আধ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে রামজীবন বলছিলেন এপার বাংলার পশ্চিম প্রান্তের প্রত্যন্ত গ্রামে হতদরিদ্র এক পরিবারের জীবনের একমাত্রিক কাহিনী। পিছিয়ে পড়া এলাকায় আর পাঁচ-দশটা প্রান্তিক পরিবারের জীবনযাত্রা বিশ শতকের সাতের দশকে যেমন ছিল আর কি। কিন্তু দশ মিনিট আগে হঠাৎ এন্ট্রি নিয়ে তাঁর ভাই দু’মিনিটে সেই কাহিনীতে একাধিক মাত্রা যোগ করলেন। শুনছি আর ভাবছি, কী কারণে যে কী হয়? ঠিক কোন রাগ, ক্ষোভ, ভালবাসা কিংবা কোন ব্যক্তিগত কারণে একটা মানুষ, একটা পরিবার কিংবা গোটা একটা গ্রাম সরকার বিরোধী হয়ে যায়, রাজনৈতিক অ্যাফিলিয়েশন চেঞ্জ করে নেয়, তার কি কোনও হদিশ রাখে শাসক দল? ঝাড়গ্রাম মহকুমার এক ছোট্ট নাম না জানা গ্রামে সাতের দশকে কোন একজন ছোটি মাহাতো কংগ্রেস করতেন। ১৯৭৭ সালে কংগ্রেস সরকার চলে গেল, দল বদল করে শাসক পার্টি সিপিআইএমে চলে গেলেন তিনি। আর পুরো গ্রামটাই এই ‘বেইমানি’র বদলা নিতে ঝাড়খন্ড পার্টিতে কনভার্ট করে গেল! ছোটি মাহাতোর শ্রেণি অবস্থান যে রাতারাতি সিপিআইএমে যোগ দিয়ে বিরাট পালটে গেল তা হয়তো নয়। কিন্তু গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষ বুঝে নিলেন, এই দল বদলের পেছনে নিশ্চিতভাবে রয়েছে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ফায়দা তোলার আকাঙ্খা। এই যে এক ব্যক্তি কিংবা একটি পরিবারের সামান্য ভালো থাকার, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার স্পৃহা, আর দশটা মানুষকে কত দ্রুত গোঁড়া প্রতিষ্ঠান বিমুখ করে তুলতে পারে তার বুনিয়াদি উদাহরণ ওই গ্রামে সহদেব, নকুলদের ঝাড়খন্ডি পার্টি গড়ে তোলার ঘটনা। আর তার সঙ্গে গ্রামের অধিকাংশ কংগ্রেসি সমর্থক এবং কোনওদিন মিটিং-মিছিল না করা সাধারণ মানুষের দল বেঁধে সেই ঝাড়খন্ড পার্টিকে সমর্থন করা।
সাংবাদিকতার সূত্রে রাজ্যের নানান ব্লকের শয়ে শয়ে গ্রামে ঘোরার অভিজ্ঞতা থেকে বহু সময় দেখেছি, একটা মানুষের প্রত্যক্ষ রাজনীতি করা, শাসক দলের সঙ্গে থাকা কিংবা বিরোধী দল করার পেছনে অধিকাংশ সময়ই কোনও আদর্শগত কারণ থাকে, তা নয়। বরং বেশিরভাগ সময়ই কাজ করে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, এক্কেবারে এলাকাভিত্তিক সামান্য কিছু ইস্যু কিংবা কোনও ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিত্রিয়া। আর থাকে নিখাদ অর্থনৈতিক কারণ। নকুল মাহাতোর ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক এবং অর্থনৈতিক, দুটো কারণই ছিল একসঙ্গে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন আমাকে শিখিয়েছে, জমি নিজের হয়, গরু-ছাগলও নিজের হয়, এমনকী মোরগও, কিন্তু ভোট নিজের হয় না। একটি রাজনৈতিক দলকে ভোট দেওয়া কোনও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। তা পাল্টে যায় নানা কারণে। তার মধ্যে একটা বড় কারণ, নকুলের বলা একটি শব্দ, শায়েস্তা। কাকে শায়েস্তা করতে যে গ্রামের কত লোক নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে, বা না করে এক মুহূর্তে কী সিদ্ধান্ত নেয়, তাই বোধয় সংসদীয় রাজনীতির সবচেয়ে বড় রহস্য। হ্যাঁ, কিষেণজি মৃত্যু রহস্যের থেকেও তা জটিল, বহুমাত্রিক!
ডহরেশ্বর সেন একটা বৃহত্তর ছবির হদিশ দিয়েছিলেন। কীভাবে ছ’য়ের দশকে জমি আন্দোলনকে ঘিরে ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে সিপিআইএমের লড়াইয়ের সূত্রপাত। কিন্তু ক্লাস সেভেন অবধি পড়া এই নকুল মাহাতোর সঙ্গে ২০০৯ সালের মাঝামাঝি কথা না বললে জানা তো দূরের কথা, ভাবতেও পারতাম না, আটের দশকে ঝাড়খন্ড পার্টি প্রসারের বহুমাত্রিক কারণ।
আপনি যে ঘটনাটা বলছেন, সেটা মোটামুটি কোন সময়ের? জিজ্ঞেস করলাম নকুল মাহাতোকে।
অনেকক্ষণ ভাবলেন নকুল। উত্তরটা দিলেন দাদা রামজীবন, ‘১৯৮১-৮২ হবে। ছোটি মাহাতো সিপিআইএমে যাওয়ার পর ওরই আগের সঙ্গী সহদেবরা অনেকে ঝাড়খন্ড পার্টি শুরু করল। তারপরই শুরু হল আমাদের এলাকায় গণ্ডগোল। মারপিট। তার আগে কিন্ত গ্রামে কোনও অশান্তি ছিল না। বরং ডাকাতি হোত এই গ্রামগুলোতে খুব। এলাকার সব লোক ডাকাতদের সঙ্গে লড়ত। আমরা তো গ্রামের সব কম বয়সী মিলে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ডাকাতি আটকাতে রাত পাহারা দিতাম। বড় বড় চিনির বস্তা দিয়ে ঢোলা জামা বানানো হোত। জামার ওপর ওই চিনির বস্তা দিয়ে বানানো ঢোলা জামা পরতাম, নীচে লুঙ্গি। মাথায় কাপড় পেঁচিয়ে বেঁধে পাগড়ির মতো করতাম। ডাকাতরা তীর ছুঁড়লে যাতে শরীরে না ঢোকে তাই এই চটের চিনির বস্তা পরার ব্যবস্থা ছিল। ডাকাতরা বেশি দূর থেকে তীর ছুঁড়লে ঢোলা চটের বস্তায় লেগে শরীরে তত জখম হোত না। আমাদের সঙ্গেও থাকত তীর, ধনুক, বল্লম, লাঠি। তখন ডাকাতারা বন্দুক ব্যবহার করত না। তীর, ধনুক থাকত ওদের কাছে। ’৭৪-৭৫ সাল থেকে টানা প্রায় ৭-৮ বছর গ্রামে রাত পাহারা দিয়েছি পালা করে। অনেকবার লড়াই হয়েছে ডাকাত দলের সঙ্গে। কুকুরশোল বলে একটা গ্রাম ছিল। একবার সেখানে ডাকাত পড়ল। পুলিশে কাজ করত এক চৌকিদার, থাকত সেখানে। চৌকিদার, তার ছেলে আর গ্রামের লোক লড়াই করে অনেককটা ডাকাতকে ধরে ফেলে। সাত-আটটা ডাকাত মারা যায় ওই দিন। তারপর ডাকাতি প্রায় বন্ধই হয়ে গেল।’
‘কিন্তু, বলছিলেন যে, গ্রামে বেশিরভাগ লোকই গরিব ছিল। তবে ডাকাতি হত কেন? কী নিতে আসত ডাকাত?’
