(১)
১৯৪৫ সালে দৈনিক ‘কৃষক’ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত হয় তারাশঙ্করের উপন্যাস ‘উদয়াস্ত’। পরের বছর উপন্যাসটি বই হিসেবে প্রকাশ করার সময় তারাশঙ্কর নিজেই নামটি পালটে দিয়েছিলেন ‘সন্দীপন পাঠশালা’। বাংলা সাহিত্যে শিক্ষকদের জীবন নিয়ে এর পূর্বে লেখালিখি অবশ্য হয়েছে, তবে তারাশঙ্কর লিখলেন তৎকালীন গ্রাম্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের কথা। আরও পাঁচটি উপন্যাসের মতো এই উপন্যাস যে তাঁর অভিজ্ঞতা প্রসূত তা বলাই বাহুল্য। একটা সময় সমাজ সেবক অথবা ইউনিয়ন বোর্ডের সহসভাপতি এবং পরে সভাপতি হিসেবে তারাশঙ্কর গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন। সেই সময়ের গ্রাম্য পাঠশালা এবং পাঠশালার পণ্ডিতের দুর্দশাগ্রস্ত জীবন যে তাঁর সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি, এ কাহিনি তারই প্রামাণ্য দলিল। বইটির উৎসর্গের পাতায় তারাশঙ্কর লিখেছিলেন, ‘বাংলা দেশের শিক্ষক-জীবন অবহেলিত, অনাদৃত। পাঠশালার শিক্ষক বা পণ্ডিত মশাইদের তো কথাই নাই। এঁদের সুখ-দুঃখ অবহেলিত, সমাজ-জীবনে সামান্যতম সম্মান থেকেও এঁরা বঞ্চিত। এঁদের নিয়ে দু-চারটি হাস্যরসাত্মক রচনা আমাদের সাহিত্যে আছে- সেইগুলিই এঁদের প্রতি অবহেলার নিদর্শন। সীতারাম আমার কাছে বাস্তব; তার মনের পরিচয় বহুবার পেয়েছি। তাকে সাহিত্যে রূপদানের বাসনা ছিল, এতদিনে তা সম্ভবপর হওয়ায় আমি নিজে আনন্দিত হয়েছি সবচেয়ে বেশি।’
‘সন্দীপন পাঠশালা’র আগে তারাশঙ্কর তাঁর ছোটগল্পে শিক্ষক-মহাশয়দের কথা অল্প অল্প তুলে ধরেছেন। ১৯৩৩ সালে বঙ্গশ্রীর অগ্রহায়ণ সংখ্যায় ‘মধু মাস্টার’, ১৯৩৬ সালে দেশ পত্রিকার চৈত্র সংখ্যায় ‘পণ্ডিত মশাই’ এবং ১৯৪১ সালে প্রবাসীর বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘হরি পণ্ডিতের কাহিনি’। ‘পণ্ডিত মশাই’এর যতীন চাটুজ্জে এবং ‘হরি পণ্ডিতের কাহিনি’র হরিনাথ চাটুজ্জে যে একই ব্যক্তি তা বুঝতে পাঠকের অসুবিধা হয় না। দুজনেই পল্লীগ্রামের পণ্ডিত। দুজনেরই পাঠশালা বসে জমিদারের কাছারি বাড়িতে। ছেলে পড়ানোর চাকরির অঙ্গ হিসেবে দুজনকেই গ্রাম দেবতার পুজো করতে হয় এবং জমিদারের আগমন হলে রাঁধুনির ভূমিকা পালন করতে হয়। এঁদের দুজনেরই কাজে প্রবল নিষ্ঠা। খেটেখুটে একেকটি ছেলেকে এঁরা তৈরি করেন বৃত্তি পরীক্ষার উপযুক্ত করে। আর পার্শ্ববর্তী পাঠশালা সেই ছাত্রকে লোভ দেখিয়ে ভাঙিয়ে নিয়ে যায় পরীক্ষার আগেই। তাই এঁদের পাঠশালা সরকারের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার যোগ্যতায় পিছিয়ে থাকে। যতীন অথবা হরি পণ্ডিতকে এই কারণে লোকে ‘কাক-পণ্ডিত’ বলে। চিরকাল কাকের মতো তাঁরা অপরের বাচ্চাকে উপযুক্ত করেই যান।
