এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  শিক্ষা

  • 'তাহাদের কথা' 

    প্রবুদ্ধ বাগচী লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | শিক্ষা | ০৪ নভেম্বর ২০২২ | ৭৯১ বার পঠিত
  • তাহাদের কথা'

    প্রবুদ্ধ বাগচী

    উত্তর কলকাতার এক বিখ্যাত কলেজে বাংলা বিভাগের এক জনপ্রিয় অধ্যাপক অনার্সের ছাত্রছাত্রীদের রবীন্দ্রনাথের ‘রথের রশি’ নাটক পড়াচ্ছিলেন। নাটকের আলোচনা শেষে তিনি পড়ুয়াদের অনুরোধে এই নাটকটি নিয়ে প্রাসঙ্গিক কয়েকটি রেফারেন্স বইয়ের পরপর উল্লেখ করে গেলেন। ক্লাসের শ্রোতারা দ্রুত সেগুলি তাদের খাতায় লিখে নিতে লাগল। তালিকার প্রথম গ্রন্থটির নাম ‘কালের যাত্রা ও রবীন্দ্রনাথ’, লেখক : শঙ্খ ঘোষ।

    মুখে হাল্কা দাড়ি, চোখে বাদামি ফ্রেমের চশমা, পরনের জামা কাপড় তেমন উজ্জ্বল নয়, পেছনের দিকে বেঞ্চে বসে থাকা একটি তরুণ হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে অধ্যাপককে প্রশ্ন করল, স্যার বইয়ের নামটা কি ঠিক আছে ? মনে হচ্ছে একটু ভুল হচ্ছে।
    ভ্রু কুঁচকে অধ্যাপক বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন, কেন বলো তো?
    মানে, স্যার আমি যতদূর জানি শঙ্খ ঘোষের এই নামের কোনো বই প্রকাশিত হয়নি।
    কী করে জানলে ?
    আসলে ওঁর বইটার নাম ‘কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক’, আপনি যে নামটা বললেন ওই নামে কি অন্য কারোর…
    ‘এই দ্যাখো’ অধ্যাপক ছাত্রটির কথা থামিয়ে দিয়ে হাতের কাগজটা উঁচু করে দেখালেন ‘ এটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠানো রেফারেন্স বইয়ের লিস্ট ---- এখানে পরিষ্কার লেখা রয়েছে ‘কালের যাত্রা ও রবীন্দ্রনাথ’ । হয়তো এই বইটা নতুন বেরিয়েছে, তুমি জানো না। সবকিছু তো সবার সব সময় জানা থাকে না। নাও বসে পড়ো। যা লেখাচ্ছি লিখে নাও।’
    হতচকিত তরুণটি বসে পড়ে।

    মাস্টারমশাইয়ের ক্লাস একসময় ফুরিয়ে যায়। বাকি ছেলে-মেয়েরা যে যার কাজে চলে যায় অন্য ক্লাসে বা লাইব্রেরিতে বা কমন রুমের আড্ডায় কিংবা ছাত্র রাজনীতির দাদাদিদিদের হয়ে বেগার খাটতে। আর, এই ছেলেটি হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে কলকাতার বইপাড়ায়। এই-প্রকাশক ওই-প্রকাশক, এ-দোকান ও -দোকান ঘুরে খুঁজে চলে ওই নামের বইটি। পায় না। ওই নামে আদৌ কোনও বই নেই। পরের দিন আবার সেই স্যারের ক্লাসে আসে সে। চুপ করে নোট নেয়। মনের মধ্যে কোথাও একটা অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করে --- কিন্তু ছাত্রপ্রিয় ও নামী অধ্যাপকের মুখোমুখি হতে কোথাও আটকায় তার। সে চুপ করে যায়।

