দ্বিতীয় অংশ
কথারম্ভ
করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন কিংবা ওষুধ আবিষ্কার প্রায় হয়েই গেল বলে নিত্যনতুন খবরের বিরাম নেই। সমস্যা হল, করোনা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার উপযোগী রসদ, অর্থাৎ নির্দিষ্টভাবে ভাইরাসকে মারার উপযুক্ত অ্যান্টিবডি ও এই নির্দিষ্ট ভাইরাস মারার জন্যই প্রস্তুত রক্তকণিকা আমাদের দেহে তৈরি হয়ে নেই। কারো দেহে একবার ভাইরাস আক্রমণ হলে তবেই সেরকম সুনির্দিষ্ট অস্ত্রশস্ত্র দেহে তৈরি হবে। অন্য উপায় হল করোনা-র কার্যকর ভ্যাক্সিন বা টিকা। কিন্তু ভ্যাক্সিন পাবার পরে, বা একবার করোনা বীজাণুর আক্রমণ হবার পরে, দেহে যে বীজাণু-মারা অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হবে, তা কোভিড-১৯ ভাইরাসকে মারতে পুরো সক্ষম হবে তো? যেমন আরেকটি ভাইরাসঘটিত রোগ গুটিবসন্ত একবার হলে সারাজীবনের জন্য আর গুটিবসন্ত হয় না, আর তার ভ্যাক্সিন একবার শরীরে গেলেও তা প্রায় একই রকম সুরক্ষা দেয়। কিন্তু কোভিড-১৯ রোগের ক্ষেত্রে কি সেরকম হবে? মনে রাখতে হবে, একবার জলবসন্ত হলে জীবনে আর জলবসন্ত হয় না, কিন্তু অন্যান্য অধিকাংশ ভাইরাসঘটিত রোগ একবার হলে সারাজীবন তার থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায় না। যেমন ভাইরাল ফ্লু বারবার হতে পারে। আবার টিকা দিয়ে সুরক্ষা অনেকসময়েই আংশিক, যেমন ফ্লু ভ্যাক্সিন নিয়ে এত বছর এত গবেষণার পরেও তা মোটামুটি ৫০% মতো সুরক্ষা দেয়, জলবসন্ত ভ্যাক্সিন দেবার পরেও ২৫%-৩০% ক্ষেত্রে জলবসন্তের কমজোরি আক্রমণ হওয়া সম্ভব।
এইসব মনে রেখে আমরা জেনার-এর গুটিবসন্ত ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করার ইতিহাস খুঁটিয়ে দেখব। বুঝতে চেষ্টা করব কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিনের কতটুকু কার্যকারিতা আশা করা বাস্তবসম্মত, আর কতোটা স্রেফ লাক বা চান্স! অবশ্য আগেকার দিন আর নেই, আমরা বিজ্ঞানে অনেক এগিয়েছি। তবে মানবদেহে ভ্যাক্সিন পরীক্ষা করা এখন অনেক বেশি আইনকানুনের নিগড়ে বাঁধা, অন্যদিকে ভ্যাক্সিন তৈরি করতে পারলে সম্ভাব্য লাভের অঙ্কটা বিশাল। ফলে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে কোভিড ভ্যাক্সিনের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ আঁচ করা বেশ সমস্যার ব্যাপার।
পর্ব ২
গুটিবসন্ত বীজাণু শরীরে ঢুকিয়ে রোগ আটকানোর পদ্ধতি ভারত ও চীনে চলত। এর নাম ছিল ভ্যারিওলেশন, বা ভ্যারিওলা তৈরি করা। ভ্যারিওলা মানে গুটিবসন্ত। আর জেনার-এর পদ্ধতির নাম হবে ভ্যাক্সিনেশন। এই শব্দদুটো আমাদের মনে রাখতে হবে।
সাধারণাব্দ (CE) ১৮০০ সাল নাগাদ এডোয়ার্ড জেনার গুটিবসন্তের টিকা, ভ্যাক্সিন, আবিষ্কার করলেন। তার ১৭০ বছর পরে বিশ্ব থেকে গুটিবসন্ত নির্মূল করা গেল। কিন্তু প্রথমে ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটি ভ্যাক্সিনেশন মানে নি।
