ঝাড়গ্রাম থানা, কেস নম্বর ৬২/০৩
সন্ধে প্রায় সাড়ে সাতটা। মোটামুটি নির্বিঘ্নে নির্বাচন শেষ হয়েছে ঝাড়গ্রাম মহকুমায়। কঠিন পরীক্ষায় পাশ করা ছাত্রের মতোই পুলিশ এবং প্রশাসন খানিকটা স্বস্তির শ্বাস ফেলেছে। পুলিশের ভাষায়, সারাদিন মেজর ইনসিডেন্ট ফ্রি। এমনই সময় ঝনঝন শব্দে ফোন বাজল জামবনি থানায়। সারাদিন কত কারণেই তো ফোন বেজে উঠেছে! এসডিপিও ঝাড়গ্রাম বাস্তব বৈদ্য তখন থানায় বসে হিসেব মেলাচ্ছেন সমস্ত বুথ থেকে ঠিকমতো ব্যালট বাক্স ঝাড়গ্রাম শহরে পৌঁছেছে কিনা। ‘স্যার, বড়ো সাহেব।’ ফোনটা তুলেই বাস্তব বৈদ্যর দিকে এগিয়ে দিলেন থানার এক অফিসার। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পুলিশ সুপার কে সি মিনা ফোন করেছেন।
‘স্যার...’
‘বাসু ভকত মিসিং?’
‘এমন খবর তো আমাদের কাছে নেই স্যার।’
‘দেখ তো। খোঁজ নাও এখনই। সিপিআইএমের লোকেরা বলছে। ডুলুং নদীর পাশে পাঁচামি গ্রামের কাছাকাছি নাকি বাসু ভকতকে তুলে নিয়ে গিয়েছে ঝাড়খন্ডিরা।’
‘স্যার...’
‘ভালো করে দেখ। আমি আসছি।’
‘স্যার...’
পুলিশ সুপার কে সি মিনার ফোন ছেড়েই বেরনোর জন্য রেডি হলেন এসডিপিও ঝাড়গ্রাম বাস্তব বৈদ্য। সারাটা দিন মোটামুটি শান্তিপূর্ণ থাকার পর সন্ধ্যায় সিপিআইএমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা বাসু ভকত মিসিং? এর থেকে তো সারাদিন গণ্ডগোল হলে ভালো হোত। বাসু ভকতের অপহৃত হওয়ার খবরের গুরুত্ব বোঝার মতো বয়স এবং অভিজ্ঞতা দুইই তখন হয়েছে ঝাড়গ্রাম মহকুমার পুলিশের।
বাসু ভকত সিপিআইএমের জামবনি লোকাল কমিটির সম্পাদক। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়, জেলা সম্পাদক দীপক সরকারের বিশেষ অনুগত এবং ডান হাত বাসু ভকত তখন ঝাড়গ্রামের জঙ্গল ঘেরা এলাকায় সিপিআইএমের মুখ। জামবনির চুটিয়া গ্রামের বাসিন্দা বাসু ভকত সেই সময় ওই এলাকায় শেষ কথা। আজ একে ধরছেন, তো কাল তাকে মারছেন। ঝাড়খন্ডিদের এক নম্বর টার্গেটের নাম বাসু ভকত। আবার এর মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন, ওর ছেলের পড়ার খরচ দিচ্ছেন। সিপিআইএম কর্মীদের কাছে লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ তাঁর। ওই এলাকার আদিবাসীদের ওপর সিপিআইএমের যে নেতার প্রভাব তখন সর্বাত্মক, গোপীবল্লভপুর, বেলপাহাড়ি, জামবনির গ্রামে গ্রামে যাঁর পায়ে হেঁটে অবাধ বিচরণ সেই ডহরেশ্বর সেনের মতো গ্রামে রাত কাটানো মানুষ তখন মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদক দীপক সরকারের ইচ্ছেয় দলে একেবারেই কোণঠাসা। ঝাড়খন্ডি, সিপিআইএম, কংগ্রেস নির্বিশেষে আদিবাসী এবং গরিব মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় ডহরেশ্বর সেন নন, বিহার সংলগ্ন মেদিনীপুরের জঙ্গল ঘেরা এলাকায় শাসক দলের মুখ তখন বাসু ভকত।
সিপিআইএমের নির্বাচনী লাইন নিদান দিয়েছে, ঝাড়খন্ডিরা বড্ড বেয়াড়া। বাম জমানাতেও প্রবল পরাক্রান্ত সিপিআইএমের বিরোধিতা করে কথায় কথায়। তাই তাদের সবক শেখাতে দরকার বাসু ভকতের মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতার। দীর্ঘ বছর সরকার চালিয়ে সিপিআইএমের তখন চাই নিঃশর্ত আনুগত্য। চাই সমস্ত এলাকায় দখলদারি। রাজনৈতিক একাধিপত্য। দলের ভিতরে এবং বাইরে সামান্য বিরোধিতা মানেই, না, তখনও মাওবাদী নন আপনি, কিন্তু অবশ্যই শত্রু শিবিরের লোক। মেদিনীপুর জেলার সিপিআইএমের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর কাছে তখন নিজের দলেরই নেতা ডহরেশ্বর সেন এবং ঝাড়খন্ড পার্টির নেতা নরেন হাঁসদা প্রায় একই ব্র্যাকেটের বাসিন্দা। দুজনকেই মোকাবিলার জন্য দরকার বাসু ভকতদের। বিরোধীদের দমন করতে হবে পেশি শক্তি দিয়ে, আর নিজের দলের মধ্যে ভিন্ন মতটাকে দমন করতে হবে তাঁকে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে।