    এবার আমরা একটু দৃশ্যান্তরে যাই। কলকাতা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বের এক শহরতলির চেনা মিশনারি কলেজের বাংলার অধ্যাপিকার অভিজ্ঞতা শুনি। এই ভদ্রমহিলা স্নাতক শ্রেণির প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, একেবারে সাম্প্রতিক সময়ের বাংলাভাষার পরিচিত গল্পকারদের নাম তাদের জানা আছে কি না। অধিকাংশ পড়ুয়া এর কোনো জবাব দিতে পারেনি। গুটিকয় ছেলেমেয়ে অনেক ভেবেচিন্তে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় অবধি পৌঁছেছিল।

    পাশাপাশি উল্লিখিত এই দুটি ঘটনা কিন্তু কাল্পনিক নয়। আর এই দুটোকে যদি মিলিয়ে দেখা যায় তাহলে দুটো সাধারণ সত্যের হদিশ পাওয়া যাবে। প্রথম কথা হল, যারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকাডেমিক বৃত্তে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ান তাঁদের একটা বড় অংশ গতানুগতিক সিলেবাস, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেফারেন্স বই, পরীক্ষা ও তার মডেল উত্তর এইসবের বাইরে পা বাড়াতে গররাজি। আমাদের উল্লিখিত বিশিষ্ট অধ্যাপকটি এই অধিকাংশের দলে পড়েন, বোঝা যায়। নতুবা শঙ্খ ঘোষের সুবিখ্যাত গ্রন্থের ভুল নাম জানিয়ে তিনি ছাত্রদের বিভ্রান্ত করতেন না। মনে হওয়া স্বাভাবিক, ওই বইটি তিনি নিজে কখনো পড়েননি। কারণ ওই বিশেষ বইটিকে সেইভাবে অ্যাকাডেমিক বইয়ের তালিকায় ফেলা যায় না। প্রধানত, ওই বইয়ের লেখাগুলি প্রকাশ হয়েছিল বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে। ছাত্রদের পরীক্ষা পাশের সহায়ক হবে এমন কোনো অভিপ্রায় লেখাগুলির পেছনে আদৌ সক্রিয় ছিল না। কিন্তু মজার ও বিস্ময়ের কথা, বিশিষ্ট কলেজের বিশিষ্ট অধ্যাপকের লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এইসব মৌলিক লেখার শুলুক সন্ধান না রাখলেও দিব্যি দিন চলে যায়। বরং তার থেকে বেশি অ্যাকাডেমিক বইপত্রের হদিশ জানা থাকলে ছাত্রমহলে তার কদর বেড়ে যায়, বেড়েই চলে।

    অন্যদিকে ছাত্রছাত্রীদের কথা ভাবুন। যারা বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়তে আসেন সেই ভাষার হাল আমলের সাহিত্যধারার সঙ্গে তাঁদের কোনো সামান্য যোগাযোগ ঘটে না। এমন নয় যে প্রাচীন বা মধ্যযুগের সব সাহিত্য তারা পড়ে ফেলেছেন। কিন্তু একজন ছাত্র বা ছাত্রী ঠিক কোন জায়গা থেকে সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত হয়ে ওঠেন? নিশ্চয়ই খুব পুরনো সাহিত্যধারা নয়, সাম্প্রতিক বা তার আগের কয়েক দশকের সাহিত্য তার সামনে মুক্ত থাকে, সেগুলোর মধ্যে দিয়েই সাহিত্যর একটা প্রাথমিক ধারনা বিবর্তিত হয় অনুরাগে। আঠারো উনিশ বছরের যে ছেলেটি বা মেয়েটি সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বেরোলেন তিনি সাধারণভাবে সাহিত্যপাঠে আগ্রহী হলে সাম্প্রতিক পত্রপত্রিকায় হাল আমলের লেখকদেরই খুঁজে পাবেন। আরেকটু আগ্রহী হলে তিনি পাবেন রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তারাশংকর, বিভূতিভূষণ, মানিক বা আরও কাউকে কাউকে। কিন্তু প্রায় হলফ করে বলা যায়, সদ্য পাশ করে বেরোনো তরুণ-তরুণী কৃষ্ণদাস কবিরাজ বা ভারতচন্দ্র বা সৈয়দ আলাওলকে সহজে পাবেন না, পড়তেও চাইবেন না। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাসের কথা ছেড়েই দিন। কিন্তু যারা হাল আমলের লেখালিখিরই খোঁজ রাখেন না, তারা সাহিত্যের ক্লাসে ঢুকে পড়লেন কী করে?

