বিশ্বখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে খ্যাতনামা স্থপতি জাহা হাদিদ বলেছিলেনঃ “এটা একটা দুইদিক ধারালো তলোয়ারের মত। যখনই আমার নারীত্ব গ্রহণ করে নেয়া হয়েছে, আমার আরবী পরিচয় নতুন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। “ কিন্তু এই দুই-ধারী তলোয়ারকেই দক্ষতার সাথে নিজের অনুকূলে কাজে লাগিয়ে তার স্থাপত্য মেধা পৌঁছে গেছে লন্ডন থেকে সাংহাই, বাকু থেকে ভিয়েনা, সিউল থেকে নিউইয়র্ক; পৃথিবীর প্রধান শহরগুলির আকাশরেখা সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ১৯৫০ সালের অক্টোবরে ইরাকে জন্মগ্রহণকারী ব্রিটিশ নাগরিক জাহা হাদিদের স্থাপত্যের ধারণা পালটে দেয়া কৃতিত্বগুলির।
জাহা হাদিদের পিতা মুহাম্মদ হাদিদ ইরাকের বাদশাহ ফয়সালের অর্থ মন্ত্রনালয়ের উচ্চ পদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারী পদে অধিষ্ঠিত হন। এই ক্ষমতাবলয়ে জন্মগ্রহনকারী জাহা হাদিদ সবসময় একটা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন। এদিকে মসুল শহরে পিসির পরিকল্পিত বাড়ির নকশা ও মডেল তার মধ্যে ছয় বছর বয়সেই স্থাপত্যবিদ্যার প্রতি ভালবাসা তৈরী করে বয়সের সাথে সাথে যা বুদ্বুদ্ আকারে ক্রমেই বাড়তে থাকে।
১৯৫৮ সালে ইরাকের হাসেমি রাজতন্ত্রের পতনের পাঁচ বছর পর বামপন্থী ক্যু হলে মুহাম্মদ হাদিদের সম্পত্তি জাতীয়করণ করা হয়। এই অবস্থায় কন্যা জাহাকে বিদেশ পাঠিয়ে দেন তার পিতা। এক সময় পূর্বের প্যারিস বলে পরিচিত লেবাননের বৈরুতে পাড়ি দেন জাহা এবং ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ও খ্যাত বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর যাহা লন্ডনের মর্যাদাপূর্ণ আর্কিটেকচারাল এসোসিয়েশান স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে চতুর্থ বছরের প্রজেক্ট পরীক্ষায় জাহা একটি হোটেলের নকশা প্রণয়ন করেন পুরোপুরি একটি ব্রিজের আদলে। এটা ছিল স্থাপত্যেরর মাধ্যমে ভাবনাকে প্রকাশ করার তার একটি সহজাত ঝোঁক, যা পরবর্তী তিন দশক জাহাকে অণুপ্রেরণা যুগিয়ে গেছে। তার শিক্ষকদের একজন তাকে ৮৯ ডিগ্রির আবিষ্কারক বলতেন, কারণ কখনোই তার কোন কাজ সোজাসুজি ৯০ ডিগ্রিতে থাকতো না; একটু অন্যরকম, একটু ব্যতিক্রমী হতই। গ্রাজুয়েশানের পর শিক্ষানবিশ কাল সম্পন্ন করার পর ১৯৮০ সনে নিজের ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন জাহা। উজ্জল ভবিষ্যৎতের হাতছানি দেখাচ্ছিল তার নতুন ফার্ম। কিন্তু উদ্ভাবনীশক্তিসম্পন্ন ও দর্শনীয় হলেও তার কাজগুলি সহজ -সরল ও একরৈখিক ছিল না; জাহার জটিল স্থাপত্যগুলোর বাস্তবায়ন খুবই ব্যয়সাপেক্ষ ছিল। ফলে তার ডিজাইনগুলি অনেকটা সময় ধরে অ-নির্মিত হয়ে থাকে;আর সেই যজ্ঞহীন সময়টা তিনি পার করেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যলয়গুলোতে স্থাপত্যের উপর ভাষণ দিয়ে দিয়ে।
