সুবর্ণা জানিয়েছে—
“রোহন আজ বাড়ি ফিরে এল অসময়ে। ভাবলাম পড়া পারেনি বলে মাস্টারমশাই ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। হঠাৎ আমার কাছে এসে বলল, মা, তোমার কি করোনা হয়েছে?
আমার ক্যানসার। কয়েক বছর ধরে চিকিৎসা চলছে—আপাতত নিউ টাউনের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে। মরে যেতে পারি যে কোনো দিন, আবার বেঁচেও থাকতে পারি দশ-বিশ বছর। আমি ট্রিটমেন্ট এর জন্য টাটাতে যাচ্ছি, তাই নাকি আমার থেকে করোনা ছড়িয়ে পড়বে। এই ভয়ানক দুশ্চিন্তা এবং সামাজিক কর্তব্যপালনের দায় থেকে রোহনের সহপাঠীদের বাবা-মায়েরা রোহনকে বলেছেন, টিউশন পড়তে আসিস না তুই।”
মধুদা কাটোয়ায় একাই থাকছেন এখন, স্ত্রী নাতনির দেখাশোনা করার জন্য কলকাতায়। লকডাউন হবার পরে যাতায়াত বন্ধ। রবিবার চার মাস পর গাড়ি ভাড়া করে মধুদার মেয়ে তার মাকে নিয়ে এসেছে কলকাতা থেকে। মধুদা তাদের জন্য বাজার করে রেখেছেন, আদরের নাতনিও আসছে যে! বাজার থেকে ফিরতে না ফিরতেই দরজার সামনে জটলা। শুভানুধ্যায়ীর দল। “দাদা, আজ বৌদিরা আসছেন?” উত্তর শুনে তাঁদের আবার প্রশ্ন, তা সব কাগজপত্তর তৈরি করে আনছেন তো ? কিসের কাগজ? কেন? ওরা যে করোনা রোগ নিয়ে ঢুকছেন না, তার কাগজ!
এদিকে ট্রেন না চললেও কাটোয়া-কলকাতা বাস চলছে রোজ। সবাই অফিস করছে বাসে করে। তাদের রোজ করোনা সার্টিফিকেট লাগে নাকি? তা লাগেনা, তবে কিনা…
তবে কিনা মধুদা একা মানুষ, তাঁর হয়ে শুভানুধ্যায়ীর দলকে ভাগানোর মতো লোকের অভাব। তাই শহরে ঢোকার রাস্তাতে গাড়িতে তিনঘন্টা বসে রইলেন এক বৃদ্ধা, তাঁর কন্যা ও নাতনি। ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে দেখাতে ডাক্তার অবাক! লিখে দিলেন করোনার কোনো জ্ঞাত সিম্পটম নেই—অবশেষে অনুমতি মিলল নিজের বাড়ি ঢুকবার। ততক্ষণে সকালে কেনা মাছ তরকারি ফ্রিজে নেতিয়ে গিয়েছে। বেলা দুপুর গড়িয়ে বিকেল।
এখন করোনা তথা হচ্ছে বলে অন্য আর কোনো রোগ হচ্ছে না, এমন তো নয়। সর্দি কাশি জ্বর পেট খারাপ ইত্যাদি দৈনন্দিন রোগ হচ্ছে। হচ্ছে হার্টের রোগ, হচ্ছে চোখের বা স্কিনের রোগ, নাক কান গলার রোগ, স্নায়ুরোগ, মনের রোগ। এমনকি আমাদের হাত-পা মাঝেমধ্যে অবিবেচকের মত ভেঙেও যাচ্ছে। ক্যানসার বা হার্ট এ্যাটাকের মত মারাত্মক রোগ কভিডের জন্য ছুটি নেয়নি, এমনকি তারা যে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছে, এমন কোন খবরও পাঠায়নি। তারা রীতিমতো রোগীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে ভিজিট করছে, যদিও ডাক্তারবাবুরা খুব সঙ্গত কারণেই এখন রোগীদের বাড়ি বিশেষ যেতে পারছেন না।
এমন অবস্থায় রোগ হলে লোকে যে যার সাধ্যমতো ডাক্তার দেখাচ্ছেন। যাদের একটু পয়সা আছে রোগ হলে তাঁরা প্রথমে পাড়ার ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন, তেমন রোগ হলে স্পেশালিস্ট ডাক্তার। বড় রোগে কর্পোরেট হাসপাতাল বা নার্সিং হোম। গরীবরা যাচ্ছেন সরকারি হাসপাতালে। কিন্তু ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতালে কাছে যেতে হচ্ছে সকলকেই। প্রাইভেট ব্যবস্থায় সব সমান নয়। কোথাও ঠিকমতো দূরত্ব বজ্য রাখার, মাস্ক পরানোর জন্য কর্মচারীরা বেশি চেষ্টা করছেন, কোথাও কম। সরকারি হাসপাতালে লম্বা লাইন। ঠিকমতো মাস্ক পরার ও দূরত্ব বজায় রাখা হচ্ছে না। অর্থাৎ বাজারে বা অফিসে বা বাসে অটোতে কোভিদ সংক্রমণের যেটুকু ঝুঁকি নিতেই হচ্ছে আমাদের, হাসপাতালেও তাই। এরকম ঝুঁকি না নিয়ে হয়তো বড় মন্ত্রী, নেতা বা বিলিয়নেয়ার, এরা বাঁচতে পারেন। আমজনতা তো তা পারেনা।
