ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশায়ার শহর। ঘড়ির কাঁটা বলছে সময়টা মধ্যরাত। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে শহরের তাপমাত্রা। প্রতিরাতের মতোই সেই রাতেও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ল্যাঙ্কাশায়ার শহর, ব্যতিক্রম নন ল্যাঙ্কাশায়ার থানার ডিউটি অফিসারও। হঠাৎই যেন জীবন্ত হয়ে উঠল থানার একমাত্র টেলিফোনটা। ফোনের আকস্মিক আর্তনাদে সাময়িক তন্দ্রা ছুটে গেল অফিসারের। ‘স্যার, এখানে ব্রিজের নিচে একটা লাশ পড়ে আছে।’
উপরের ঘটনাটি ১৯৩৫ সালের। তারপর থেকে কেটে গেছে সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর। গঙ্গা আর টেমস নদীর উপর দিয়ে বয়ে গেছে গ্যালন গ্যালন জল। ১৯৬০ সালের মার্চ মাস, ঘটনাস্থল সাউথ পোর্ট পুলিশ স্টেশন। পঁচিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া ল্যাঙ্কাশায়ারের সেই ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি। একইরকম ভাবে সেদিনও টেলিফোনের যান্ত্রিক আওয়াজে ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছিল রাতের সমস্ত নীরবতা। ডিউটি অফিসারকে ছুটে যেতে হয়েছিল তারাতলার কাছে একটি পরিত্যক্ত ঝিলের ধারে। যেখান থেকে উদ্ধার হল আস্ত একটি নরকঙ্কাল। কিছুদিনের মধ্যেই ঘটনার তদন্তভার এসে পড়ল লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের হাতে। তদন্তে নামলেন ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের অন্যতম দুঁদে অফিসার অনিল ব্যানার্জী।
পঞ্চম শুক্লা হত্যা রহস্য দিনের পর দিন ঘনীভূত হতে শুরু করল। রহস্যের জাল এতদূর বিস্তৃত ছিল যে, লালবাজারের পোড়খাওয়া গোয়েন্দারাও প্রথমে কিনারা করতে পারেননি এই হত্যা রহস্যের। শেষ পর্যন্ত অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গ্রেপ্তার করা হল পঞ্চমের বন্ধু রামলোচনকে। জেরায় স্বীকারও করল, সে পাঁচশ টাকা ধার নিয়ে শোধ না দেওয়ার জন্যই রাগের মাথায় হত্যা করেছে পঞ্চমকে আর তথ্যপ্রমাণ লোপাটের জন্যই পঞ্চমের দেহ ঝিলের মধ্যেই পুঁতে ফেলেছিল।
অন্যান্য আর পাঁচটা সাধারণ খুনের সঙ্গে খুব একটা পার্থক্য ছিল না পঞ্চম শুক্লা মার্ডার কেসের। কিন্তু অতি সাধারণ হয়েও এই হত্যা রহস্যের জট খুলেছিল অভাবিতভাবে। বস্তুতপক্ষে এই কেসের সূত্র ধরেই মৃতদেহের সঠিক পরিচয় পেতে ভারতের বুকে প্রথম ব্যবহার করা হল সুপার ইম্পজিশন পদ্ধতি। যা তৎকালীন সময়ে ছিল বর্তমানের ডিএনএ পরীক্ষার সমতুল্য। কী এই সুপার ইম্পোজিশন পদ্ধতি? সুপ্রতিম সরকার তার 'গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার' বইয়ে লিখছেন - "কোন এক অবয়বের কোন একটি জায়গার একটি নির্দিষ্ট বিন্দু অন্য একটি অবয়বের ওই জায়গার একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে মিলে যাওয়া, মিশে যাওয়া নিখুঁতভাবে।" এই সম্পূর্ণ পদ্ধতিটির নাম 'সুপার ইম্পোজিশন।' খুন হওয়া ব্যক্তিই যে পঞ্চম শুক্লা তা প্রমাণ করতে এই সুপার ইম্পোজিশন পদ্ধতি যথেষ্ট সহয়তা করেছিল তদন্তকারী দলকে। ডাক্তাররা খুলির 'সুপার ইম্পজিশন' করে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন উদ্ধার হওয়া নরকঙ্কালটি পঞ্চম শুক্লারই। পুরো তদন্তে ডাঃ নির্মলকুমার সেন ছিলেন প্রচারের আড়ালে, অথচ তদন্তের সফলতার ক্ষেত্রে তিনিই হয়তো সিংহভাগ কৃতিত্বের দাবিদার। সেই সময় তিনি ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির অধিকর্তা। তাঁর নেতৃত্বেই সুপার ইম্পোজিশন পদ্ধতিটির সফল প্রয়োগ হয়।
এবার আমরা ফিরে যাব ল্যাঙ্কাশায়ারের সেই হত্যাকাণ্ডের কথায়। কাকতালীয় কিনা জানা নেই, কিন্তু কলকাতার বন্দর এলাকার নিরাপত্তারক্ষী পঞ্চম শুক্লার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল প্রায় পঁচিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া ল্যাঙ্কাশায়ারের সেই হত্যাকাণ্ড।
রতনজি হাকিম ছিলেন একজন ভারতীয় ডাক্তার। ডাক্তারি পরীক্ষায় পাশ করার পর ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান তিনি। কিছুদিনের মধ্যে পসারও জমে ওঠে তার। যিনি সন্দেহের বশে খুন করেন তার স্ত্রী ইসাবেলাকে। তার সঙ্গেই তথ্য-প্রমাণ লোপাটের উদ্দেশ্যে খুন করা হয় মেরী নামক আরও একজনকে। এই ঘটনার কিনারা করতেই বিশ্বের বুকে প্রথম ব্যবহৃত হয় 'সুপার ইম্পোজিশন’। যার হাত ধরেই প্রায় পঁচিশ বছর পরে সমগ্র ভারতের নিরিখে কলকাতাতে প্রথম ব্যবহৃত হল 'সুপার ইম্পজিশন' পদ্ধতি। যার অন্যতম পথিকৃৎ হয়ে রয়লেন ডা নির্মলকুমার সেন। খুন-তথ্যলোপাট-খুনের কিনারা এসবের মধ্যে এভাবেই আড়ালে থেকে যায় হাজারো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং নির্মলবাবুর মতো এরকম অজস্র নেপথ্য নায়কের কথা।
তথ্যসূত্র - গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার - সুপ্ৰতিম সরকার
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।