১৯৮২ সালে জাহা প্রথম গোল্ড মেডেল লাভ করেন, যা তাকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রতিদ্বন্বিতামূলক বাজারে অনেকটাই এগিয়ে দেয়। এরপর ১৯৮৮ সালে নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে তার কাজ প্রদর্শিত হলে জাহার খ্যতি আকাশের চুড়া স্পর্শ করে; বন্যার স্রোতের মত ভাসিয়ে দিতে থাকে পুরুস্কারে। ২০০৪ সালে প্রথম নারী হিসেবে জাহা ভূষিত হন প্রিটযকার আর্কিটেকচার প্রাইজে যা তার ফিল্ডের সব থেকে মর্যাদাপূর্ণ এবং একই সাথে আর্কিটেকচারের নোবেল বলে বিবেচিত। জুরি বোর্ডের লর্ড রথচাইল্ড বলেন, “তার শক্তিমত্তা ও চিন্তা এমনকি ভবিষ্যতের জন্য আরো বড় কিছুর প্রতিশ্রুতি বহন করছে।“ এত স্বীকৃতি তাকে নিশ্চয়ই আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছিল, আর তাই তিনি বলতে পেরেছিলেন যে, তিনি আরব স্থপতি বা নারী স্থপতি নন, তিনি শুধুই একজন স্থপতি। তিনি জানতেন, উৎকর্ষ নির্ভর করে সহযোগীতার উপর; আর তাইতো ভেঙে দিয়েছিলেন মহিলাদের চিরাচরিত একটি ধারণা। জাহার ভাষায়ঃ “মাঝে মাঝে মহিলারা মনে করে, সব কিছু তাদের নিজেদেরই করতে হবে; একান্ত নিজের কাজটা ছাড়াও যে বাড়ির কাজ, সন্তান লালন-পালন ইত্যাদি তাদেরই করতে হবে । কিন্তু … তোমায় শিখতে হবে যে সবকিছু তুমি একাই আর নিজের হাতে করতে পারো না। “
জাহার সমালোচকরা তার কাজের পেছনে ‘বিমূর্ততা, বিনির্মাণবাদ, প্যারোমেত্রিকতা’ এসব অস্বচ্ছ লেবেল লাগিয়ে দিয়েছেন। হ্যাঁ, সব সময় সোজা লাইন থেকে ঘুরে গেছেন তিনি। জাহা গ্লাস, স্টিল ও কংক্রিট নিয়ে অনেক কিছু কল্পণা করেছেন যা পদার্থবিদ্যার সূত্রকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ২০১২ এর অলিম্পিকের জন্য নির্মিত লন্ডন অ্যাকোয়াটিক সেন্টার, আর চায়নার গুয়াংঝু অপেরা হাউজের একটি ভাসমান বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা এর পর্যবেক্ষকদের একটি স্থায়ী চলন ও গতির অভিজ্ঞতা উপহার দিতে সক্ষম হয়। জাহা হাদিদ তার স্টাইল নিয়ে নিজেই বলেনঃ “৯০ ডিগ্রি পেতে হবে এমন চিন্তা থাকে না আমাদের মাথায়। বরং, আমরা শুরুতে একটি কর্ণকে নিয়ে ভাবি। কারণ কর্ণ বা ডায়াগনাল একটি বিস্ফোরণের ধারণা নিয়ে আসে যা কিনা স্পেস বা শূন্যকে কাটাকাটি করে একটা রিফর্ম বা সংস্কারের রূপ দেবে।“
২০১৬ এর ৩১ মার্চ জাহা হাদিদ অনেক প্রজেক্টের কাজ অসম্পূর্ণ রেখে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অনেকটা হঠাৎ করেই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যান। জাহা তার মুসলিম পরিচিতিটির উপর কখনো জোর দেননি। কিন্তু তারপরো বিংশ শতাব্দীতে একজন মুসলিম নারীর স্বপ্ন, প্রত্যাশা, অর্জন ও পদমর্যাদা - এসব আলোচনায় এলে জাহা হাদিদ প্রথমদিকেই থাকবেন এবং অনূপ্রানিত করে যাবেন বিশ্ববাসীকে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।