ছোট-মাঝারি প্রকাশকের বাংলা বই। অচেনা লেখকের প্রথম বই। বেশ গুরুগম্ভীর প্রবন্ধের আড়াইশোটি পৃষ্ঠা। কোভিডের ঝড়ে মুখ থুবড়ে পড়া বই-ব্যবসার সময়ে প্রকাশিত। নির্বাচনের ডামাডোলের দু’দিন আগে, অতিমারিতে বন্ধ-বইমেলাতে প্রকাশের জন্য রাখা বই। ইংরাজিতে একে বলে recipe for disaster, বাংলায় বলতে পারি হেরো হেরো হেরো।
তবে কিনা, শেষ অবধি হারেনি। ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম সংস্করণ বেরোনোর পরে সে-বছরই আগস্টে পরিমার্জিত দ্বিতীয় সংস্করণ অধুনা কোনও বাংলা বইয়ের হয়েছে কি? বই-বাজারের হালহকিকত জানা দুঁদে পড়ুয়ারাও নাকের ওপর চশমা তুলে সবিস্ময়ে বলছেন, সেকি!
তবে কি বাঙালি হুজুগে পড়ে বই কিনল? তেমনটাও সম্ভব বলে মনে হয় না। কোনও নামী সংবাদপত্রে বইটি নিয়ে এক কলমও ভালমন্দ সমালোচনা জোটেনি। হুজুগ তোলারও তো লোক চাই! ফেসবুকে খানিক প্রচার হয়েছে বটে, যেমন সব বইকেই প্রমোট করা হয়। তার বেশি কিছু হয়নি। লেখক বইয়ের বিষয়ে আকাদেমিক চর্চা করে খুব নাম-ডাক কিনেছেন, এমনও নয়। কেন লোকে বইটা কিনে পড়ছে, সেটা খানিকটা প্রহেলিকা। বড় জোর বলা যেতে পারে, যারা কিনেছে তারা ঠকছে না।
বাংলা বইয়ের বাজারে বিষয়টা নতুন। বছর তিনেক আগে টনি যোসেফ লিখেছিলেন একখান ইংরাজি বই, ‘আর্লি ইন্ডিয়ানস’। বেস্ট সেলারের তালিকায় নাম উঠেছিল সে বইয়ের। মধুশ্রীর বিষয় অনেকটা আর্লি ইন্ডিয়ানস-এর ধারে-কাছে। ভারতবর্ষে বিভিন্ন মানুষজন কবে এসেছে, কারা ভারতের আদি বাসিন্দা, এটা দুই বইয়েরই প্রতর্কের অন্যতম বিষয়। তবে টনি মূলত সাংবাদিক, অনবদ্য স্টোরি টেলিং-এর ওপর ভর করে তিনি এগিয়েছেন। লেখার মধ্যে তথ্য-যুক্তিতে ফাঁক থাকলেও তা সহজে ঠাওর করা মুশকিল। টনির ব্যক্তিগত পরিচয়-বৃত্ত আর ইংরাজি ভাষায় বড় প্রকাশক বাকিটা কামাল করেছে।
এদিকে মধুশ্রীর প্লাস পয়েন্ট হল দুটো। এক, মূল গবেষণা-পত্রগুলোর ক্রিটিক্যাল পাঠ। দুই, সহজ ভাষা। সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না লেখা সহজে। তারপরেও অবশ্য অধ্যাপক পার্থ পি মজুমদার তাঁর লেখা মুখবন্ধে পাঠককে প্রথমেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, বইটি পড়ার সময়ে পাঠকের পূর্ণ মনোযোগ দাবি করে- এ স্রেফ হাল্কা চালে পড়ার মত গ্রন্থ নয়। সহমত না হয়ে উপায় নেই।
এনআরসি-সিএএ ও তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের আবহাওয়াতে ভারতবর্ষের ‘আদি’ বাসিন্দা কারা তা নিয়ে রাজনৈতিক চাপান-উতর গত তিন বছরে এক অন্য মাত্রা পেয়েছে। তার সমাধানে ইংরাজি ও বাংলাভাষায় ইতিহাস-প্রাগিতিহাস চর্চা বেড়েছে। কিন্তু বাংলায় তাই নিয়ে ইতিহাসের বই ছিল না, এটিই প্রথম। সাধারণত এদেশের ইতিহাস গবেষণা এদেশের ভাষায় হয় না; এমনকি জনপ্রিয় ইতিহাস বইগুলোও প্রায়শই কেবল ইংরাজিতেই মেলে। অবশ্যই কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম রয়েছে, এবং এই বইটি তাদেরই দলে। ভবিষ্যতে এই প্রবণতা গতি পেলে ভাল হয়।
