কথারম্ভ
করোনা ভাইরাসের কার্যকরী ওষুধ যেদিন বেরোবে, সেদিন আমাদের আতঙ্ক কমবে ঠিকই, কিন্তু রোগ ছড়ানো কমবে না। রোগ হওয়া আটকাতে চাই করোনা-র টিকা। টিকার ইতিহাস থেকে মনে হয়, প্রথমেই খুব ভাল টিকা আবিষ্কার হবার সম্ভাবনা কম। প্রথম ধাপে যে টিকা আবিষ্কার হল, তা দিয়ে কিছু কাজ হল, পরে আরেকটি উন্নত টিকা এল, তাতে আরও ভাল কাজ হল, এমনটাই সম্ভব। ভাইরাসঘটিত একটি রোগ পোলিও এখন নির্মূলের মুখে—সেখানে প্রথমে ইঞ্জেকশন দেওয়া টিকা ছিল, পরে মুখে খাবার টিকা দিয়ে রোগ নির্মূলের কাজ প্রায় পুরোটা হয়েছে। এখন আবার নির্মূলীকরণের শেষ পর্যায়ে ইঞ্জেকশন টিকা দিতে হচ্ছে। আর আমরা তো জানি, গুটিবসন্ত নির্মূল হয়েছে জেনারের ভ্যাক্সিনে, কিন্তু তার সলতে পাকানোর কাজ করেছে ভারত-চীনের আবিষ্কার ভ্যারিওলেশন।
ইউরোপে প্রায় এক’শ বছরের ভ্যারিওলেশনের ইতিহাসে আমরা দেখেছি, উল্লেখযোগ্য সাফল্য সত্ত্বেও তা সমস্ত জনসাধারণকে দেবার কথা ভাবা হয়নি। ভারতেও সবাই পাননি, আর সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ভারতে কতজন মানুষ ভ্যারিওলেশন পেয়েছিল? কে তাদের এই টিকা দেবার ব্যবস্থা করেছিল? ভ্যাক্সিন আসার আগে ও পরে বৃটিশ সরকার এ নিয়ে কেমন মনোভাব দেখিয়েছিল?
পর্ব ৪
সেন্সাস বা জনগণনা। যিশুর জন্মের সময় নাকি সেখানকার রাজা জনগণনার জন্য সমস্ত লোককে একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছিলেন, আর তাই নাকি আস্তাবলে যিশুর জন্ম হয় (সাধু লুকের সুসমাচার)। জনগণনা খুব প্রাচীন পদ্ধতি হলেও, নিয়মিত সেন্সাসের চল সভ্যতার নিরিখে নেহাতই অল্পদিনে, আর তাতে রোগ ব্যাধি বা টিকাকরণের সংখ্যা গুনে রাখা একেবারেই হাল আমলের ব্যাপার। তাই বাংলায় ১৭৫৭ সালের পর থেকে কার্যত বৃটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও সে-সময় কতজন দেশীয় পদ্ধতিতে টিকা নিয়েছিল, সেটা জানা একান্ত অসম্ভব। অবশ্য ইউরোপের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু এদেশে একশ’ বছর সাম্রাজ্য চালানোর পরে, বিশেষ করে সিপাহী যুদ্ধের পরে, বৃটিশরা বুঝল সেন্সাস জাতীয় কিছু তথ্য উপনিবেশ চালানোর জন্য একান্তই জরুরি। যেমন সিপাইদের তথ্য। যেমন স্কুলের তথ্য। শ্রমিকদের তথ্য। জেলখানার তথ্য।
প্রথমে জেলখানার তথ্যেই আসি। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির জেলবন্দীদের সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যে শতকরা ষাটভাগেরও বেশি বন্দী দেশীয় পদ্ধতির টিকা নিয়েছেন। জেলে যারা যায় তাদের সামাজিক অবস্থা গড়পড়তা মানুষের চাইতে খারাপ হয়। তাই জেলবন্দীদের মধ্যে শতকরা ষাট জন ভ্যারিওলেশন করে থাকলে জনসাধারণের মধ্যে এই সংখ্যাটা আরও বেশি হবার কথা।
১৮৭২-৭৩ সালে সরকার বাহাদুর সতের হাজারের কিছু বেশি মানুষের ওপর একটা সমীক্ষা করেন। তার মধ্যে ছিল জেলবন্দী, স্কুলছাত্র, সরকারি ডিসপেন্সারিতে আসা নানা রোগী, আর কিছু শ্রমিক। দেখা গেল তাদের মধ্যে শতকরা ৬৬ ভাগ দেশীয় পদ্ধতিতে টিকা নিয়েছে আর মাত্র ৫ ভাগ জেনারের সরকারি টিকা নিয়েছেন। খেয়াল রাখতে হবে ততদিনে এদেশে জেনারের পদ্ধতি সত্তর বছর ধরে চালু আছে। আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করার মতো। বাকিদের মধ্যে শতকরা ১৮ ভাগের গুটিবসন্ত হয়ে গেছে, অর্থাৎ তাদের কোনো টিকার দরকার নেই। বাকি মাত্র ১১ ভাগ কোনোরকম সুরক্ষা পায়নি।
