ঊনবিংশ শতকের সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসের পাতা ওল্টালে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িকে অস্বীকার করা যায় না কিছুতেই। রবীন্দ্র সরণী - যার আদিনাম চিৎপুর রোড, সেই রাস্তা ধরে কিছুদূর এগোলেই চোখে পড়বে দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলি। এই গলির পাঁচ ও ছয় নম্বর বাড়ি ছিল ঊনবিংশ শতকের বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের পীঠস্থান।
তবে ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে কান পাতলে শুধু যে সাহিত্য-সংস্কৃতির জয়ধ্বনি শোনা যেত তাই নয়, সেই সঙ্গে শোনা যেত অগুন্তি মৃত্যুর হাহাকার আর সম্পর্ক ভাঙার শব্দও। অন্তত ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস সেই কথাই বলে।
ঠাকুর পরিবারের রীতি ছিল খুব সাধারণ পরিবারের মেয়েদের বাড়ির বউ করে আনা। বিয়ের পর সেই মেয়েদের নামও পাল্টে ফেলা হত। দিগম্বরী দেবী দ্বারকানাথের স্ত্রী হয়ে ঠাকুরবাড়িতে পা দেন মাত্র ছয় বছর বয়সে। রূপে-গুণে তিনি ছিলেন অতুলনীয়া। মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন একান্নবর্তী পরিবারের দায়িত্ব। অন্যদিকে দিগম্বরী ঠাকুর পরিবারে আসার কিছুদিনের মধ্যেই দ্বারকানাথের ব্যবসা বিস্তৃত হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে পাবনা রংপুর পর্যন্ত। স্বাভাবিকভাবেই অতি অল্পদিনের মধ্যেই পরিবারের সকলের কাছেই দিগম্বরী হয়ে উঠলেন সুলক্ষণা।
অন্যদিকে ব্যবসা যত ফুলেফেঁপে উঠতে লাগল, দ্বারকানাথও ততই বিলাসিতায় ডুবতে লাগলেন ধীরে ধীরে। আসক্ত হয়ে পড়লেন মদ্যপানে। চলতে লাগল অফুরন্ত আমোদ-প্রমোদ। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে বেলগাছিয়ায় একটি বাগানবাড়ি প্রস্তুত করেছিলেন তিনি। সেখানেই রাতের পর রাত চলতে লাগল ফুর্তি।
দ্বারকানাথের স্ত্রী দিগম্বরী ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ মহিলা। দ্বারকানাথের এই অতিরিক্ত বিলাসিতা কোনোদিনই ভালোভাবে নেননি তিনি। বাড়ির দীর্ঘদিনের পুজোর অধিকার আগেই হারিয়েছিলেন দ্বারকানাথ। এবার অতিরিক্ত বিলাসিতার কারণে স্ত্রী দিগম্বরীর সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করল। শুরু হল প্রবল দাম্পত্য কলহ। বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ির কথা যেদিন দিগম্বরী দেবীর কানে এল, সেদিনই তিনি ঠিক করলেন এই কুলধর্ম জলাঞ্জলি দেওয়া স্বামীর সঙ্গে আর এক মুহূর্ত নয়। যদিও শেষ পর্যন্ত দ্বারকানাথকে ছেড়ে যাননি। কিন্তু সম্পর্কের সেই আগের আবেগ ফিরে আসেনি আর কখনওই।
এ-বিষয়ে ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘দ্বারকানাথের জীবনী’ বইয়ে লিখেছিলেন - '...দিগম্বরী দেবী ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতগণের নিকটে মতামত চাহিয়া পাঠাইলেন যে, যদি স্বামী ম্লেচ্ছদিগের সহিত একত্র পানভোজন করেন, তবে তাঁহার সহিত একত্র অবস্থান কর্ত্তব্য কি না! তাঁহারা উত্তর দিলেন যে, স্বামীকে ভক্তি ও তাঁহার সেবা অবশ্য কর্তব্য, তবে তাঁহার সহিত একত্র সহবাস প্রভৃতি কার্য্য অকর্ত্তব্য। এই বিধান অনুসারে দিগম্বরী তাঁহার উপযুক্তমত সেবাকর্ম্ম ব্যতীত আর সর্বপ্রকার সম্পর্ক ত্যাগ করিলেন। ...যতবার তিনি দ্বারকানাথের সহিত কথা কহিতে বাধ্য হইতেন, ততবারই সাতঘড়া গঙ্গা জলে স্নান করিয়া নিজেকে পরিশুদ্ধ বোধ করিতেন। এ বিষয়ে তাঁহার দিনরাতের বিচার ছিল না।'
এর কিছুদিনের মধ্যেই দিগম্বরী দেবীর মৃত্যু ঘটে। দিগম্বরী বেঁচে থাকতেই যে সম্পর্কে ভাটার টান লেগেছিল, তাঁর মৃত্যুতে সে সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটে নিশ্চিতভাবেই। তারপরও কি দ্বারকানাথ তাঁর অভ্যাস বদলেছিলেন একটুও? ইতিহাস জানান দেয় – না। সম্পর্কের দীর্ঘশ্বাস এভাবেই পাক খেয়েছিল সেবার, ঠাকুরবাড়ির দেওয়ালে-দেওয়ালে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।