মধুশ্রী তার বইতে অবশ্য নাগরিকত্বের মত আধুনিক সমস্যা নিয়ে কিছুই বলেননি, সেখানে আলোচনা ভারত ও বাংলায় ঐতিহাসিক-প্রাগৈতিহাসিক মানুষের আগমন ও বিস্তার নিয়েই সীমাবদ্ধ থেকেছে। ভারতীয়দের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে প্রশ্ন এসেছে, কারা ভারতীয়? তারা কি অন্য কোথাও থেকে এসেছে? আমাদের সুদূরতম আদি পুরুষ ও আদি নারীর উদ্ভব কি একই জায়গায় হয়েছে? শেষ প্রশ্নটি কিঞ্চিৎ ধাঁধার মত। আদি পুরুষ আর আদি নারী পৃথক ভূমি থেকে আসবে কি করে? এই ধাঁধার উত্তর পেতে জানতে হবে বংশগতি (হেরেডিটি) আর প্রজনন বিদ্যার (জেনেটিক্স) কথা। বর্তমান বইটিতে ছোট করে তার মূলকথা দেওয়া আছে।
বইটির প্রথম অধ্যায়ে আছে মানুষের উদ্ভবের কাহিনি ও ভারতবর্ষে তাদের আগমনের কথা। দ্বিতীয় অধ্যায় হল সিন্ধু সভ্যতার মানুষদের উৎস ও তাদের উত্থান-পতনের কথা। তৃতীয় অধ্যায়ে আছে ‘আর্য’-আগমন কথা। এগুলিই হল ভারতে মূল তিনটি পরিযান। চতুর্থ অধ্যায়ে বাংলায় পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আরো দুটি পরিযান এবং বাঙালি জাতিগোষ্ঠী গঠনের কথা আলোচিত হয়েছে। পঞ্চম ও শেষ অধ্যায়ে আছে মানুষ কেমন করে ‘মানুষ’ হল, সেই কথা।
চিরাচরিত প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব আর ভাষাতত্ত্বের সাহায্যে এই সমস্ত বিষয়ে যেটুকু বলা যায়, তার সারকথা এই বইতে নানা জায়গায় বিধৃত আছে। কিন্তু বর্তমান যুগে এই আলোচনায় অবশ্য-প্রয়োজনীয় একটি ডিসিপ্লিন হল জেনেটিক্স। এই বইটি শুরুই হয়েছে বিবর্তন তত্ত্ব আর মানুষের উদ্ভব থেকে। বর্তমান বিবর্তন তত্ত্ব জেনেটিক্স কণ্টকিত, চিরাচরিত ইতিহাস পাঠকের কাছে তেমন পরিচিত নয়। প্রথম সংস্করণটি তাদের সমস্যা পুরোটা অনুধাবন করতে পারেনি, তবে বর্তমান সংস্করণে সে প্রচেষ্টা লক্ষণীয়।
বইয়ের মধ্যে ছড়ানো-ছিটানো আছে প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে কথিত গল্প। সেগুলোর ঐতিহাসিক সত্যতা নেই, কিন্তু সমকালকে চিত্রিত করার মুনশিয়ানা আছে। এই গল্পগুলোতে প্রাচীন মানুষ আর তার চারপাশের গাছ-প্রান্তর-পশুপাখির সঙ্গে আমাদের দূরত্বের বেড়া ভেঙে পড়তে থাকে-
দিনটা উষ্ণ ও আর্দ্র। আকাশের এক কোণে ঘাপটি মেরে থাকা কালো মেঘ মাঝে মাঝে সূর্যকে ঢেকে দিচ্ছে। চারিদিকে সবুজ তৃণভূমি; দূরে নীল পাহাড়ের ঢালে স্লেটের মত ধূসর অরণ্য ভূমির রেখা দেখা যায়। সহস্র পশু চলেছে একে অপরকে অনুসরণ করে। ওয়াইল্ড বিস্ট, এলাণ্ড, ইম্পালার দল খাদ্যের সন্ধানে ধীর গতিতে চলেছে। ওই পশুদের অনুগমন করছে খান শতেক মানুষ। মানুষগুলো লম্বা, কালো, হিলহিলে। ওদের কোমরে এক টুকরো পশু চর্ম বাঁধা আছে। হাতে আছে পাথরের কুঠার। ওরা জানে না কোথায় চলেছে, শুধু জানে ওই পশুদের সঙ্গে হেঁটে যেতে হবে। তবে মিলবে নতুন খাদ্য সমৃদ্ধ ভূমি।
এই হল এক লক্ষ তিরিশ থেকে আশি হাজার বছর আগেকার পূর্ব আফ্রিকার এক খণ্ড-চিত্র।