সমস্ত তথ্য মিলে আমরা এখন জানি, দেশীয় এই টিকা তখন বাংলা প্রেসিডেন্সিতে খুবই চালু ছিল। এই অঞ্চলের তখনকার জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ২০ ভাগ ছিল ‘অন্ত্যজ অস্পৃশ্য’। তারা বাদে বাংলা, ঊড়িষ্যা, বিহার ও আসাম-এর প্রায় প্রত্যেকেই টিকা নিতেন। সারা ভারতের চিত্র অবশ্য এরকম ছিল না। সারা ভারতে্র মধ্যে সুবে বাংলাতে প্রথম ইংরেজ শাসন স্থাপিত হয়, সেখানে দেশীয় টিকা খুব চালু ছিল। সুবে বাংলা বলতে বর্তমান দুই বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা। বাকি ভারতের মধ্যে বর্তমান উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে, গুজরাট, মহারাষ্ট্রের উপকূল এলাকা, পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে সিন্ধ অঞ্চলে, রাজস্থানের কোথাও কোথাও, কুমায়ুন, তামিলনাড়ুর উত্তরদিক—এসব জায়গায় দেশী টিকা কমবেশি চালু ছিল। এছাড়া বাকি ভারতে দেশীয় টিকা চালু ছিল বলে জানা যায় নি।
বাংলায় টিকাকারের কাজ করতেন ‘নীচু’ ব্রাহ্মণ, মালাকার/মালি, কুম্ভকার, শঙ্খকার, তাঁতি, নাপিত ইত্যাদিরা। এদের অধিকাংশই কাছেপিঠের শহর-গ্রাম থেকে আসতেন। বাংলার বাইরে আবার এসব জাতের মানুষ ছাড়াও অন্যান্য জাতের লোকেরা টিকাকার ছিলেন, যেমন কুনবি, সিন্দুরিয়া, আর রোজা। রোজা বা ওঝাদের সাধারণ কাজ ছিল ঝাড়ফুঁক। তাই টিকাকরণ একদিকে লোকধর্মের অনুসঙ্গ হিসাবে ছিল, অন্যদিকে প্রান্তিক মানুষের অপদেবতায় বিশ্বাস ইত্যাদির সাথে ঠাঁই করে নিয়েছিল বলে মনে হয়। আরও উল্লেখ্য হল, বাংলার বাইরে অন্তত টিকাকারদের মধ্যে মুসলমান ছিলেন, আবার গোয়ার মতো জায়গায় ক্যাথলিক পাদ্রিরাও ছিলেন। এরা শীতলা মন্ত্র জপ করতেন কিনা তা অবশ্য জানতে পারিনি। ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রীয় বিধান বা আয়ুর্বেদ থেকে উৎপন্ন হয়ে টিকার প্রথাটি লোকধর্মে মিশেছিল, নাকি লোকধর্ম থেকে ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করেছিল, নাকি উভয় দিক থেকেই একত্রে এসেছিল, এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের সাহায্যে তার বিচার করা কার্যত অসম্ভব।
কিন্তু এ-সত্ত্বেও ভ্যারিওলেশন সর্বভারতীয় প্রথা হয়ে উঠতে পারেনি। বারাণসীর পশ্চিমদিকে দিল্লি পর্যন্ত গোটা উত্তরভারত, নেপাল, তখনকার হায়দারাবাদ, মাইশোর ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি (অর্থাৎ গোটা দক্ষিণ ভারত) ও নেপালে এই টিকা চালু থাকার কোনো প্রমাণ নেই। মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশের কিছু কিছু অঞ্চল ছাড়া টিকার প্রমাণ মেলেনি।
তবে উল্লেখ করার মতো বিষয় হল অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে কলকাতা বা বাংলায় ইংরেজদের মধ্যে দেশী টিকার প্রচলন হয়েছিল। ১৭৮০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত এখানকার ইংরেজরা দেশীয় টিকা নিতেন, কিন্তু সেটা এ-দেশের সংস্কার হিসেবে নয়। আগেই আমরা দেখেছি, সেই সময় ইংল্যান্ডে ভ্যারিওলেশন প্রচলিত হয়েছে। এদেশে বসবাসকারী ইংরেজ তারপরে বুঝতে পারেন ভারতে দেশী টিকা নেওয়া দরকার।
ইউরোপে ভারিওলেশন-কে সরিয়ে জেনারের টিকা চালু হবার পরে, এদেশেও দেশীয় পদ্ধতি সম্পর্কে বৃটিশ মনোভাবের দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। ইউরোপে চালু হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ১৮০২ সালে ভারতে জেনারের ভ্যাক্সিনের আগমন ঘটে। অবশ্য ভারতে বসবাসকারী ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয়রা তার প্রথম লক্ষ্য ছিল। জেনারের ভ্যাক্সিন এদেশের ইংরেজদের এই প্রথম একটা নিরাপদ ও ইউরোপীয় বাঁচার পথ দেখাল। গুটিবসন্তের ভয় থেকে তারা নিজেদের পুরো মুক্ত করতে পারবে, আর তার জন্য কোনো বিজাতীয় (অর্থাৎ ভারতীয়) প্রথার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে না, এমন আশ্বাস পেয়ে এদেশের ইংরেজরা কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বে থেকে ১৮০৬ সালে মোট প্রায় আট হাজার পাউন্ড পাঠাল। জেনারের কাছে সে টাকার মূল্য বড় কম নয়। আমরা আগে দেখেছি বৃটিশ পার্লামেন্ট স্বয়ং জেনারকে সর্বসাকূল্যে ত্রিশহাজার পাউন্ড দিয়েছিল।
