এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • শিশির বিন্দুর গান

    Arundhati Sarkar Santra লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৮ নভেম্বর ২০২২ | ৯৪১ বার পঠিত
  • চতুর্দোলা করে রাজারানী ঝমঝমিয়ে এলেন, সঙ্গে এলো দাসদাসী, সেপাই সান্ত্রী, মন্ত্রী, কোটাল রাজকবি, রাজজ্যোতিষী মায় বিদূষক পর্যন্ত; সব্বাই ঝলমলে আর চকচকে। তারা সভা আলো করে বসেন, রাজত্ব করেন, দেশজয় করেন, ধর্মপ্রচারে যান। দানদরবার, যুদ্ধবিগ্রহ, প্রেমভালবাসা, বিশ্বাস, বিশ্বাসঘাতকতার কতই না রঙিন নকশাদার সেসব কাহিনী। নবাব, বাদশা, বেগম, পীর, দরবেশ সব্বার রয়েছে আপন আপন গল্পের গুলদস্তা। কত ধরণের যে ময়ূরপঙ্খী কিস্সাবাহার। সেইসব নিয়েই তো চিরকালীন পুরানা দাস্তানগৈ ....... ইতিহাসের কথকতা।

    কিন্তু এই আলোঝলমল পাথরকঠিন ইতিহাসের রাজপথে চিরকালই ব্রাত্য থেকে গেল যারা, সেই নামহীন, সদাভীরু বনফুলগুলির কথা তো কোথাও লেখা হল না। যুগযুগান্ত ধরে কৃষকের জন্য ভাত রাঁধলে যে রমণী, পন্ডিতের পড়ার আসন সাজিয়ে রাখলে যে প্রিয়া; শ্রমিকের, বণিকের, সৈনিকের ঘরে প্রতি সন্ধ্যায় মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালালে যে গৃহবালা, কেউ তো তাদের নিয়ে গান লিখল না। জনজাতির মূলধারার জীবনশিখাটিকে খাইয়ে পরিয়ে সেবা করে সাবধানে বাঁচিয়ে নিয়ে চলল যে মেয়েরা তাদের জন্য, তাদের নিয়ে কোন বিজয়সঙ্গীত ইতিহাসে লেখা হল না তো। তবে কি ইতিহাসের সোনার রাজপথে তাদের কাহিনী রথের চাকার ঘর্ঘর ধ্বনির তলায় একেবারেই হারিয়ে গেল? নাকি তাদের কথকতা এই আশেপাশেই মেঠো পথের ধারে, ভাঙা উঠানের চাতালে, তুলসীতলায় সন্ধ্যাপ্রদীপের আলো আবছায়ায় আজ বেঁচে রয়েছে?

    নিজেদের কাহিনী তবে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজেরাই লিখে নিয়ে; নিজেরাই গান গেয়ে; নদীর মাটি, বনের ফুল আর পিটুলি গোলার আঁক কেটে তারা যখন সবার জন্য মঙ্গল চাইলে.... তখন সেই কাহিনী কে কেউ ইতিহাস বললে না, তার নাম দিলে 'ব্রতকথা'।

    এই বারব্রতের কাহিনীর ইতিহাস একান্তই বাংলার মেয়েদের নিজস্ব জীবনকথা।
    আমরা নিজেরাও সেই যে মঙ্গলচণ্ডীর ব্রতের ছড়া বলেছি…………

    ‘সোনার মঙ্গলচণ্ডী রূপোর বালা
    কেন মা, মঙ্গলচণ্ডী এতো বেলা?
    সোনার দোলায় দুলতে, শাঁখা, সিঁদুর পড়তে,
    আঘাটায় ঘাট করতে, অপুত্রকে পুত্র দিতে
    তাই এতো বেলা’

    গ্রামের বাড়িতে আল্পনা দিয়েছি, গয়না, মই, লাঙল, বীজধানের ছবি, ইতুর ঘটে শস্যবীজ ছড়িয়েছি। এগুলিতে যে আমাদের জাতির ইতিহাসের আবহমান কালের চিত্র ধরা আছে তেমন করে হয়তো বুঝতেই পারি নি। তবে একজন ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি হলেন জোড়াসাঁকোর অবন ঠাকুর। তাঁর মতো এতো সুন্দর করে ‘ব্রতকথার’ কথা কেউ বুঝি লিখতে পারবে না। আমরা এই বাংলার মেয়েবউরা, যারা শাস্ত্র মোটে পড়ি নি বা ব্রাহ্মণ ডেকে পুজো করানোর সামর্থ্যটুকুও যাদের নেই্, তাদের অরণ্যষষ্ঠী, কুলকুলতি, সুবচনীর কথা, আল্পনা, গান, ছড়া হারিয়ে যাবার আগেই অবন ঠাকুর ‘বাংলার ব্রত’ বইতে বড় আদর দিয়ে লিখে, এঁকে রেখে গেছেন। রঙে রূপে রসে বৈচিত্র্যে ব্রতকথার নিজের সাহিত্যগুণ কম তো নয়ই বরং বঙ্গভূমির ইতিহাসের দরবারেও এর অবদান মোটেই ফেলে দেবার নয়।