জেনার যেভাবে গো-বসন্ত আর গুটিবসন্ত বীজাণু মানুষের দেহে ইচ্ছেমত প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন, আজকের দিনে এইভাবে সরাসরি মানুষের ওপর পরীক্ষা করা যায় না। কিন্তু সেসময় এরকম পরীক্ষা চলত । আর তখন চিকিৎসাশাস্ত্র এতোই অনুমাননির্ভর ছিল, মানুষের ওপর করা পরীক্ষার এতোই অভাব ছিল যে এক-দুজন মানুষের রোগ ঠেকানো গেলে সেটাকেই একটা বেশ বড়সড় প্রমাণ বলে ভাবা হত। তাই জেনার-এর টিকার এমন হাতেগরম ফল সাধারণভাবে অগ্রাহ্য হবার কারণ ছিল না। কিন্তু ইংল্যান্ডের ডাক্তার সমাজ এই টিকা আবিষ্কারকে চট করে মেনে নিতে পারলেন না, বরং তাদের একটা বড় অংশ একে উড়িয়ে দিতে চাইলেন।
তখন ইংল্যান্ডে বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে মান্যতা দেবার মতো একটাই সংস্থা ছিল—রয়াল সোসাইটি। রয়্যাল সোসাইটিতে জেনার তাঁর গবেষণাপত্র পাঠালেন, কিন্তু সোসাইটি তা ছাপল না, ফিরিয়ে দিল। অবশ্য এর পেছনে অনেক কারণ আছে, আর তা পুরোটা জেনারের এই পরীক্ষা নিয়ে অবিশ্বাসের ফল নয় (পাদটিকা ১)। তখন অনন্যোপায় জেনার তাঁর অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার ঝেড়ে ২৩টি কেস রিপোর্ট একত্র করে একটি ছোট বই ছাপালেন—An Inquiry into the Causes and Effects of the Variolae Vaccinae।
জেনারের এই বইতে ছিল ২৩-টি কেস রিপোর্ট। তখনকার বিচারে সংখ্যাটি কম বলা যেত না। তবে সবকটি কেস একরকম ছিল না।
কিন্তু জেনারের আগে ভ্যারিওলেশন পদ্ধতি ইউরোপ আমেরিকায় চালু হয়েছিল। আর সেটা জেনারের পদ্ধতির খানিকটা প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিল।
রাণী মারিয়া থেরেজা-র (১৭১৭- ১৭৮০ সাধারণ অব্দ) কথা এখন অনেকেই ভুলে গেছেন। পূর্ব-ইউরোপের নানা দেশে পর্যটকেরা এখনও অজস্র প্রাসাদ ও গীর্জায় অষ্টাদশ শতকের এই প্রবল-প্রতাপশালী রাণীর সপরিবার চিত্র দেখে অবাক হয়ে গাইডকে জিজ্ঞেস করেন—কে এই রাণী? পর্যটকের দোষ নেই, প্রথম মহাযুদ্ধে অস্ট্রো-হাঙ্গারিয়ান সাম্রাজ্য প্রথম আক্রমণ শুরু করেছিল বটে, কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের শেষে সেই সাম্রাজ্য ধ্বংস হয় যায়—তাই সেখানকার পূর্বতন রাণীকে কে-ই বা মনে রাখবে!
সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক, ফ্রেডরিক দ্য গ্রেট (১৭১২-১৭৮৬ সাধারণ অব্দ) নামেই বেশি খ্যাত, প্রুশিয়া সাম্রাজ্যের ‘আলোকপ্রাপ্ত চরম-ক্ষমতাধর’এর ধারনার প্রবক্তা, ভবিষ্যতের জার্মানির মেরুদণ্ড গড়ে তোলার নায়ক, তাঁকেও আমরা খুব বেশি মনে রাখিনি। অথচ মনে রেখেছি এই সময়ের এক ব্যর্থ ‘অপদার্থ’ শাসক, ফ্রান্সের সম্রাট ষোড়শ লুই-কে (১৭৫৪ -১৭৫৩ সাধারণ অব্দ), কারণ তাঁর গলা গিলোটিনে কাটা পড়েছিল। আর মনে রেখেছি রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী জারিনা দ্বিতীয় ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট-কেও (১৭২৯-১৯৯৬ সাধারণ অব্দ), তবে সেটা বোধহয় স্বামীকে সরিয়ে সিংহাসন দখল আর অজস্র সেক্স-স্ক্যান্ডালের জন্য।
কিন্তু অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্দ্ধের ইউরোপের এই বিখ্যাত রাজপরিবারগুলোর মধ্যে কী মিল ছিল বলুন তো?