জেনারের টিকার প্রথম লক্ষ্য ছিল ইউরোপীয়রা। কিন্তু করোনা-র সময় আমরা যেমন দেখছি, ছোঁয়াচে রোগের জন্য একা নিরাপদ থাকা যায় না, আশেপাশের সবাই নিরাপদ থাকলে তবেই আপনি নিরাপদ, জেনারের টিকা নিয়েও বৃটিশ সরকার সেরকম ভেবেছিল। ইউরোপীয়দের পরে তাদের টিকা দেবার লক্ষ্য হল ইউরোপীয়দের কাছে থাকা মানুষজন। বাড়ির চাকরবাকর, সিপাহী, সে সময় ইউরোপীয়দের হাতে গড়া অর্থকরী ফসল নীল ও আফিম ক্ষেতের শ্রমিক। এদের ভ্যাক্সিন দেওয়া হল। আর যেহেতু ভ্যারিওলেশন থেকে গুটিবসন্ত ছড়ানোর সামান্য হলেও সম্ভাবনা আছে, এদের ভারতীয় টিকা নিষিদ্ধ হল।
এরপর ইউরোপীয়দের দাবি উঠবে, তাদের উপনিবেশে অর্থাৎ গোটা ভারতে ভ্যারিওলেশন বন্ধ করে ভ্যাক্সিনেশন চালু করতে হবে, নইলে তাদের নিজেদের নিরাপত্তা থাকে না যে! কিন্তু ভারতে সে কাজটি করা কি তেমন সহজ ছিল? কীভাবে ভ্যাক্সিনেশন চালু হয়েছিল? প্রাচীন দেশীয় পদ্ধতি ভ্যারিওলেশন আবার ভারতবাসীর ধর্মীয় আচরণের সঙ্গেও যুক্ত, তার বিলোপে কি কোনো বাধা আসেনি? আর, কেবলমাত্র ভারতে থাকা ইউরোপীয়দের নিরাপত্তা ছাড়া অন্য কোনো বোধ, কোনো সিভিলাইজিং মিশন কি বৃটিশকে এদেশে ভ্যারিওলেশন তুলে ভ্যাক্সিনেশন চালু করাতে অনুপ্রাণিত করেনি?
ট্রপিক্যাল মেডিসিন। কথাটা ইউরোপীয়দের তৈরি। মূলত ভারতে এসে ইংরেজ ডাক্তাররা এদেশের রোগ নিয়ে ভারতের রোগ, বাংলার রোগ, ইত্যাদি শব্দবন্ধ ব্যবহার করত। একসময় এদের একটা সাধারণ নাম দিল, ট্রপিক্যাল রোগ। রোগ নিয়ে জার্ম থিয়োরি বা জীবাণুতত্ত্ব-র হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পেল ট্রপিক্যাল রোগ-তত্ত্ব, কিন্তু তার জমি স্থাপিত ছিল জীবাণুতত্ত্বের বিজ্ঞানভূমির বাইরেও, ইউরোপীয় মননেই। চিকিৎসার জন্য হল আলাদা একটা বিভাগ, ট্রপিক্যাল মেডিসিন। ইউরোপীয়রা আফ্রিকা আর এশিয়ার যত জায়গা দখল-আধাদখল করেছিল সবই হল ট্রপিক। ভৌগলিকভাবে ট্রপিক্যাল মানে নিরক্ষরেখার পাশে উষ্ণ অঞ্চল। ট্রপিক্যাল রোগ হল ইউরোপ ও ইউরোপের বাইরে অন্য আবহাওয়ার রোগ, ইউরোপীয় মননে তা অন্য মানুষের রোগ। ইউরোপীয়দের সে রোগ আক্রমণ করছে বটে, তবে সেটা ঘটনাচক্রে।
কলেরা, ম্যালেরিয়া, পীতজ্বর, কালাজ্বর—এসব রোগ ছিল ট্রপিক্যাল মেডিসিনের চর্চার বিষয়। প্লেগ ও কুষ্ঠ ইউরোপে খুবই ছিল, কিন্তু সেখানে সভ্যতা বাড়ল, এসবের প্রকোপ কমল, ফলে এরাও ট্রপিক্যাল মেডিসিনের আওতায় এল। কেননা ট্রপিক্যাল অসুখ অন্য সভ্যতার, এমনকি অ-সভ্যতার রোগও। এই কথাগুলো ট্রপিক্যাল মেডিসিনের টেক্সট-বইয়ে আলাদা করে বলার দরকার হয়নি। উপনিবেশ গড়তে গড়তে কয়েকশ’ বছর ধরে রোগ ও সভ্যতার এই সম্পর্ক পাশ্চাত্য ধারনায় গেঁথে গেছে। ট্রপিক্যাল মেডিসিন হল চিকিৎসার এমন একটা ধারা যা অন্যদের রক্ষা করার খাতিরে এই ‘অন্য’-দের জীবনযাত্রা বদলে সভ্য করে, অন্য-কে মূলধারায় আনে।
কিন্তু সমস্যা ছিল গুটিবসন্ত নিয়ে। এ কি ট্রপিকের অসুখ? ঐতিহাসিকভাবে গুটিবসন্ত কেবল ট্রপিকের অসুখ নয়। ইউরোপে তার প্রকোপ কম ছিল না। তার থেকে বড় কথা, ভ্যারিওলেশন গ্রহণ করছে যে ইউরোপ, সে কিন্তু নিজেকে পাল্টাচ্ছে, পাল্টাচ্ছে ভারত-চীন-তুরস্কের প্রথায়। অন্যকে বদল করে, সভ্য করে, স্যানিটাইজ করে অসুখ দূর করার প্রকল্পটি কলেরা বা ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে চলছে। কিন্তু গুটিবসন্তের ক্ষেত্রে উলটপুরাণ!
ভ্যারিওলেশনকে দায়ে পড়ে মেনে নেওয়া হয়েছিল বটে, কিন্তু ইউরোপের বিজ্ঞানচর্চার জগতে ছিল এক অবাঞ্ছিত দখলদার। রেঁনেসা পরবর্তী ইউরোপ যখন তার জ্ঞানরাজ্যকে এক যুক্তিগ্রাহ্য ও সামগ্রিক রূপ দিতে চাইছে, আর একাডেমিক সোসাইটিগুলি যেখানে প্রায়ই জাতি বা রাষ্ট্রের সীমানা ছাড়িয়ে জ্ঞান-বিনিময় করছে, সেখানে প্রাচ্যদেশীয় রহস্যময় টিকার আগমন পাশ্চাত্য শ্রেষ্ঠত্বকে ব্যাঙ্গ করছিল। পাশ্চাত্যের ‘নিজস্ব’ এবং কার্যকর কিছু দরকার ছিল। অপ্রাতিষ্ঠানিক ‘অবৈজ্ঞানিক’ চর্চার ধারা থেকে উদ্ভূত হয়েও জেনার-এর ভ্যাক্সিন পাশ্চাত্যের নিজস্বতার শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠা করল। ভ্যাক্সিন টিকা দেবার পদ্ধতি আত্মসাৎ করল ভ্যারিওলেশন থেকে, কিন্তু এই প্রাচ্য শিকড় ভুলে যাবার চেষ্টা জারি থাকল। উপকথায় গোয়ালিনীর গো-বসন্ত জায়গা পেল, কিন্তু ভ্যারিওলেশন পদ্ধতিকে জেনার হুবহু অনুসরণ করলেও তা বিস্মৃতিতে চলে গেল। পাশ্চাত্যের ইতিহাসবোধ বস্তুনিষ্ঠ সন্দেহ নেই!
ভারতে গুটিবসন্তের ভ্যাক্সিন এল উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে। প্রথমে তার লক্ষ্য ছিল দেশের ইউরোপীয়দের রক্ষা। তারপর তাদের বাড়ির চাকর, সিপাহী, খামারের মজুরচাষী—এদেরও ভ্যাক্সিন দেওয়া। এতদিন যে ইউরোপীয়রা ভারতে এসে ভারতীয় পদ্ধতিতে টিকা নিতে পেরে বেঁচে গেছে, আজ তার অবস্থান উলটে গেল। তার মনে হল গুটিবসন্তকে ভ্যাক্সিনে আটকানো যায়, আর ভারতীয়রা পুরনো টিকা দিয়ে এই রোগকে নিজের ঘরে ডেকে আনছে। বসন্তরোগের দেবীর পুজো সারা ভারতেই চালু ছিল—উত্তরে যিনি শীতলা দক্ষিণে তিনিই দেবী মারিয়াম্মা। ভ্যাক্সিন আসার পরে আত্মবিশ্বাসী ইউরোপীয়-মননে রোগের কাছে ভারতীয়দের এই আত্মসমর্পণ তাদের চারিত্রিক দুর্বলতার আরেকটা প্রকাশ হয়ে উঠল। ভ্যারিওলেশন হল আত্মসমর্পণের ক্ষত।
ভ্যাক্সিন দিয়ে ইউরোপীয়দের রক্ষা করা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রথম প্রয়োজন ছিল। কিন্তু পাশ্চাত্য চিকিৎসার ঔৎকর্ষ আর সভ্য ইংরাজ রাজত্বের প্রজা-হিতৈষণা, এ-দুটো একসাথে প্রকাশের জন্য ভারতীয়দের ভ্যাক্সিন যে ভারি সুবিধার, তা রাষ্ট্র দ্রুতই বুঝেছিল। উনবিংশ শতকের প্রথমে ভ্যাক্সিন আসার সময়ে ভারতের বড় অংশে বৃটিশ নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছে ঠিকই, কিন্তু তখনও মারাঠাদের সঙ্গে লড়াই চলছে। উত্তর ও মধ্যভারতের বিরাট অংশে ইংরাজের প্রাধান্য স্বীকার করে নানা রাজা-বাদশা রাজত্ব করছেন। তাদের তুলনায় ইংরেজ রাজত্ব শ্রেয় বলে দেখানোর একটা তাগিদ বৃটিশের ছিল। এর বছর-পঞ্চাশ পরে অপশাসনের অভিযোগে দেশীয় রাজ্য (যেমন অওধ) দখল করবে কোম্পানি। নিজের সুশাসনের নিদর্শন রাখার দরকার কোম্পানি আগে থেকেই বুঝেছিল।