দলের ভেতরে এবং বাইরে গণতন্ত্র কি সত্যিই ছিল সিপিআইএমে তখন? বিশেষ করে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়। গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত যদি হয় বিরোধী এবং দুর্বল মতকে শোনা এবং তাকে উপযুক্ত সম্মানজনক অগ্রাধিকার দেওয়া, তবে এ’রাজ্যে দীর্ঘ সিপিআইএম জমানায় তার লঙ্ঘিত হওয়ার অন্যতম পরীক্ষাগার ডুলুং, কংসাবতী নদীর পারের রুক্ষ লাল মাটির একের পর এক গ্রামে। সব মিলিয়ে ঝাড়গ্রাম মহকুমা। মূলত আদিবাসী অধ্যুষিত ঝাড়গ্রাম এলাকায় ঝাড়খন্ড পার্টির প্রভাব, প্রতিপত্তি দমন করাই আটের দশক থেকে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় সিপিআইএমের প্রধান এবং একমাত্র রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পর্যবসিত হল। আদিবাসীদের সমর্থন আদায় করা কিংবা তাদের মন জয় করা দীর্ঘমেয়াদি এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় সাফল্যের জন্য যে ধৈর্য, ত্যাগ, রাজনৈতিক কর্মসূচি দরকার, সংসদীয় গণতন্ত্রে তাৎক্ষনিক সাফল্য তত সময় অনুমোদন করে না। ভোটটা তো জিততে হবে! সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের হৃদয় না জিতেই যদি একের পর এক নির্বাচনে সাফল্য করায়ত্ত্ব হয়, তবে এত সমুদ্রমন্থনের প্রয়োজন কী? সেই সময় নিজের দলের মধ্যেও ভিন্ন মতটা শোনার মতো ধৈর্য দেখাননি প্রথমে অবিভক্ত ও পরে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সিপিআইএম নেতৃত্ব। আর রাজ্য নেতৃত্বের কাছে জেলা নেতাদের যোগ্যতার একটা গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি নির্বাচনী সাফল্য। সেই সাফল্য কোন পথে আসছে, কীভাবে আসছে তা মামুলি ব্যাপার।
কিন্তু পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় সিপিআইএমের গণতন্ত্রের অনুশীলন ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সন্ধ্যায় প্রশাসনের কাছে বড় প্রশ্ন ছিল না। একমাত্র প্রশ্ন ছিল, বাসু ভকত মিসিং! এমনই খবর পৌঁছেছিল জেলার পুলিশ সুপার কে সি মিনা মারফত জামবনি থানায়।
দু’গাড়ি ফোর্স নিয়ে ঝাড়গ্রামের এসডিপিও বেরলেন জামবনি থানা থেকে। এরই মধ্যে বেলপাহাড়ি থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অপারেশন রাজেশ সুবর্ণকে ডেকে পাঠানো হয়েছে জামবনিতে। এসপি’র কথা মতো জামবনি থানা থেকে সাপধরা, পাঁচামির দিকে রওনা দিল দু’গাড়ি ফোর্স। থানা থেকে বেশি দূর নয়, কিন্তু চারদিকে ঘন অন্ধকার। অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে জঙ্গলে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলেন পুলিশ অফিসাররা। জনপ্রাণী নেই কোথাও। বেশ কিছু সময় রাস্তা এবং জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করে কিছু দেখতে না পেয়ে জামবনি থানায় ফিরলেন অফিসাররা। ততক্ষণে থানায় পৌঁছে গিয়েছেন জেলার এসপি কে সি মিনা।