‘কী আর নেবে? কারও বাড়িতে হয়তো কিছু চাল ছিল, নিয়ে গেল। মুড়ি, গুড়, কাপড়, তেল সব নিয়ে যেত। লন্ঠন, কুপিও ব্যাগে ভরে নিয়ে গেছে। ডাকাতও তো গরিব। এক্কেবারে খেতে পেত না এমন কিছু লোক ডাকাতি করত। কিন্তু কুকুরশোলের ঘটনার পর তা অনেকটাই বন্ধ হল।’
সিপিআইএমের সঙ্গে মারপিটও কি তীর, ধনুক নিয়েই শুরু হল? জিজ্ঞেস করলাম নকুল মাহাতোকে।
‘আমরা আদিবাসীরা সব সময়ই তীর, ধনুক ব্যবহার করতাম। আমরা ঝাড়খন্ড পার্টি শুরু করার পর গ্রামে প্রায় সব আদিবাসী বাড়ি ঝাড়খন্ডি হয়ে গেল। সিপিআইএমের বেশি লোক ছিল না। কিন্তু ভোটের দিন ওরা খুব ঝামেলা করত। আমি অনেকবার ভোট দিতে পারিনি। আমার ভোট পড়ে যেত। দাদাও সিপিআইএমকে সমর্থন করত না। কিন্তু দাদার ভোট পড়ত না। আমার, সহদেব আর কিছু যারা ঝাড়খন্ড পার্টির লিডার ছিল তাদের পুলিশ ভোটের আগে তাড়া দিত। আমাদের নামে পুলিশে অভিযোগ করত সিপিআইএম। ভোটের আগে পুলিশের ভয়ে পালিয়েছি অনেকবার। সিপিআইএম জানত, ঝাড়খন্ডি লিডাররা ভোটের দিন এলাকাছাড়া হলে ওদের মাতব্বরির বিরোধিতা করার কেউ থাকবে না। গ্রামের লোক ভয়ে মুখ খুলবে না।’
পাশে বসে ঘাড় নাড়ছিলেন রামজীবন। আর আমি ভাবছিলাম, এই কথাই তো শুনেছি নয়ের দশকের মাঝামাঝি মেদিনীপুরে কাজ করা প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়ের মুখে। ‘সিপিআইএম বেছে বেছে ঝাড়খন্ডি লিডারদের বিরুদ্ধে থানায় কেস করত। তারপর তাদের ধরতে গ্রামে ঢুকত পুলিশ। দিনের পর দিন এই জিনিস চলার পর ক্ষুব্ধ হয়ে গ্রামেই পুলিশের ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদিবাসীরা।’ একই কথা বলেছিলেন তুষার তালুকদারও। ঝাড়গ্রামের প্রথম এসডিপিও পরে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে থাকার সময় আটের দশকে গিয়েছিলেন ঝাড়গ্রাম। আমাকে বলেছিলেন, গ্রামের গরিব আদিবাসীরা কেন পুলিশকে এত ভয় পায়, তা তাঁকে অবাক করেছিল। তা তিনি ১৯৬৫ সালে এসডিপিও থাকার সময় দেখেননি। সেই ভয়ের কারণ অনেকটাই বুঝতে পারছিলাম নকুল মাহাতোর সঙ্গে কথা বলে।
কিন্তু মানুষ তো সারা জীবন ভয় পাবে না। একদিন সে রুখে দাঁড়াবেই। তিন বছরে, পাঁচ বছরে একটা ভোট দিতে না পারা তো মামুলি ব্যাপার নয়। জীবন-জীবিকার মতোই গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীনতা এবং আত্মমর্যাদাবোধ। আর নিজের ভোট নিজে দেব, এটা তো একটা আত্মমর্যাদাবোধ বটেই। জমিকে কেন্দ্র করে ছয়ের দশকের শেষে যে লড়াই শুরু হয়েছিল, সে লড়াইটারই ইস্যু পালটে গেল আটের দশকের শুরু থেকে। প্রতিপক্ষের ভূমিকায় চলে এল ঝাড়খন্ড পার্টি এবং সিপিআইএম। এবার লড়াইটা শুরু হল রাজনৈতিক জমি দখলের। অভিন্ন দুই শ্রেণির মানুষ অস্ত্র হাতে নিল শুধু রাজনৈতিক জমি দখলের জন্য। তীর, ধনুক তো ছিলই, আদিবাসী মানুষের হাতে পৌঁছল বন্দুকও। চূড়ান্ত রাজনৈতিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে কোনও এলাকা বিরোধীশুন্য করে দেওয়ার যে মডেল সিপিআইএম একতরফাভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিল রাজ্যে বাম শাসনের ১০-১২ বছর পর থেকে, তার প্রথম ল্যাবরেটরি হয়ে উঠল রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তের ঝাড়গ্রাম মহকুমা। যে মহকুমার লাগোয়া সেই সময় বিহার এবং পরবর্তীকালে ঝাড়খন্ড রাজ্য।
অনেক বছর বাদে ২০০৬ সালের পর যখন বারবার ঝাড়গ্রামে গিয়েছি মাওয়িস্ট আন্দোলনের সময়, দেখেছি এমন হতদরিদ্র মানুষকে মাওবাদীরা খুন করেছে স্রেফ সিপিআইএম করার অপরাধে, যাদের পরিবারের দিকে তাকানো যেত না। ভেবেছি, এই দিন আনি-দিন খাই গরিবকে খুন করে, কোন শ্রেণি সংগ্রাম সংগঠিত হচ্ছে? আমার এই ভাবনার পালটা জবাব দিয়েছেন জঙ্গলমহলের সিপিআইএম বিরোধী মানুষ। বলেছেন, ‘শ্রেণি আন্দোলনের কোন কর্মসূচি কার্যকর করতে এলাকা দখলের জন্য জন্য অস্ত্র হাতে নেমেছিল বাসুদেব ভকতের বাহিনী? জামবনি, বিনপুরকে কেন্দ্র করে অবিভক্ত মেদিনীপুরের নানা জায়গায় কেন নিষিদ্ধ হয়েছিল বিরোধী দলের রাজনৈতিক অধিকার? কেন ভোটের ঠিক আগে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে যেত সমস্ত বিরোধী কার্যকলাপের ওপর?’