শিক্ষক-মহাশয়দের আপন প্রতিষ্ঠা লাভের স্বপ্ন ছাড়াও ছাত্র তৈরির স্বপ্ন বার বার তারাশঙ্করের লেখায় উঠে এসেছে। শিক্ষকরা স্বপ্ন দেখেছেন, ছাত্ররা বড় হয়ে সমাজের এক একজন বিশিষ্ট মানুষ হবে। জজ-ম্যাজিস্ট্রেট হবে অথবা আরও বড় শিক্ষক হবে। তার জন্যে পরিশ্রম করছেন। এই প্রসঙ্গে ‘পণ্ডিত মশাই’ গল্পের যতীন চাটুজ্জের ছাত্র বাৎসল্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ছাত্রের জন্যে তিনি চুরি পর্যন্ত করেছেন। জমিদারের কাছে নিজের অপরাধ স্বীকার করে সাধু ভাষায় কথা বলা পণ্ডিত বলছেন, ‘বড়ই মেধাবী ছাত্র এটি। কিন্তু সংসারে বড়ই অভাব। আমাকে কিছু কিছু করে সাহায্য করতে হয়। নতুবা উদরের দায়ে বালকটিকে পড়া পরিত্যাগ করে কারও গো-চারণ চাকুরি গ্রহণ করতে হবে। ... আর ঘৃতটুকু হুজুর, ঐ ওকেই সেবন করতে দিয়েছি, - মেধাবী ছাত্র, ঘৃতে মেধা বৃদ্ধি হয়।’
দুএক জন ছাত্রের মধ্যে দিয়ে শিক্ষকদের আশা পূরণ হয়ত হতো কিন্তু তাতে শিক্ষক-মহাশয়দের জীবনে উপেক্ষা, অনাদর বা দারিদ্রের সমাপ্তি ঘটত না। একজন মানুষের সমগ্র কর্মজীবনকে পর্যালোচনা করলেই হয়ত সম্পূর্ণ ছবিটি দেখতে পাওয়া যায়। ‘সন্দীপন পাঠশালা’ তৎকালীন শিক্ষক-জীবনের একটি সামগ্রিক চিত্র। শিক্ষক-জীবনের ট্র্যাজেডির সঙ্গে জাতিভেদের সামাজিক চিত্র এবং শিক্ষা ব্যবস্থার বিবর্তনের ছবি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে এই কাহিনিতে। পূর্ববর্তী ছোটগল্পগুলিতে শিক্ষক-মহাশয়দের সকলেই ছিলেন উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণ। ‘সন্দীপন পাঠশালা’র শিক্ষক সদগোপ- চাষি। ফলে তাঁর চলার পথখানি ঠিক কতটা বন্ধুর সেই বাস্তব ছবিটি এই কাহিনিতে স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে। সঙ্গে আছে বিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধে গ্রাম বাংলার শিক্ষাব্যবস্থার ছবিও।
(২)
সরকারি দরখাস্ত ও অগুনতি ফর্মে ‘জাতি’র কলামে বরাবর লিখে এসেছি ‘সদগোপ’। সদগোপ হল চাষার ভালো নাম। নামের শুরুতে ‘সৎ’, তাই ছোটবেলায় মনে হয়েছিল শব্দটা, ‘চাষা’র থেকে অনেক ভালো। বিষয়টা নিয়ে ঠাকুমার সঙ্গে আলোচনা করতে গেলে ঠাকুমা ছড়া কেটে বলেছিলেন,
‘তিলি তামুলী গোপ গোছালী চিটে পিটে কামার
এই ক’ঘর আমার।’
সোজা কথায় আমরা হলাম সৎশূদ্র। পেশা অনুযায়ী আমাদের আলাদা জাতিতে ভাগ করা হলেও ছড়ার সাতটি জাতি মান-মর্যাদায় সমান। বামুন-কায়েতের থেকে নিচে, তবে শূদ্রদের উপরে। জাতপাতের এই স্তর বিভাজন সেই বয়সের জন্যে যথেষ্ট ভারি ছিল। পুরোটা না বুঝলেও এটুকু বুঝতে পারলাম যে ‘চাষা’ শব্দটি লোকে যেমন অবজ্ঞার সঙ্গে উচ্চারণ করে, চাইলেও সেভাবে কেউ ‘সদগোপ’ উচ্চারণ করতে পারবে না। ‘সদগোপের’ সঙ্গে ‘সৎশূদ্র’। দু-দুটো ‘সৎ’, যেন সোনায় সোহাগা! পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটা আভিজাত্য আবিষ্কার করে আমি পুলকিত হয়েছিলাম। অবশ্য বাস্তবে পুলকিত হওয়ার কোনও কারণ ছিল না। ‘সদগোপ’ শব্দটা উচ্চারণই করত না কেউ। নাম, বাবার নাম, দাদুর নাম বলে পরিচয় দিলে বলত, ‘বুঝেছি, ওই পাড়ার চাষাদের অমুকের বিটি তো?’
