দুর্গাকে 'বেশ্যা' পর্যায়ে ফেলা হচ্ছে কেন তার একটি সঙ্গত ব্যাখ্যা হয়তো এই যে- আগেকার দিনে যেমন ষোড়শ মহাজনপদের কালে ও তৎপূর্বে, আম্রপালির মতো নগরনটী, বারাঙ্গনা বা জনপদবধূ(রবীন্দ্রনাথের 'শ্যামা' স্মর্তব্য)রা যেমন সমাজে যথেষ্ট ক্ষমতা-প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারিণী ছিলেন ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অলিন্দে আনাগোনা ছিল তাঁদের বিভিন্ন সঙ্গত কারণে, honey trap tool হিসেবে ব্যবহৃত হবার জন্যই হোক, বা গুপ্তচরবৃত্তির কাজের উদ্দেশ্যেই হোক। সেরকমই কোনো এক গুরুত্বপূর্ণ পদের অধিকারিণী ছিলেন দুর্গা কোন আর্যরাজত্বাধীন অঞ্চলে। এ প্রসঙ্গে দুটি বেশ কৌতুহল-উদ্রেককারী reference দেওয়া যায়- ১. দুর্গার উৎপত্তি-সমস্ত দেবতাদের 'বীর্য নিজ অঙ্গে ধারণ করে'(বাস্তব দৃষ্টিতে দেখলে, হয় সূক্ষ্মভাবে এই ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে-দুর্গা ইন্দ্রাদিনানাদেবতাতুল্য-দেবসদৃশ পুরুষদের থেকে উৎপন্ন কন্যা, অর্থাৎ স্থূল অর্থে কোন জনপদবধূজাতা নারী, কোন "বেশ্যাপল্লীজাতা" "বেশ্যা"নন্দিনী, অথবা তিনি নিজেই স্বয়ং কোনো ক্ষমতাশালিনী বারনারী যিনি এই ক্ষমতার শীর্ষে থাকা আর্যপুরুষদের অঙ্কশায়িনী ও 'বীর্যধারিণী', আর তখনকার দিনে মুখ্যত এইরূপ বারমুখ্যা ও বারাঙ্গনা নারীরা বহু বিদ্যা(৬৪ কলা) য় পারদর্শিনী হবার প্রশিক্ষণ পেতেন, বিষবিদ্যা, ভেষজ বিদ্যা ও শস্ত্রবিদ্যা সহ, আত্মসুরক্ষার কারণে)। এই দেবীর নিবাস যে আর্যরাজত্বে ছিল, সেই রাজ্যের সাথে অন্য রাজ্যের অনার্য শাসক (মহিষাসুর/হুদুড় দুর্গা/বা অন্য কিছুও নাম হতে পারে, নামে কিছু এসে যায় না) এর দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলে, কিছুতেই অনার্য শাসককে বাগে আনতে না পেরে, এই আর্য দেবতা-তথা-শাসকেরা দুর্গাদেবীকে honey trap অথবা উপঢৌকন বা ভেট/নজরানা/সন্ধিপ্রস্তাবক দূতী/গুপ্তচর হিসেবেই পাঠান এই অনার্য রাজার কাছে, এবং প্রাথমিকভাবে, অনার্য শাসক দেবীর রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়ে দেবীকে অধিকার করার জন্য আক্রমণ করলে বা আগ্রাসী ব্যবহার করলে দেবী বাধ্য হন ভল্ল/বর্শা প্রয়োগ করে সেই আক্রমণকারীকে বধ করতে, যা হয়তো দেবীর নিয়োগকারী 'দেবতা'দের ও প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল না। দেবতারা এতে হয়তো ভীত/শঙ্কিত হন যে, যে