    অথচ অস্বীকার করা যাবে না, একেবারে টাটকা ও সজীব সাহিত্যধারার একটা ছাপ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিনগুলির মধ্যেই পাওয়া সম্ভব। হয়তো সব পত্রিকায় নয়, বেশ কিছু উন্নতরুচির পত্রিকায়। মেনে নিতে অসুবিধে নেই, লিটল ম্যাগাজিনের জগতে অনেক ধান্দাবাজি ও অনভিপ্রেত আচার আচরণের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তবু এর পরেও জনপ্রিয় পত্র-পত্রিকায় মূল ধারার সাহিত্যের চর্চা হলেও নিরীক্ষাধর্মী লেখালিখির জন্য আজও খোলা থাকে লিটল ম্যাগাজিনের পাতা। এমন অনেক লেখককে আমরা পরবর্তী সময়ে মূলধারার বাণিজ্যিক পত্রিকায় সফল হতে দেখেছি যারা নিজেরা হাত পাকিয়েছেন লিটল ম্যাগাজিনেই। তাছাড়া মুক্ত অর্থনীতি ও বিশ্বায়িত ব্যবস্থার ফলে এই দুই ধারার একটা সংমিশ্রণও আজ খুব একটা দুর্লভ নয়। কিন্তু সাহিত্য নিয়ে যারা এত রকম চর্চার দুয়োর খুলে রেখেছেন, খোদ সাহিত্যে ছাত্রছাত্রীরা এই উদ্যোগগুলির সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারছেন না কেন? পারছেন না, নাকি, চাইছেন না।

    এখানে আসলে সেই ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’র পরিচিতি বিভ্রান্তি-বৃত্তের সূচনা হতে পারে। অর্থাৎ, পড়ুয়ারা আগ্রহী নয় বলে মাস্টারমশাইরা অ্যাকাডেমিক বেড়ার লক্ষণরেখা পেরোচ্ছেন না, নাকি, শিক্ষক সীমাবদ্ধ স্থানাঙ্কে ঘোরাফেরা করছেন বলে তার ছাত্ররাও চেনা ছকের বাইরে বেরোতে চাইছেন না? এই প্রশ্নের সামনে অধ্যাপকরা নিশ্চিতভাবে বলবেন তাঁদের সীমাবদ্ধতার কথা। অর্থাৎ, স্নাতকস্তরে তাঁরা যেটুকু ক্লাসে পড়ানোর অবকাশ পান তার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস শেষ করাটাই বেশ দুরূহ, তার ওপরে বাড়তি কিছু শিক্ষার্থীদের তাঁরা জোগাবেন কী করে? তার ওপর গড়পড়তা কলেজে ছাত্র-শিক্ষকের যে ভয়াল অনুপাত, তাতে ক্লাসে পড়িয়ে ওঠাটা সাঙ্ঘাতিক এক শক্তিময় পেশি-সঞ্চালনে পর্যবসিত ---- কোনোক্রমে নিজের বরাদ্দ ক্লাসটুকু সেরে নিলেই ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। স্বাভাবিক, এই প্রতিবেশে পড়ার বইয়ের বাইরের পড়া নিয়ে মুখ খুলতে গেলে শিক্ষকের নিগৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা।

