এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  প্রবন্ধ

  • জাগা, জেগে থাকাও একটা ধর্ম: শঙ্খ ঘোষ 

    Eman Bhasha লেখকের গ্রাহক হোন
    প্রবন্ধ | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ৬৯৫ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • মুণ্ডমালায় ওই হেঁটে যায়
    দশ বছরের দেনা
    বুড়ি শুধু ডাকে: ও বাপু ছেলেরা
    কেউ কিছু বলবে না?

    এতো 'দশক'-এর শুধু নয়, শতাব্দীর কথা। আমার জানা এক প্রবীণা আছেন, যাঁর ঘুম হচ্ছে না, কেন জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ভয়ঙ্কর স্মৃতি মুছে ফেলার বিরুদ্ধে কেউ কিছু তেমন বলছে না, করছে না পশ্চিমবঙ্গে।
    শঙ্খ ঘোষ কবেই লিখেছেন, এই কবিতা, বোবা দর্শক বেড়ে যাচ্ছে, সবাই নিজেকে নিয়ে চিন্তিত ও ব্যস্ত, সমাজ সংস্কৃতি দেশ খারাপ থাকলে তিনিও যে ভালো থাকবেন না, থাকতে পারবেন না-- এই বোধটাই অনুপস্থিত।
    শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন:
    তোমার কোন ধর্ম নেই, শুধু
    শিকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরা ছাড়া
    ....
    তোমার কোন ধর্ম নেই, এই শূন্যতাকে ভরিয়ে দেওয়া ছাড়া।
    'ত্রিতাল'-এর কথা কি শুধু? এতো বহু তালের বহু কালের কণ্ঠ।


    শঙ্খ ঘোষের নাম শুনেছি, ১৯৭৬ এ শীতের রাতে। বাবা দাদা ও দাদার এক বন্ধু এবং বাবার র এক অনুগামীর সঙ্গে আলাপে।
    জরুরি অবস্থা চলছে।
    গভীর রাতে গোপন বৈঠক।
    কী করণীয়?
    বললেন, সব বিয়ে বাড়িতে শঙ্খ ঘোষের কবিতার বই 'বাবরের প্রার্থনা' দাও। দিনেশ দাশের 'কাস্তে' দিলে সন্দেহ ও ঝামেলা করবে, কংগ্রেসের লোকরা মাথামোটা, শঙ্খ ঘোষ বুঝবে না।
    যাঁকে দেওয়া সে ঠিক বুঝবে।

    পালা বদলের পর যত আবৃত্তি প্রতিযোগিতা হতো আমাদের এলাকায়, সব জায়গায়, যমুনাবতী সরস্বতী বাঁধা।
    আমার মনে আছে, বাবা যখন ফেরার, সংগঠন করায় মিথ্যা মামলার দায়ে,  আমি পড়ছিলাম,
    'হাসপাতালে বলির বাজনা/ আমার ভাই ছিল ফেরার' মা ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন।
    আমার ভালো লাগতো, ব্রিগেডের মাঠে হেঁটে গেল দুই যুবক যুবতী শিরস্ত্রাণহীন।
    ব্রিগেড দেখার পটভূমিটাই বদলে দেন শঙ্খ ঘোষ। আমি আর গায়ক চিকিৎসক ক্ষেত্রমাধব দাস সন্ধ্যাবেলায় কতবার হেঁটেছি ব্রিগেডিয়ার হয়ে, ব্রিগেডের ঘাসে।
    ৪.
    শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে সরাসরি আলাপ ১৯৮৯ । অগ্রজ কবি জয়দেব বসুর সঙ্গে। আমার বিশ্বাস ছিল, কবি লেখক সাহিত্যিকরা লেখেন ভালো, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে বোধহয় আলাদা। যা লেখেন, তা করেন না। এড়িয়ে চলায় বিশ্বাস তাই।
    পরে অশোক মিত্র শঙ্খ ঘোষ অমিয় বাগচী অরুণ মিত্র অন্নদাশঙ্কর রায়, তরুণ সান্যাল, তপন রায়চৌধুরী, দেবাশিস ভট্টাচার্যসহ বহু লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে। দেখেছি, মানুষ হিসেবে এঁরা অনেক মহৎ।
    শঙ্খ ঘোষ অশোক মিত্র শামসুজ্জামান খান অমিয় বাগচী আমার পিতৃপ্রতিম মানুষ।
    শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে গেলাম রবিবারের এক আড্ডায়। তখন প্রতি শনিবার কলকাতা এসে কফি হাউসের আড্ডা, রাতে থেকে পরদিন সকালে শঙ্খ ঘোষের বাড়ি।
    ওই আড্ডার মান ছিল তখন বেশ উন্নত।
    আমাদের প্রিয় অধ্যাপক বিজিতকুমার দত্ত, অশ্রুকুমার শিকদারকে দেখেছি ওই আড্ডায় তর্ক-বিতর্কে। আমরা মূলত শ্রোতা। তবে বর্ধমানের পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইতেন।  একবার বিজিত বাবুর মুখে আমি কবিতা লিখি শুনে বললেন একটা কবিতা পড়ো।
    পড়লাম।
    প্রতিভাবান বিষয়ক প্রশস্তিমালা

