১৭৫৭ সালের ২৩এ জুন। পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত নবাব সিরাজদৌল্লা। শুধু মীরজাফর বা মিরকাশিম নন, ইংরেজদের হাতে নিজেকে বিক্রি করেছেন নবকৃষ্ণ দেবও। এমনকি যুদ্ধজয়ের পর একপ্রকার তাঁর নেতৃত্বেই নবাব সিরাজের কোষাগারে চালানো হয় যথেচ্ছ লুণ্ঠন। যুদ্ধজয়ের সেলিব্রেশনের জন্য এরপর শোভাবাজার রাজবাড়িতে শুরু হল দুর্গোৎসব, যে রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেব স্বয়ং।
অবশ্য শুধুমাত্র পলাশীর যুদ্ধজয়ের বিজয় উৎসব পালনের জন্যই যে দুর্গাপুজোর সূত্রপাত, সে কথা বললে ভুল বলা হবে। এর পিছনেও ছিল জটিল রাজনৈতিক অভিসন্ধি। কৌশলী রবার্ট ক্লাইভ দুর্গাপুজোকে ব্যবহার করে এই সব জমিদারদের মাধ্যমে শুরু করেন জনসংযোগ। রবার্ট ক্লাইভ বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন, শুধুমাত্র অত্যাচারী শাসকের পন্থা অবলম্বন করলে বেশিদিন তাদের আধিপত্য বজায় রাখা অসম্ভব হবে। ফলে, দুর্গাপুজোর সঙ্গে যুক্ত হল ইংরেজদের স্তাবকতার এক করুণ ইতিহাস।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগেও দুর্গাকে মা রূপে পুজোর প্রচলন ছিল। সেই সময় থেকেই দুর্গা হয়ে ওঠেন একপ্রকার 'গার্ল নেক্সট ডোর' অর্থাৎ পাশের বাড়ির মেয়ে। ইংরেজ শাসনকালে পরিবর্তন এল দুর্গাপুজোয়। দুর্গাপুজো ব্যবহৃত হতে থাকল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে। এমনকি ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো এর ব্যতিক্রম ছিল না। মুর্শিদাবাদ বা লখনৌ থেকে নাচিয়েরা এসে আসর জমিয়ে গেছেন, ঠাকুরবাড়িতে রয়েছে এমন উদাহরণও। তবে ইংরেজদের চাটুকারিতার উদ্দেশ্যে আয়োজিত দুর্গাপুজোর ইতিহাসে যবনিকা পড়ল ঊনবিংশ শতকের উত্তাল সময়ে। দুর্গা তার চিরাচরিত মাতৃরূপ থেকে হয়ে উঠলেন ইংরেজ বিতাড়নের অন্যতম অস্ত্র।
বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর 'আনন্দমঠ' উপন্যাসে দুর্গাপুজোর প্রসঙ্গ ফিরিয়ে এনেছেন বারংবার। এমনকি সেই সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান প্রকাশিত হয়েছে দুর্গাপ্রতিমার ছবির নিচে, রয়েছে এমন নিদর্শনও।
১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয় 'বেঙ্গলি' পত্রিকা। যেখানে দুর্গাকে খরা বন্যা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে মুক্তির জন্য 'দুর্গতিনাশিনী' বলে অভিহিত করা হয়েছে। দুর্গা মূর্তির সামনে বিপ্লবী যুবকদের শারীরিক কসরত বা লাঠি খেলার অভ্যাস করা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমনকি ভবানী পাঠক দেবী চৌধুরানীকে দেবী দুর্গার সামনে পাঠ দিয়েছিলেন সাধন-ভজনের। আবার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের ফলে জেলবন্দি যুবকদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল দুর্গাপুজো। জেল থেকে বেরিয়ে আসার পরেও বিভিন্ন দুর্গাপুজোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সুভাষচন্দ্র। ১৯২৫ সালে সুভাষচন্দ্র বসু জেল থেকে পত্র মারফত এক বন্ধুকে জানাচ্ছেন, জেল আধিকারিকের থেকে দুর্গাপুজোর অনুমতি পাওয়া গিয়েছে। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের নিদর্শন হিসেবে বাগবাজারে আজও পালিত হয় বীর-অষ্টমী। ১৯১৯ সালে স্বদেশি আন্দোলনের সময় সমস্ত বিপ্লবী সংগঠনকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসার জন্য বর্তমান বাংলাদেশের খুলনা চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলেও সূত্রপাত ঘটে মাতৃবন্দনার। শিবপুরের রায়চৌধুরী পরিবারে ইংরেজ বিরোধিতার নিদর্শন হিসেবে সাদা ছাগল বলি দেবার প্রচলন আছে আজও।
এভাবেই দুর্গাপুজো নিজের পরিচয় বদলেছে বারবার। হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক অস্ত্র। স্তাবকতা থেকে রূপান্তরিত হয়েছে বিপ্লবে। ইতিহাস তার চলা থামায়নি আজও ...
তথ্যসূত্র –
১। দুর্গাপুজোর ইতিহাস- তোষামদ থেকে স্তাবকতা ভায়া জাতীয়তাবাদ বিবর্তনের দুর্গাপুজো, মধুরিমা দত্ত, এনডিটিভি বাংলা
২। রোর মিডিয়া
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।