কিন্তু কে এই বাসুদেব ভকত? কেন তাঁর ওপর এত রাগ জামবনি, বেলপাহাড়ি, বিনপুরের এত মানুষের? জঙ্গলমহলের একটা রহস্যের ওপর আলো পড়েছে কি পড়েনি, নতুন প্রশ্ন এসে হাজির হচ্ছে সমানে। কিন্তু কিছু করার নেই, ২০০৮ সালের নভেম্বর মাস থেকে ২০১১ পর্যন্ত লালগড় আন্দোলন, কিষেণজি যার নাম দিয়েছিলেন দ্বিতীয় নকশালবাড়ি, তার প্রেক্ষাপট এবং তাঁর মৃত্যু রহস্যের নাগাল পেতে এই সবকটা প্রশ্নই প্রাসঙ্গিক।রামজীবন মুর্মু এবং তাঁর ভাই নকুল মাহাতোর সঙ্গে কথা হচ্ছিল তাঁদের পরিবার, স্ট্রাগল এবং সব মিলে তাঁদের বেঁচে থাকা নিয়ে। রাজনীতি নিয়ে কথা উঠতেই বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট হওয়ার আগে চলে এল সিপিআইএম, নির্বাচন এবং বাসুদেব ভকতের কথা। আর এই বিষয়গুলোকে এড়িয়ে গিয়ে রামজীবন মুর্মু কিংবা নকুল মাহাতোর সাক্ষ্য নেওয়ার মানেও হয় না। তাই এবার আলোচনা সিপিআইএম নিয়ে।
১৯৬৯ নভেম্বর, গোপীবল্লভপুর এবং সন্তোষ রাণা
সিপিআইএম এবং বাসুদেব ভকতের কথায় আসব, কিন্তু তার আগে অল্প সময়ের জন্য হলেও একবার ঘুরে আসা দরকার গোপীবল্লভপুর থেকে। গোপীবল্লভপুর এমনিতেও ঝাড়গ্রাম মহকুমায়। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে বেশি দূরও না। তাই সময়ও লাগবে না বিশেষ। তাছাড়া, জামবনির বুড়িশোল জঙ্গলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মাওয়িস্টের পলিটব্যুরো সদস্য কিষেণজির মৃত্যু রহস্যের শুনানি হবে, অথচ সেখানে গোপীবল্লভপুর প্রসঙ্গ আসবে না, সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সন্তোষ রাণা হাজির হবেন না, তা কি সম্ভব? আর সাক্ষ্য দেওয়ার সময় সিপিআইএম নেতা ডহরেশ্বর সেনও তো বলে গিয়েছেন সন্তোষ রাণার নাম।
১৯৭৭ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বাংলাজুড়ে সিপিইএমের জয় জয়কার। কংগ্রেস ধুয়েমুছে সাফ। সিপিআইএমের এই মারকাটারি নির্বাচনী সাফল্যের সময় ঝাড়গ্রাম মহকুমার গোপীবল্লভপুর আসনে জিতল সিপিআইএমএল। বিধায়ক হলেন সন্তোষ রাণা। সন্তোষ রাণার সঙ্গে আমি কথা বললাম ২০১৭ সালে, তাঁর পূর্ব কলকাতার বাড়িতে। এই মামলার পরবর্তী সাক্ষী ছ’য়ের দশকের শেষে নকশাল আন্দোলনের নেতা, ১৯৭৭ সালে গোপীবল্লভপুরের বিধায়ক সন্তোষ রাণা। তাঁর বাড়ি গোপীবল্লভপুরেই।
সন্তোষ রাণাকে আমার প্রথম প্রশ্ন, ‘এই যে ঝাড়গ্রাম মহকুমায় একুশ শতকের শুরুতে টানা কয়েকটা বছর তীব্র মাওবাদী আন্দোলন চলল, এর সঙ্গে ছ’য়ের দশকের শেষের ডেবরা কিংবা গোপীবল্লভপুরে জমি আন্দোলনের যোগ কতটা? অবিভক্ত মেদিনীপুরের ডেবরা, গোপীবল্লভপুরে নকশাল আন্দোলন হয়েছিল বলেই কি ৩৫-৩৮ বছর পরও তার পরম্পরা বহন করেছে বিনপুর, বেলপাহাড়ি, জামবনি কিংবা লালগড়?’