১৮০২ সালে প্রথম ভ্যাক্সিন চালু হল বোম্বেতে। তারপরে বোম্বের ইংরেজ গভর্নরের মন্তব্য ছিল, “এই একটা কাজের মধ্যে আমাদের প্রেস্টিজ বেড়েছে আর মানুষের কাছে আমাদের সম্পর্কে খুব ভাল ধারনা তৈরি করেছে।” ইংরেজরা ধরে নিয়েছিল ভারতের জনগণ তাদের এমন উপকার করায় খুব কৃতজ্ঞ থাকবে, আর হিন্দুদের পবিত্র জীব গোরুর শরীর থেকে এই ভ্যাক্সিন তৈরি হয়েছে বলে তারা খুব খুশি হবে। কিন্তু দু-এক বছরের মধ্যেই বোঝা গেল ভারতবাসী সহজে এই ভ্যাক্সিন মেনে নেবে না। অবশ্য ইউরোপে ভারিওলেশন ও তারপরে ভ্যাক্সিনেশন নিয়ে বিস্তর প্রতিরোধ ছিল, কিন্তু ভারতের লোকের যে ইউরোপীয়দের মতোই প্রত্যাখানের যুক্তি থাকতে পারে সেটা ইউরোপীয় শাসক ভাবল না, অন্তত সেরকম লিখল না কোথাও। এখানে ইংরেজরা ভ্যাক্সিনেশনের ব্যর্থতার মধ্যে দেখলেন—“নেটিভদের কুসংস্কার ও কুঁড়েমি... তাদের ভাগ্যনির্ভরতা, যার ফলে তারা গুটিবসন্তের কাছে আত্মসমর্পন করে।” যে সব ইংরেজ ভাক্সিন দেবার কাজে কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন তাদের প্রায় সকলের বক্তব্যের মূল সুর এক। হিন্দুরা সমস্ত আবিষ্কারের বিরুদ্ধে, আর খেটে খাওয়া মানুষগুলো স্টুপিড ও বোধহীন। তারা বোঝে না সরকারি ভ্যাক্সিন ব্যবস্থা কতটা আশীর্বাদ। হিন্দুধর্মের খারাপ প্রভাবে তাদের মন-বুদ্ধি বাঁধা পড়ে আছে, যুক্তিবোধ আচ্ছন্ন। যে বিষয় একেবারে সরাসরি তাদের পক্ষে লাভজনক, সেটা পাবার জন্যও তারা পুরনো প্রথা ত্যাগ করবে না। এরা যুক্তিহীন ধর্মবিশ্বাস আর জাতপ্রথার জন্য ভ্যাক্সিন কম নিচ্ছে।১
অন্যদিকে, ভ্যাক্সিনের বিফলতার অনেকটা দায় পড়ল দেশীয় টিকা অর্থাৎ ভ্যারিওলেশনের ওপর। ডা. হলওয়েলের বিবরণে আমরা দেখেছি যখন ইংল্যান্ডে ভ্যারিওলেশন চালু হচ্ছে তখন এদেশের সাহেব ডাক্তাররা এদেশীয় ভ্যারিওলেশনের গুণগান করতেন। এখন সাহেব ডাক্তারদের বক্তব্য একেবারে উলটে গেল। ভ্যারিওলেশনের ইতিবাচক প্রভাব তাঁরা অস্বীকার করলেন। বললেন ঐসব কুসংস্কার বন্ধ না করলে ভ্যাক্সিনেশন চলবে না। আবিষ্কার করা হল, কলকাতায় দশ-পনেরোজন টিকাদার গুটিবসন্তকে টিকিয়ে রাখছে। তারা ভ্যাক্সিন নিয়ে আতঙ্কজনক মিথ্যা গুজব ছাড়াচ্ছে, যাতে তাদের ব্যবসা বজায় থাকে। এক ভ্যাক্সিন কমিশনার বললেন,
“... যে দেশে শিশুহত্যা আর সতীদাহ ধর্মের দোহাই দিয়ে এই সেদিন পর্যন্ত চলেছে, সেদেশে অজ্ঞান হিন্দুদের ভুলপথে চালানোর জন্য ধর্মান্ধরা আছে। তাদের সরল ও বিশ্বাসী মনে ভয় জাগানোর জন্য নতুন সব কিছুকে এরা ধর্মবিরোধী বলে চালায়... এদের খুনে ব্যবসা আর চালাতে দেওয়া যায় না।”