অবজ্ঞার ভাষা আপন অনুভবেই ধরা পড়ে। ‘চাষার বুদ্ধি’ অথবা আচার-আচরণ যে গালাগালির পর্যায়ে পড়ে একথা গ্রামের ছেলেমেয়েরা শৈশবেই জেনে যায়।
সেই শৈশবেরই কথা। বারোমাস অন্ধকার থাকতে উঠে পড়েন দাদু। মেজাজি মানুষ। ভোরবেলাতেই তর্জন গর্জন সহকারে কাজকর্ম শুরু করেন। বর্ষাকালে মেঘের গর্জনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাদুর গর্জনও তীব্র হয়। ঠাকুমা ছিলেন দাদুর ঠিক উলটো। তাঁর সঙ্গে হাসিঠাট্টাও করা যেত, ঝগড়াঝাঁটিও করা যেত। একবার দাদু মাঠের দিকে রওনা দিতেই ঠাকুমাকে ধরলাম,
- ঠাকুমা তোমার স্বামীটা কী গো?
- কেন রে?
- সকালবেলা উঠেই মাঠ মাঠ করে। কেন স্কুলে যেতে পারে না?
- এই বয়সে তোর দাদু স্কুল যাবে? (সহাস্যে)
- কেন মাষ্টার দাদু তো আসে। সে তো দাদুর চেয়েও বড় তাহলে?
আমার কথা নিয়ে বাড়িতে হাসিঠাট্টা হয়েছিল কিন্তু আমি কোনও সদুত্তর পাই নি। আজ হায়দ্রাবাদে বসে যখন ‘আমার চোখে তারাশঙ্করের গল্পভুবন’ লিখি, তখন স্মৃতির অতলে ডুব দিই। তুলে আনি ছোটবেলার কথা। ঠাকুমার সঙ্গে অনেক স্মৃতি! তাঁর সঙ্গে প্রতিবেশী গ্রামে ভ্রমণ সূত্রে একটা জিনিস লক্ষ করেছিলাম। নিজের পরিচয়ের অনুষঙ্গে ঠাকুমা দুটি কথা বলতেন, ‘আমার বাপের বাড়ি কীর্ণাহার’ আর ‘আমার বাবা পণ্ডিত ছিলেন’।
ঠাকুমার বাবাকে আমরা চোখে দেখি নি। তাই বহুশ্রুত কথা দুটি ঠাকুমাকে আমাদের কাছে ঠাট্টার পাত্র করে তুলেছিল। ভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরেই তাঁর নাতিনাতনিরা একজন আর একজনকে বলত, ‘জানিস তো, ঠাকুমা আবার সেই!’ অথবা বাড়িতে কারোর আগমন হলে তারা পরস্পরকে ইশারা করত, ‘দেখ, এইবার ঠাকুমা ঠিক বলবে, আমার বাবা পণ্ডিত ছিলেন...’
স্কুলে না গিয়ে দাদুর মাঠে যাওয়া অথবা ঠাকুমার বাপের বাড়ি নিয়ে ঠাকুমার গর্বের রহস্য আমাদের বোধের বাইরেই থেকে গিয়েছিল দীর্ঘদিন। ঠাকুমাও দীর্ঘদিন ছিলেন আমাদের মাঝে। হাসিঠাট্টাও ছিল। তাঁর প্রপৌত্র অথবা প্র-দৌহিত্র যখন নামতা বলতে বলতে খাবি খেত আর তিরস্কৃত হত, তখন চলচ্ছক্তি হীন ঠাকুমা হামাগুড়ি দিয়ে এসে পিটপিট করে দেখতেন। সাত চোদ্দ কত বলতে না পেরে শিশুদ্বয় যখন একে অন্যের মুখের দিকে তাকাত, তখনই হয়ত ঠাকুমা বলে উঠতেন, ‘বল বাবু, আঠানব্বুই’। শিশুরা নিষ্কৃতি পেয়ে যেত। আর ঠাকুমার নাতিনাতনিরা পড়ত ঠাকুমাকে নিয়ে,
- শরীর অচল হয়ে গেল ঠাকুমা, মাথাটা এখনও পরিষ্কার! তোমার বাবা পণ্ডিত হয়েও এমন মেয়েকে লেখাপড়া শেখান নি!