এর মধ্যেও আমজনতা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে। নিজেরাই ঠিক করে নিচ্ছে, ওই লোকটা যা যা করে তাতে ওর কোভিড হবার ঝুঁকি খুব বেশি। যেমন কিছুদিন আগে শুরু হয়েছিল নার্স এবং ডাক্তারদের পাড়াছাড়া করার তোড়জোড়। তারাই নাকি পাড়াতে করোনা ছড়াচ্ছে। নার্স এবং ডাক্তাররা যথেষ্ট প্রশিক্ষিত বলে নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে ঝুঁকির অবস্থায় কাজ করেও নিজেদের সংক্রমণ থেকে বাঁচান, সেটা এতদিনে পরিসংখ্যান থেকে প্রমাণিত। কিন্তু তবু লোকের ছুতমার্গ যায়না। ভাগ্যক্রমে ডাক্তার এবং নার্সরা নিজেদের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারেন এটা প্রমাণ করে ফেলেছেন, তাই এখন তাদেরকে টার্গেট কম করা হচ্ছে।
এখন টার্গেট হচ্ছে সাধারণ লোক যিনি কোনো কারণে হাসপাতালে যেতে বাধ্য হয়েছেন। বিশেষ করে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা যদি করতে হয়, তাহলে বাড়ি ফেরার সময় নিজের প্রতিবেশীদের সন্দেহভাজন হয়ে পড়ছেন এরা। সামাজিক বয়কটের হুমকি আসছে। সত্যি সত্যি "বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান" বলে রক্তচক্ষু প্রদর্শন পর্যন্ত হচ্ছে। যারা এইসব হুমকি দিচ্ছেন তারাও কিন্তু অনেকেই সাধারণ মানুষ। তারাও হয়তো দুদিন পরে নিজের কোনো বিপদে হাসপাতাল গিয়ে ভর্তি হচ্ছেন। তখন পুরনো পাপ ফিরে এসে তাদের তাড়া করছে। যারা একসময় অন্যকে বাড়িছাড়া করবার হুমকি দিয়েছিলেন, তারা এবার নিজেই বাড়িছাড়া হবার হুমকি পাচ্ছেন।
অথচ,
১) হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজনে যারা ভর্তি হচ্ছেন তাদের দরকার মনে করলেই কোভিদ টেস্ট করা হচ্ছে। অন্যদের সে টেস্ট করানোর সুযোগ নেই।
২) যে সমস্ত মানুষ বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন এবং খুব সতর্কভাবে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করছেন, তাদের থেকেও সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য মানুষেরা গড়পড়তায় অনেক বেশি সতর্ক।
হাসপাতাল ফেরত মানুষ, বা অন্য শহর থেকে আগত মানুষ, এদের আগমনে রোগ ছড়ানোর আতঙ্কের কোনো বাস্তবসম্মত ভিত্তি নেই। আর হুমকি দেওয়া শুধু বেআইনি নয়, তা হুমকি দেওয়া লোকটির ভবিষ্যতের পক্ষেও খুব বিপজ্জনক। অন্য শহরে থাকলে বা হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা করলেই করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যায় না। আর তার বাড়ির লোককে সামাজিকভাবে বয়কট করা তো হাস্যকর বোকামি।
সমস্যা হল যখন একসঙ্গে অনেক লোক অকারণ আতঙ্কে ভোগেন, আর সেই আতঙ্ক থেকে আক্রমণাত্মক হয়ে পড়েন, তখন তাদের বুঝিয়ে শান্ত করা খুব কঠিন ব্যাপার, অসম্ভবই বলা যায়। সরকার থেকে যতই ফোনের কলার টিউনে প্রচার করা হোক না কেন, রোগ নিয়ে বৈজ্ঞানিক সত্য ভুলে গুজবে কান দেওয়া মানুষ খুব কম নয়।
এর বিপরীত উদাহরণও আছে। হাসপাতালে কাজ করা এক চিকিৎসক লিখছেন—
