক, উচ্চ রক্তচাপ ও সংক্রান্ত অসুখে যাঁরা ভুগছেন, এমন মানুষদের জন্য সে বিশেষ করে বিপজ্জনক। তবে অন্যান্যবারের তুলনায় এর থেকে সাধারণ মানুষের মৃত্যুহার ০.2% থেকে শুরু করে ৩.৪% পর্যন্ত হতে পারে, অবশ্যই উচ্চ রক্তচাপের ও ডায়াবিটিস রুগীর জন্য বিশেষ করে ক্ষতিকর, যাঁরা ওই সব অসুখের ওষুধ নেন, অবশ্যই ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলবেন, বিশেষ করে যদি মনে হয় সংক্রমণ হয়েছে।
২) করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়াতে থাকে, সমাজে কারো যদি ইমিউনিটি না হয়ে থাকে, তাহলে একজন মানুষের থেকে ২ কি তিন জনের ছোঁয়াচ লাগতে পারে । এই ব্যাপারটা খেয়াল রাখুন, যার জন্য যাতে না ছড়ায় বা আপনি যাতে অন্য কাউকে না করোনাভাইরাস দেন, সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। অতএব, প্রাণে হয়ত মারবে না, কিন্তু খুব ভোগাবে ও সাংঘাতিক ছোঁয়াচে এই অসুখটি জলের ড্রপলেট, হাঁচি, কাশি, নিঃশ্বাস, কাউকে জড়িয়ে ধরলেন, বা কেউ জড়িয়ে ধরল, বাস ট্রামে ট্রেনে পাশাপাশি কারো সঙ্গে বসে এলেন, (যাঁর রোগের জীবাণু আছে), এমন নানান সূত্রে আপনার ছোঁয়াচ লেগে হতে পারে।
৩) অসুখটির এখনো পর্যন্ত কোন ওষুধ বা প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কৃত হয় নি, অতএব চূড়ান্ত সাবধানতা অবলম্বন না করলে অসুখ দ্রুত ছড়াবে ।
কি কি করলে অসুখটির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে?
আপাতত এইটুকু ।
এর পরের পর্বে Herd Immunity, R0 ইত্যাদি নিয়ে লিখব ।
এই নির্দেশিকাগুলো WHO র বিধান। শুধু ভারত তো নয়, আরো বহু দেশ আছে যেখানে এই সমস্যা রয়েছে । ডিসট্যানস না মেনটেন করতে পারলে না করবে। এইগুলো আইডিয়াল। পারলে ভাল।