- তুমি লেখাপড়া শিখলে, নির্ঘাত তোমার বাবার চেয়েও বড় স্কুলের দিদিমণি হতে!
- বাচ্চা মেয়ের বিয়ে দিয়েই তোমার বাবা তোমার সারা জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছেন, ঠাকুমা!
‘সন্দীপন পাঠশালা’র সীতারাম পালকে খুঁজতে গিয়ে সেকালের গ্রামাঞ্চলের মেয়েদের পড়াশোনার ছবিটা সামান্য হলেও নজরে পড়ে। পলাশবনির কন্যাদায়গ্রস্ত পণ্ডিত মশাই যেন তারই প্রতীক। মেয়ের বিয়ে না দিতে পারলে তিনি সমাজে পতিত হবেন। তাই বৃদ্ধ কুলীন পাত্রের তৃতীয়পক্ষ করে অন্ধকার ভবিষ্যতের মুখে ঠেলে দেন নিজের মেয়েকে। সীতারামের ইচ্ছে থাকলেও তার পক্ষে মেয়েকে লেখাপড়া শেখানো সম্ভব হয় না।
সীতারাম পালকে খুঁজতে খুঁজতে পিছিয়ে গিয়েছিলাম একটি প্রজন্ম। আমার বাবার ছোটবেলায়। সময়টা স্বাধীনতা উত্তর পঞ্চাশের দশক। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি তখনও পুরনো পাঠশালার ছাঁচ ভেঙে বেরিয়ে আসে নি। শ্রেণিকক্ষ দু-একটা থাকলেও বারান্দায় বা উঠোনেও ক্লাস হয়। গ্রামের অধিকাংশ ছাত্র প্রথম প্রজন্ম স্কুলে যাচ্ছে। স্কুলের পাশাপাশি তাই তাদের গৃহশিক্ষকের প্রয়োজন হয়। গৃহশিক্ষার পদ্ধতি পুরোপুরি পাঠশালার অনুরূপ। মাস্টার মশাই নিজের বাড়িতে অথবা মন্দির জাতীয় কোনও বারোয়ারি জায়গায় পড়ান। পাড়া মুখরিত করে, সুর করে ছাত্ররা পড়া মুখস্থ করে। পড়া ধরার সময় মাস্টার মশাই-এর তিরস্কার পাড়ার লোকে শুনতে পায়। ছাত্ররা শাস্তি পেলে পথ চলতি লোকের চোখে পড়ে। বাবা সেইরকম একটা আসরে পড়তে গিয়েছেন। নামতা ঘোষতে দাঁড় করালেন মাস্টার মশাই। ‘ঘোষা’ কথার অর্থ ঘোষণা করা। একজন দাঁড়িয়ে জোরে জোরে বলবে, ‘দুই এক্কে দুই’... বাকিরা বসে বসেই সমস্বরে বলবে ‘দুই এক্কে দুই’। বাবা দুইয়ের ঘরের নামতা ঘোষতে পারলেন না। মাস্টার মশাই তিরস্কার করলেন, ‘চাষার বুদ্ধি! আবার অঙ্ক করবে!’
ঠিক সেই সময়ই রাস্তা দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছিলেন বাবার পিতামহী। কথাটা তাঁর কানের ভেতর দিয়ে সোজা মরমে প্রবেশ করল। এর চেয়ে মাষ্টার দু’ঘা দিলে তাঁর গায়ে হয়ত অতটা লাগত না। তিনি নাতির নড়া ধরে তুলে আনলেন। বললেন, ‘সেই ভালো, চাষার ছেলে চাষ করেই খাবে।’
বাবা মনের আনন্দে বই খাতা তুলে দিল সাঙায়। তাই দেখে বাবার কাকা একদিন বাবাকে তুলে নিয়ে গিয়ে তাঁর মামার বাড়িতে রেখে এলেন, ‘কীর্ণাহারে অতবড় স্কুল! দাদু পণ্ডিত মানুষ। তুই মূর্খ হবি?’