    বুদ্ধিহীনেরাই শুধু প্রশ্ন করে অনর্থক
    বুদ্ধিমানেরা প্রশ্নও করে না উত্তরও দেয় না
    তারাই প্রতিভাবান যারা শুধু ঘাড় নাড়ে।
    উনি 'বাহ' বলায় লেখার উৎসাহ বাড়ল।
    ২০১৮ তে এ উনি আমাকে ১৯৯১,এ প্রকাশিত আমার কাব্য গ্রন্থ 'বর্শাফলক স্নান করছে' বের করে দেখানোয় আমি চমকে যাই। প্রত্যেকের দেওয়া বই এত যত্ন করে রাখতেন উনি-- শেখার বিষয়।
    সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের 'কূকুর সম্পর্কে দুটো একটা কথা যা আমি জানি' নিয়ে আড্ডা সরগরম।
    আমিও একটু মতামত দিলাম সাহস করে। প্রচলিত কথার বিরুদ্ধেই ছিল মতটা,  উনি বললেন, ওই জন্যই তো আলোচনা।
    ১৯৮৯ এ আমরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একটা সংখ্যা করার সিদ্ধান্ত নিই কফি হাউসের আড্ডায়। অঞ্জন মুখোপাধ্যায় আর পার্থ মুখোপাধ্যায়কে সম্পাদক করে। সেখানে স্যারের লেখা চাই। দেন।
    এরপর ২০০১ থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে কিছু লিখলে কয়েকজন স্যারকে গিয়ে দাগ দিয়ে দিয়ে দেখানো শুরু করে, দেখুন, ইমানুল কী লিখছে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে।
    উনি কিন্তু একটা কথাও বলেন নি আমাকে।
    রাজনীতি নিয়ে আমার মতামত প্রথম দিকে তেমন পছন্দ হতো না স্যারের। স্রোতের বিপরীতে বলছি। কিন্তু ২০০১থেকে আমার মত মিলতে শুরু করে স্যারের সঙ্গে। শিলিগুড়িতে ২৬ জন নকশাল আন্দোলনের কর্মী গ্রেপ্তার হলো, লেনিনের 'কী করিতে হইবে' রাখার অপরাধে।
    তিনজন বিবৃতিতে সই করলেন অশোক মিত্র, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ।
    ২০০২-এ গুজরাট গণহত্যার পর একসঙ্গে বহু কর্মসূচি।
    রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে পয়সা তুলেছেন আমাদের সঙ্গে। ছয় এপ্রিল ২০০২ ধর্মতলায় মেট্রো স্টেশনের সামনে দিয়ে শুরু। এরপর রাজাবাজার, রিপন স্ট্রিট, মেটিয়াবুরুজ, ভবানীপুর, কলেজ স্ট্রিট, রবীন্দ্র সদন, শ্যামবাজার, খান্না -- ৪০ জায়গায় সভা মিছিল করে গণহত্যা পীড়িতদের জন্য পয়সা তোলা। পয়সার কৌটো রাখা থাকতো স্যারের বাড়িতে। আর ব্যানার পোস্টার আমি নিয়ে যেতাম বাগুইআটিতে।
    আমাদের সঙ্গে মিলে খুচরো পয়সা গুনতেন তিনি। এক লাখ ৩৬ হাজার টাকার খুচরো। ২ পয়সা থেকে পাঁচ টাকা সব আছে।
    ৫ পয়সা ১০ পয়সা ২০ পয়সা ২৫ পয়সা আট আনাই বেশি। গোনার কত ঝামেলা।
    স্যারের ভ্রূক্ষেপ নেই।
    গুজরাট সংহতি সমিতি গড়ে তোলা হয় স্যারের বাড়িতে একাধিক বৈঠক করে। আমি আর সাংবাদিক মধুদা/ বিশ্বজিৎ রায় সবচেয়ে বেশি উদ্যোগ নিই। প্রথমে ঠিক হল, আমি সম্পাদক প্রতুল মুখোপাধ্যায় কোষাধ্যক্ষ।
    রবীন্দ্র সদনে একটা নাগরিক সভা হলো চার এপ্রিল মূলত ভাষা ও চেতনা সমিতির ডাকে। সেই সভায় বাংলার প্রায় সমস্ত বুদ্ধিজীবী হাজির হন।