পুরুষ, প্রবল পরাক্রান্ত 'অসুররাজ'কে, তাঁরা, বড়ো বড়ো 'বীর বোগাতীর' ইন্দ্র-বরুণ-অগ্নি দেবতারা বধ করতে পারেননি, তাকে এক সামান্য 'নগরবধূ' পর্যায়ের নারী বধ করেছে, যা তাঁদের 'পৌরুষ', 'ক্ষমতার দম্ভ'এর প্রতিস্পর্ধী হতে পারে- সেই আশঙ্কায় দুর্গার 'দেবী/দৈব ক্ষমতার অধিকারিণী-যে দৈব ক্ষমতা দেবী পুরুষদেবতাদের থেকেই লাভ করেছেন' এরূপে বিনির্মাণ শুরু হয়- এভাবে 'দেবতা'রা এক ঢিলে দুই পাখি মারেন-
ক. দুর্গাকেও যথোচিত সম্মান দেখানো হলো- মানবী নগরবধূ না, অসুরঘাতিনী দেবী হিসেবেই ভাবীকাল তাঁকে শুধু স্মরণ করবে না, পূজাও করবে, আর সেই 'ধূপের ধোঁয়া ফুলের মালা' র আড়ালে এক অসামান্যা নারীর বীরত্বের ও আত্মসম্মান রক্ষার অধিকারের কাহিনী ঢাকা পড়ে গিয়ে তার দৈবী অলৌকিক মহিমার আখ্যানটিই অধিক প্রচারিত হবে।
খ.দেবতাদের নিজেদের "পৌরুষগর্ব" ও "ক্ষমতার অধিকার" ও সুরক্ষিত রইলো- দুর্গা এখন সামান্যা নগরনটী, বহুভোগ্যা 'নারী' থেকে দেবী পর্যায়ে উন্নীতা হয়ে যিনি 'রাষ্ট্রী', রাষ্ট্রশক্তির প্রতিস্পর্ধী নয়, রক্ষাকারিণী দেবী তিনি। এই প্রসঙ্গে বলা যায়, পরবর্তীকালেও এইরকম অসুরকে রূপের মায়া-মোহজালে আবদ্ধ/বশীভূত করে বধ করার আখ্যান আমরা পাচ্ছি শ্রীশ্রীচন্ডীর আরেক অধ্যায়, "মহাসরস্বতী চরিত্রে", শুম্ভ-নিশুম্ভ বধার্থে দেবীর সম্মোহনী রূপ পরিগ্রহ করা, দেবীর 'কৌশিকী' রূপে তারা আকৃষ্ট হলে "চামুন্ডা" রূপে চন্ডমুন্ডাদিসহ অসুরদের নিধন করা, পরে নরকাসুর বধের সময়েও "কামাখ্যা"র নিজরূপ দ্বারা অসুরকে আকর্ষণ করা ও ছলের আশ্রয় নিয়ে হত্যা করা(অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনীতেও সমগোত্রীয় ঘটনার সন্ধান পাই- বিষ্ণুর 'মোহিনী' রূপধারণ কর্তৃক অসুরদের অমৃত থেকে বঞ্চিত করা, সমুদ্রমন্থনকালে তারা সমান শ্রমদান করে অমৃতের ন্যায্য অধিকারী হলেও, অথবা 'তিলোত্তমা'র দ্বারা সুন্দ-উপসুন্দের মধ্যে ভ্রাতৃদ্বেষ সৃষ্টি করা প্রভৃতি) এবং শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ যুক্তিতে এইসব ঘটনাক্রমকে justify করা। আবার ক্রমশ এভাবেই রাষ্ট্রশক্তির রক্ষিণী হিসেবে দেবীর বিভিন্ন রূপের উত্থান-বিভিন্ন রাজপুত রাজবংশের কুলদেবী(অম্বাদেবী প্রভৃতি), দাক্ষিণাত্যের রাজশ্যামলা-বিন্ধ্যবাসিনী প্রমুখাদি রূপে রাজবংশের অধিষ্ঠাত্রী-রক্ষয়িত্রী দেবীরূপে প্রতিষ্ঠালাভ, মহাভারতে যুধিষ্ঠির-অর্জুনকৃত দুর্গাস্তব বা কৃত্তিবাসী