(৩)
এর পরের কাহিনি দীর্ঘ। বাবা তাঁর শিক্ষকতার চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন দশবছর হয়ে গেল। তবে আমার জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন হতেই আমি বাবাকে দেখেছিলাম পূর্ব শতাব্দীর পাঠশালার পণ্ডিত জাতীয় মানুষ হিসেবেই। বিএসসি পাশ করার পর থেকে চেষ্টার ত্রুটি না থাকলেও দীর্ঘদিন তাঁর চাকরি জোটে নি। অতএব আমার দাদুর অবস্থা হয়েছিল সন্দীপন পাঠশালার সীতারামের বাবা রমানাথ পালের মতো। ছেলে তো চাষের বিন্দুবিসর্গ জানে না। মাস্টারি করছে কিন্তু ছাত্রছাত্রীতে ঘর ভরে গেলেও তার অর্থমূল্যে সংসার চলে না। তাই বাবা মুদি-দোকান খুলেছিলেন। নুন তেলও বেচেন আবার দোকান বাড়ির ভেতর দিকে টানা বারান্দায় ছাত্রও পড়ান। তবুও সীতারামের সঙ্গে বাবার চেহারাটা মিলেও শেষপর্যন্ত মেলে নি। মেলে নি সম্ভবত কালের নিরিখে।
আমার খোঁজ তাই শেষ হয় নি। বাবার হাত ধরেই পিছিয়ে পিছিয়ে পৌঁছলাম বিংশ শতাব্দীর গোড়ায়। বাবা বললেন তাঁর মাতামহ অর্থাৎ আমার ঠাকুমার বাবার কথা। ঠাকুমার দুটি গৌরবের একটি। তাঁর সময়টা সীতারাম পণ্ডিতের সময়কালের কাছাকাছি। সীতারাম পাঠশালা খুলছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। সীতারাম তার জীবনে স্মরণীয় দিনগুলি প্রথমে দেওয়ালে ও পরে ডাইরিতে লিখত। তাই সময়কালের ধারণা খুব স্পষ্টভাবেই পাওয়া যায় কাহিনিতে। ঠাকুমার বাবার জন্ম বিংশ শতাব্দীর গোড়ায়। স্বাধীনতার দুই দশক আগে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। পরলোক গমন করেছেন ১৯৭২ সালে। বছরটি তারাশঙ্করের মৃত্যুর ঠিক পরের বছর। তাঁর ছোটবেলা অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন দেশে শিক্ষাব্যবস্থার একটা যুগ সন্ধিক্ষণের সময়। সেই সময় বীরভূম জেলার ছবি দেখতে গেলেই প্রথমেই চোখে পড়বে ১৯০১ সাল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করলেন। কিন্তু তার আগে? সমগ্র বীরভূম জেলায় হাই(ইংলিশ)স্কুলের সংখ্যা আঙুলে গোনা। নতুন শতকে ছবিটি পালটাতে লাগল। জেলায় বেশ কিছু হাইস্কুল ও মাইনর স্কুল প্রতিষ্ঠা হল। তার মধ্যে তারাশঙ্করের স্বগ্রাম লাভপুরের হাইস্কুল অন্যতম। প্রাথমিক স্তরের লেখাপড়া তখন পাঠশালাতেই হতো। কিছু পাঠশালা সরকারি সহায়তা পেত, কিছু পেত না। পাঠশালার পড়া শেষ হলে মাইনর স্কুল। মাইনর স্কুলের পর হাইস্কুলে পাঠ শেষে ম্যাট্রিক পরীক্ষা।
ঠাকুমার বাবা ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন। পরে হুগলী থেকে ভার্নাকুলারে ট্রেনিং করেছিলেন। কাটোয়া থেকে জলপথে হুগলী যেতেন সেকথাও ঠাকুমার মুখে শোনা। সেই মুখে শোনা কথার উপর ভিত্তি করে ইতিহাসের পাতা ধরে আরও কিছুটা পিছিয়ে গেলে দেখতে পাই, সেই আমলে যারা পাঠশালার পণ্ডিতের জীবিকা গ্রহণ করতেন তাঁদের জন্যে বঙ্গদেশে এক ধরণের গুরু ট্রেনিং স্কুল ছিল। তবে সেগুলি গুণ ও মানে আধুনিক ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ক্রিশ্চান মিশনারির উদ্যোগে ১৭৯৩ সালে দেশের প্রথম টিচার্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউশন নির্মাণ হয় শ্রীরামপুরে। যার নাম ‘নর্মাল স্কুল’। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ক্ষেত্রে আধুনিক ব্যবস্থার সেই প্রাথমিক ধাপ। নর্মাল স্কুলের প্রসঙ্গ ‘সন্দীপন পাঠশালায়’ বারবার এসেছে। কাহিনির নায়ক সীতারামও সেখানেই গিয়েছিল পাঠ নিতে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় আরও কয়টি ধাপ যোগ হয়েছিল। সেগুলি ছিল ট্রেনিং অফ প্রাইমারি ফর মিডল স্কুল টিচার্স, ট্রেনিং অফ অ্যাংলো ভার্নাকুলার টিচার ফর সেকেন্ডারি ইংলিশ স্কুল আর ট্রেনিং অফ ভার্নাকুলার টিচার্স। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে তখন ‘ট্রেনিং অফ সেকেন্ডারি ভার্নাকুলার টিচার’ স্কুল ছিল মোট আটটি। তার একটি ছিল কলকাতায় আর একটি হুগলীতে।
ভার্নাকুলার ট্রেনিং শেষে ঠাকুমার বাবা চাকরি নিয়েছিলেন পূর্ব বর্ধমানের শিবলুন গ্রামে। সংস্কৃত এবং বাংলা পড়ালেও পাটীগণিতে তাঁর যথেষ্ট দখল ছিল। অঙ্কের মাস্টার মশাই হিসেবে তাঁর দৌহিত্র অর্থাৎ আমার বাবার বেশ নামডাক হয়েছিল পরে। ম্যাজিকের মতো মনে মনে বড় বড় যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগ করার শিক্ষা বাবা তাঁর মাতামহের কাছেই পেয়েছিলেন। তিনি শিবলুনে থাকলেও তাঁর পরিবার থাকত কীর্ণাহারে। সপ্তাহ শেষে বাড়ি আসতেন। চাষির ছেলে এককড়ি ঘোষ ‘এককড়ি পণ্ডিত’ নামে খ্যাত হয়েছিলেন কিন্তু তাতে তাঁর সংসারে খাদ্যের অভাব মেটে নি। সম্ভবত সেই কারণেই তিনি নামমাত্র স্বাক্ষর, বেশ খানিকটা জমির মালিক চাষি ছেলেকে কন্যার পাত্র হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন।
(৪)
শিক্ষক-মহাশয়দের অবস্থা স্বাধীনতার পর যে দ্রুতবেগে বদলে গিয়েছিল এমন নয়। একই কথা বলা যায় শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রেও। শিক্ষার পথে শতেক বাধা। নানা রকম সামাজিক বাধা ছাড়াও আছে মানুষের মনের ভেতরে গড়ে ওঠা শক্ত শক্ত বাধার দেওয়াল। কেবল সীতারাম পণ্ডিতদের মতো গ্রামাঞ্চলের কিছু মানুষ চেষ্টা করে যায়। যত্ন করে দুটি হাতের আড়াল দিয়ে প্রদীপের শিখাটি জ্বলন্ত রেখে আলো দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তবুও এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে শিক্ষার আলো পৌঁছতে কত দশক লেগে যায় হিসেব নেই। একই গ্রামের একটা গলি থেকে আর একটা গলিতে আলো পৌঁছতে ঘটে যায় যুগান্তর। মুষ্টিমেয় কয়েকটি জায়গায় অভ্যুদয় হয় মনীষীর। তাঁরা কোন রহস্যময় আলোয় আপন ‘প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে’ ধরাধামে অবতীর্ণ হন জানা নেই। তবে সেই আলোয় তাঁদের চারিপাশ ঝলমল করে ওঠে। বিংশ শতকের শুরুতে তেমনটাই ঘটেছিল লাভপুরে এবং তারও আগে কীর্ণাহারে। সেই অর্থে ঠাকুমার গর্ব ভিত্তিহীন ছিল না। কীর্ণাহার বা লাভপুরের আশপাশে মাইলের পর মাইল জুড়ে শতশত গ্রামগুলি শুধু সেদিন নয়, আজও শিক্ষা সংস্কৃতিতে সময়ের হিসেবেও অনেক পেছনে অবস্থান করে।