    সেখান থেকে ফিরে দেবেশ রায় এবং জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায় স্যারকে বললেন, দেবেশ রায় সম্পাদক ও জ্যোতিদা কোষাধ্যক্ষ হতে চান। ইমানুল হক আর বিশ্বজিৎ রায় যুগ্ম সম্পাদক হোক।
    স্যার ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, মতামত।
    আমরা বললাম, কাজটা হওয়া জরুরি।
    পদটা নয়।
    এইসময় অনেক অনেক বড় বড় কাজ হয়। নাটকের দলগুলো মিলে ফ্যাসিবাদ বিরোধী নাটক তৈরি করেন। তার সম্পূর্ণ অর্থ তুলে দেন গুজরাট সংহতি সমিতিকে।
    'মেফিস্টো'   অভিনীত হল।
    প্রতিটি শো প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ।
    সুমন মুখোপাধ্যায় পরিচালক। গৌতম হালদার, দেবশঙ্কর হালদার, বিমল চক্রবর্তীসহ বাংলার বহু বিশিষ্ট অভিনেতা অভিনেত্রী এই নাটকে অভিনয় করেন।
    কৌশিক সেন করলেন 'প্রাচ্য' নাটক।
    এই নাটকেই প্রথম অভিনয় করলেন কৌশিক সেনের শিশুপুত্র ঋদ্ধি।
    চিত্রপরিচালক গৌতম হালদার এগিয়ে এলেন। স্যারের বাড়িতে বৈঠক হল।
    আমজাদ আলী খান দুই পুত্রকে নিয়ে রবীন্দ্র সদনে বাজালেন। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে।
    আমাদের কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতসাধক ও স্রষ্টা  কবীর সুমনকে তখন একদল মানুষ ব্যক্তিগত কারণে  কোনঠাসা করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। সাদিকুজ্জামান প্রস্তাব দিলেন কবীর সুমনকে দিয়ে একটা অনুষ্ঠান করার রবীন্দ্র সদনে। উনি একটা পয়সাও নেবেন না। সব টাকাই যাবে গুজরাট ত্রাণে।
    কয়েকজন আপত্তি তুললেন। আমাদের প্রবল আগ্রহে স্যার বললেন, কবীর সুমন গান গাইবেন এতো আনন্দের কথা।
    রবিবার সকাল ১০ টায় গুজরাট গণহত্যার ত্রাণসংগ্রহে কবীর সুমনের অনুষ্ঠান। অনেকদিন পর কবীর সুমন অনুষ্ঠান করছেন।‌ রবীন্দ্র সদন কানায় কানায় পূর্ণ। স্যার জানতেন, আমি সহজে আবদার করি না। করলে ছাড়ি না।
    কবীর সুমনের পর প্রতুল মুখোপাধ্যায়, শুভেন্দু মাইতি, অজিত পাণ্ডে, দোহার, নীলিম গঙ্গোপাধ্যায় চন্দন বসু সহ যে-সব শিল্পীরা এতদিন আমাদের সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়েছেন তাঁদের নিয়ে অনুষ্ঠান। সেখানে স্যারকে রাজি করালাম অনেক কষ্ট করে, আপনি বলবেন।
    হঠাৎ সভা শুরুর একটু আগে এক ব্যক্তি এসে বললেন, অন্য একজন শুরুতে বলবেন। স্যার চুপ করে মেনে নিলেন। আমার ও বিশ্বজিৎদার খুব রাগ হয়ে গেল।
    স্যার বললেন, তোমরা এ-নিয়ে কিছু বলো না।
    আমি শুধু বললাম, ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা।
    উনি স্মিত হাসলেন।
    বললেন, কথা দাও, এ-নিয়ে ওদের কিছু বলবে না।
    বললাম না বটে, মানতেও পারলাম না।
    স্যার গুজরাট সংহতি সমিতির  প্রতিটা প্রকাশ্য সভায় থাকতেন। বলতেন না। ঘরোয়া বৈঠকে কিন্তু স্পষ্ট মত জানাতেন।