    তাছাড়া শুধু শিক্ষকদের দোষ দিয়েই বা কী লাভ? ছাত্র ছাত্রীদের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিও তো এখানে জড়িত। পশ্চিমবাংলার বেশির ভাগ কলেজেই সাহিত্য, অন্তত বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ানোর ব্যবস্থা আছে। সেইসব বিভাগে ভর্তি হয় অজস্র ছেলেমেয়ে ---- তার মানে কি এই পরিমাণ তরুণ তরুণী বাংলা সাহিত্যকে ভালবাসে? না, মোটেও তা নয়। গোটা রাজ্যেই উচ্চমাধ্যমিকের বিজ্ঞান বিভাগে যারা ভর্তি হয়, তাঁদের সামনে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা উচ্চতর বিজ্ঞানচর্চার হাতছানি থাকে। সেই সুযোগ সর্বভারতীয় স্তরে ছড়িয়ে আছে। ডাক্তার বা প্রযুক্তিবিদ্যার সুযোগ পাওয়ার বাইরের ছাত্ররা ভর্তি হয় স্নাতকস্তরের বিজ্ঞান বিভাগে, তাঁদের কেউ কেউ নিজেদের পছন্দের বিষয়ও হয়তো পেয়ে যান। কিন্তু সব কলেজেই বিজ্ঞান বিভাগে ছাত্র নেওয়ার সীমাবদ্ধতা আছে। রাজ্যের এমন অনেক কলেজ আছে যেখানে আদৌ বিজ্ঞান বিভাগই নেই। ফলে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগের সব সিট পূরণ হওয়ার পরেও দাঁড়িয়ে থাকে এক উদ্বৃত্ত ছাত্রদল। এই দলের একটা বড় অংশ ভিড় করে সাহিত্য বিভাগে, তার আবার বড় কারণ, বিভিন্ন বিষয়ের একটা কৌলীন্যপ্রথা । অমুক কলেজে পদার্থবিদ্যা পড়তে গেলে উঁচু নম্বর চাই, অর্থনীতি পড়তেও তাই চাই। কিন্তু বাংলা বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়তে চাইলে অত বেশি নম্বর লাগে না। ফলে আদপে যার পদার্থবিদ্যা পড়ার ইচ্ছে ছিল বা ইচ্ছে ছিল গণিত বা অর্থনীতি নিয়ে পড়ার কোথাও ঠাই না পেয়ে শুধু পড়াশোনার ছেদচিহ্ন আটকাতে তিনি ভর্তি হয়ে গেলেন বাংলায়। এই ঘটনা হামেশা ঘটে চলেছে বছরের পর বছর। তাই বলে সাহিত্যকে ভালবেসে কি কেউ সাহিত্য পড়তে আসছেন না? আসছেন, তবে সেই সংখ্যাটা আণুবীক্ষণিক --- আর এই পড়ুয়ারাই আদপে পরের জীবনে অনেকেই সাহিত্যর অধ্যাপনার এলাকাটায় বাস করতে আসছেন। কিন্তু সাহিত্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আসলে সাহিত্যবিমুখ--- কোনোক্রমে একটা স্নাতক ডিগ্রি জোগাড় করে নেওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ভাবনা তাঁদের মধ্যে আছে, এমন ভাবা ভুল।আর, এই অংশটা এমন একটা স্তরের, বৌদ্ধিক বিচারে যারা দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারিভুক্ত। অবশ্য বিকল্পই বা কী? পরিস্থিতির বিচার বাদ দিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া চলে না। আজ ন্যায্য চাকরির দাবিতে যারা পথে বসেছেন তাঁদের বেশিটাই এই অংশের বাসিন্দা, যদিও সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ।

    তাই বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটা বড় ট্র্যাজেডি এই যে সৃষ্টির মৌলিক ক্ষেত্রটাকে যারা সজীব রেখেছেন সেই লিটল ম্যাগাজিনের প্রয়াসগুলির সঙ্গে সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের একটা বড় ব্যবধান ঘটে গেছে। যেটুকু আছে তা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। তাহলে এই বিপুল সংখ্যক পত্র-পত্রিকার পাঠক কারা ? অবশ্যই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের পড়ুয়ারা নন, এঁদের বাইরে থাকা সাহিত্যরসিক মানুষ, যারা সকলেই হয়তো অ্যাকাডেমিক অর্থে সাহিত্যের ছাত্র ছাত্রী নন। এখন এই পর্যন্ত বললে সংগতভাবেই প্রশ্ন উঠবে এই ব্যবধান মেরামত হওয়া কি সম্ভব?