রাত সাড়ে আটটা-ন’টা হবে। বাসু ভকতের নিরুদ্দেশের খবর ততক্ষণে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে জামবনিজুড়ে। আর সেই খবর যত ছড়াচ্ছে, জামবনি থানার সামনে তত ভিড় বাড়ছে সিপিআইএমের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের। পুলিশ অফিসাররা আবার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন তল্লাশিতে যাওয়ার। বাসু ভকত মিসিং সামান্য কোনও ব্যাপার নয়। এসডিপিও এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দুজনেই বেরলেন থানা থেকে। সঙ্গে ফোর্স এবং তাঁদের পেছনে প্রচুর সিপিআইএম নেতা-কর্মী। তাঁরাও সব যাবেন পুলিশের সঙ্গে বাসু ভকতের খোঁজে। পুলিশ অফিসাররা বুঝলেন শাসক দলের ক্যাডারদের সঙ্গে নিয়ে নেতার তল্লাশিতে যাওয়া ঠিক হবে না। তাঁরা জানিয়েও দিলেন সিপিআইএমের ভিড়টাকে সে কথা, যাওয়া যাবে না পুলিশের সঙ্গে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সিপিআইএমের লোকজন যাবেনই। তাঁদের প্রিয় নেতা নিরুদ্দেশ! সামান্য দূরত্ব রেখে পুলিশকে অনুসরণ করল সিপিআইএমের ভিড়টা। গাড়িতে চেপে আশপাশের আরও নানা জায়গা থেকে শাসক দলের লোকজন তখন হাজির হয়েছে জামবনি থানায়।
রাত প্রায় সাড়ে নটা। ঝাড়গ্রাম এবং জামবনি পঞ্চায়েত সমিতির সীমানায় পাঁচামির জঙ্গলে পৌঁছোল পুলিশের কনভয়। কনভয় মানে চার-পাঁচ গাড়ি পুলিশ। বড় রাস্তায় গাড়ি রেখে আস্তে আস্তে দুটো-তিনটে দলে ভাগ হয়ে পুলিশ ঢুকল জঙ্গলের ভেতরে। সিপিআইএমেরও কিছু ছেলে পুলিশের পেছনে। হাতে বড় টর্চ, এসডিপিও ঝাড়গ্রাম একটা টিম নিয়ে আগে আগে চলেছেন। পেছনে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী। অন্য একটা টিম নিয়ে রাস্তার অন্যদিকে জঙ্গলে ঢুকলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাজেশ সুবর্ণ। দুটো দলেরই পিছু নিল শাসক দলের অল্প কিছু যুবক। বাকি সিপিআইএমের লোকজন দাঁড়িয়ে থাকলেন বড় রাস্তায়। পুলিশের দুটো দল অন্ধকার জঙ্গলে টর্চ হাতে শুরু করল সার্চ অপারেশন।
বড়ো রাস্তা থেকে জঙ্গলের ভেতর ৩০০-৩৫০ মিটার এগোতেই মাটিতে পড়ে থাকা পাতা একটু এলোমেলো দেখলেন বাস্তব বৈদ্য। এদিক-ওদিক টর্চ ঘোরাতেই দেখলেন মাটিতে টাটকা রক্ত। থিকথিক করছে। তার থেকে কুড়ি ফুট এগোতেই মাটিতে পড়ে আছে বাসু ভকতের মৃতদেহ। বুকে ভয়ঙ্করভাবে বিঁধে রয়েছে লম্বা তীর। পুরো শরীর ক্ষতবিক্ষত। আর কিছু না দেখে মুহূর্তের মধ্যে টর্চ নিভিয়ে দিলেন বাস্তব বৈদ্য। সঙ্গে সঙ্গে নিলেন ইউ টার্ন। ফোর্স এবং সিপিআইএম বাহিনীটাকে নিয়ে সরে গেলেন অন্যদিকে। সেকেন্ডের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, এই পরিস্থিতিতে মৃতদেহ উদ্ধার করা যাবে না। তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, বাসু ভকতের মৃতদেহ উদ্ধার হলেই সিপিআইএমের লোকজন তা নেওয়ার চেষ্টা করবে। তারপর সেই মৃতদেহ নিয়ে শাসক দলের মিছিল থেকে শুরু করে গোটা এলাকায় যে পরিস্থিতি তৈরি হবে পরদিন থেকে, তা আর সামলানো যাবে না। আগুন জ্বলবে পুরো ঝাড়গ্রাম মহকুমায়। বাসু ভকতের মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতার খুনের বদলা এবং তাকে কেন্দ্র করে শুরু হবে চূড়ান্ত অরাজকতা, নৈরাজ্য। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি।
কিছুক্ষণ জঙ্গলের মধ্যে এদিক ওদিক ঘুরে বড় রাস্তায় গিয়ে উঠলেন ঝাড়গ্রামের এসডিপিও। সিপিআইএম ক্যাডারদের আগে এখান থেকে সরানো দরকার। নয়তো মৃতদেহ উদ্ধার করা অসম্ভব। কিন্তু বুঝতে পারছেন, বললেই সিপিআইএম বাহিনীটা এলাকা ছেড়ে যাবে না। এদিকে যা করার করতে হবে রাতের অন্ধকারেই। ভোর হয়ে গেলে মুশকিল। সিপিআইএমের ভিড়টাকে বললেন, ‘এই রাতের অন্ধকারে জঙ্গলে খোঁজাখুজি করা যাবে না। যা করার করতে হবে কাল সকালে। আপনারা সব চলে যান। কাল সকালে আসবেন। আমরাও থানায় যাচ্ছি। এখানে পিকেটিং থাকুক।’ এই বলে এসডিপিও গাড়িতে উঠলেন। গাড়িতে উঠেই জেলার পুলিশ সুপারকে ওয়্যারলেসে জানালেন, ‘স্যার, হি ইজ নো মোর।’
রাত প্রায় সাড়ে ১১টা। জামবনি থানায় ফিরল পুলিশের টিমটা। থানায় এসপি, ডিআইজি বসে।
‘স্যার, বডি দেখে এসেছি।’
‘শিওর? মারা গেছে?’