    এরপর গুজরাটে টাকা পাঠানো হবে। সিদ্ধান্ত হল, গুজরাট যাওয়া হবে না। টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আমি তীব্র আপত্তি করলাম।
    যাক টাকা ব্যাঙ্ক মারফৎ গেল। কিন্তু ভাষা ও চেতনা সমিতির পক্ষ থেকে আমরা গেলাম গুজরাট। স্যারের সম্মতি নিয়ে, মহাশ্বেতা দেবীও গেলেন। তার আগেই গেছেন অশোক দাশগুপ্ত, তপন মিত্র, দিলীপ রায়, রঞ্জন সেনগুপ্ত। 
    আমরা সেবার হর্ষ মান্দারের উদ্যোগে গোধরা, মেহসানা, শাহ আলম ক্যাম্প সহ বহু জায়গায় যাই। 
    গোধরায় গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করি।
    কবি অশোক বাজপেয়ী, অধ্যাপক অপূর্বানন্দ আমাদের সঙ্গে ছিলেন।
    ওই সময় বরোদার ত্রাণ শিবিরে দেখা হয় নবম শ্রেণির ছাত্রী জাহিরা ও তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে।
    বরোদার বিধায়ক ছিলেন মুসলিম। এবং তিনি বিজেপির লোক। কিন্তু কাউকে বাঁচাতে পারেন নি। বিশিষ্ট সঙ্গীতসাধক ফৈয়াজ খানের মাজার রাতারাতি গুঁড়িয়ে দিয়ে রাস্তা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
    এই যাওয়ার সময় বেলডাঙ্গার নজরুল সঙ্ঘ ত্রাণ পাঠায় আমাদের মারফৎ । তা আমরা গুজরাটের ত্রাণকর্মীদের হাতে তুলে দিই। সান্ত্বনা সেনগুপ্ত ও অধ্যক্ষ  সনৎবাবু মুখ্য ভূমিকা নেন।
    ফিরে আসার পর স্যার বললেন, গিয়ে খুব ভালো করেছো।

    আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসের সামনে ফাঁকা জায়গায় সারাদিন পয়লা বৈশাখ উদযাপন করে আসছি ১৯৯৯ থেকে।
     ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে ঠিক হল, বাংলাদেশের মতো মুখোশ নিয়ে মিছিল হবে।
    ঢাকার মতো এখানেও সরকারি আর্ট কলেজকে যুক্ত করে।
    এ-কাজে প্রয়াত জয়ন্ত চৌধুরী ও তৎকালীন অধ্যক্ষ কমলেশবাবু যথেষ্ট সহায়তা করেন।
    এবং আর্ট কলেজের অধ্যাপকমণ্ডলী ও ছাত্র-ছাত্রীরা বিপুল সহায়তা করেন।
    বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পী সৈয়দ হাসান ইমাম ও তাঁর স্ত্রী নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান এ-দেশে থাকার সময় আমাদের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ছিলেন। নানা বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। আমাদের একজন হয়ে উঠেছিলেন দুজনে। বাংলাদেশ থেকে পড়তে আসা ছাত্র ছাত্রীদের যুক্ত করে দেন আমাদের সঙ্গে। বাংলাদেশ সরকারি চারু ও কারুকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন ছাত্র ছাত্রী মেহেদী, টুটুল এল। ১০ দিন ধরে আমার বাড়িতে থেকে কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের শেখাল মুখোশ বানানো। সেই শুরু কাগজ দিয়ে নানা পশু পাখি র মুখোশ কর্মশালা। পরে একটা দুর্গাপূজাও হল মুখোশ ব্যবহার করে। ঠিক হল, এবার সকালে মিছিল হবে সরকারি আর্ট কলেজের সামনে থেকে।
    শঙ্খ ঘোষ ও আমি মিলে নাম ঠিক করলাম, বৈশাখী যাত্রা। নববর্ষের সকালে সেই হাঁটা শুরু স্যারের। আমার মা এসেছিলেন সেবার।
    মায়ের সঙ্গে আলাপ হল।
    শঙ্খ ঘোষের আমাদের সঙ্গে হাঁটা আমাদের প্রাণিত করেছে। শত ঝঞ্ঝাতেও আমরা সেই বৈশাখী শোভাযাত্রা বজায় রাখতে পেরেছি।
    সারাদিন পয়লা বৈশাখ ও  ২০ ফেব্রুয়ারি সারারাত বাংলা ভাষা উৎসব উদযাপন অনুষ্ঠানে শঙ্খ ঘোষ বহুবার এসেছেন। সব বার উদ্বোধন করেন নি। কিন্তু এসেছেন। উৎসাহ দিয়েছেন।
    ২০০৯ এ আয়লার সময় সুন্দরবন বিপর্যস্ত।
    আমরা মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড ব্যবসায়ী সমিতির আলমগীর ফকিরদের সহায়তায় ত্রাণ নিয়ে গেলাম সুন্দরবনে।
    শঙ্খ ঘোষ সকাল বেলায় এলেন বিজ্ঞান নগরীর সামনে। আমাদের পাশে থাকতে। 
    ভাষা ও চেতনা সমিতি গুজরাট, সুন্দরবন, হাওড়া, হুগলি, মালদা, রায়গঞ্জ,  ইটাহার, কিংবা নেপাল যেখানেই ত্রাণ নিয়ে যাক-- স্যারকে প্রণাম করে যেত।
    ২০০৯ এ আয়লার প্রথম ত্রাণ বিতরণ করে আসার পর স্যারকে জানালাম, সুন্দরবনের বাগবাগানে   ৩২০০ ( বত্রিশ শো) মানুষের একটা যৌথ রান্নাঘর শুরু করে এসেছি। ওখানে তিন চারটা গ্রামে নিজেরা  রান্না করে খাওয়ার কোনো উপায় নাই। শঙ্খ ঘোষ ছাড়া আরেকজন মানুষ ছিলেন অশোক মিত্র। তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করতাম। অশোক দাশগুপ্ত ও দেবাশিস ভট্টাচার্য সব বিষয়ে আমাদের সহায়তা করতেন।
    তখন বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম নিয়ে আমরা ওরা জোর ভাগ।
    ঠিক হল, অশোক মিত্র ও শঙ্খ ঘোষের আহ্বানে ত্রাণ সংগ্রহ হবে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের সামনে থেকে।
    কাকে ডাকা হবে আর কাকে নয়?
    আমি সবাইকে ডাকার পক্ষে।
    শঙ্খ ঘোষও সম্মতি দিলেন। অশোক মিত্র অসুস্থ শরীরে এলেন। নাট্যকার বিভাস চক্রবর্তী ও কবি সুবোধ সরকার তখন দুই শিবিরের অগ্রণী ভূমিকায়।
    দুজনে একসঙ্গে কফি হাউসের দোতলায় উঠে কৌটা নিয়ে আয়লা ত্রাণের জন্য অর্থ সংগ্রহ করলেন। সঙ্গে ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ  সেনগুপ্ত।
    পরে তখন কলকাতার মহানাগরিক বিকাশ ভট্টাচার্য। তাঁকে ত্রাণ সংগ্রহে ডাকা নিয়ে দু একজন আপত্তি করলেন। এবারেও স্যার সহায়।
    বিকাশ ভট্টাচার্য কবি শ্রীজাত, বিনায়ক, অধ্যাপক  সব্যসাচী দেব, অভীক মজুমদারের সঙ্গে মিলে ত্রাণ সংগ্রহ করলেন।
    স্যার সব জায়গায় আছেন। তীব্র রোদ। 
    স্যার ঠায় দাঁড়িয়ে। 
    ছাতা মাথায় নেবেন না। কারণ আমাদের মাথায় ছাতা নেই।