    শূন্যস্থান পূরণের ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রী বা পত্রিকা সম্পাদক-প্রকাশকদের ভূমিকা কতটুকু তা নিয়ে ঘোর সংশয়। কিন্তু অন্য একটা প্রবণতা আজকাল বেশ কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে যে লিটল ম্যাগাজিন গুলির একটা অংশ অ্যাকাডেমিক বিষয়কেন্দ্রিক লেখাপত্র ছাপতে আগ্রহী হচ্ছেন ও ছাপছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের মুখ চেয়ে এমন আয়োজন এই কথা বলতে চাইব না, বরং মনে হয়, নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার স্বার্থেই এই ধরনের কাজে তাঁদের কোমর বাঁধতে হচ্ছে। কিন্তু এতে দুয়ো দেওয়ার কারণ দেখি না। দিনকাল সত্যি বড় খারাপ। ভাল পাঠক, সিরিয়াস পাঠক ক্রমশ কমে আসছে, কমে আসছে মানুষের অবসর আর যেটুকুও বা অবসর তার দখল নিয়েছে মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া, প্রযুক্তিনির্ভর বিনোদন। পত্রিকা প্রকাশ করে তাকে তো পাঠকের কাছে বিকোতে হবে, সেই পথে পথে বিস্তর পাথর ছড়ানো। বরং অন্য একটা দিকে একটু নজর ফেরাই।

    কথাটা হল এই অ্যাকাডেমিক আর না-অ্যাকাডেমিক ---- এই গিরিখাদটা আসলে তৈরি করেছেন কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস নিয়ন্ত্রকরা ও সেই সঙ্গে সাহিত্য শিক্ষার অন্যান্য নিয়ামকরা। এঁরা সকলেই নামজাদা গুণিজন, পণ্ডিত, কোনো সন্দেহ নেই ---- কিন্তু সাহিত্যের একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তাঁদের প্রত্যাশাটা ঠিক কী? এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠিত প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের পাঠ্যক্রম খুঁজে দেখে (এখন এইসব অনায়াসে ইন্টারনেটে দেখতে পাওয়া যায়) আমাদের মনে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আসলে সাহিত্যের ছাত্রকে যতটা মস্তরকমের সাহিত্য সমালোচক হিসেবে তৈরি করতে চান তার থেকে ঢের কম চান সাহিত্যের নিবিড় রসগ্রাহী পাঠক হিসেবে গড়ে তুলতে বা মৌলিক সাহিত্য সৃষ্টির অভিপ্রায়ে তাঁদের প্রণোদিত করতে। প্রশ্নের ধরন ধারন, উত্তরের প্রার্থিত কাঠামো সবই যেন এই সমালোচক তৈরির দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রন্থিত। ফলে অনেক সময়েই পাঠ্য মূল বই না পড়েও সেই বিষয়ে নানা বাজার-চলতি আলোচনার বই পড়েই দিব্যি পরীক্ষায় উতরে যাওয়া যায়, মৌলিক সাহিত্য-প্রতিভা বিকাশের তেমন কোনো উদ্যোগ এর মধ্যে আদৌ নেই। আর, সমালোচনা বা মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও প্রথাগত ভাবনাচিন্তার বাইরে যাওয়ার তেমন কোনো রাস্তা নেই, ফলে স্বাধীন ভাবনার স্রোত সেখানে রুদ্ধগতি। অধ্যাপক নিজেই যদি ‘কালের যাত্রা ও রবীন্দ্রনাথ’ বইকে সঠিক বলে জানেন, আর মেধাবী পড়ুয়া যদি সত্যি সত্যি ‘কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক’ কে রেফারেন্স করে উত্তর লেখেন --- তার সঠিক মূল্যায়ন কি হতে পারে ওই শিক্ষকের হাতে? আর এইখানেই অ্যাকাডেমিক আর না-অ্যাকাডেমিকের বিরোধ বাধে ----- বাধিয়ে তোলা হয়।