‘হ্যাঁ স্যার। বুকে তীর। পুরো শরীরে রক্ত। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। রাতেই বডি তুলে আনতে হবে। কাল বড়ো ঝামেলা হতে পারে।’
জামবনি লোকাল কমিটির সম্পাদক বাসু ভকতের মৃত্যুর খবর মাঝরাতেই পাঠানো হল কলকাতায়। মহাকরণের প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে চাওয়া হল অতিরিক্ত ফোর্স। যত দ্রুত সম্ভব। ঝাড়গ্রাম মহকুমায় প্রায় সমস্ত এলাকায় ফোর্স মোতায়েন করতে হবে হিংসা-প্রতিহিংসা ঠেকাতে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, এসডিপিও ভেবেছিলেন, অত রাতে সিপিআইএমের ছেলেরা বাড়ি ফিরে যাবে। কিন্তু কোথায় কী? কয়েক’শো ছেলে মাঝরাতেও থানার বাইরে দাঁড়িয়ে। রাত প্রায় দেড়টা। জামবনি থানার অফিসাররা ততক্ষণে বুঝে গিয়েছেন, সিপিআইএমের বাহিনীটাকে আর সরানো যাবে না। কিন্তু সময়ও নেই বেশি। দিনের আলো একবার ফুটে গেলে এই জমায়েতটাই কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। এখনই করতে হবে যা করার। ফের থানা থেকে বেরলেন কয়েকজন অফিয়ার। এবং যথারীতি আবারও তাঁদের পিছু নিলেন সিপিআইএমের লোকজন। বাসু ভকতের অনুগামীরা।
রাত প্রায় দুটো। আবার পাঁচামির জঙ্গলের ধারে আগের জায়গায় ফিরল পুলিশের লম্বা কনভয়। টর্চ হাতে জঙ্গলে ঢুকলেন এসডিপিও। ঝাড়গ্রাম থানার ওসিকে বলাই ছিল, পিও’তে (প্লেস অফ অকারেন্স) পৌঁছেই ৩-৪ জন পুলিশ কর্মী মুহূর্তের মধ্যে বাসু ভকতের মৃতদেহ তুলে অন্ধকারে নিঃশব্দে গাড়িতে গিয়ে রাখবেন। বাস্তব বৈদ্য টর্চ নিয়ে আগে গিয়ে মৃতদেহ দেখিয়ে দিয়েই একটু পাশে সরে যাবেন। তাঁর পেছন পেছন সিপিআইএম বাহিনীটা সরে গেলেই পুলিশের ৩-৪ জন অন্ধকারে মৃতদেহ নিয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে গাড়িতে রাখবে। বড় রাস্তা থেকে জঙ্গলে ঢুকে এগোচ্ছেন বাস্তব বৈদ্য। সঙ্গে ৮-১০ জন পুলিশ অফিসার এবং সিপিআইএম বাহিনী। ১০ মিনিট, ১৫ মিনিট, আধ ঘন্টা টর্চ জ্বালিয়ে জঙ্গলে ঘুরছেন এদিক ওদিক। কিন্তু মৃতদেহ নেই। কোত্থাও দেখা যাচ্ছে না বাসু ভকতের মৃতদেহ। অথচ কিছুক্ষণ আগেও নিজের চোখে দেখে গিয়েছেন। মেরুদণ্ড দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে পুলিশ অফিসারদের। মৃতদেহ গায়েব? কীভাবে সম্ভব? কে নিয়ে গেল বাসু ভকতের মৃতদেহ? মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে হাজারো চিন্তা। কলকাতা থেকে ফোর্স রওনা দিয়েছে। সিনিয়র অফিসাররা সবাই জেনে গিয়েছেন সিপিআইএমের জামবনি লোকাল কমিটির সম্পাদকের খুনের কথা। এই অবস্থায় মৃতদেহ উধাও? প্রায় মিনিট চল্লিশেক জঙ্গলের মধ্যে এলোমেলো ঘোরাঘুরি করে বড় রাস্তায় গিয়ে উঠল এসডিপিওর নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী। এবং বড় রাস্তায় উঠেই বাস্তব বৈদ্য বুঝলেন, অন্ধকারে ভুল রাস্তা দিয়ে জঙ্গলে ঢুকেছিলেন।
বড়ো রাস্তা থেকে আবার জঙ্গলে ঢুকলেন সিঙ্গল লাইন ফর্মেশন করে। প্রথমবার যে জায়গা দিয়ে ঢুকেছিলেন সেখান থেকে। এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পেয়ে গেলেন বাসু ভকতের মৃতদেহ। একইভাবে মাটিতে পড়ে রয়েছে। ঝাড়গ্রাম থানার ওসি দীপক সরকারকে বোঝানোই ছিল সব কিছু। তাঁকে ইশারায় মৃতদেহ দেখিয়েই ঘুরে অন্যদিকে এগোলেন এসডিপিও। তাঁর পেছনে পেছনে চলেছে সিপিআইএমের ৪০-৫০ জন। এসডিপিও সিপিআইএম বাহিনীটাকে নিয়ে অন্যদিকে কয়েক পা এগোতেই অন্ধকারে বাসু ভকতের মৃতদেহ চার পুলিশ কর্মী সন্তর্পনে তুলে নিয়ে গিয়ে রাখলেন গাড়িতে। এক মুহূর্তের মধ্যে সেই গাড়ি সিপিআইএমের জামবনি লোকাল কমিটির সম্পাদকের মৃতদেহ নিয়ে রওনা দিল ঝাড়গ্রাম শহরের দিকে। ঝাড়গ্রাম পুলিশ ফাঁড়ি হয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই বাসু ভকতের দেহ পাঠিয়ে দেওয়া হল ঝাড়গ্রাম হাসপাতালের মর্গে।