"আমার কোয়ার্টারের গায়ে লাগা হাসপাতাল, তার মর্গ হাসপাতালের পিছনে। আমাদের বেডরুম বা ব্যালকনি থেকে দূরত্ব খুব বেশি হলে একশো ফুট। সেখানে প্রায় প্রতিদিন তিন থেকে চারটি সর্বাঙ্গ ঢাকা মরদেহ ঢুকছে অথবা বেরুচ্ছে। পিপিই পোশাক পরিধায়ী জনা চারেক মানুষ সে কাজে লিপ্ত। অনুমান করা যায় মরদেহগুলির কিছু করোনা আক্রান্তের নয়। হাসপাতালটি প্রথমে কোয়ারেন্টিন সেন্টার হিসেবে নেওয়া হয়েছিল, এখন কোভিড চিকিৎসাও হয়, উপায় নেই।
এখন পর্যন্ত আশপাশের কেউ করোনা আক্রান্ত হয়েছে বলে শুনিনি। আবার হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স অথবা অন্যান্য কর্মচারীরাও নিরাপদ আছেন বলেই জানি।
সুতরাং যথাযথ নিরাপত্তা, দূরত্ব বজায় রাখলে সংক্রমণ এড়ানো সম্ভব।"
চন্দননগরের এক ব্যস্ত চিকিৎসক। সামনের ফ্ল্যাটে ‘করোনা বেরিয়েছে’। ক্লাবের ছেলেরা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে এসে বলল, ডাক্তারবাবু, চেম্বার বন্ধ করে দিন—রোগীদের বিপদ, আপনিও সপরিবারে থাকেন। ডাক্তারবাবু বুঝতে পারছিলেন না এটা কি হুমকি, নাকি সত্যিই শুভাকাঙ্ক্ষী এরা। শুভাকাঙ্ক্ষী বলেই মনে হল যখন, তখন বুঝিয়ে বললেন। বাজারে বাসে দোকানে না-জানা করোনা রোগীর কাছ থেকেই বিপদ, কারণ আমাদের দেশে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা হয় না, সবাই মাস্ক ঠিকমতো পরতে জানেন না। সামনের ফ্ল্যাটে করোনা হয়েছে সেটা তাঁরা জানেন ও ব্যবস্থা নিচ্ছেন। আলাদা আছেন, বাড়ির বাইরে করোনা-আক্রান্ত বেরচ্ছেন না। ক্লাবের ছেলেরা বুঝল। তারপর ডাক্তারবাবু বললেন, একটা কাজ করবেন? ওদের বাড়িতে নিয়মিত রান্না করা খাবার পৌঁছে দেবেন?
বিকেলে তার ব্যবস্থা হল। একজন বাড়ি বাড়ি খাবার হোম ডেলিভারি করেন, তাঁকেই ধরে বলা হল। ক্লাবের ছেলেরাই এখন অন্যদের বলছেন, মাস্ক ঠিক করে পরতে। গরীব বলে অনেকেই মাস্ক পরা বা দূরত্ব বজায় রাখা হাত ধোয়া এগুলো ঠিক্মতো পারবে না। কিন্তু যারা পারবে তারা যেন সখ করে নিজের বা অন্যদের বিপদ না বাড়ায়।
করোনা হোক আর ক্যানসার। কিংবা বাচ্চার জ্বর বা প্রেগন্যান্সি। ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতালে মানুষকে যেতেই হবে। চড়তে হবে বাসে, যেতে হবে অফিসে, কর্মস্থলে। একশ ভাগ নিরাপত্তার কোনো গ্যারান্টি নেই কোনোখানেই। ঠিকমতো মাস্ক পরা আর দূরত্ব বজায় রাখা—এতেই যেটুকু নিরাপত্তা—সে অন্য শহরে হোক আর হোক হাসপাতাল থেকে বাড়িতে। নাক থেকে মাস্ক অর্ধেক নামিয়ে বাজার করছেন যিনি, অকারণে বিপদ বাড়াচ্ছেন তিনিই। আর হ্যাঁ, কাকে টেস্ট করাতে হবে সে নিয়ে পাড়ার লোকের কাগজ-পড়া টিভি-দেখা পাণ্ডিত্য আসলে অত্যাচার।
এই অত্যাচার করলে সবচেয়ে বিপদ হল, অত্যাচার যারা করছেন, তাদেরও একদিন হাসপাতালে যেতে হবে, আর তখন তাদের ওপরে এই অত্যাচার ঠিক ফেরত আসবে। যারা হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হবার অপরাধে বা অন্য শহর থেকে আসার কারণে প্রতিবেশীকে বয়কট করছেন, তারা এটুকু মনে রাখবেন। এই প্রবণতা চললে একদিন তাদের নিজেদেরও এই বয়কটের শিকার হতে হবে।
হবেই।
কাটোয়ার ঘটনাটির মতো ঘটনা বৈদ্যবাটিতেও ঘটেছে। এক ষাটোর্ধ দম্পতি কলকাতায় মেয়ের বাড়ি গেছিলেন। বাড়ি ফেরার সময় পুলিশ নিয়ে ঢুকতে হয়েছে।
অত্যন্ত যথাযথ। চারপাশে এই মাস্তানি দেখতে দেখতে ক্লান্ত।