‘দেখুন ১৯৬৯ সালে গোপীবল্লভপুরে যে জমির আন্দোলন হয়েছিল তার পেছনে ছিল নকশালবাড়ির প্রত্যক্ষ প্রভাব এবং অনুপ্রেরণা। ’৬৯ এর নভেম্বরে গরিব মানুষ, মূলত তফশিলি জাতিভুক্ত এবং আদিবাসী মানুষ উৎসবের মেজাজে জোতদার, জমিদারদের বেনামি জমি দখল করতে নেমেছিল। জোতদারের মাঠের ধান কেটে নিয়েছিল। কিন্তু সেই ঐতিহ্য কিংবা পরম্পরা বহন করেই মাওবাদীরা ২০০৬-০৭ সাল থেকে ঝাড়গ্রাম মহকুমাজুড়ে আন্দোলন চালিয়েছে, সেটা এক কথায় বলা ঠিক হবে না। ছ’য়ের দশকের শেষে প্রকৃত অর্থেই শ্রেণি সংগ্রাম হয়েছিল গোপীবল্লভপুরে। অথচ ২০০৬-০৭ এর পরে হাতে বন্দুক নিয়ে মাওবাদীরা সেই শ্রেণি সংগ্রামটাই ভুলে গেল। যেই বিরোধী দল করবে তাকেই নির্মমভাবে হত্যা করতে হবে, এটা কোনও ক্লাস স্ট্রাগল হতে পারে না।’ থামলেন সন্তোষ রাণা।
আবার শুরু করলেন, ‘দেখুন, ২০০৬-০৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ঝাড়গ্রাম মহকুমায় তীব্র মাওবাদী আন্দোলন, লালগড়ের একটা অংশকে মুক্তাঞ্চল করে তোলা, কিংবা সব শেষে ২০১১ সালের নভেম্বরে কিষেণজির মৃত্যু, এই সব কিছুর প্রেক্ষাপট এক কথায় বলা যাবে না। এর একটা ইতিহাস আছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক কারণ আছে।
সেটা ছ’য়ের দশকের একদম শুরুর দিক। আমি ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজে ভর্তি হলাম। সেই সময় আমাদের গোপীবল্লভপুর তো বটেই, পুরো ঝাড়গ্রাম মহকুমাতেই মারাত্মক দারিদ্র ছিল। অধিকাংশ পরিবারে দু’বেলা খাবার ছিল না। সে দারিদ্র আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কল্পনাও করা যায় না। আর তার সঙ্গে ছিল নির্মম শোষন। তফশিলি জাতি, আদিবাসী এবং গরিব মানুষের ওপর অসহনীয় অত্যাচার ছিল জোতদার, জমিদারদের। আমরা ছিলাম মধ্য-চাষি পরিবার। কিছু জমি-জায়গা ছিল। বাবা, জ্যাঠারা একসঙ্গে থাকত। নিজেরা চাষ-আবাদ করত। আমাদের বাড়ির কেউ বড়লোকের জমিতে মজুর খাটতে যেত না। বরং চাষের সময় দু’চারজন মজুর খাটাতো আমাদের জমিতে। আমাদের মতো বেশ কিছু মধ্যবিত্ত শ্রেণিভূক্ত পরিবার ছিল গোপীবল্লভপুরে। এই মধ্য-চাষি, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো ছিল মূলত সদগোপ, তেলি।
কিন্তু সেই সময় গোপীবল্লভপুরে বেশিরভাগ মানুষ ছিল তফশিলি জাতিভুক্ত এবং আদিবাসী। সেই সংখ্যাটাই মোট জনসংখ্যার ৫৫-৫৮ শতাংশ। তফশিলি জাতিভূক্তরা ছিল মূলত বাগদি, মাল, ডোম, কেওট। এদের প্রায় কারওরই কোনও জমি-জায়গা ছিল না। এরা ছিল মূলত ভূমিহীন। এরা বংশ পরম্পরায় জোতদারের ঘরে বছর বাঁধা মজুর খাটত। অনেকটা ক্রীতদাস প্রথার মতো ছিল ব্যাপারটা। এদের বাড়ির পুরুষ, মহিলা, বাচ্চা সবাই জোতদারের ঘরে কাজ করত প্রায় বিনা মজুরিতে। সামান্য খাবারটুকু পেত। এদের ওপর অত্যাচার হোত সবচেয়ে বেশি। আর আদিবাসীরা ছিল মূলত সাঁওতাল, মুন্ডা, মাহালি। জঙ্গলে থাকত। এদের হাতে বরং অল্প কিছু জমি ছিল। কিন্তু সেই জমি ছিল প্রধাণত জঙ্গলে। খুব একটা চাষযোগ্য ছিল না সেই জমি। তাতেই চাষ করতে গিয়ে মহাজনী দেনার দায়ে এই আদিবাসী পরিবারগুলো আটকা থাকত সারা বছর। বেশিরভাগের তো সারা জীবনেও জোতদারের ঋণ শোধ হোত না। গরিব মানুষ একবার ঋণের ফাঁদে আটকা পড়লে আর বেরতে পারে না।
এই মধ্য-চাষি এবং গরিব তফশিলী জাতি, আদিবাসীর বাইরে ছিল বড় জোতদার, জমিদাররা। বিপুল জমির মালিক এই জোতদার পরিবারগুলোই ছিল সেই ছ’য়ের দশকে গ্রামে গ্রামে শোষনের ভরকেন্দ্র। এই জোতদার, জমিদাররা ছিল মূলত কর, হোতা, মিশ্র। বেশিরভাগই ওড়িয়া ব্রাহ্মণ। আমাদের গোপীবল্লভপুরে সবচেয়ে বড় জোতদার পরিবার ছিল মোহন্ত গোস্বামীরা। প্রায় সাত হাজার বিঘা জমির মালিক ছিল মোহন্ত গোস্বামীরা। গোপীবল্লভপুরের আর এক বড় জোতদার ছিল সাঁকরাইলের রোহিনীর শৈলবালা মহাপাত্ররা। মহাপাত্রদের ছিল প্রায় আড়াই হাজার বিঘা জমি। তাঁর ছেলে হরিশ মহাপাত্র ছিলেন নির্মম অত্যাচারী। ১৯৭২ সালে তিনি গোপীবল্লভপুরের কংগ্রেসের বিধায়ক হয়েছিলেন। আমার এক বন্ধু জিতেন ছোটবেলায় হরিশ মহাপাত্রদের পুকুরে স্নান করতে গেছিল। স্নান করে উঠে পুকুরের ধারের টগর গাছ থেকে দুটো ফুল ছিঁড়েছিল। তার জন্য মহাপাত্ররা জিতেনকে সারা দিন মোষ বাঁধার গোয়ালে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিল। তখন জিতেনের ১২-১৩ বছর বয়েস। এমন হাজারো অত্যাচারের কাহিনী ছড়িয়ে আছে গোপীবল্লভপুরজুড়ে।
এই জোতদার পরিবারগুলোর জমি চাষের ব্যবস্থাও ছিল শোষনের এক নির্মম উদাহারণ। মোহন্ত গোস্বামীদের প্রায় ৫০০ বিঘা ভালো জমি ছিল। এই জমি ছিল একদম শহরে। সেই সময় যে জমিতে আষাঢ় মাসে জল দাঁড়িয়ে যেত তাকেই বলা হোত ভালো জমি। তখন তো সেচের ব্যবস্থা ছিল না বিশেষ। বর্ষার শুরুতেই যে জমি চাষের জন্য তৈরি করা যেত, সেটাই ভালো জমি। এই জমিতে মোহন্ত গোস্বামীরা নিজ-চাষ করত। নিজ-চাষ মানে নিজের জন্য চাষ। কিন্তু জোতদারদের এই নিজ-চাষ ব্যপারটাও ছিল এক অদ্ভুত শোষন। জোতদারদের বাড়িতে লাঙল, হাল ছিল না কিছু। গোস্বামীদেরও বাড়িতে হাল, লাঙল ছিল না। আষাঢ় মাসে এই ভালো জমিতে জল দাঁড়ালেই গোস্বামীদের বাড়ি থেকে দূর-দূর গ্রামের লোকদের ডাকা হোত। মানে, এই ভাল জমিতে চাষের জন্য লোক ডাকা হোত। বিভিন্ন গ্রামের গরিব লোক, তফশিলি, আদিবাসী মানুষ নিজেদের হাল, লাঙল নিয়ে চলে আসত গোস্বামীদের বাড়িতে। তারপর তারাই নিজেদের হাল, লাঙল দিয়ে সেই ভালো জমি কুপিয়ে চাষযোগ্য করে দিত। জমি তৈরি করার পর সেখানে চাষ করত। সেই ভালো জমির ফসল পুরোটাই চলে যেত মোহন্ত গোস্বামীদের ঘরে। যারা দূরের গ্রাম থেকে এসে ভালো জমিতে চাষ করে যেত তারা এই ফসলের এক কণাও পেত না। শুধু তাই নয়, এর জন্য মজুরিও পেত না এক টাকা। এমনই ছিল তখন সিস্টেম। এর বাইরে গোস্বামীদের যে জমি ছিল, সেখানে চাষ শুরু হত কিছুদিন পরে। সেই বাদবাকি জমিতেও চাষের জন্য লোক ভাড়া করত গোস্বামীরা। সেই জমির ফসলের অর্ধেক চলে যেত জমিদার বাড়িতে। বাকি অর্ধেক পেত কৃষক। এমনই ছিল সেই সময়, মানে ছ’য়ের দশকে জঙ্গলমহলের চাষের ব্যবস্থা।’ টানা বলে থামলেন সন্তোষ রাণা।
