গাছের যে অংশ থাকে মাটির ওপরে তাই আমরা দেখি। অর্থাৎ কাণ্ড , শাখা, ডালপালা আর পাতা - ফুল - ফল। আর যা থাকে মাটির নীচে, সেটা অদৃশ্যগোচরই রয়ে যায়। যেমন, শিকড়। শিকড় সন্ধান করতে লাগে.... খুঁজলে পাওয়া যায়। আর না খুঁজলে, বিস্মৃতির অতলে। আমাদের আদত যাপন চিত্রের এক অনুপুঙ্খ ধারা - বিবরণ হিসেবে নয়, ধারণ করে রাখে যে সব পাতা, সে সব পাতাগুলো এক জায়গায় জড়ো করলে হয় ইতিহাস। ইমানুল হকের লেখা 'কাদামাটির হাফলাইফ' সে অর্থে ইতিহাস।
মানুষ যেটা জানে, সেটাই সে মানে না। মানা অর্থে মেনে চলা। আমরা জানি, সমবায়িক জীবনের উত্তরাধিকারই আমাদের যথার্থ উত্তরাধিকার কিন্তু জেনেও সে যে সবসময় আমরা মানি, তা কিন্তু নয়।
কিছু বই থাকে যা অনেকটা আকরগ্রন্থের মত। যা নিয়ে ঠিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চলে না। 'কাদামাটির হাফলাইফ' এই নামকরণটিই তার সপক্ষে।
লেখক নিজেই যখন মুখবন্ধে বলে উঠলেন, 'চিন্তন। মন, মনন। মনোদর্শন, জীবনবোধ, জীবনচর্চা ও যাপনের সমন্বয় লেখা'। তখনই এই বইয়ের গোত্র নির্ধারিত হয়ে যায়।
পর্ব বিভাজনে মোট ১ থেকে ১১৬, যার মধ্যে অনেকটাই উপন্যাসের ধর্মে পর্বগুলো সাজানো। আর লেখক হিসেবে ইমানুল হক বই মুদ্রণ জনিত যে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন, ভাবতে অবাক লাগে - সেটাও ফর্মুলা ব্যতিরেকে। একে ঠিক কৈফিয়ত বলা চলে না। একটা অনুজ্ঞা। এই বাচনেও তাঁর শিক্ষকমনস্কতা প্রবল কিন্তু তা অনেকটাই পাঠকের সঙ্গে একই সমতলে দাঁড়িয়ে।
কী নেই এই বই তে? শুনতে অতিশয়োক্তি লাগবে কিন্তু সত্যি, যে, কি আমাদের সম্পদ ছিল যা আমরা হারিয়েছি আর তার পুনঃনির্মাণ সম্ভব কি না... নিখিল বিশ্বের নিরিখে বাঙালি কোথায় নিজেই তার নিজস্বতা হারাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে তার নিজেরই বিস্মৃতি থেকে আর মননে - সংস্কৃতিতে ও রাজনৈতিক চেতনায় কোথায় এই জাতি "জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন " নিতে পারে - এর উজ্জ্বল আলোকপাত এই বইয়ের বৈশিষ্ট্য। পুঁজিবাদী সংস্কৃতি কে চিনতে না পেরে, তার আগ্রাসন মেনে নিলাম, তরপর সেটাকেই আমাদের নিজের বলে জানলাম - শ্লীলতা অশ্লীলতার মান গুলিয়ে ফেললাম, স্বনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতির বিলোপ সাধন, নিজের খাদ্যাভ্যাস চিনতে না পারা, প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের সিলেবাসযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ, এবং মানুষের জীবন শেষ পর্যন্ত যে সমবায়িক এমন কি রাজনৈতিক দিশা সঠিক না হলে একটা জাতির মেরুদন্ডও যে ক্রমান্বয়ে অবনমিত হয়ে পড়ে - তার জীবন্ত দলিল এই 'কাদামাটির হাফলাইফ '।
এবার কথনের ভঙ্গির কথায় আসি। বড় অন্তর ছোঁয়া - ঠিক বাঙালির মন্ময় রূপটি যেন, নিবিড় - এতটাই স্নিগ্ধ এই বলার ভঙ্গিটি, যেন শৈশব জড়ানো মায়ের কোল, বন্ধুর কাঁধে হাত রাখার বিশ্বাস। সেই অর্থে - গদ্য হলেও, এর বুনন কাব্যধর্মী আর সেই দোষ (পড়ুন গুণ) লেখকের নিজস্ব। ইমানুল হক স্বভাবধর্মেই কবি।
তাই তাঁর গদ্যও চিরটাকাল কাব্যময়। বইয়ের যে কোনো পাতা থেকে, যে কোনো পংক্তি তুলেই তার উদাহরণ দেয়া যাবে, তাই এই উদ্ধৃতি প্রমাণ নিষ্প্রয়োজন।
সাহিত্যের মজা হলো এই, যে, লেখন কোনোদিন, কোনোকালেই নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না । কারণ: স-হিত সাধন হলেই সাহিত্য। লেখক যা জানাতে চান, সেটা সার্বিক হিতসাধনের লক্ষ্যে। তাই তাঁর বাচন অনুজ্ঞাসূচক হতে বাধ্য। কাব্যময়তার প্রসঙ্গ তোলার জন্য একটা ছবির উল্লেখ করতে মন চাইছে :
"বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখি কল্পনার শিল্পী কে। যেমন লুকিয়ে রাখি , গরুর গাড়ি করে আলু বইতে যায় কালো টগর ভাইরা", বা "দেখো দিকিনি কী লিখতে গিয়ে কী সব লিখে ফেললাম, সেই জন্যই বোধহয় বলে আশি তে আসিও না", বা "আলু পোড়া ও আলুর ভবিষ্যত পোড়া", বা "দলে মিশলে মেঘ কথা বলে না", বা "বাথরুমে গিয়ে দেখি কলের চেয়ে আমার চোখে বেশি জল ঝরে" - এমন অজস্র উপমেয়র মনিমুক্তো সাজানো আছে এই বইতে।
আর আছে হাস্যরস, স্যাটায়ার নয় - হিউমার। একজন পূর্ণ কথাশিল্পী যে যে বৈশিষ্ট্যের জন্য সম্পূর্ণ হয়ে ওঠেন, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই হাস্যরস। "এক মাস্টার মশাইয়ের অভিভাবক মহলে খুব নাম। খুব পেটাতেন। ইংরেজির মাস্টার। কিচ্ছু শিখিনি 'টি'-'টা'-'খানা'-'খানি' ছাড়া। আর শাস্তি ছিলো - মেয়েদের দিয়ে মুখে বাঁ হাত বোলানো। আমি এই শেষ শাস্তি একবার পেয়েছিলাম । তাতেই আমার পড়াশোনায় মন এলো।
- মহাত্মা গান্ধীর মায়ের নাম কী?