কিন্তু ইংরেজদের মধ্যেও দেশী টিকাদার সম্পর্কে এর বিপরীত ভাবনা ছিল। যেমন ঢাকার সিভিল সার্জন জেমস ওয়াইজ বললেন, ভ্যাক্সিনেশন শুরু হবার আগে ভ্যারিওলেশন বন্ধ করা ঠিক হবে না। ভ্যাক্সিনেশনের সামগ্রিক দায়প্রাপ্ত চার্লস সাহেব ১৮৬০ সালে সমস্ত পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখে বললেন, ভ্যারিওলেশন থেকে মহামারি বিশেষ ছড়ায় না, আর বড়জোর শতকরা ১ জন মানুষ এতে মারা যায়। তাই টিকাদারদের সরকারি নিয়ন্ত্রণে এনে ভ্যারিওলেশন চালানো হোক। এই বিতর্ক প্রায় পঞ্চাশ বছর চালানোর পরেও একমত হওয়া যায় নি। তবে ১৮৭০ নাগাদ পুরনো ভারিওলেশন টিকাদারদের সরকারি ভাক্সিন দেবার কাজে বিপুলভাবে নিয়োগ করা হয়েছে। একসময় যাদের সমস্ত সমস্যার মূল বলে চিহ্নিত করা হল, তাদেরই নতুন ব্যবস্থার অংশীদার করে নেওয়া হল। ১
অন্যদিকে প্রভাবশালী নেটিভদের ভাক্সিন দিয়ে তার প্রচার করে ভাক্সিনকে জনপ্রিয় করতে চাইল সরকার। মোঘল বাদশাহ পরিবার, পুনের পেশোয়া পরিবার, বারাণসীর মহারাজা, বিভিন্ন জমিদার, নানা ব্রাহ্মণ গোষ্ঠি—এদের ভ্যাক্সিন দিয়ে তার প্রচার করা হল। শিক্ষিত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা কেউ কেউ ভ্যাক্সিনের সমর্থনে পুস্তিকা লিখলেন। ‘মাঝারি’ জাতির নেতাস্থানীয় মানুষদের টিকা দেওয়া হল, তার প্রচার হল। এর সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের কিছু ইংরাজি শিক্ষিত ও বৃটিশ ঘনিষ্ঠ মানুষও ভ্যাক্সিন চালু করার পক্ষে সওয়াল করলেন।
এর বিপরীতে আদিবাসী অঞ্চলে বা তৎকালীন অওধের মতো অঞ্চলে দেশী ভ্যারিওলেশনের কোনো অভিজ্ঞতা মানুষের ছিল না। তাদের ওপর জোর করে ভ্যাক্সিন চাপানোর চেষ্টা হল, এবং সেটা তাঁরা প্রায় সম্পূর্ণ প্রত্যাখান করলেন। আবার বৃটিশের সঙ্গে সহযোগিতা করে চলা অনেক প্রতিষ্ঠিত এদেশীয়রাও ভ্যাক্সিনের বিরোধিতা করেছেন। নানা মিউনিসপ্যালিটিতে প্রতিনিধিরা ভ্যাক্সিনের প্রস্তাব বাতিল করেছেন—গোরুর ওপর অত্যাচার আর গোরুর পুঁজ শরীরে নেওয়া তাঁদের পছন্দ ছিল না।
ভ্যাক্সিনের কর্মক্ষমতা, গুণমান ও পরিমাণের স্বল্পতা নিয়ে ইংরেজ আধিকারিকদের মধ্যে বিস্তর চাপান-উতোর হয়।২ কিন্তু ভারতীয়রা এব্যাপারে তেমন মন্তব্য করেছেন এমন দেখা যায় না। কিন্তু সত্যিই কি যে পরিমাণ ভ্যাক্সিন ভারতে আনা দরকার ছিল সে পরিমাণ ভ্যাক্সিন কোনোদিন বৃটিশরাজ ভারতে এনেছিল? যেটুকু এনেছিল তার গুণমান অক্ষুণ্ণ ছিল? ভ্যাক্সিন দিয়ে ভারতের মানুষকে যথাযথ সুরক্ষা দেওয়া গিয়েছিল? আর, ভারিওলেশন পদ্ধতির মতো একবার ভ্যাক্সিন দিয়ে সারাজীবন সুরক্ষা মিলবে, ইংরেজদের এই ধারনা কি সত্যি ছিল?