    অথচ যদি এমনটা না হত। যদি সাহিত্য নিয়ে পড়তে আসার একটা যোগ্যতা-স্মারক হত তার সাহিত্যমনস্কতা, আর মৌলিক সৃজন প্রত্যাশার একটা আবহ তৈরি করে রাখতে পারতেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্তারা, তবে হয়তো এই শাখা ওই শাখা থেকে ব্যর্থ হয়ে ফেরত-আসা পড়ুয়ারা সবেধন নীলমণি হিসেবে সাহিত্যের শাখায় ভিড় জমাতে পারতেন না এমনভাবে। তাহলে হয়তো সত্যি সত্যি সাহিত্যর ক্লাসে খুঁজে পাওয়া যেত উৎকৃষ্টতর পড়ুয়াদের, যারা হয়তো নিজেরা নিজেদের তাগিদেই জড়িয়ে যেতেন লিটল ম্যাগাজিনের ব্যতিক্রমী উদ্যোগগুলির সঙ্গে, হয়ে উঠতে চাইতেন তাদেরই শরিক। আর এই মিথস্ক্রিয়ায় সমৃদ্ধতর হত বিকল্প সাহিত্য চর্চার আধারগুলি। কারোরই তাতে কোনো ক্ষতি হত না, বরং তা ছিল দুই পক্ষেরই লাভ। খেয়াল রাখতে হবে, এই সংকট কিন্তু বিজ্ঞান বা বাণিজ্যের কোনো শাখায় নেই। বাংলা না পড়তে পেরে কেউ রসায়ন বা উদ্ভিদবিদ্যা পড়তে যেতে পারে না। তবে আপাতত এসব অরণ্যে রোদন মাত্র, সাতমণ তেল পুড়িয়েও শেষ অবধি রাধা নাচবে এমন আশা না করাই ভাল। তার থেকে চলুন, আমরা ওই নামী অধ্যাপকের পরের ক্লাসে ঢুকে পড়ি, গালে হাত দিয়ে তার পড়ানো শুনি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০৪ নভেম্বর ২০২২ | ৭৯১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অর্করূপ গঙ্গোপাধ্যায় | 45.64.***.*** | ০৪ নভেম্বর ২০২২ ১৯:৩২513438
  • খুবই প্রাসঙ্গিক লেখা। আরেকটি জিনিস বাংলা ভাষা-সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে বলতে বাধ্য হচ্ছি : ইউজিসি নেট বাংলা পরীক্ষার প্রশ্নের যে শোচনীয় মান, তাতে ভবিষ্যতের অধ্যাপকদের মানও তথৈবচ হবে এবং ইতিমধ্যেই হচ্ছে । কারণ অমুক কী রঙের জামা পরেছিলো তা জানিয়ে বা সিঁড়ি, দেওয়াল, ছাদের মধ্যে ক্রমবিন্যাস ঠিক করে আর যাই হোক সাহিত্যের অধ্যাপক হওয়া যায় না। অত্যন্ত নামী ও মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করার পর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, সেই প্রতিষ্ঠানে এখন ফার্স্ট ইয়ার থেকেই নেট সেট পাশ করে jrf নামক মোক্ষটি খুড়োর কলে বেঁধে দেওয়া হয়, যাতে বিভিন্ন বই পড়া বা রুচিনির্মাণের থেকেও গুরুত্ব পাচ্ছে উৎসাহেতে ধেয়ে চলার প্রেরণা। সেকেন্ড ইয়ার থেকে আসন্ন নেটের জন্য অল্পস্বল্প পাঠ শুরু হয়ে যাচ্ছে। এইসবের ফেরে পড়ে বোধবুদ্ধির বিকাশ বা পঠন এমন তলানিতে থাকছে যে jrf এর সৌরভও তা আটকাতে অক্ষম।
    এঁরাই  যে ভবিষ্যতের নামী অধ্যাপক হবেন সেটা ভাবলে ভালো লাগে না। (ব্যক্তিগত মতামত )
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে প্রতিক্রিয়া দিন