১. ঈশ্বর (অণু গল্প)
‘একটা অভিযোগ নিয়া আসছি, ম্যানেজার সাহেব?’
একজন বয়স্ক লোক, চোখে কড়া পাওয়ারের চশমা, সফেদ ফিনফিনে পাঞ্জাবি গায়ে, হালকা চন্দন কাঠের গন্ধ বেরোচ্ছে সেখান থেকে। পরিপাটি করে আচরানো চকচকে কালো চুলগুলো যখন ঝিলিক মারছিল, কপালের ঠিক মাঝখানটিতে একটি কালো চিহ্ন তখন ফুলে ফুলে উঠছিল!
আমি উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোককে বসার ইঙ্গিত করলাম, কিন্তু সে দরজায় দাঁড়িয়েই তাড়া খাওয়া কণ্ঠে বলতে শুরু করে, “ আপনার মেইন গেটের লোকটা একটা আস্ত বেয়াদপ। আচ্ছা, আমি নাহয় একটা ফোন করতে লাইন থেকে বের হয়ে গেছিলাম, কিন্তু ওর কি দুঃসাহস, মুখের উপর বলে দিল, ‘একবার বাইর হইলে আর ঢুকার নিয়ম নাই, সবার পেছনে গিয়া দাঁড়ান!”
আমি দূর থেকে জামালের মুখটা যখন খুঁজতে চেষ্টা করি, ততক্ষণে সে আরো একজন কাস্টমারকে দরজা খুলে দিচ্ছিল। সেই নির্লিপ্ত, ভাবলেশহীন চোখ-মুখ! এতদিন হয়ে গেল, কিন্তু গ্রাহকের সাথে কী করে কথা বলতে হয় শেখেনি।
‘ভাই, কিছু মনে করবেন না, ওরা কি মানুষের পর্যায়ে পড়ে?’ – বলতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম ফুঁসে উঠা ক্ষোভকে চাপা দিতে গিয়ে স্বাভাবিক লাইন ও লেংথ হারিয়েছে আমার কণ্ঠ! জামালকে প্রথম যেদিন আবিষ্কার করেছিলাম, সেদিনই বুঝেছিলাম, ভোগাবে! ভীষণ অস্বাভাবিক ছিল তার চলা-ফেরার স্টাইল, আর কথা-বার্তার ধরণ। সে যতবারই দেখতো আমায়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের গার্ড অফ অনার প্রদান করতো আর এক বিশ্রী ইঁদুরপচা গন্ধ ছড়িয়ে যেত তার কস্টিউমটা। তার চোখদুটো থেকে সারাদিনই উপচে পড়তো লাল পেয়ালা!
‘আর পারা যাচ্ছে না, আগেও অভিযোগ এসেছে…আজই রিপোর্ট যাচ্ছে তোমার এজেন্সিতে!’ – বেলাশেষে জামাল এসে দাঁড়িয়েছিল আমার রুমে, আমার কথাটা শুনে তার ঝুঁকে থাকা মাথাটা নুয়ে পড়লো প্রায় হাঁটু অবধি; তারপর শুয়ে পড়ল আমার পায়ের খুব কাছে, ছুঁয়েই ফেলতে যাচ্ছিল, যদি না আমি সময় মত সরে পড়তাম।
‘মাপ কইরা দেন, স্যার! আল্লার কসম আর হইব না!’ জামালের কপালটা সিমেন্টের মেঝেয় ঠেক দিয়ে অচেতন পড়ে থাকে কিছুটা মুহূর্ত।
‘আল্লার নাম নিতে লজ্জা লাগে না? পশ্চিমমুখি হও দিনে একবারও?’ আমার হুংকারে যখন মাথাটা তুলেছে জামাল, ততক্ষণে তার কপালে ধূলো-জলের ক্ষুদে কিছু ছোপ তৈরী হয়েছে। কিন্তু সেদিকে নজর দেয়ার সুযোগ ছিল না, কারন ইমাম এসে পড়েছিল নামায পড়াতে, আর সবার সাথে আমিও বিদ্যুতচালিত হয়ে ওযুঘরে দৌঁড়াতে শুরু করেছিলাম।