‘সন্দীপন পাঠশালা’র রত্নহাটা গ্রাম, বাবুদের গ্রাম। গ্রামটির সঙ্গে লাভপুরের প্রভূত সাদৃশ্য আছে। গ্রামে ঢোকার আগেই উঁচু উঁচু পাকা দালানগুলো চোখে পড়ে। সীতারাম পাল রত্নহাটার অদূরে একটি গ্রামের বাসিন্দা। তার ধারণা, রত্নহাটার মতো জায়গায় শিক্ষক হবার স্বীকৃতি তার প্রতিষ্ঠাকে সুনিশ্চিত করবে। শুরুতে গৃহশিক্ষকের চাকরিই সে গ্রহণ করে। রত্নহাটার একটি জমিদার পরিবারের গৃহশিক্ষকতা। পরে সে পাঠশালা খোলে। বাবুদের বাড়ির ছেলেরা তার পাঠশালায় আসবে না। পাঠশালায় উপার্জনও তেমন হবে না। এসব কথা জানে বলেই সে চাষি, শুঁড়ি, কৈবর্তদের ছেলেদের নিয়ে শুরু করে। তার প্রবাসে চাকরি করার স্বপ্ন, গ্রামের মানুষদের কাছে গণ্যমান্য, সম্মানীয় হবার আকাঙ্ক্ষা কিছুটা পূরণ হয় ভিন্ন গ্রামে, ব্রাহ্মণ জমিদার পরিবারে গৃহশিক্ষকতা করার ফলে।
রত্নহাটার দক্ষিণে আড়াই মাইল দূরে সীতারামের গ্রাম। এলাকার প্রাচীন মানুষদের মুখে শোনা যায় সীতারামের সঙ্গে তারাশঙ্করবাবুর বাড়ির একজন গৃহশিক্ষকের (রামকানাই পাল) সাদৃশ্য আছে। তিনি আসতেন লাভপুরের অদূরে মস্তলী গ্রাম থেকে। সচ্ছল ছিমছাম কৃষক পরিবারের মানুষ ছিলেন।
লেখকের বর্ণনায় যে মেঠো রাস্তা বেয়ে সীতারাম রত্নহাটায় পৌঁছতেন সেই মাঠঘাটের ছবি আমরা শৈশবে দেখেছি। বিস্তীর্ণ খেতগুলি পেরিয়ে যেতে যেতে মাঝে মাঝে নালা পড়ত। সেই নালা লাফ দিয়ে পেরিয়ে যেতে হত। কেবল বর্ষাকাল নয়, বারোমাস নালাগুলিতে বয়ে যেত স্বচ্ছ জল। দূরে কোন একটা জায়গা থেকে দেখা যেত মাটি থেকে জল উঠছে। প্রাকৃতিক ঝরনা। সেই ঝরনার খোঁজ চাষিদের নখদর্পণে থাকত। এমনই একটি ঝরনার ধারে সীতারামের একাকীত্বের উদযাপন কাহিনির মধ্যে বারে বারে পাওয়া যায়।
গৃহশিক্ষকের চাকরিতে বহাল হবার আগে সীতারাম যখন চাকরির সন্ধানে তার চারিপাশে ঘুরেছে, সে তার গ্রামের দক্ষিণে চার মাইল দূরে গিয়েছিল বিপ্রহাটে সেখানে একটি মাইনর স্কুল আছে। ম্যাপ ধরে মস্তলীর দক্ষিণে গেলে বিপ্রহাট না হলেও বিপ্রটিকুরী নামে একটি গ্রাম পাওয়া যায়। সেখানে সেই সময় একটি মাইনর স্কুল ছিল বৈকি। সেই মাইনর স্কুলই ১৯৬৮ সালে ম্যাট্রিক স্কুলে উন্নীত হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে হয়েছিল মাধ্যমিক স্কুল। বিপ্রটিকুরীর স্কুল থেকেই আমরা মাধ্যমিকের দোরগোড়ায় পৌঁছেছি। ততদিনে অবশ্য বিংশ শতাব্দী শেষলগ্নে পৌঁছেছে। সে অন্য প্রসঙ্গ।
স্থান কাল মিলিয়ে এই উপন্যাস পাঠ করতে করতে কখনও পৌঁছে গিয়েছি ঠাকুমার বাবার সময়ে, কখনও ফিরে এসেছি আপন গাঁয়ে। সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাঁদের আমরা মাস্টার দাদু বলতাম, তাঁদের কাছে। গ্রাম সূত্রে সম্পর্ক একটা ধরতে হতো। তাই ছোটবেলায় শিক্ষকদের আমরা মাস্টার মশাই না বলে সম্পর্ক ধরে বলেছি। তাঁদের কেউ কেউ বয়সে দাদুর চেয়ে বড় ছিলেন। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী কালের মানুষ ছিলেন তাঁরা। আজ বেঁচে থাকলে শতাব্দী প্রাচীন হতেন। বড়দের মুখে তাঁদের অর্থকষ্টের কথা শুনেছি। মাস্টারির বেতনে বৃহৎ পরিবার প্রতিপালন করতে গিয়ে তাঁরা সারাজীবন নাস্তানাবুদ হয়েছেন। অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটিয়েছেন। যুদ্ধের বাজারে মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় তাঁদের কেরোসিন তেল কেনার পয়সাটুকুও থাকত না। ঘরে টিমটিম করে প্রদীপ জ্বলত। সন্ধ্যে হতেই খেয়ে শুয়ে পড়তে হতো সেই সব জ্ঞানপিপাসু মানুষদের।