জামবনির দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিআইএম নেতা বাসু ভকতের মৃতদেহ নিয়ে পুলিশের গাড়ি ঝাড়গ্রাম শহরের দিকে রওনা দেওয়ার পর অন্তত প্রথম চিন্তাটা কাটল পুলিশের সিনিয়র অফিসারদের। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোর হবে। এবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা বাকি। এই খুনকে কেন্দ্র করে হিংসা-প্রতিহিংসা যেন শুরু না হয়ে যায় সিপিআইএম এবং ঝাড়খন্ড পার্টির মধ্যে। তার প্রস্তুতি নিতে হবে। পাঁচামির জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ঘন অন্ধকারে বড় রাস্তায় নিজের গাড়ির সামনে দিয়ে দাঁড়ালেন ঝাড়গ্রামের এসডিপিও। সিপিআইএম নেতা-কর্মীরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে। তাঁদেরই একজন, এলাকায় পরিচিত ভাই নামে, তাঁকে আলাদা করে ডেকে নিলেন বাস্তব বৈদ্য। জানিয়ে দিলেন বাসু ভকতকে খুনের কথা। বললেন, বাসু ভকতের মৃতদেহ এই মাত্র পাঠানো হয়েছে ঝাড়গ্রাম শহরে।
‘এটা স্যার হওয়ারই ছিল। একদিন না একদিন তো মরার কথাই ছিল।’
বিশ সেকেন্ড নীরবতার পর স্বগোতক্তির মতো উত্তর দিলেন ভাই। যেন জানতেন বাসু ভকতের জীবনের অনিবার্য পরিণতির কথা।
পুলিশ অফিসাররা বুঝলেন, বাসু ভকতের ব্যাপারে তাঁরই অনুগামীদের ঠিক কী মূল্যায়ন!
কিন্তু কীভাবে ঘটল এই ঘটনা? মেদিনীপুরে জঙ্গল এলাকায় সিপিআইএমের সবচেয়ে শক্তিশালী মুখ তখন বাসু ভকত। সব সময় সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনী, নিজের কাছে রিভলভার! সেই সময় জামবনির প্রতিটা বাচ্চা-বুড়ো থেকে শুরু করে গোটা ঝাড়গ্রাম মহকুমা জানে, অস্ত্র এই এলাকার রাজনীতিতে শেষ কথা। আর অস্ত্র উঁচিয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের যে রাজনীতি, তার শেষ কথা বাসু ভকত। রাজ্যের অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া এবং বিহার লাগোয়া এক ব্লকে বাসু ভকতের উত্থান সাতের দশকে। আদিবাসী অধ্যুষিত হতদরিদ্র মানুষের বসবাস যে এলাকায় সেই এলাকার নেতা বাসু ভকত। কিন্তু কেন নৃশংসভাবে খুন হতে হল তাঁকে?
গরিব প্রান্তিক মানুষের স্বাভাবিক সমর্থন যে পার্টির সেরা সম্পদ তার নেতাকে কেন দরিদ্র, আদিবাসী মানুষের সমর্থন আদায়ের জন্য অস্ত্র ধরতে হয়, সেই প্রশ্নের ভেতরেই লুকিয়ে রয়েছে এর জবাব। কেন বাড়ি ছেড়ে লোকাল কমিটির অফিসে জীবন কাটানো নেতা বাসু ভকতকে গরিব, আদিবাসী মানুষের হাতে নৃশংসভাবে খুন হতে হয় একুশ শতকের গোঁড়ায়, তারও উত্তর মিলবে একই প্রশ্নে। গণতন্ত্রের উৎসব নির্বাচনের দিন কেন এই হত্যার রাজনীতি? কেন অগণতান্ত্রিক এবং অসংসদীয় রাজনীতির অনুশীলন? বাসু ভকতের খুন কি রাজনৈতিক হিংসা না প্রতিহিংসা? নির্বাচনের দিন অস্ত্রের আধিপত্য, বুথ দখল, বিরোধী শূন্য বুথের পরম্পরা, খুনোখুনির যে ঐতিহ্য এ’রাজ্যের গণতান্ত্রিক পরিবেশে যুক্ত হয়েছিল, তার সঙ্গে কি কোনও যোগ রয়েছে ২০০৩ পঞ্চায়েত নির্বাচনের সন্ধ্যায় সিপিআইএমের জামবনি লোকাল কমিটির সম্পাদককে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনার!