রামায়ণে, জগদ্রামী অদ্ভুত রামায়ণে রাজা রাম কর্তৃক দুর্গার/সীতারূপিণী শক্তির বোধন/আরাধনা, অনার্য অধ্যুষিত লঙ্কারও রক্ষয়িত্রী রূপে রাবণ-অহিরাবণ-মহীরাবণ পূজিতা ভদ্রকালীর উপাসনা-একথাই বারংবার প্রমাণ করে, কিভাবে প্রকৃতি ও শক্তি মাতৃকা আরাধনার যে অনার্য মাতৃতান্ত্রিক সমাজের শক্তিসাধনার ধারাটি, তা আর্য discourse এ এসে প্রাতিষ্ঠানিক রাজশক্তি/শাসকশক্তির পৃষ্ঠপোষক/সংরক্ষক দৈবশক্তির আরাধনায় রূপান্তরিত হয়েছে, ও ছলনা, শঠতার আশ্রয়ে আর্যগৌরবান্বিত পুরুষতান্ত্রিক শাসকশক্তির সহায়ক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে মাত্র।
দেবী দুর্গার রূপকল্প বিশ্লেষণ করলে চার-পাঁচটি উল্লেখযোগ্য দিক উঠে আসে-
১.আর্যগুণসম্পন্না দেবী(পীতঅতসীপুষ্পবর্ণা, যদিও অনেক জায়গাতেই দেবীকে গলিত স্বর্ণ, অগ্নির মতো রক্তবর্ণা বলেও উল্লেখ করা হয়েছে, যা আর্য-অনার্য সঙ্কর জাতি উৎসের ইঙ্গিতবাহী, পরে গিরিজা যোদ্ধৃরূপা দেবীকে আর্য ব্রাহ্মণ্য দেবপরিমন্ডলে স্থান দেবার জন্য পূর্ণ বিশুদ্ধ আর্যনারীসুলভ বৈশিষ্ট্যাবলী আরোপিত হয়েছে দেবীর রূপে)
২.মহিষ/মহিষদানব মর্দিনী দেবী( buffalo demon slayer goddess)
৩.বহুভুজা(৪/৮/১০/১৮ ভুজা) দেবী(ইনান্না/ইশতার প্রভৃতি মেসোপটেমিয়/ব্যাবিলনীয় সভ্যতার দেবীরা স্মর্তব্য এই প্রসঙ্গে), যার জন্য আব্রাহামিক ধর্মগুলির অন্যতম, খ্রিস্টধর্মের প্রচারক পাদ্রীরা প্রাচ্যদেশে ধর্ম ও ঔপনিবেশিকতার প্রচারে এসে কালী, দুর্গার মতো দেবীদের 'many handed aboriginal demoness' হিসেবে অভিহিত করেছেন।
৪.সিংহবাহিনী দেবী(lion-riding war goddess cult reference)
৫.মাতৃকাদেবী(fierce but nurturing protective mother goddess cult)
৬.প্রকৃতিদেবী(nature and fertility goddess cult)
এই বহুপ্রকার ভিন্ন ভিন্ন দেবীরূপ, যাঁদের ভূমিকাও ভিন্ন ভিন্ন, একটি দেবীতে এসে সমাহিত হয়েছেন, যিনি দুর্গা-মূলে যিনি ছিলেন মানবী, জনপদমোহিনী নারী, পুরুষতান্ত্রিক আর্য শাসকতন্ত্রের জটিল কূটনীতির ক্রীড়নক হয়েও
যিনি নিজের সম্ভ্রমরক্ষার্থে অনার্য শাসক তথা ধর্ষককে সংহার করেছিলেন, কূটনৈতিক জটিলতার তোয়াক্কা না করেই, আর্য বীরপুরুষ শাসকেরাও সম্মুখসমরে যা পারেননি।