‘তো যে লোকগুলো মোহন্ত গোস্বামী কিংবা অন্য জোতদারদের এই ভালো জমিতে চাষ করে দিয়ে যেত তারা মজুরিও পেত না? তবে এই কাজ করত কেন তারা?’ বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না সন্তোষ রাণার কথা।
‘দেখুন জোতদারদের ভালো জমিতে, মানে নিজ-চাষ জমিতে চাষ করার জন্য কারও না বলার উপায় ছিল না। এই জমিতে চাষ করার বদলে গরিব, তফশিলি জাতি কিংবা আদিবাসী মানুষগুলো গোস্বামীদের মন্দিরের প্রসাদ পেত রোজ। কোনও দিন হয়তো সামান্য কিছু খাবারও পেত জমিদার বাড়ি থেকে। এই যে নিজ-চাষ জমিতে তারা বিনা মজুরি, বিনা ফসলে কাজ করে দিত তার বদলে জোতদারদের অন্য জমিতে চাষের সুযোগ পেত তারা। সেই চাষের জন্য যে ফসল জুটত তাতেই বছরে ছ’মাস একবেলা করে খেতে পেত কোনওভাবে। সেই সময় গ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে এই চরম সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা মেনে নেওয়া ছাড়া গরিব মানুষগুলোর আর কিছু উপায়ও ছিল না। তাছাড়া অর্থনৈতিক কারণের পাশাপাশি আরও একটা সামাজিক বিষয়ও ছিল সেই সময়। সেটা হচ্ছে সামাজিক বৈষম্যের এক চূড়ান্ত রূপ। বলা যেতে পারে জাতি বৈষম্য। গোপীবল্লভপুর সদরে মোহন্ত গোস্বামীদের মন্দির ছিল। সেই সময় তফশিলি জাতি, আদিবাসী এবং নিম্নবর্গের মানুষের কাছে ব্রাহ্মণের সেবা করা ছিল একটা বড় ব্যাপার। এই যে মজুরি ছাড়া, ফসল ছাড়া তারা গোস্বামীদের জমিতে নিজ-চাষ করে দিত, এটা ছিল তাদের কাছে ব্রাহ্মণের সেবা। এই সেবার বদলে তারা গোস্বামীদের মন্দিরের যে প্রসাদ পেত সেটাই ছিল সেই সময় তাদের কাছে বিরাট ব্যাপার। এমনই ছিল তখন সামাজিক অবস্থা।
এই যে তীব্র শোষন, গরিব নিম্নবর্গের মানুষের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন, একে এক কথায় শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দূরাবস্থা কিংবা দারিদ্র বলা যাবে না। আমি একে বলি কাস্ট ফিউডালইজম। জাতিভিত্তিক সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা। আর এই জাতিভিত্তিক সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাটা যখন একটা চরম চেহারা নিচ্ছে, তখনই ঘটে গেল নকশালবাড়ি। ১৯৬৭, আমি তখন কলকাতায়। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ছি। এই নকশালবাড়ির প্রভাবেই বলা যায় পিএইচডি শেষ না করেই ’৬৭র শেষে গ্রামে ফিরে গেলাম। গোপীবল্লভপুরে। নকশালবাড়ির প্রভাব তখনও তেমন পড়েনি ঠিকই, তবে তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এই যে জোতদার, জমিদারদের বঞ্চনা, শোষনের বিরুদ্ধে উত্তরবঙ্গের নকশালবাড়ি নামক এক জায়গায় গরিব মানুষ জাগছে, জমি দখল করছে, মাঠের ধান কেটে নিচ্ছে, সেই কথাবার্তা তখন গোপনে শুরু হয়ে গেছে গোপীবল্লভপুরের তফশিলি জাতি এবং আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে। নকশালবাড়ি আন্দোলনের পর পরই এই গ্রামগুলোতে আমরা যেতে শুরু করলাম। প্রথমেই যেতে শুরু করলাম তফশিলি জাতি এবং আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে। সেখানকার মানুষেরই অবস্থা ছিল সবচেয়ে খারাপ। গ্রামগুলোতে যাওয়া শুরু করা মাত্রই বুঝতে পারলাম, মানুষ প্রস্তুত হয়েই আছে। দীর্ঘ দিনের বঞ্চনা, শোষন আর চরম দারিদ্র মানুষগুলোকে এমন জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিল, কিছু করার জন্য তারা যেন রেডি হয়েই ছিল। জোতদারের এই বিঘার পর বিঘা জমি কেড়ে নিতে হবে, সেখানে নিজেদের চাষ করতে হবে। সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে, কারণ জোতদারের পাশে দাঁড়াবে পুলিশ-প্রশাসন। এই ছিল আমাদের সহজ-সরল রাজনীতি। সবার প্রথম রেসপন্ড করল মাল গ্রামগুলো। তারপর আস্তে আস্তে মুন্ডা, বাগদি, কেওট, সাঁওতাল সমস্ত গ্রামের মানুষ জাগতে শুরু করল। দেড়-দু’বছরের মধ্যে গোপীবল্লভপুর জুড়ে আন্দোলনের ঢেউ উঠে গেল।
১৯৬৯ এর নভেম্বর। গোপীবল্লভপুরের মাঠে-মাঠে ধান পেকে রয়েছে। চাষিরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করল, ‘আমাদের মেহনতে ধান হয়েছে। আমরাই তা কেটে নেব।’ মধ্যবিত্ত শ্রেণির কিছু মানুষও এসে দাঁড়াল এই গরিব, হতদরিদ্র মাল, মুন্ডা, বাগদি, সাঁওতাল চাষির পাশে। একসঙ্গে ৩০-৩৫ হাজার মানুষ সেই নভেম্বরে একজোট হয়ে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। উৎসবের পরিবেশ তখন গোপীবল্লভপুরজুড়ে। ধামসা-মাদল বাজিয়ে হাজার হাজার পুরুষ-মহিলা নিজেদের পরিশ্রমের চাষ করা ধান কাটতে শুরু করল জোতদারদের জমি থেকে। প্রথমেই কাটা হল মোহন্ত গোস্বামীদের জমির ফসল। গোপীবল্লভপুরের সবচেয়ে বড় জোতদার গোস্বামীদের জমিতে হাত পড়তেই, গ্রামে গ্রামে পরিবেশ পালটে গেল।’
ছ’য়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত গোপীবল্লভপুরে নকশাল আন্দোলন, তার প্রেক্ষাপট এবং প্রভাব এখনও যেন গতকালের ঘটনার মতোই দেখতে পাচ্ছিলেন সন্তোষ রাণা। ২০১৭ সালের শেষে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে হচ্ছিল, ৫০ বছর আগের নয়, একদিন আগের ঘটনা শুনছি। যে ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হাজার-লক্ষ গরিব খেটে খাওয়া মানুষের, নিম্নবর্গের পরিবারগুলোর দীর্ঘ দিনের শোষন, অত্যাচারের জাল ছিড়ে বেরিয়ে আসার স্বপ্ন। অর্থনৈতিক এবং জাতিগত বৈষম্য কাটিয়ে পুর্নজন্ম ঘটে যাওয়ার এক রোমাঞ্চকর কাহিনী, যা পঞ্চাশ বছর পরেও দেশজুড়ে এক গভীর আলোচনার বিষয়।
‘কিন্তু আপনি যে বলছিলেন, জাতিভিত্তিক সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, এটা কেন? তাছাড়া ’৬৯ এর নভেম্বরে যে আন্দোলন তাকে তো ধরেও রাখা গেল না বেশি দিন!’