প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর হবে না, না, এবং না। পরবর্তীকালে জেনারের ভ্যাক্সিন বিশ্ব থেকে গুটিবসন্তকে নির্মূল করার বিশাল সাফল্য অর্জন করে। আমরা দেখব, সাফল্য পাবার পর সেই কাহিনী দিয়ে ঔপনিবেশিক ভারতে ভ্যাক্সিনের অতীত বৈজ্ঞানিক ত্রুটি ও ভ্যাক্সিন প্রয়োগে সরকারি বিফলতা—দুইই ঢেকে রাখা হয়েছে।
বাগদাদ থেকে বোম্বে—ভাসমান জাহাজে সার্জনের ছুরি এক শিশুর হাত কেটে পুঁজ গেঁথে দিচ্ছে আরেকজনের শরীরে। ১৮০২ সালে প্রথম জেনারের ভ্যাক্সিন ভারতে আসে। বোম্বেতে স্থলপথ ও জলপথে এই ভ্যাক্সিন আসে, তবে মাল হিসেবে তা আসেনি, এসেছিল শিশুদের হাতের ঘা হিসেবে! ইস্তাম্বুলে প্রথম একটি শিশুর হাতে গো-বসন্তের টিকা দেওয়া হল। তার টিকার জায়গার ফুস্কুড়ির থেকে রস নিয়ে আরেকজন শিশুকে টিকা দেওয়া হল। তার ফুস্কুড়ির রস থেকে আবার পরের শিশু... এইভাবে চলল বোম্বেতে জাহাজ ভেড়া পর্যন্ত।৩
ভ্যাক্সিন প্রথম আসে বোম্বেতে, এবং এই প্রেসিডেন্সিতে সবথেকে বেশি সফল হয়। এমনকি সেখানেও পঞ্চাশ বছর সরকার প্রচেষ্টার পর মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.৫ শতাংশ ভ্যাক্সিন পেয়েছিল। (মনে রাখবেন, ইংরেজ সরকারে হিসেব অনুসারে, অষ্টাদশ শতকের শেষাশেষি বাংলার শতকরা ৬০ ভাগের মতো মানুষ দেশীয় ভ্যারিওলেশন নিয়েছিলেন)। প্রথমদিকে মানুষের হাতের ভ্যাক্সিনজনিত ফুস্কুড়ি থেকে রস নিয়ে অন্যকে ভ্যাক্সিন দেওয়া চলত। তারপর গরুর রস থেকে ভ্যাক্সিন নেবার প্রক্রিয়া চালু করার চেষ্টা শুরু হয়, আর কুড়ি বছর পরে সে প্রচেষ্টার ফল পাওয়া যায়। বিংশ শতকের প্রথমে বোম্বে প্রেসিডেন্সিতে ভারতের প্রথম ভ্যাক্সিন ইনস্টিটিউট স্থাপিত হবার পরে ঘাটতি কিছু কমে। সে সময় বোম্বে প্রেসিডেন্সির একবছরের নিচে বাচ্চাদের শতকরা ৮০ ভাগ ভ্যাক্সিন পায়।
বাংলার অবস্থা এর থেকে খারাপ ছিল। আর সারা ভারতের গড় ছিল আরও খারাপ, যেমন বর্তমান উত্তর ও মধ্য প্রদেশ অঞ্চলের একবছরের নীচের শিশুদের অর্ধেক মাত্র ভ্যাক্সিন পেয়েছিল। অথচ ১৮৬৫ সাল থেকে বৃটিশ সরকার প্রথমে কলকাতার আশেপাশে, তারপর আস্তে আস্তে সারা বাংলা প্রেসিডেন্সিতে, দেশীয় ভ্যারিওলেশন আইনত নিষিদ্ধ করে। ১৯০০ সাল নাগাদ বাংলার বাচ্চাদের মধ্যে ২০ শতাংশের বেশি এবং প্রাপ্তবয়স্কদের একটা বড় অংশ ইংরেজি ভ্যাক্সিনের সুযোগ পায়নি। তাদের জন্য দেশীয় টিকাও হল বেআইনি! ভ্যাক্সিন যোগানে সমস্যা ছিল, কারণ ভারতে গো-বসন্ত ছিল বিরল। শুরু হবার পর নব্বই বছর ধরে ভ্যাক্সিনের বড় অংশ বৃটেন থেকে আমদানি করতে হত। আমরা দেখেছি, প্রথম ভ্যাক্সিনের মালমসলা এসেছিল বাচ্চা ছেলেদের হাতের ঘায়ের মাধ্যমে। এরপরে অবশ্য শুকনো মামড়ি, রস ইত্যাদি হিসেবে সীল করে ভ্যাক্সিন পাঠানো হত। তার কার্যক্ষমতা নিয়ে বৃটিশ কর্মচারীরা যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ঐ আমদানি করা ভ্যাক্সিন দিয়ে এদেশে সফল টিকা পেয়েছে, এমন বাচ্চার হাতের রস নিয়ে ভ্যাক্সিন দেওয়া শুরু হল তারপর। সেটা চলল অনেক বছর। সেই অভিজ্ঞতা অনেক সময় বেশ ভীতিপ্রদ ছিল। ১৮৯৩ সালের বাংলা স্যানিটারি কমিশনার স্বয়ং লিখেছেন—