এই সমস্ত প্রশ্নের হদিস করার আগে দেখে নেওয়া জরুরি, কীভাবে সেদিন ঝাড়খন্ড পার্টির সমর্থকদের হাতে খুন হয়েছিলেন বাসু ভকত?
এক অচেনা ব্যক্তির ফোনে যে খবরটা সকালে জামবনি থানায় এসেছিল, তার সূত্র ধরে দুবরা গ্রাম থেকে একটা গাড়িকে দুপুরেই ধরেছিল পুলিশ। কিন্তু হদিশ পাওয়া যাচ্ছিল না দ্বিতীয় গাড়িটার। এরই মধ্যে বিকেল থেকে সেই গাড়িটার কথা আর মাথায়ও আসেনি পুলিশ অফিসারদের। নির্বিঘ্নে ভোট শেষ করানো, সমস্ত বুথ থেকে ব্যালট বাক্স আনানো এবং সেই পর্ব মিটতে না মিটতেই বাসু ভকতের নিরুদ্দেশের খবর। আর সন্ধে থেকে ভোর রাত হয়ে গেল বাসু ভকতের মৃতদেহ উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠাতে।
ভোটের পরদিন বাসু ভকতের খুনের তদন্তে নামল ঝাড়গ্রাম পুলিশ। তদন্তে উঠে এল চমকপ্রদ তথ্য। তদন্তে অফিসাররা জানতে পারলেন, গড়বেতার দ্বিতীয় গাড়িটা ছিল বাসু ভকতের সঙ্গে।
সকাল থেকেই জামবনির নানা বুথে ঘুরে ভোটের তদারকি করছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে ছিল গড়বেতার একটা গাড়ি, তাতে সশস্ত্র ৫-৬ জন। দুপুরের পর তাদের নিয়ে গিধনির দিকে যান বাসু ভকত। বিকেলে তিনি আবার পরিহাটি হয়ে চলে যান চিঁচিড়ার দিকে। মাঝখানে বম্বে রোড়ের ধারে চিঁচিড়াতে এক জায়গায় তাঁরা খাওয়াদাওয়া করেন। তারপরই দুপুর ৩টে নাগাদ গড়বেতার দ্বিতীয় গাড়ির লোকজনের কাছে অন্য গাড়িটি ধরা পড়ার খবর পৌঁছয়। প্রায় একই সময় জেলার এক সিপিআইএম নেতা ফোন করেন বাসু ভকতকে। তাঁকে বলেন, একটা গাড়ি ধরা পড়েছে, পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় করছে গড়বেতার অন্য গাড়িটার খোঁজে। তিনি যেন গড়বেতার গাড়িটাকে সঙ্গে নিয়ে না ঘোরাফেরা করেন। আর তাদের সঙ্গে থাকা বন্দুকও সরিয়ে ফেলার জন্য বাসু ভকতকে নির্দেশ দেন জেলার ওই নেতা। বন্দুকসহ বাইরের ছেলে জামবনিতে ধরা পড়ে গেলে খারাপ হবে। সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে যান বাসু ভকত। খাওয়াদাওয়ার পর গাড়িতে থাকা বন্দুকগুলো চিঁচিড়াতেই এক নিরাপদ জায়গায় রেখে দেন তিনি। ঠিক হয়, ভোট মিটে গেলে দু’একদিন বাদে সেগুলো গড়বেতায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। পুলিশের কাছে যখন একবার খবর পৌঁছে গিয়েছে, এত বন্দুক গাড়িতে রাখা ঠিক হবে না। তাছাড়া ভোটও প্রায় শেষ লগ্নে। লম্বা বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামছে। গড়বেতার ছেলেদের ছেড়ে দিলেন বাসু ভকত। গড়বেতার গাড়ি জামবনি ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
গড়বেতা বাহিনীকে ছেড়ে নিজের গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে সামনের সিটে বসলেন বাসু ভকত। ড্রাইভার আর নিজের মাঝে রাখা তাঁর নিজস্ব রিভলভার। পুলিশও জানত, নিজের নিরাপত্তার জন্য সব সব সময় রিভলভার নিয়ে ঘোরেন তিনি। গাড়ির পেছনের সিটে দু’তিনজন স্থানীয় সিপিআইএম কর্মী। যাঁরা তাঁর একদম নিজস্ব লোক। এরপর বাসু ভকতের গাড়ি রওনা দিল জামবনির দিকে। ভোট তো প্রায় শেষ। এবার জামবনি পার্টি অফিসে বসে সমস্ত বুথের ভোটের খবর নিতে হবে। ব্যালট পেপার বেরতে শুরু করবে বুথ থেকে। অনেক কাজ বাকি এখনও।