সারাজীবন গৃহশিক্ষকতা করে, দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে করতে আজও কত মানুষ জীবন কাটাচ্ছেন। শিক্ষার বেসরকারিকরণের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের জীবনে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন সঙ্কট ও সংগ্রাম। সরকারি স্কুলে পার্শ্বশিক্ষক নামে একটি আলাদা শ্রেণি সৃষ্টি করা হয়েছে। তাঁদের জীবন সংগ্রাম ও সংঘর্ষে পরিপূর্ণ। সেসব আলোচনার খুঁটিনাটিতে না গেলেও, মনের মধ্যে যেন একটি বিশ্বাস গড়ে ওঠে, শিক্ষক-জীবনের দুর্ভোগ সংকুল যাত্রাপথ কোনোদিনই বোধ হয় শেষ হবার নয়। এ যাত্রা অনন্ত।
‘সন্দীপন পাঠশালা’ বইটি প্রকাশের পর চলচিত্রে রূপান্তরিত হয়েছিল। তারপরই হাওড়া থেকে উঠেছিল নিন্দার ঝড়। অনেক গালিগালাজ ভরা চিঠিপত্র লেখক পেয়েছিলেন। তবুও ১৯৪৯ সালের ১০ই এপ্রিল হাওড়ার একটি ক্লাবের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিলেন তারাশঙ্কর। পথে ব্যারিকেড করে তাঁর গাড়ি আটকে দুই-তিনশো মানুষ আক্রমণ করেছিল। লাঠির আঘাতে গাড়ির জানলা ভেঙেছিল। থান ইট, জুতোর পাটি, লাঠি, ঘুষি বর্ষিত হয়েছিল তারাশঙ্করের উপর। রক্তাক্ত তারাশঙ্কর সেদিন ড্রাইভারের কুশলতার জন্যেই প্রাণে বেঁচে ফিরেছিলেন। এই প্রসঙ্গে নিজের ভুল স্বীকার করেছেন তিনি ‘আমার সাহিত্য জীবনে’। বাংলার অন্যতম প্রগতিশীল সম্প্রদায় মাহিষ্য আর চাষি-কৈবর্ত যে একই সম্প্রদায় তিনি জানতেন না। তাঁর লেখা নিজের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে। রাঢ় অঞ্চলে এই সম্প্রদায় দরিদ্র গৃহস্থ। উপরন্তু তারা নিজেদের মাহিষ্য বলে না। ঘটনাটি যেন উপন্যাসটির মতই তাৎপর্যপূর্ণ। শিক্ষক-মহাশয়দের দুর্দশার কথা লিখেই মুক্তি পান নি তারাশঙ্কর। শিক্ষকদের প্রাপ্ত অবহেলা, অনাদরের ভাগ তাঁদের সহমর্মী লেখককেও খানিকটা নিতে হয়েছিল।
তথ্যসূত্র:
১। সন্দীপন পাঠশালা; তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (ষষ্ঠ সংস্করণ)।
২। আমার সাহিত্য জীবন; তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
৩। Chaitali Kundu: Training of Vernacular teachers in pre-independent India in the first half of Twentieth Century; Int. Edu and Res 3(6.)
কৃতজ্ঞতা:
আঞ্চলিক তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন চিকিৎসক ডঃ সুকুমার চন্দ্র এবং অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শ্রী বেণুকর মণ্ডল।
আমার সাহিত্য জীবন
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশক: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি
বাড়িতে বসে বইগুলি পেতে হোয়াটসঅ্যাপে বা ফোনে অর্ডার করুন +919330308043 নম্বরে।