এঁদের সবার টিকা দেওয়া ছিল। না, রাজটিকা নয়, সেটাও ছিল হয়তো, আমি গুটিবসন্তের টিকার কথা বলছি। এবং এই টিকা তাঁদের সকলকেই গুটিবসন্ত থেকে আজীবন সুরক্ষা দিয়েছিল।
কিন্তু এঁরা তো ১৮০০ সালের আগেই ধরাধাম ত্যাগ করেছিলেন। আর জেনার সাহেবের টিকা আবিষ্কার হল ১৭৯৭ সালে, সেটা চালু হয়েছিল ১৮০০ সালে। এঁরা টিকা পেলেন কোত্থেকে? শুধু এঁরা নিজেরা নন, এঁদের পরিবারের সবাই টিকা নিয়েছিলেন, এমনকি সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক প্রুশিয়া-র সৈন্যদলের সবাইকে টিকা দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন! রহস্যটা কোথায়?
যারা একটু মন দিয়ে পড়েছেন তাঁরা অবশ্যই বুঝতে পেরেছেন, রহস্য কিছু নেই। এই রাজারাণীরা গুষ্টিশুদ্ধু যে টিকা নিয়েছিলেন তা জেনারের টিকা নয়, তা হল ভারত-চীন থেকে তুরস্ক হয়ে আমদানি করা ভ্যারিওলেশন—গুটিবসন্তের রস থেকে প্রস্তুত করা টিকা। জেনারের টিকা চালু হবার পর থেকে ভ্যারিওলেশনের ভূমিকা অস্বীকার করার জন্যই যেন জেনারের টিকা থেকেই ইতিহাসে ভ্যাক্সিন-এর শুরু, এমন একটা ধারনা চালু করা হয় । ইউরোপকেন্দ্রিক ইতিহাসে এমনই হবার কথা। কিন্তু সেটা বলার পরেও প্রশ্ন থাকে—কেন একটা প্রচলিত টিকা-পদ্ধতি ইউরোপে চালু হয়ে, সেখানকার রাজাগজাদের স্বীকৃতি পেয়েও তারপর ইতিহাস থেকে একেবারে নামসমেত লোপাট হয়ে গেল! কোন ভূমিতে জেনারের ভ্যাক্সিন সারজল পেয়ে প্রতিষ্ঠা পেল?
অষ্টাদশ শতকের ইউরোপে বছরে চার লক্ষ মানুষ গুটিবসন্তে মারা যেত, আর মোটামুটি সমসংখ্যক মানুষ একচোখ বা দুচোখেই অন্ধ হয়ে যেত। বাচ্চাদের বসন্ত হলে শতকরা আশিজন মরে যেত। রাজপরিবারগুলোও রক্ষা পেত না। বেঁচে গেলে চামড়ায় দাগ এতোই বিশ্রী হত যে রোগটার ল্যাটিন নাম ছিল ‘ভ্যারিওলা’, চামড়ায় দাগের রোগ, আর ইংরেজি নাম পক্স কথাটাও মুখে গর্ত হবার প্রাচীন ইংরেজি শব্দ থেকে নেওয়া। এরকম রোগের চিকিৎসা খুঁজছিলেন সবাই, কিন্তু সেটা এল পূর্বদিক থেকে।
আমরা আগেই দেখেছি ভারত, চীন আর আফ্রিকার কোনো কোনো জায়গায় কয়েক শতাব্দী ধরে ভ্যারিওলেশন টিকা চালু ছিল। কোনো রোগীর গুটিবসন্তের গুটির রস অন্য মানুষের চামড়ায় টিকা হিসেবে দেওয়া হত। টিকা দেবার পরে টিকার জায়গাটা ফুলে ফোস্কা বেরত, জ্বর হত। দেহের অন্যত্রও সামান্য গুটিবসন্তের গুটি বেরত, তারপর সেরে যেত। ক্বচিৎ কদাচিৎ কারও টিকা নেবার ফলে পুরোদস্তুর গুটিবসন্ত হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারত। তাছাড়া যেহেতু অন্য মানুষের শরীরের রস দেওয়া হচ্ছে, তাই টিকা থেকে টিবি, সিফিলিস এসব হতে পারত, আর পুঁজ হয়ে কষ্টকর ঘা হওয়া বেশ সাধারণ ঘটনা ছিল। কিন্তু গুটিবসন্তের মতো ভয়ানক রোগ আটকাতে লোকে টিকার এইটুকু বিপদ মেনে নিত।