ঝুপ করে অন্ধকার নামল জঙ্গলমহলে। সাপধরা বুথ পেরিয়ে বাসু ভকতের গাড়ি এগোচ্ছে পিচ রাস্তা ধরে, জামবনির দিকে। জঙ্গলে আবছা অন্ধকারে বাসু ভকত কিংবা চালক গাড়ির দূর থেকে দেখতেও পেলেন না, গাছের গুঁড়ি ফেলে রাস্তা আটকে রেখেছে ঝাড়খন্ড পার্টির লোকজন। বিকেল থেকেই রাস্তার ধারে গাছের আড়ালে অপেক্ষা করছিল প্রচুর মহিলা-পুরষ এবং তীর, ধনুক নিয়ে সশস্ত্র ঝাড়খন্ডি বাহিনী। সরকারি গাড়ি গাছের গুঁড়ির সামনে থামলেই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ব্যালট বাক্স নিয়ে চম্পট দেবে তারা। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটের সন্ধ্যায় ব্যালট বাক্সের গাড়ি নয়, পাঁচামির জঙ্গলের ধারে ঝাড়খন্ডিদের তৈরি করা ব্যারিকেডের সামনে এসে থামল বাসুদেব ভকতের গাড়ি।
আটের দশকের প্রায় মাঝামাঝি থেকেই বেলপাহাড়ি, বিনপুর, জামবনির গ্রামে গ্রামে যে ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক হিংসা এবং সংঘর্ষের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল ঝাড়খন্ড পার্টি এবং সিপিআইএমের মধ্যে, তাতে সেই সন্ধ্যায় একশো বুথের ব্যালট বাক্স পেয়ে গেলেও ওই জমায়েতটা এত খুশি হোত না, যতটা তারা হয়েছিল শাসক দলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতাকে হাতের কাছে পেয়ে। ব্যালট বাক্সের গাড়ি ভেবে মহিলা এবং পুরুষদের ভিড়টা মুহূর্তের মধ্যে ঘিরে ফেলল সিপিআইএম নেতার গাড়ি। আর সেকেন্ডের মধ্যে একজন অন্ধকারেই চিনে নিলেন বাসু ভকতকে। এমন একজন বাসু ভকতকে চিনে ফেললেন, ঝাড়খন্ড পার্টি করার অপরাধে যাঁর বাড়ি কয়েকদিন আগে পুড়িয়ে দিয়েছিল সিপিআইএম বাহিনী। তিনি বাসু ভকতকে চিনতেন। তাঁকে দেখেই তিনি চিৎকার করতে শুরু করেন। কেন তাঁর বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছিল, কৈফিয়ত দাবি করেন বাসু ভকতের কাছে। হতভম্ব বাসু ভকত কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁকে টেনে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিল সশস্ত্র ঝাড়খন্ডি বাহিনী। সিটের পাশে রাখা রিভলভার হাতে তোলার সময়ই পেলেন না তিনি। এক’দু মিনিটের মামলা, গাড়ির চালক এবং পেছনের সিটে বসে থাকা দুই দলীয় কর্মী কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাসু ভকতকে মারতে মারতে পাঁচামির জঙ্গলের ভেতরে টেনে নিয়ে গেল ঝাড়খন্ডিরা। হিংস্র নেকড়ের দল যেভাবে বড় শিকার পেলে আর তুচ্ছ প্রাণীর দিকে ফিরেও তাকায় না, সেই মানসিকতা থেকেই হয়তো কিংবা মুহূর্তের উত্তেজনায় গাড়ির বাকিদের গায়ে হাতও দিল না তারা। গাছের গুঁড়ি সরিয়ে বাসু ভকতকে ছাড়াই তাঁর গাড়ি রওনা দিল জামবনির দিকে।
এর পরের ঘটনা ভয়ঙ্কর। বল্লম, তির দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হল বাসু ভকতকে। তারপর মাত্র কয়েক ফুট দূর থেকে তির ছোড়া হল তাঁর বুকে। ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত বাসু ভকতের মৃতদেহ পড়ে রইল পাঁচামির জঙ্গলে। বাসু ভকতের মৃতদেহে সর্বত্র প্রতিশোধের চিহ্ন স্পষ্ট। জঙ্গলমহলে হিংসা-প্রতিহিংসার রাজনীতিতে একটা ছোট্ট বৃত্ত সম্পুর্ণ হল! কিন্তু বৃহত্তর কিছু প্রশ্ন তুলে দিল ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোট এবং বাসু ভকতের হত্যা। জামবনির একইসঙ্গে জনপ্রিয় এবং দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিআইএম নেতার খুন ক্রিয়া না প্রতিক্রিয়া?