‘আমরা অবুঝ, অবোধ, অজ্ঞান, সারা দিনমান খালি ভুল করি, আমাদের ক্ষমা কইরা দাও মাওলা’ – শেষদিকটায় হুজুরের ধরে আসা গলার সাথে সাথে উপর দিকে তাক করে রাখা আমার চোখজোড়াও আদ্র হতে শুরু করে। টের পেয়েই যখন তাদের অন্যত্র সরিয়ে নিতে চেষ্টা করি, দেখতে পাই জামালকে; গেইটটি শক্ত করে ধরে তাকিয়ে আছে আমারই দিকে, অনেকটা রোবটের মত! আর এক করুন আর্তি ঝরে পড়ছে চোখ থেকে! অফিসের অন্য সবার স্বার্থে জামালকে নামাযের বাধ্যবাধ্যকতা থেকে মুক্তি দিয়েছিল প্রতিষ্ঠান।
‘মনে রেখো, এটাই শেষ চান্স।‘ সেইভ করে রাখা ইমেইলটা ক্যানসেল করতে করতে চোখ-মুখ যতটা সম্ভব শক্ত রেখে বলি আমি। চাকরি থেকে অপসারণের আবেদন রাখা হয়েছিল ইমেইলটিতে। নামায শেষে জামালকে ফের ডেকে পাঠিয়েছিলাম আমার কক্ষে।
আমার কথা তার কানে গেল কিনা জানি না। সে আগের মতই অদ্ভুত করুণ দুটি চোখ মেলে তাকিয়ে ছিল, তবে এবার মাটির দিকে নিবদ্ধ ছিল পাতাদুটো। তার মাথাটা আগের মতই নীচু, আর হাতদুটো তেমনি জোড় বাঁধা! কাঁপা কাঁপা হাঁটু দুটো দেখে মনে হচ্ছিল, যেকোন মুহূর্তে লুটিয়ে পড়বে আবার। আমার পায়ের কাছে।
(সমাপ্ত)
২. নায়িকার দুঃখ (পরমাণু গল্প)
জানালাটা দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। তার একহারা দেহ, বাঁশির মত নাক আর পটলচেরা চোখ পুরো বিঁধে আছে। সামনে নয়, উপরে। জানালার বাইরের সীমানা পাচিলটা ঢেকে রেখেছে একটা উঁচু দালান; তার ফাঁক গলে মাত্রই এক টুকরো আকাশ ধরা দেয় তার কাছে। ঘরে আসবাব বলতে একটা চৌকি যাতে শুয়ে রয়েছে একটি শিশু। কী মনে করে শাড়ির ভাঁজে রাখা টাকাগুলো গুণতে শুরু করে মাঝপথেই থেমে যায় সে, আর জলে ভিজে যাবার আগেই ওগুলো রেখে দেয় যথাস্থানে।
এ পর্যন্ত এসে, আহা, আহা করতে করতে পাতাটা পুরো জলে ভিজে যাবার আগেই বইটা বন্ধ করে শিয়রে রেখে দেয় দীপ। নিশ্চয়ই মেয়েটির স্বামী তাকে ছেড়ে গিয়েছে। হয়ত দুকুলে কেউ নেই তার। কিন্তু সত্যি এমনটা হয়? হতে পারে? মাত্র অর্ধেকটা পর্যন্ত পড়েছিল সে, পরের পাতাগুলোতে নিশ্চয়ই কিছু আছে! প্রবল উত্তেজনায় বইটা আবার খুলে বসে সে, আর কিছুদূর যেয়েই উজ্জ্বল হয়ে উঠে তার চোখ-মুখ! নাহ, মেয়েটির সব আছে। ঐ তো দেখা যাচ্ছে, একটি এগারো বছরের বালিকাকে নিয়ে ঘরে ঢুকছে একটি পুরুষ, কাঁধে তার স্কুল ব্যাগ।
সন্ধ্যে হয়ে এসেছিল। বইটি রেখে দিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ে দীপ। আলনা থেকে শার্টটা গায়ে গলিয়ে বোতাম লাগাচ্ছিল - একটু বাইরে বেরিয়ে আসা দরকার, মাথাটা জ্যাম হয়ে আছে। ঘর থেকে বেরুনোর আগে বইটির দিকে হঠাৎ চোখ পড়তেই চমকে উঠে সে! বিমূর্ত প্রচ্ছদটিতে একটি ছবি ভেসে উঠেছে, একটি মেয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দীপের দিকে, আর তার মুখটা আগের থেকেও রক্তশূন্য!
বইটিতে তখনো একটি পাতা ছিল, অপঠিত।
(সমাপ্ত)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।