    তিনি যে আমাদের কাছে কত বড়ো ছাতা  ছিলেন বলার নয়।



    ৭.
    এবারেও খুচরো গোনায় স্যার।
    বাগড়ি মার্কেট বড়বাজার থেকে টর্চ, দেশলাই, সাবান, স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে জমা করা হচ্ছে স্যারের বাড়ি। মশারি শত শত-- স্যারের বাড়ি। ভোর পাঁচটার সময় চাল ডাল তেল মশলা কিনে স্যারের বাড়ি থেকে সকালে ওইসব সামগ্রী তুলে দিনের পর দিন গেছি সুন্দরবন।
    স্যারের দুই নাতনি তখন ছোটো, বিপুল উৎসাহে হাত লাগাত স্যারের সঙ্গে জিনিসপত্র বইতে।
    ৮.
    একবার সবাই মিলে যাওয়া হল রান্নাঘর দেখতে এবং সাতজেলিয়া, বড়ো মোল্লাখালি, ছোটো মোল্লাখালি, কুমীরমারীর মতো দুর্গম অঞ্চলে ত্রাণ দিতে। সকাল সকাল বের হওয়া। আমরা চাল ডাল তেল নুন কিনে এসে ভোরে স্যারের বাড়িতে এসে বাকি জিনিস নিয়ে চলছি। সেবার শঙ্খ ঘোষ নিজে চলেছেন আমাদের সঙ্গে।
    কবি সব্যসাচী দেব, লেখক গৌতম সেনগুপ্ত, কবি দীপঙ্কর, অধ্যাপক লেখক অভীক মজুমদার ( সেই কোষাধ্যক্ষ), শিল্পী বিপুল অনু্শ্রী, শান্তনু বেজ, অভিজিৎ, সহ এক বড় একটা দল মিলে যাওয়া হল। বাগবাগানে দুপুরে যৌথ রান্নাঘরে খাওয়া।
    ত্রাণ দেওয়া  শেষ হল রাত নটায়। সাতজেলিয়ায়। দুর্গম অঞ্চল।
    কলকাতা ফিরলাম রাত তিনটায়।
    আমি তো স্যারের পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে কাদা।
    স্যারের কাঁধে মাথা পড়েছে। খেয়াল নেই।
    ঘরের কাছে এসে বললেন, ওঠো।
    স্যার কিন্তু একবারও ঘুমোন নি।

    জাগা, জেগে থাকাও একটা ধর্ম।

    তিনিই তো শিখিয়ে গেছেন।
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • প্রবন্ধ | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ৬৯৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে প্রতিক্রিয়া দিন