সিপিআইএম নেতা এবং জামবনি লোকাল কমিটির সম্পাদক বাসুদেব ভকতের মৃত্যু সামান্য একটা খুন ছিল না ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের দিন। আসলে ২০০৩ এর পঞ্চায়েত ভোটের দিন রাজ্যের তিনটে জেলায় সকাল থেকে পৃথক পৃথক বিরোধী দলের সঙ্গে নিরবিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ হচ্ছিল শাসক দলের। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর, কুলতলি, ক্যানিং এলাকায় সিপিআইএমের সঙ্গে মারাত্মক সংঘর্ষ হয় এসইউসিআইয়ের। মুর্শিদাবাদের ডোমকলসহ বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ হয় সিপিআইএমের সঙ্গে কংগ্রেসের এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রামে সিপিআইএমের সঙ্গে ঝাড়খন্ড পার্টির। গ্রাম পঞ্চায়েত এবং জেলা পরিষদের আসনে বিরোধী দলের অস্তিত্ব থাকবে না এবং রাজ্যজুড়ে নিজেদের এক দলীয় শাসন ব্যাবস্থা কায়েম করাই তখন সিপিআইএমের একমাত্র রাজনৈতিক লক্ষ্য। জ্যোতি বসু তখন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। দলে এবং সরকারে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রভাব সেই সময় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিপিআইএম রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রসে তৈরির পর আচমকা একটা রাজনৈতিক ধাক্কার মুখোমুখি হয়েছিল বটে ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। সরকার থাকবে কিনা সেই প্রশ্নও উঠে গিয়েছিল সিপিআইএম নেতৃত্বের একটা বড় অংশের মধ্যে। কিন্তু ২০০১ বিধানসভা ভোটে তা সামলে ওঠা গেছে। আর সেই বিধানসভা ভোটে ‘হয় এবার, নয় নেভার’ স্লোগান তুলে বিপর্যস্ত হওয়ার পর তৃণমূল কংগ্রেসের তখন এমনই ৩০ রানে আট উইকেট অবস্থা, ২০০৩ পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্যের বহু গ্রামে তারা প্রার্থীই দিতে পারেনি। প্রায় বিরোধীহীন দক্ষিণবঙ্গে সিপিআইএমের অশ্বমেধের ঘোড়াকে যে দু’তিনটে পয়েন্টে এসইউসিআই, কংগ্রেস কিংবা ঝাড়খন্ড পার্টি থামানোর চেষ্টা করেছে, সেই এলাকাই রক্তাক্ত হয়েছে। কিন্তু ওই পঞ্চায়েত ভোটের দিন মুর্শিদাবাদের ডোমকল কিংবা দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর, কুলতলিতে কংগ্রেস এবং এসইউসিআইএমের সঙ্গে লড়াইয়ের থেকেও ঝাড়গ্রামে ঝাড়খন্ডিদের সঙ্গে সিপিআইএমের লড়াইয়ের একটা মৌলিক ফারাক ছিল। ডোমকল, জয়নগর কিংবা কুলতলিতে বিরোধীদের কাছে লড়াইটা ছিল কয়েকটা মাত্র গ্রাম পঞ্চায়েত দখলের, আর ঝাড়গ্রামের লড়াইটা ছিল শাসক দল সিপিআইএমকে নিকেষ করার। তাই সেদিন সিপিআইএমের জামবনি লোকাল কমিটির সম্পাদক বাসু ভকতের নৃশংস খুন মামুলি একটা ব্যাপার ছিল না। বরং বিরোধী মতকে খতম করে গণতন্ত্র-বিপরীত যে পরম্পরা, ঐতিহ্য সিপিআইএম উত্তর বাংলা বহন করছে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকেও, তার সূত্রপাত হয়েছিল বহু বছর আগে সিপিআইএম জমানাতেই, যা শত পুষ্পে বিকশিত হল ২০০১ এর বিধানসভা নির্বাচন থেকে শুরু করে দু’বছর পরের পঞ্চায়েত ভোট পর্যন্ত। এই গাছের চারা এমন একটা সময় অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রামে পোঁতা হয়েছিল, যখন উদার অর্থনীতি চালু হয়নি দেশে, বাবরি মসজিদও ভেঙে পড়েনি উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদ জেলায়। বাসু ভকতের মৃত্যু কারণ সন্ধানে এবার আমার ডেস্টিনেশন ঝাড়গ্রামের জামবনি ব্লক।
কারণ, কিষেণজি মৃত্যু রহস্যের সন্ধান করতে হলে সিপিআইএম নেতা বাসুদেব ভকতের হত্যার কারণও জানা জরুরি। পৃথক রাজ্যের দাবি নিয়ে আটের দশকের গোড়া থেকে তীব্র আন্দোলন শুরু না হলে যেমনভাবে ঝাড়গ্রামে বাসু ভকতের নেতৃত্বে সিপিআইএমের আধিপত্যবাদের রাজনীতির দরকার পড়ে না, তেমনই বাসু ভকত না থাকলে কিষেণজির নির্বিচারে ব্যক্তি হত্যার রাজনীতিও জঙ্গলমহলে সামাজিক স্বীকৃতি পায় না একটা সময় পর্যন্ত। আর কিষেণজির নেতৃত্বে শুরু হওয়া এই ব্যক্তি হত্যার রাজনীতি যে কতটা কাউন্টার প্রোডাকটিভ হতে পারে, তা জঙ্গলহল সুদে-আসলে তাঁকে ফেরত দিয়েছে ২৪ নভেম্বর ২০১১। সেই জামবনি, যেখানে দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিআইএম নেতা বাসু ভকতকে ২০০৩ সালে খুন হতে হয়, সেই জামবনিই সাক্ষী থাকে ২০১১র নভেম্বরে আরও এক মৃত্যুর! মাঝে মাত্র আট বছরের ব্যবধান।
ক্রমশ।..
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।