    পুরোহিতের অর্চনা নয়, কঠিন শাস্ত্রের দাঁতভাঙ্গা মন্ত্রও নয়; সংসারের, দেশের, দশের মঙ্গলের জন্য যে আকুতি তাকেই মেয়েরা বাঁধলে আনন্দের গানে, সামান্য উপচার নিয়ে ব্রতের অনুষঙ্গে বাঁচিয়ে রাখলে পুরাকালীন সমাজচিত্রটুকু।

    আদিম সমাজের টোট্যাম বা প্রাকৃতিক শক্তির পুজোর সাথে মিল রেখে ফুটিফাটা গ্রীষ্মকালে জলকে দেবতা করে ব্রত করলে 'পুণ্যি পুকুর'। পুকুর কেটে বললে 'পুণ্যি পুকুর ব্রতমালা/ কে করে গো সকাল বেলা/ আমি সতী, লীলাবতী / সাত ভাইয়ের বোন ভাগ্যবতীl’। 

    পৃথিবী এঁকে সবার জন্য মঙ্গল চেয়ে তারা করলে 'পৃথিবী ব্রত'।  বৃক্ষকে ভালবেসে 'অশ্বথ ব্রত'। গাভীর জন্য করলে গোকুল ব্রত। কখনো এর সাথে মিশে গেল শাস্ত্রীয় কিছু আচার।

    কিছু ব্রত আবার হয়ে উঠল দৈনন্দিন আশা আকাঙ্খার কাহিনী। পুরুষের বহুবিবাহের ফলে মেয়েদের উপর অসহনীয় কৌলীন্যপ্রথার অত্যাচার তা ধরা আছে 'সেঁজুতি ব্রতের' ছড়ায়; এই ব্রতে বঁটির ছবি এঁকে মেয়েরা ছড়া কাটছে 'বঁটি বঁটি বঁটি / সতীনের শ্রাদ্ধের কুটনো কুটি'। পুরুষতান্ত্রিক নির্মম সমাজে মেয়েদের অসহায়তার এ যেন এক নিদারুন আলেখ্য। 

    ভাদুলি ব্রতে আবার দেখতে পাই বণিক বাঙালিকে….. 'নদী নদী কোথা যাও? / বাপ্ ভাই এর বার্তা দাও'। কুমারী ব্রত, সধবা ব্রত, বিধবা ব্রত কত রকমের যে ছড়া আর গান। এই নিয়ে বলতে বসলে শেষ বুঝি আর হবে না।

    অবন ঠাকুর ভারি সুন্দর করে এইসব বারব্রত কে লিখে, এঁকে সাজিয়ে রেখেছেন তাঁর বইটিতে। সে বই ভারি লোকসংস্কৃতির প্রবন্ধের নয়, গবেষকের নিরীক্ষারও নয়। অনায়াস দক্ষতায় তিনি ব্রতের উপাখ্যান নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা করলেও এই বই আসলে গ্রাম বাংলার মেয়েবউদের। যাদের কথা ইতিহাস কোথাও লেখা থাকে না। ক্ষমতা, যুদ্ধ, উচ্চকিত প্রেম সর্বস্ব খাঁটি ইতিহাসের অলিন্দে মায়েদের, মেয়েদের এই নম্র ভালবাসার রূপরেখাটি বংশকৌলিন্যে গৃহীত না হলেও অবনীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ‘বাংলার ব্রত’ বইটি তার একটি চিত্র বুকে নিয়ে আপন ধারায় বেঁচে থাকবে বৈকি। তিনি যে অনেক নামী লেখক, বড় চিত্রকর, জগৎজোড়া নাম তাঁর। তবু তিনি নিজের দেশের লৌকিক সত্ত্বাটুকুকে ভুলে যান নি। আমরা মায়েরা তো আর অত কিছু বুঝি নে। হলুদ মাখা হাত, আধময়লা আঁচলে মুছে শুধু বলি,  ‘আহা, অমন ছেলে যেন এই বাংলার ঘরে ঘরে জম্মায়। এত ভালবাসার মায়া জড়ানো মন তার। ঐ যে গো যেমন ঠাকুরবাড়ির অবন।’

    No photo description available.
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৮ নভেম্বর ২০২২ | ৯৪১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে প্রতিক্রিয়া দিন