‘দেখুন সেই সময় গোপীবল্লভপুর, ঝাড়গ্রাম, নয়াগ্রাম, বিনপুর, মেদিনীপুর জেলার তফশিলি জাতি এবং আদিবাসী এলাকাগুলোতে জাতি বৈষম্য ছিল মারাত্মক। বিনপুরে পরিস্থিতিটা ছিল একটু আলাদা। কারণ, সেখানে তফশিলি জাতি এবং আদিবাসীদের হাতে তাও বেশ কিছু জমি-জায়গা ছিল। ফলে কিছু বড়লোক তফশিলি এবং আদিবাসী পরিবার ছিল সেখানে। তার বাইরে বেশিরভাগই ছিল গরিব। বিনপুরে এই গরিব, দরিদ্র তফশিলি এবং আদিবাসী মানুষগুলো তুলনায় বড়লোক তফশিলি এবং আদিবাসী পরিবারের জমিতে চাষ করত। তাদের মধ্যে শ্রেণি বিভেদ ছিল ঠিকই, কিন্তু জাতি বিভেদ ছিল না। বিনপরে বড় জমির মালিক এবং মজুর একই সঙ্গে বসে খাওয়া-দাওয়া করতে পারত। আর এটাই ছিল গোপীবল্লভপুর, ঝাড়গ্রাম, নয়াগ্রামের সঙ্গে বিনপুরের মৌলিক ফারাক। গোপীবল্লভপুরের মোহন্ত গোস্বামী, শৈলবালা মহাপাত্র, ঝাড়গ্রামের কর, হোতা কিংবা মল্লদেব পরিবার, সমস্ত জোতদার, জমিদারই ছিল উচ্চবর্ণের। এখানকার কিংবা ওড়িশার ব্রাহ্মণ। ৮০ শতাংশ জমির মালিক ছিল এরাই। অল্প জমি ছিল আমাদের পরিবারের মতো কিছু তেলি, সদগোপ সম্প্রদায়ের মধ্য-চাষি কিংবা মধ্যবিত্তের হাতে। আর তফশিলি এবং আদিবাসীরা ছিল মূলত ভূমিহীন কিংবা যৎসামান্য জমির মালিক। ফলে একদিকে এই পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর ওপর একই সঙ্গে ছিল চরম অর্থনৈতিক শোষন এবং জাতিগত বিদ্বেষ। নকশাল আন্দলন শুরুর পর গোপীবল্লভপুরেই এই জাতিভিত্তিক সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা আমরা অভিজ্ঞতার মধ্যেও বারবার দেখেছি।’
‘কী রকম?’
‘নকশালবাড়ির প্রভাবে আমরা যখন গোপীবল্লভপুরের বিভিন্ন এলাকায় যেতে শুরু করলাম, দেখলাম গ্রামগুলো রেসপন্ড করছে কমিউনিটি হিসেবে। প্রথমে এল মাল গ্রামগুলো। তারপর একে একে মুন্ডা, কেওট, সাঁওতালরা এগিয়ে এল। অর্থনৈতিকভাবে এবং জাতিগতভাবে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশ প্রথম এই আন্দোলনে সাড়া দিয়েছিল। ’৬৯ এর নভেম্বরে প্রথম যখন ৩০-৩৫ হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে জোতদারের জমির ধান কাটতে শুরু করে, তার একশো শতাংশই ছিল তফশিলি জাতিভুক্ত এবং আদিবাসী মানুষ। আন্দোলনের তীব্রতা দেখে আস্তে আস্তে মধ্য-চাষি কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণিও এতে যোগ দেয়। বলা যেতে পারে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করতে শুরু করে। কিন্তু মধ্যবিত্তের এই জোতদার-জমিদার বিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করার মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল না। যখন আন্দোলনে জোয়ার আসত তখন মধ্যবিত্ত শ্রেণি তার পাশে দাঁড়াত, আবার ভাটা এলে তারা আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে জোতদারদের পক্ষ নিত। এমন অভিজ্ঞতা আমাদের বহুবার হয়েছে। তাই আমরা যখন পুলিশের থেকে বাঁচতে গোপনে মুভ করতাম, সব সময় চেষ্টা করতাম মধ্যবিত্ত পাড়া কিংবা গ্রাম এড়িয়ে তফশিলি এবং আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম দিয়ে যাতায়াতের। গ্রেফতারি এড়াতে আশ্রয়ও নিতাম তফশিলি এবং আদিবাসী গ্রামে। মধ্যবিত্তরা জোতদার এবং পুলিশের চরের কাজ করেছে, এমন ঘটনা প্রচুর। কিন্তু কোনও গরিব পরিবার বেইমানি করত না। কেন বলছি, সেই সময় গোপীবল্লভপুরে শুধুমাত্র শ্রেণি চরিত্রটাই শেষ কথা ছিল না? তার কারণ, আমরা অভিজ্ঞতায় বারবার দেখেছি, দশ বিঘা জমির মালিক সাঁওতাল আর দশ বিঘা জমির মালিক তেলির মধ্যে মৌলিক ফারাক ছিল। যে পরিমাণ জমির আদিবাসী মালিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছিল, একই পরিমাণ জমির মালিক তেলি কিন্তু তাতে যোগ দেয়নি। প্রয়োজন বুঝে মাঝেমধ্যে আন্দোলনকে সমর্থন করেছে মাত্র। আবার সুযোগ বুঝেই বড়লোক জোতদারের পক্ষ নিয়েছে।’
এও এক নতুন মৌলিক তত্ত্ব হাজির করলেন কিষেণজি মৃত্যু রহস্যের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী সন্তোষ রাণা। শুধুমাত্র শ্রেণি চরিত্র নয়, জাতিগত বিন্যাসও বড় প্রভাব ফেলেছিল ছ’য়ের দশকের শেষে গোপীবল্লভপুরের নকশাল আন্দোলনে। সন্তোষ রাণার ব্যাখ্যায় এটাই ‘কাস্ট ফিউডালইজম’। কারণ, স্বাধীণতার পর গ্রামে গ্রামে বড়লোক, জমিদার, জোতদারদের যে শোষন, অত্যাচার, তা শুধুমাত্র গরিবের ওপরেই কেন্দ্রীভূত ছিল না, জাতিগতভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের ওপর তা ছিল আরও বেশি। আর একই সঙ্গে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া এবং নিম্নবর্গের মানুষের ওপর যে বহুমাত্রিক আক্রমণ তাকেই ‘কাস্ট ফিউডালইজম’ আখ্যা দিয়েছেন সন্তোষ রাণা। কিন্তু শুধুমাত্র গোপীবল্লভপুরে ছ’য়ের দশকের আন্দোলনের সামাজিক কিংবা শ্রেণি চরিত্র নয়, তার বাইরেও কিছু জানার ছিল তাঁর কাছে৷