২. এ তো গেল একটা ধরনের dispositional deconstruction, দ্বিতীয় বিষয়টায় আসি-দুর্গাপূজায় প্রতিমা নির্মাণ, ঘটস্থাপন ও মহাস্নান কালে বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা ব্যবহার-হঠাৎ বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকাই কেন? গজদন্ত-বরাহদন্তমৃত্তিকার ও না হয় ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে সেগুলি অপেক্ষাকৃত দুর্লভ বস্তু, তাই সেগুলি জোগাড়ের মাধ্যমে পূজায় একধরনের কৃচ্ছসাধন হয় ও পূজার জাঁকজমক-ধুমধাম ব্যাপারটিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা যায় জনমানসে-কিন্তু বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা?!! দুর্গার সাথে অস্ত্রশস্ত্র-বীরত্বব্যঞ্জক বিষয়গুলির সংযোগ রয়েছে-তাই অস্ত্রাগার, যুদ্ধক্ষেত্রের মৃত্তিকা অথবা অন্য কোন বৃত্তিধারী মানুষ-পাঠশালা/গুরুগৃহের পণ্ডিত শাস্ত্রবেত্তা ব্রাহ্মণের গৃহাঙ্গনের মাটি, অথবা ক্ষত্রিয় শাসকের রাজগৃহের রাজদ্বারমাটি, বা শ্মশানবাসী ডোম-চন্ডালের গৃহের মৃত্তিকাও তো সুপ্রশস্ত হতে পারতো শক্তিরূপা দেবীর তন্ত্রমতে আরাধনায়-তাহলে এতকিছুর বদলে বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা কেন? তবে কি এইখান থেকে এই ইঙ্গিতই পরিস্ফুট হয়, এই বেশ্যাপল্লীর সাথে দেবী দুর্গার সুপ্রাচীন নৃতাত্ত্বিক কোনো সংযোগ রয়েছে, যা কালক্রমে বিস্মৃতির আড়ালে চলে গিয়েছে, কেবল শাস্ত্রাচারটিই পড়ে রয়েছে?
উপসংহারে এটিই বলা যায়, যেসব বিশেষ আব্রাহামীয় ধর্মানুসারীরা ভাবছেন ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মের একজন প্রধানা দেবীকে "বেশ্যা" অভিহিত করে তাঁরা "হিন্দুধর্মকে বেশ একহাত নিলেন" ও অপরপক্ষে যাঁরা মনে করছেন, "বেশ্যা" অভিধায় দেবী 'অপমানিতা' হচ্ছেন, হিন্দুধর্ম 'অপমানিত' হচ্ছে, সেইসব পুঙ্গবদের জন্য অনেক সেলাম-আদাব ও গৈরিক নমন। তাঁরা যুদ্ধ করুন, যোদ্ধা দেবী দুর্গা ও তাঁর উপাসক-উপাসিকাদের মনোরঞ্জন করুন, আমার শেষ প্রণাম সেইসব দেবীদের চরণে, যাঁদের মধ্যেও ব্রহ্মস্বরূপিণী হৈমবতী ও লীলাময়ী মহামায়া সংস্থিতা-আমাদের মতোই যাঁরা রক্ত-মাংস সমন্বিত আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানবী, যাঁদের সমাজ "দেহপসারিণী" বলে ঘৃণা-করুণা করতেই অভ্যস্ত, তাঁদের মানবাধিকারের কথা বিস্মৃত হয়ে-সেইসব মানবীদের প্রতি, রামকৃষ্ণ চিৎপুরের রাস্তায় যাঁর মধ্যে 'দক্ষিণেশ্বরের মা' কে দর্শন করেন, বা বিবেকানন্দ ফরাসী বারাঙ্গনাপল্লীতে যাঁদের দুরবস্থায় অশ্রুবর্ষণ করেন, সেইসব মহাভাবভাবিনীদের কল্যাণ হোক। শুভমস্ত।।