অটোমান সাম্রাজ্য থেকে সপ্তদশ শতকের শেষদিকে ইউরোপীয়দের লেখা ভ্যারিওলা টিকার প্রথম বিবরণ পাওয়া যায়, আর তারাই ইউরোপে এ-বিষয়ে লিখে পাঠায়। ছ’শ বছর ধরে ইরাক থেকে তুরস্ক নিকটপ্রাচ্য এবং পূর্ব ইউরোপ জুড়ে অটোমানদের বিরাট সাম্রাজ্য ছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তা বিলুপ্ত হয়। তুরস্কের ইস্তাম্বুল থেকে কয়েকজন ইংরেজ ১৭১৪ সালে ভ্যারিওলেশনের পদ্ধতির বিবরণ দিয়ে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিকে চিঠি লেখেন।
ইংরেজ অভিজাত-কন্যা লেডি মেরি মন্টাগু-র (১৬৮৯ -১৭৬২ সাধারণ অব্দ ) গুটিবসন্ত হয়েছিল—তাঁর মুখটা দাগে কদর্য হয়ে যায়। পরের বছর তাঁর ভাই গুটিবসন্তে মারা যায়। তারপর লেডি মন্টাগু-র স্বামী ইংল্যান্ডের রাজপ্রতিনিধি হিসেবে ইস্তাম্বুলে আসেন। এখানে এসেই লেডি মন্টাগু ভ্যারিওলেশন টিকা-পদ্ধতি দেখেন আর একে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে একমাত্র হাতিয়ার বলে বুঝতে পারেন। তিনি নিজের বাচ্চা ছেলেকে টিকা দেন। ইস্তাম্বুল থেকে লন্ডনে ফিরে লেডি মন্টাগু তাঁর পরিচিতির বৃত্তে থাকা অভিজাত ইংরেজদের বোঝান--টিকা ছাড়া তাঁদের ছেলেমেয়েদের বাঁচার রাস্তা নেই।
ডা. চার্লস মাইটল্যান্ড প্রথমে লেডি মন্টাগু-র কথায় নিজের বাচ্চা মেয়েকে টিকা দেন, তারপর ভ্যারিওলেশন-এর ট্রায়াল করার জন্য তিনি রাজকীয় অনুমোদন লাভ করেন ও ছয়জন বন্দীর দেহে টিকা দিয়ে তার ফলাফল লিপিবদ্ধ করেন। ডা. মাইটল্যান্ড বন্দীদের প্রথমে ভ্যারিওলেশন অর্থাৎ গুটিবসন্তের রস দিয়ে টিকাকরণ করলেন। তারপর এদের গুটিবসন্ত রোগীদের সংস্পর্শে এনে দেখা গেল রোগটি ওদের হল না। এর কয়েকমাস পর ১৭২২ সালে স্বয়ং প্রিন্সেস অফ ওয়েলস-এর দুই কন্যাকে ভ্যারিওলেশন করলেন ডা. মাইটল্যান্ড। এরপর ইংল্যান্ডে অভিজাত সমাজে ভ্যারিওলেশন পুরোদমে চালু হয়ে গেল।
সেই অষ্টদশ শতকের মাঝামাঝিই গোটা ইউরোপে চিকিৎসক সমাজ একটা বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিল। এক দেশে একটি আবিষ্কার হলে তা দ্রুতই অন্যদেশে ছড়িয়ে পড়ত। (পাদটীকা ২) ফলে ইংল্যান্ডের ডাক্তাররা একবার ভ্যারিওলেশন মেনে নিলে, গোটা ইউরোপে এই টিকা ছড়িয়ে পড়ল। এবং আগে যেমন বলেছি, ইউরোপের রাজারাজড়া সবাই এই টিকা নিলেন—যদিও তখনও জনসাধারণের টিকাকরণ নিয়ে তেমন প্রচেষ্টা ছিলনা—একমাত্র প্রুশিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক সৈন্যদলের সবাইকে টিকা দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন ।
ইউরোপে টিকাকরণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আমেরিকায় ইউরোপীয় কলোনিগুলোতে ভ্যারিওলেশন ছড়িয়ে পড়ল। বিশেষ করে বোস্টন ও ম্যাসাচুসেটস-এর নান জায়গায় কয়েকজন ডাক্তার ভ্যারিওলেশন শুরু করলেন। কিন্তু সেখানে এর বিরুদ্ধ জনমত শক্তিশালী ছিল—বোস্টনের এক ডাক্তারের বাড়িতে টিকা দেবার অপরাধে কে বা কারা বোমা মেরেছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ১৭২১ সালের গুটিবসন্ত মাহামারির সময় টিকার পক্ষে থাকা ডাক্তাররা পরীক্ষা সহকারে প্রমান করে দেখালেন যে, টিকা নিলে ক্ষতি হয় কম। বোস্টনের ১২,০০০ মানুষের আর্ধেকের গুটিবসন্ত হয়েছিল—যাদের টিকা দেওয়া হয়নি তাদের শতকরা ১৪ ভাগ মারা যায়। অন্যদিকে টিকা দেওয়া লোকেদের শতকরা মাত্র ২ ভাগ মানুষ মারা গিয়েছিল। বিশ্বের ইতিহাসে মহামারি বিষয়ে এটাই প্রথম পরিসংখ্যান-তত্ত্বের প্রয়োগ।