‘একুশ শতকের গোঁড়ায় এই যে তীব্র মাওবাদী আন্দোলন শুরু হল মেদিনীপুর, বাকুঁড়া, পুরুলিয়ার বিভিন্ন অংশে, যা চূড়ান্ত আকার নিল লালগড়ে এসে তার ওপর গোপীবল্লভপুর কিংবা ডেবরার নকশাল আন্দোলনের প্রভাব কতটা? কিষেণজির নেতৃত্বে মাওবাদীদের লালগড় আন্দোলনকেই বা আপনি কোন দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখেন?’
‘দেখুন, আমি শুরুতেই বলেছি, মাওবাদীরা ক্লাস স্ট্রাগল ভুলে গেল। আমাদের সময় ছ’য়ের দশকের শেষে ব্যাপারটা তেমন ছিল না। তাছাড়া মাঝের ৩৫-৪০ বছরে বাংলার গ্রামগুলোর শ্রেণি চরিত্র, জাতি চরিত্রও অনেক পাল্টেছে। আমাদের সময় ছিল তীব্র দারিদ্র, ক্ষুধা, শোষন আর অত্যাচার। যার বিরুদ্ধে মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৭১-৭২ এর পর সেই আন্দোলনে ভাটা পড়ে। মাঝখানে কয়েক বছর কংগ্রেস শাসন। আবার জোতদার, জমিদারদের হাত শক্ত হল। তারপর ১৯৭৭ এ বামফ্রন্ট সরকার গঠন হলে ফের জোতদারের জমি দখল শুরু হল। ’৭৭ সালে সাঁকরাইলের রোহিনীর জমিদার হরিশ মহাপাত্রকে হারিয়ে আমি বিধায়ক হলাম। রাজ্যজুড়ে শুরু হল অপারেশন বর্গা। ব্যাপক ভূমি সংস্কার। জোতদার, জমিদারদের এক্তিয়ার বহির্ভুত জমি দখল। আমরা এবং সিপিআইএম একসঙ্গে সাঁকরাইলের মহাপাত্রদের জমি খাস করেছিলাম। ঝাড়গ্রামের জোতদার কর এবং হোতাদের জমি খাস করল সিপিআইএম। এই যে ঝাড়গ্রাম ব্লকজুড়ে জমি খাস করার আন্দোলন শুরু হল তা গরিব তফশিলি এবং আদিবাসীদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলল। ১৯৭৭ থেকে ’৮৭, প্রথম দশ বছর সিপিআইএমের ভূমিকাও ছিল অত্যন্ত ভাল। কিন্তু তারপরই গোলমালটা শুরু হল ঝাড়গ্রামের বিভিন্ন এলাকায়। আটের দশকের গোঁড়া থেকেই আলাদা ঝাড়খন্ড রাজ্যের দাবি নিয়ে জোর আন্দোলন শুরু করল ঝাড়খন্ড পার্টি। একদম শুরুর দিকে বিনপুরে ঝাড়খন্ড পার্টির কিছু প্রভাব ছিল। কিন্তু আটের দশকের মাঝামাঝি থেকেই তীব্র আধিপত্যের রাজনীতি শুরু করে দিল সিপিআইএম। মূলত ঝাড়খন্ড পার্টিকে দমন করতেই সিপিআইএমের এই আধিপত্যবাদের সূত্রপাত। আর সিপিআইএম যত দলীয় আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে, ততই মানুষ ঝাড়খন্ড পার্টির দিকে ঝুঁকেছে। ঝাড়খন্ডিদের শক্তি ততই সংহত হয়েছে। সিপিআইএম যদি আধিপত্যের রাজনীতি না করত তবে ঝাড়খন্ডিদের এত শক্তি বৃদ্ধিও হোত না। আসলে বিরোধী কোনও রাজনৈতিক মতকেই মান্যতা দেওয়ার সহিষ্ণুতা সিপিআইএম সেই সময় দেখায়নি। শাসক দল হিসেবে সিপিআইএম যদি বিরোধী মতকে মান্যতা দিত, তবে ঝাড়গ্রামে এত গরিব তফশিলি, আদিবাসী মানুষ লাইন দিয়ে ঝাড়খন্ড পার্টির দিকে চলে যেত না।
আটের দশকের শুরু থেকে আরও একটা ব্যাপার হয়েছিল ঝাড়গ্রাম মহকুমায়। আলাদা ঝাড়খন্ড রাজ্যের দাবি তুলল ঝাড়খন্ড পার্টি। তাতে সরাসরি যোগ দিল কংগ্রেস। তখন কংগ্রেস মানেই সব বড়লোক, জোতদার, জমিদার পরিবার। আর নীতিগতভাবে আমরাও আলাদা রাজ্যের দাবিকে সমর্থন জানালাম। আলাদা ঝাড়খন্ড রাজ্যের দাবির একমাত্র বিরোধিতা করল সিপিআইএম। রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিকভাবে। ফলত, সেই সময় একদিকে জোটবদ্ধ হল ঝাড়খন্ড পার্টি, কংগ্রেস এবং পুরনো নকশালরা। অন্যদিকে, সিপিআইএম। সিপিআইএমের সঙ্গী তখন প্রশাসন। তারপরেই দু’দলের মধ্যে শুরু হয়ে গেল রক্তাক্ত সংঘর্ষ। খুন-পাল্টা খুনের রাজনীতি। প্রথমে টাঙি, বল্লম, তীর ধনুকের লড়াই। তারপর আমদানি হল বন্দুকের। সেই লড়াইটা চলল বহু বছর। রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে ঝাড়খন্ডিদের ওপর তীব্র দমন পীড়ন শুরু করল সিপিআইএম। এমনই অবস্থা পৌঁছেছিল, টানা দু-তিনটে পঞ্চায়েত নির্বাচনে ঝাড়গ্রাম, বিনপুর, জামবনি, গোপীবল্লভপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় কোনও বিরোধী দল প্রার্থীই দিতে পারেনি। কিন্তু প্রশাসনকে ব্যবহার করে যে নির্বাচনী একাধিপত্য সিপিআইএম প্রতিষ্ঠা করেছিল, তার একটা পালটা পরিস্থিতিরও জন্ম নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছিল সেই ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই।’