পুতলি বাই না কস্তুরী বাই ভাবতে না ভাবতেই পুতলী বাই পছন্দ হল। অমনি উচালনের মাস্টারমশাই সুনীল ববু ক্লাসে দ্বিতীয় হওয়া কুলসুমাকে আদেশ দিলেন, "দে তো কুলু ওর মুখে বাঁ হাত বুলিয়ে "। আর তারপরের মজাটা আরো বেশি। লেখক তার সহপাঠিনী কে বলে উঠলেন "স্যার চলে গেলে দেখবি তোর কী হয়" - এ সব চিত্র আমাদের বড়ো চেনা স্মৃতি ও সত্তায়, তবু যে হাসিটুকু মুখে অনিবার্য ফুটে ওঠে, সেটা হিউমার।
পর্ব ৯৪তে বহু হারিয়ে যাওয়া শব্দের একটা তালিকা ও তার অর্থ সাজানো হয়েছে। এই অর্থসমূহ কেবলমাত্র আক্ষরিক নয়, ব্যঞ্জনাধর্মীও বটে। বাঙালি যদি একটা জাতির নাম হয়, তো এই হারিয়ে ফেলা শব্দার্থগুলোর তালিকা বাঙালির কাছে আর্কাইভ। ইমানুল হক এগুলো কাল্টিভেট করে রাখলেন। বইটি পড়ার সময় এই বিষয়টি যেন না ভুলি আমরা।
পৃথিবীর ইতিহাসে যে সকল মহৎ লেখা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই সব লেখকদের রাজনৈতিক চেতনা ও মনন - তাদের সৃষ্টির উদ্ভাস হিসেবে রয়ে গেছে। এই 'কাদামাটির হাফলাইফ'ও তার ব্যাতিক্রম নয় কিন্তু। পর্ব ২২-এ এসেছে ছাত্র রাজনীতির প্রসঙ্গ আর সে প্রসঙ্গ ধরেই এসেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, খড়্গপুর আইআইটি ক্যাম্পাস, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ জুড়ে ১৯৭৭ সাল থেকে প্রায় ১৯৮৪ র যাবতীয় সালতামামি। শুধু ছাত্র রাজনীতি নয়, রাজনীতির যে আদর্শ বুকে পুষে নতুনতর ইস্তেহার রচনার নির্মাণ আয়ত্ত করা, ছাত্র রাজনীতির যা অনিবার্য।
গুণ - গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব থাকে না, যা কি না অন্য অঙ্গনে ভাবাই যায় না, তার অনুভূতি এবং সেই প্রসঙ্গে বহু স্কলারদের সন্নিবেশ, যা তারকাখচিত বললেও বেশি বলা হয় না - তাদের স্বপ্নসন্ধানের অনুষঙ্গ - সে সবই লেখক বড়ো মমতা দিয়ে প্রত্যয়িত করেছেন। বাম রাজনীতির নীতিগত প্রশ্নে, কোথায় আদর্শ আর তার বিপরীতে সংশয়আকুল অমীমাংসিত প্রশ্নে নিজেদের অবশ্যম্ভাবী ক্ষয়, সেই অমোঘ যন্ত্রণার কিছু মৃদু আভাস, লেখকের কলম জানিয়েছে আমাদের। স্মৃতিকথা নয়, এক বড় স্বপ্নের অপচয়ের ইতিবৃত্ত - পাঠক ভাববেন, অবশ্যই ভাববেন। যেহেতু লেখক নিজেই সেই পর্বে হেঁটেছেন, তাই চিরকালীন এক শাশ্বত প্রশ্ন, প্রশ্ন আকারেই রেখে শেষ করেছেন এই পর্ব ২২ - "বিপ্লব হবে, অভীক দা? এই বাংলায়?" সমাজবাদের সপক্ষে বিপ্লবটাই তো কাঙ্ক্ষিত ছিলো... ভোট সর্বস্ব রাজনীতি নয় যে!
এবার বইয়ের প্রচ্ছদ ভাবনা, মুদ্রণের গুণগতমান - যা সবটাই যথাযথ, তা নিয়ে অধিকন্তু বলার নেই। উৎসর্গপত্র জুড়ে যে সব ব্যক্তিত্ববর্গের পরিচয় পাই, তাতে কোথাও বুঝতে অসুবিধা হয় না, যে সলতে পাকানোর উৎসার কি ভাবে নিহিত ছিলো এই আকর গ্রন্থের। যেখানে শুরুতেই লেখক নিজে কৈফিয়ৎ দিয়ে দিলেন "এই বই না লিখে মরে যাওয়া অন্যায় অপরাধ হতো"। তখন পাঠকের দায়িত্ব থাকে সেই বই নিজের করে নেওয়ার। সংগ্রহ করে নেওয়ার।।