ভ্যারিওলেশন ইউরোপ-আমেরিকায় রীতিমত জাঁকিয়ে বসেছিল। তাহলে তাতে সমস্যা কী এমন ছিল যে জেনারের টিকা বা ভ্যাক্সিন আসার পরে ভ্যারিওলেশন গুরুত্ব হারাল, আর তার চল্লিশ বছর পরে ভ্যারিওলেশনকে ইংল্যান্ড আইন করে তুলে দিল? ভ্যারিওলেশন টিকা দেবার রস যেহেতু অন্য মানুষের দেহ থেকে নেওয়া হত, টিকার জায়গায় ঘা, এমনকি সিফিলিস ও টিবি-রোগ হওয়ার সম্ভাবনা ভ্যারিওলেশন পদ্ধতিতে ছিল। কিন্তু তা তো জেনারের পদ্ধতিতেও ছিল, কারণ জেনারের ভ্যাক্সিন দুভাবে তৈরি হত—সরাসরি গোরুর বসন্তগুটির রস থেকে, অথবা (গো-বসন্তের বীজাণু দিয়ে) মানুষের হাতে ফুস্কুড়ি তৈরি করে, সেই ফুস্কুড়ির রস থেকে।
ভ্যারিওলেশনে মূল বিপদ, যা ভ্যাক্সিনে ছিল না, তা হল এই। গো-বসন্ত মানুষের দেহে গুরুতর রোগ হিসেবে দেখা দিত না। অন্যদিকে, ভ্যারিওলেশন পদ্ধতিতে টিকা-পাওয়া মানুষের গুটিবসন্ত রোগটিই হত, রোগলক্ষণ হয়তো কম হত। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঐ টিকা থেকেই একেবারে পুরোদস্তুর গুটিবসন্ত হত, বিরল ক্ষেত্রে গুটিবসন্তের মহামারির উৎস হয়ে দাঁড়াত কোনো একজন টিকা পাওয়া মানুষের টিকাজনিত গুটিবসন্ত।
তবু জেনারের ভ্যাক্সিন প্রথমে কিছু বাধার সম্মুখীন হয়। আমরা আগেই দেখেছি, রয়্যাল সোসাইটি প্রথমে জেনারের গবেষণাপত্র ছাপেনি, জেনার তাঁর অভিজ্ঞতার ২৩-টি কেস রিপোর্ট দিয়ে একটি ছোট বই ছাপালেন। সেই পুস্তিকাটিও প্রথমে ইংল্যান্ডের ডাক্তারদের মধ্যে বিরাট সাড়া জাগায়নি। তবে কয়েকজন ডাক্তার ব্যক্তিগতভাবে বইটি পড়ে বা জেনারের সঙ্গে আলাপের সুবাদে, তাঁর পদ্ধতিতে ভ্যাক্সিন দিতে চাইলেন। আমরা এখানে মনে রাখব, ভ্যাক্সিন কথাটা কিন্তু তখনও ব্যবহার করা শুরু হয়নি, তবে গুটিবসন্তের রস থেকে ভ্যরিওলেশন পদ্ধতি তখন প্রাচ্য থেকে এসে ইউরোপে মোটামুটি চালু হয়ে গেছে, আর তার জায়গায় গো-বসন্তের গুটি থেকে ভ্যাক্সিন চালু করার চেষ্টা করতে হচ্ছে জেনারকে। (পাদটীকা ৩)
জেনার নিজে লন্ডনে গিয়ে তিনমাস ধরে ভ্যাক্সিন দেবার জন্য ভলেন্টিয়ার খুঁজলেন, কিন্তু একজনকেও পেলেন না। অন্যদিকে ঐ লন্ডনেই জেনারের পদ্ধতিতে জেনারের সংগ্রহ করে আনা (গো-বসন্তের) রস দিয়ে ভ্যাক্সিন দিচ্ছিলেন কেউ কেউ, বিশেষ করে সার্জন হেনরি ক্লাইন। এর বেশ কিছু পরে ডা. জর্জ পিয়ারসন আর ডা. উইলিয়াম উডভাইল নিজেদের রোগীদের জন্য জেনারের ভ্যাক্সিন সমর্থন করতে শুরু করলেন। এইভাবে একে একে বেশ কয়েকজন ডাক্তার জেনারের ভ্যাক্সিন ব্যবহার করা শুরু করার পরে জেনার সারা ইংল্যান্ড জুড়ে সমীক্ষা চালালেন—কোথায় কে এই ভ্যাক্সিন ব্যবহার করেছেন আর তার ফল কী। তাঁর সমীক্ষায় দেখা হত, জেনারের ভ্যাক্সিন নেবার পরে কারও স্বাভাবিকভাবে গুটিবসন্ত হয়েছে কিনা। অথবা তাদের ভ্যাক্সিন দেবার পরে ভ্যারিওলেশন করলে তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, যেমন জ্বর, গায়ে গুটি বেরনো, এসব হয়েছে কিনা। ভ্যাক্সিন নেবার পরে গুটিবসন্ত হলে, বা ভ্যারিওলেশন-জনিত গুটি বেরোলে, ভ্যাক্সিন সুরক্ষা দেয় নি ধরা হত।