‘আচ্ছা, কংগ্রেস তো আগাগোড়াই সিপিআইএমের বিরুদ্ধে ছিল। জোতদার, জমিদারদের জমি খাস করার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছিল তার থেকে বাঁচতে কংগ্রেসিরা তখন ঝাড়খন্ডিদের সমর্থন করে। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু আপনারা কেন তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। লড়াইটা তো প্রথম শুরু হল জোতদারদের জমি খাস করার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর।’ থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম সন্তোষ রাণাকে।
‘আমি নিজে ঝাড়খন্ডিদের পৃথক রাজ্যের দাবিকে সমর্থন করেছি। আদিবাসীরা নিজেদের স্বশাসন, নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি রক্ষার দাবি নিয়ে পৃথক রাজ্যের কথা তুলেছিল। আমাদের দৃষ্টভঙ্গীতে এটা ছিল একটা গণতান্ত্রিক লড়াই। নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং অধিকার রক্ষার আন্দোলন। তাই আমরা এর সঙ্গে ছিলাম। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই ঝাড়গ্রামে সিপিআইএমের সঙ্গে সমস্ত বিরোধী দলের লড়াই, সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। যা অনেক পরে সিপিআইএমের সঙ্গে মাওবাদীদের লড়াইয়ে পরিণত হল। কিন্তু মুশকিল হল, সিপিআইএম যেভাবে বিরোধী মতকে মান্যতা দিতে অস্বীকার করেছে, পরবর্তী সময়ে একই কাজ করল মাওবাদীরাও। যে বা যারাই রাজনৈতিকভাবে মাওবাদীদের বিরোধিতা করেছে তাকেই তারা নির্বিচারে খুন করেছে। একুশ শতকের শুরু থেকে মাওবাদীরা যত লোককে খুন করেছে তারা কেউ জোতদার, জমিদার কিংবা বড়লোক ছিল না। ছিল বিরোধী রাজনৈতিক দল, মানে, মূলত সিপিআইএম করা গরিব মানুষ। আর গরিব মানুষকে খুন করে কোনও ক্লাস স্ট্রাগল হয় না। প্রথম প্রথম মাওবাদীরা যখন ঝাড়খন্ড পার্টির সমর্থনে এখানে সিপিআইএম বিরোধী লড়াইয়ে সামিল হয়েছিল, তখন তারা সাধারণ গরিব মানুষের সমর্থন পেয়েছিল। তাছাড়া, আরও একটা ফ্যাক্টর ছিল। মাওবাদীরা এখানে সিপিআইএম এবং ঝাড়খন্ডিদের মধ্যের রাজনৈতিক লড়াইয়ে শামিল হয়েছিল। গরিব পিছিয়ে পড়া মানুষের পক্ষ নিয়ে বড়লোকের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি তারা। আর এটাই ছিল এরাজ্যে একুশ শতকের গোঁড়ায় মাওবাদী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় ত্রুটি। এলাকার দখল নিতে গিয়ে ক্লাস স্ট্রাগলটা ভুলে গিয়ে স্রেফ মানুষ খুন করতে শুরু করল তারা। সমস্ত বিরোধী মতকে দমন করার যে রাস্তা সিপিআইএম নিয়েছিল, তারই পালটা ব্যবস্থা আরও নৃশংসভাবে চালু করল মাওবাদীরা।’
নকশাল আন্দোলনের আমলে গোপীবল্লভপুরের নেতা, সিপিআইএমএলের প্রাক্তন বিধায়ক সন্তোষ রাণার সাক্ষ্য মোটামুটি শেষ। তাঁর সঙ্গে কথার পরে ভাবছিলাম, কী বিচিত্র এই ঝাড়গ্রাম মহকুমার চরিত্র! দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর একটা মহকুমার কয়েকটা ব্লকে গরিব মানুষ শুধু লড়াই করে চলেছে নিজেদের মধ্যে। যে খুন করছে, আর যে খুন হচ্ছে দুই পরিবারেই চরম দারিদ্র। দু’দল মানুষেরই অধিকাংশ হয় তফশিলি জাতিভুক্ত, নয়তো আদিবাসী। শুধু তাদের রাজনৈতিক পরিচয় আলাদা। কেউ ঝাড়খন্ড পার্টি কিংবা মাওবাদীদের নেতা-কর্মী-সমর্থক। কেউ আবার সিপিআইএমের নেতা-কর্মী-সমর্থক। কিন্তু এই লড়াই, সংঘর্ষ, খুনোখুনি তো কোনও শ্রেণি কিংবা জাতি বৈষম্য দূর করার জন্য হচ্ছিল না। অথচ, এই মহকুমাতেই ছ’য়ের দশকের শেষে জেগে উঠেছিল গরিব, নিম্নবর্গীয় মানুষ। যে নকশালরা গরিব আদিবাসীকে সঙ্গে নিয়ে ছ’য়ের দশকের শেষে ডেবরা, গোপীবল্লভপুরে জোতদার, জমিদারের জমি দখলের আন্দোলন করেছে, তাদেরই উত্তরাধিকার চলে গেল এমন একটা রাজনৈতিক দলের হাতে যাদের একমাত্র রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং কৌশল হয়ে উঠল মানুষ হত্যা। উলটো পক্ষে সিপিআইএম। যে সিপিআইএম ১৯৭৭ সালে সরকার গঠন করে বহু জমি খাস করেছে, তারাই এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ল। এ কি সমাজের কোনও অগ্রগতি? নাকি স্রেফ রাজনৈতিক ক্ষমতা কব্জায় রাখার জন্য স্বল্পমেয়েদি এক বন্দোবস্ত?
ক্রমশ...।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।