“বাচ্চাটির সঙ্গে তার মা কাঁদতে কাঁদতে শহর বা গ্রামে চলেছেন। বাচ্চার হাতের ফুস্কুড়ি থেকে যতটা সম্ভব রস চেঁচে নিয়ে, তার ঘা-টির ওপর দুদিক থেকে চিমটের মতো হাতের চাপ মেরে আরও রস বের করা ছিল ভাক্সিনকারীদের সাধারণ অভ্যাস। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম, এক শহর থেকে আরেক শহর এইভাবে বাচ্চাটিকে কষ্ট দেওয়া চলত। পরে তার হাতে বেদনাদায়ক ঘা হয়ে বহুদিন তা থাকত। এরকম বাচ্চাদের টিটেনাস বা জ্বর, এমনকি স্রেফ ক্লান্তিতে মারা পড়ার ঘটনাও জানা আছে। সুতরাং বাংলার মানুষ যে ভ্যাক্সিন নিয়ে বিরূপ এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বাবা-মায়েরা ভ্যাক্সিনকারীদের কাছে থেকে ছেলেমেয়েদের লুকিয়ে রাখেন।” ১
১৮৫০ সাল থেকে এদেশে গরুর গো-বসন্ত গুটির রস থেকে ভ্যাক্সিন দেবার জন্য প্রচেষ্টা শুরু হয়। এই পদ্ধতি প্রথম চালু হয় বোম্বেতে, আর সেখানেও ঠিকমতো চালু হতে আরও বছর কুড়ি লেগেছিল। বিংশ শতকের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও এই পদ্ধতি অন্তত বাংলায় যথেষ্ট পরিমাণে শুরু হয়নি। এখানে ভ্যাক্সিনকারীরা উঁচুজাতের গরীব বাচ্চার হাতে ভাক্সিন দিয়ে তাকেই ‘সোর্স’ হিসেবে ব্যবহার করতেন। উঁচুজাতের শিশুর রস শরীরে নেবার ব্যাপারে এদেশের উঁচু বা নীচু জাতের মানুষ তত আপত্তি করতেন না। কিন্তু নীচুজাতের রক্তরস উঁচুজাতের লোকেরা নিজের বাচ্চাকে দিতে দিতেন না। অবশ্য ইউরোপীয়রা যে এসব সংস্কার থেকে মুক্ত ছিলেন তা বলা যায় না। দেশী টিকাকারদের যখন ভ্যাক্সিনকারী হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল তখন সাহেব ডাক্তাররা মালি বা নাপিত ইত্যাদি জাতের লোকদের সঙ্গে কাজ করা তাঁদের ডাক্তারি পেশার পক্ষে অপমানকর বলে বিরোধিতা করেছিলেন।
আগেকার দেশীয় পদ্ধতির টিকাদাররা ছিল সমাজের নিজের লোক। আর সরকারি আদেশনামায় বলিয়ান ভ্যাক্সিনকারীরা ছিল ভয়ের পাত্র। পাঞ্জাবের একটি সরকারি প্রতিবেদন বলছে, এরা ছিল অসৎ ও নিষ্ঠুর। একটা বাচ্চাকে ভ্যাক্সিনের সোর্স হিসেবে তুলে নিত তারা, তারপর ঘুষ না দিলে রস বের করার নামে অত্যাচার করত। অন্যদিকে বোম্বেতে ভ্যাক্সিনেশনে এমন অভিযোগ ছিল না বললেই চলে, আর সেখানেই ভ্যাক্সিন সবচাইতে বেশি হয়েছিল।
কুসংস্কারের জন্য ভারতীয়রা ভ্যাক্সিন নিতে চায় নি, উঁচুজাতের হাতের রস-ই কেবল গ্রহণ করে অসুবিধা তৈরি করেছে—এসব সত্যি। তেমনই তাদের ভ্যাক্সিন-বিরোধিতার সত্যিকারের কারণ ছিল।
যে ইতিহাস আমরা পড়ি তাতে গুটিবসন্ত থেকে আমাদের রক্ষা করেছিল জেনারের ভ্যাক্সিন, এটা লেখা থাকে। কিন্তু ভ্যাক্সিন দেবার ক্ষমতা আমাদের শাসকদের হাতে ছিল, আর তারা ছিল বিদেশী। ভ্যাক্সিন নিয়ে আমাদের আপত্তি ও সমস্যাগুলি প্রায় সর্বত্র অগ্রাহ্য হয়েছিল। সাহেব প্রশাসক ও সাহেব ডাক্তাররা যতদিন পর্যন্ত নিজেরা ভুল সংশোধন না করতেন ততদিন আমরা নিরুপায় ছিলাম। আমাদের ইতিহাসে এসব লেখা নেই। ইউরোপে ভুল বলে জানা জিনিস এদেশে বহুদিন চলত, শাসকের দয়া হলে ভুল সংশোধিত হত।
টিকাকরণের ইতিহাসের এই ভুল সংশোধনের জন্যও বোধকরি আমরা আজানা কোনো শাসকের দিকে চেয়ে আছি। দাসত্ব কেবল রাজনৈতিক পরাধীনতা নয়, তা শিরায় ঢুকে যাওয়া এক অভ্যাস, একথাটা খুব মিথ্যে নয় বোধহয়।
একদিন করোনা-র ভ্যাক্সিন বেরোবে। আমরা হয়তো জেনারের ভ্যাক্সিনের মতোই অন্যের দয়ায় ভ্যাক্সিন পাব। অথবা পাব না। ভ্যাক্সিনের ইতিহাস হয়তো পুনরাবৃত্তি হবে। প্রথমে ছিল ট্রাজেডি, আমরা গুটিবসন্তে দেখেছি। এবারে দেখব করুণ কৌতুক—নির্বোধকে ভবিষ্যৎ কোনোদিনই ক্ষমা করেনি।