জেনারের সমীক্ষা তাঁর অনুমানকে সমর্থন করল। অবশ্য ভ্যাক্সিন দেবার প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু গলদ হয়েছিল, সেসব ক্ষেত্রে নানা সমস্যা হয়। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই গুটি বসন্তের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভ্যাক্সিন এক কার্যকরী পদ্ধতি এটা সবাই মেনে নিল, আর ১৮০০ সাধারণাব্দে (CE) এই পদ্ধতি ইংল্যান্ডের বাইরে প্রায় পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। ভ্যারিওলেশন-এর ক্ষেত্রে আমরা যেমন দেখেছি, একটি কার্যকর চিকিৎসা-ব্যবস্থা ইউরোপের একটি দেশে চালু হলে তা দ্রুত সারা ইউরোপে এবং শ্বেত-আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ত। এই দেশগুলোর সরকারদের মধ্যে লড়াই চললেও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়শই নিজেদের মধ্যে আদানপ্রদান বজায় রাখত। ব্রিটেন এবং ফ্রান্স সেই সময়ে যুদ্ধে জড়িত থাকা সত্ত্বেও নেপোলিয়ান ফ্রান্সে জেনারের ভ্যাক্সিন চালু করলেন এবং জেনারকে ফ্রান্সের উচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করলেন। ইংল্যান্ডের এক ডাক্তার জেনারের কাছ থেকে ভ্যাক্সিনের নমুনা নিয়ে আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেঞ্জামিন ওয়াটারহাউস-কে সেটা পাঠান। ওয়াটারহাউস আমেরিকার একটি স্টেট ‘নিউ ইংল্যান্ড’-এ ভ্যাক্সিন দেওয়া শুরু করেন, তারপর তিনি স্বয়ং প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন-কে ভার্জিনিয়া স্টেটে ভ্যাক্সিন চালু করতে অনুরোধ করেন। জেফারসন ভ্যাক্সিন দেবার কাজে সমর্থন করেন, আর ওয়াটারহাউস-কে প্রধান করে আমেরিকায় একটা জাতীয় ভ্যাক্সিন ইনস্টিটিউট তৈরি হয়। এর অনতিবিলম্বে আমেরিকায় জাতীয় ভ্যাক্সিন প্রোগ্রাম শুরু হয়। এই কাজের গুরুত্ব তখন অনেক আমেরিকান বোঝেন নি—কিন্তু পরে অধ্যাপক বেঞ্জামিন ওয়াটারহাউস-কে তাঁর দেশে প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয়, চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাসে তিনি ‘আমেরিকার জেনার’ এই অভিধা পান।
সারা পৃথিবী জুড়ে জেনারের ভ্যাক্সিন ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। জেনার তাঁর আবিষ্কার থেকে বিরাট অর্থ রোজগার করতে চাননি। বরং ভ্যাক্সিন নিয়ে অবিশ্রাম কাজ করার সময় দিতে গিয়ে জেনারের প্রাইভেট প্র্যাকটিস নষ্ট হয়েছে, তাঁর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ১৮০২ সালে বৃটিশ পার্লামেন্ট জেনারকে দশহাজার পাউন্ড, আবার ১৮০৭-এ আরও কুড়িহাজার পাউন্ড পুরষ্কার দেয়।
তবে জেনারকে অনেক নিন্দামন্দ আর গালাগালিও সইতে হয়েছে। শেষে বোঝা গেল জেনারের ভ্যাক্সিন অত্যন্ত কার্যকর, ভ্যারিওলেশন-এর মতো গুটিবসন্ত ছাড়াবার বিপদ এতে নেই। এই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবার পরে নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে জেনারের ভ্যাক্সিন বিপুল পরিমাণে উৎপাদন করে সাধারণ মানুষকে দেওয়া হয়। (পাদটিকা ৪)
১৮৪০ সালে ইংল্যান্ডে ভ্যারিওলেশন আইনত নিষিদ্ধ হল, আর ভ্যাক্সিন-ই গুটিবসন্ত ঠেকানোর একমাত্র উপায় বলে গৃহীত হল। প্রাচ্যের পদ্ধতির ওপর পাশ্চাত্যের পদ্ধতি, জেনারের পদ্ধতির প্রাধান্য স্বীকৃত হল। কিন্তু একই সঙ্গে প্রাচ্য পদ্ধতিকে অবদমনের ও তাকে হেয় করার কাজটিও শুরু হল। প্রাচ্যের পদ্ধতি যে একসময় একমাত্র ভরসা ছিল, ইতিহাস থেকে সে কথা মুছে দেবার প্রচেষ্টা শুরু হল। ভারতবর্ষেও ইংরেজের হাত ধরে জেনারের ভ্যাক্সিন ছড়িয়ে পড়েছিল, তবে তার ইতিহাস কিন্তু ইউরোপ বা শ্বেত-আমেরিকার থেকে অনেকটাই আলাদা ছিল। আমরা এর পরের কোনো পর্বে সেদিকে নজর দেব।
পাদটিকা ১-- এর বছর দশেক আগে জেনার রয়াল সোসাইটিতে তাঁর অন্য গবেষণাপত্র পাঠিয়েছিলেন, এবং সেটি প্রকাশিত হয়েছিল। সেই গবেষণাপত্র ছিল সদ্যোজাত কোকিলছানার আচরণ বিষয়ক। এতে অবাক হবার কিছু নেই, সে সময় জেনার-এর মতো যেসব ভদ্রলোক বিজ্ঞানী (Gentleman Naturalist) ছিলেন তাঁদের আগ্রহ বহুমুখী হত, চিকিৎসক কেবল ডাক্তারি নিয়েই ভাববেন, এমন স্পেশালাইজেশনের যুগ তখনও আসেনি। কিন্তু সে কথা থাক। কোকিলছানা নিয়ে জেনার-এর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হলে কী হবে, ঐ গবেষণার মূল বক্তব্য নিয়ে অধিকাংশ ভদ্রলোক বিজ্ঞানী জেনারের মত সমর্থন তো করেনইনি, উপরন্তু তাঁকে উৎকেন্দ্রিক ভেবেছিলেন। তবে সেটা ছোট ব্যাপার। এই পাদটিকার পাদটিকা হিসেবে বলা যায়, জেনারের সদ্যোজাত কোকিলছানার আচরণ গবেষণাপত্রটি পরে সঠিক প্রমাণ হয়েছে।
বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণটি অবশ্য অন্য। ভদ্রলোক বিজ্ঞানীরা জানতেন গোয়ালাদের মধ্যে একটা প্রচলিত কথা আছে যে গো-বসন্ত হলে সেই মানুষের পরে আর গুটিবসন্ত হয় না। যে কোনো পণ্ডিতগোষ্ঠীর মতো তাঁদেরও এইসব ‘অ-ভদ্রলোকের’ মধ্যে চালু প্রথা নিয়ে যথেষ্ট অবজ্ঞা ছিল। ফলে সেটাই যখন জেনার রয়্যাল সোসাইটির মতো উচ্চমার্গের পণ্ডিতসভায় চালাতে চাইলেন, তাঁদের এতদিনকার উচ্চবর্ণের অহঙ্কার ঘা খেল। তাঁরা বললেন, যতসব ছোটলোকের প্রথা—এনিয়ে মাথা ঘামাবার কোনো দরকার নেই। পরে অবশ্য জেনার-এর ভ্যাক্সিন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে, “মন্ত্রী কহে, আমারো ছিল মনে/ কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে” বলে এসেছিলেন এঁদের অনেকেই।
পাদটীকা ২- অন্যদিকে, ভারতে বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্যারিওলেশন-এর আলাদা আলাদা ধরন ও প্রথা ছিল। এই ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিটি যে যার মতো ধরে রাখতেন বটে তবে তা নিয়ে সংগঠিত মতবিনিময়ের বালাই ছিল না। এক জায়গায় টিকা দিতেন ব্রাহ্মণ টিকাদার, অন্য কোথাও নাপিত, অন্যত্র আবার মালাকার সম্প্রদায়ের লোক, আবার কোথাও টিকাকার ছিলেন মুসলমান। তাদের মধ্যে সামাজিক আদান-প্রদান কম ছিল, ফলে জ্ঞানের আদান-প্রদান ও অভিজ্ঞতার সার-সংকলন বা বিস্তার ভারতের টিকাকারদের মধ্যে হয়নি। এমনকি ভারতের পূর্ব , পশ্চিম ও উত্তর প্রান্তে (বাংলা, গুজরাট বা পাঞ্জাবে) ভ্যারিওলা টিকা চালু থাকার কয়েক শতাব্দী পরেও মধ্য বা দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ জায়গায় এই টিকা দেওয়া হত না।
পাদটীকা ৩- গোয়ালিনীর কথা শুনে জেনার গো-বসন্ত নিয়ে ভেবেছিলেন, এই কাহিনীটি সাম্প্রতিককালে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে যে জেনার-এর নজরে আসে, কিছু চাষীর গো-বসন্ত হলে গুটিবসন্ত হত না। কিন্তু তবুও আমাদের মূল প্রতিপাদ্য— গো-বসন্ত হলে গুটিবসন্ত আটকায়, এই জ্ঞানটি ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান—সেই তত্ত্ব বহাল থাকছে।
পাদটীকা ৪- বিংশ শতকে ভ্যাক্সিন-ভাইরাস, গো-বসন্ত ভাইরাস, আর গুটিবসন্ত ভাইরাস-এর ডিএনএ বিশ্লেষণ করে দেখা গেল জিনগতভাবে এরা পৃথক। সেটা খুব আশ্চর্য ব্যাপার। এব্যাপারে অনেকগুলি আলাদা আলাদা সম্ভাবনা ভাবা যায়।
১) জেনার যে গো-বসন্তের রসই নিয়েছিলেন, কিন্তু সেই গো-বসন্তের ভাইরাস ক্রমশ মিউটেট করেছে।
২) জেনারের ভাইরাসের সঙ্গে প্রথমেই, বা পরবর্তীকালে কোনো সময়ে, অন্য কোনো ভাইরাস (এমনকি মানুষের গুটিবসন্ত ভাইরাসও হতে পারে) মিশে গিয়েছিল, এমন হতে পারে।
৩) জেনারের ভাইরাস আদতে গো-বসন্ত ভাইরাসই নয়, অন্য কোনো ভাইরাস।
১) Edward Jenner and the history of smallpox and vaccination, Stefan Riedel, Baylor University Medical Center Proceedings, 2005, Volume 18 (1), Page 21-25. .https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC1200696/ accessed on 7 May, 2020. )
২) In celebration of the 200th anniversary of Edward Jenner’s Inquiry into the causes and effects of the variolae vaccine, Robert C Brunham and Kevin M Coombs, The Canadian Journal of Infectious Diseases, 1998 Sep-Oct; 9(5): Page 310–313. (https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3250919/, accessed on 8 May, 2020)
৩) Colonizing the Body – State Medicine and Epidemic disease in Nineteenth-Century India, David Arnold. University of California Press, 1993, Page 116-158
৪) [Jenner's cowpox vaccine in light of current vaccinology]. Huygelen C, Verh K Acad Geneeskd Belg. 1996;58(5):479-536; https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/9027132 [Article in Dutch] English Abstract accessed on 11 May, 2020