(১)
সময়টা সম্ভবত আশির দশকের শেষ। রাস্তার ধার ঘেঁসে ঘেঁসে চলে গিয়েছে সারি সারি বৈদ্যুতিক খুঁটি। তাই বিদ্যুৎ পৌঁছেছে কেবল রাস্তার ধারের বাড়িগুলিতে। বড় রাস্তা থেকে গলিপথ ধরে পাড়ার ভেতরে আলো পৌঁছতে তখনও ঢের দেরি। টেলিভিশন যাদের বাড়িতে আছে, অবশ্যই তারা শৌখিন মানুষ। এবং হাতে গোনা। সেই শখের কারণে তাদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। সন্ধ্যে হলেই ঘরে ভিড় জমে। শনি রবিবারে তো কথাই নেই। কোনও বাড়ির কর্তা তাই রাগে অগ্নিশর্মা হয়, কোনও বাড়িতে আবার টেলিভিশন সেট বের করে দেওয়া হয় বারান্দায়। উঠোন ভর্তি দর্শক বই দেখে।
‘বই দেখা’ ব্যাপারটা ছোটদের জন্য তখন ছিল অপরাধ। টিভিতে আসক্ত ছেলেমেয়েরা পাড়ার লোকের নজরে ‘খারাপ ছেলে-মেয়ে’। ছাত্রছাত্রী হিসেবে তাদের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সব রকমের কলঙ্ক তিলক মাথায় নিয়েই সেই আশির দশকের গ্রাম্য বালক-বালিকারা মরিয়া হয়ে জুটত টিভির ঘরে। শনিবারে বা রবিবারে কী বই হবে সে খবর বিনিময় করত। আরও অনেক কিছু জেনে যেত এই বোকা-বাক্সটিকে কেন্দ্র করে। চিনত সেই সময়ের নায়ক নায়িকাদের। দেখত উত্তমকুমারের ছবি থাকলে মা-কাকিমারা কেমন তড়িঘড়ি কাজকর্ম গুছিয়ে, সন্ধেবেলা বই দেখতে বসে। কখনও কখনও গভীর রাতেও কাকা-জ্যাঠাদের ঘুম ভেঙে উঠে টিভির সামনে বসতে দেখা যায়। তাঁরা খেলা দেখেন। এমন আকর্ষণীয় বস্তু কেবল ছোটদের কাছে নিষিদ্ধ!
এমনই একটা সময় একদিন মেঘ না চাইতেই জল। বাবা নিজে থেকেই আমাদের নিয়ে গেলেন এক প্রতিবেশীর বাড়ি। বাংলা বই দেখাবেন। মাস্টারমশাই হবার কারণে বাবার কাজকর্ম অন্যদের কাছে বিনা প্রশ্নেই গ্রহণযোগ্য। যেহেতু তিনি নিজের মেয়েদের নিয়ে বই দেখতে এসেছেন তাই সে বাড়ির ছেলেমেয়েরাও বিনা যুদ্ধে রাজ্য জয় করল। বসে পড়ল টিভির সামনে। বাবা বললেন, ‘খুব মন দিয়ে দেখবি কিন্তু, এই বইয়ে আমাদের গাঁয়ের কথা আছে।’
চাষার ছেলের ভূমিকায়, গাঁজার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা, উদমাদা সরল গেঁয়ো উত্তমকুমারকে দেখে আমাদের বেশ লাগছিল। চাষা যেমন হয় ঠিক তেমনিই! বড়রা নানা জনে নানারকম টীকাটিপ্পনী করছিল। হঠাৎ একজন বলল, ‘উত্তমকুমার যে এমন ‘খচাং থপ’ সাজতে পারে, ভাবা যায় না।’
গ্রামাঞ্চলে চাষিদের সম্পর্কে ‘খচাং থপ’ একটি প্রচলিত বিশেষণ। অর্থাৎ কোদালে তারা মাটি কাটে ‘খচাং’ আর মাটিটা তুলে পাশের আলে ফেলে ‘থপ’। একথার অন্তর্নিহিত অর্থ, একমাত্র এই একটি বিষয়ই তারা জানে, এর বাইরে পৃথিবীর আর কোনও বিষয়ে তাদের বিদ্যেবুদ্ধি নেই।
যে যা বলছে বলুক আমরা আবার কান খাড়া করলাম। না হলে কোন ফাঁকে আমাদের গ্রামের নাম বলে দেবে শুনতে পাব না। মন দিয়ে দেখতে দেখতে সিনেমার দৃশ্যগুলোর মধ্যে আমরা নিজেরাই যেন কখন ঢুকে পড়লাম। ঢুকে পড়ল আমাদের গোটা পাড়াটাই। আমাদের চারপাশের সামাজিক চিত্রই আসলে সিনেমার এক একটি দৃশ্য। এর মধ্যেই আমাদের নিত্য বেড়ে ওঠা। এখানে এক একটি পরিবার প্রতিবেশীদের কাছে খোলা খাতার মত। গোপনীয় বলে কিচ্ছু নেই। বাড়ির কথা নিমেষে পল্লবিত হয়ে সারা গ্রাম ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে তা যদি হয় পারিবারিক কোন্দল। একবার বাধলেই হয়েছে। সেই দৃশ্য দেখার জন্যে এই টিভির ঘরের মতই লোক জমে যায়। কেউ যায় মধ্যস্থতা করতে। কেউ উস্কানি দিতে। আর ছোটরা যায় নির্ভেজাল কৌতূহলে। তারা দু’চোখ ভরে দেখে আর দু’কান ভরে শোনে।
সেই রকমই ঘটনা পরম্পরায় বিন্যস্ত ছবিটি এক সময় পৌঁছে গেল টানটান উত্তেজনাময় একটি দৃশ্যে। দুই ভাইয়ের সংসার ভাগাভাগি হচ্ছে। জমিজমা কাগজে কলমে ভাগ হয়ে গিয়েছে। বাসনপত্র, বিছানা, সামান্য আসবাব ভাগাভাগির সময় ছোটভাই বউ ভাগ করার প্রস্তাব দিল। জানাল বড়বউ অর্থাৎ তার দাদার স্ত্রী তার ভাগে থাকবে। নিজের বউকে নিয়ে সে ঘর করতে পারবে না। দাদা চাইলে ছোটবউকে নিতে পারে। নিজের বউকে ছেড়ে দিতে তার কোনও আপত্তি নেই।
বউ-ভাগের কথায় বিচারকরা ‘ছি ছি’ করে উঠল। কেউ মুচকি হাসল। এমন সময় ছোট ভাইয়ের ভূমিকায় উত্তমকুমার বলে উঠল, ‘কেনে এর আগে তোমরা ইন্দেশের বউ আর টিকুরীর বউকে দুই ভাগে ভাগ করে দাও নাই?’
তাদের প্রতিবেশী শিবকেষ্ট আর রামকেষ্ট দুই ভাই যখন ভিন্ন হয়, তখন তাদের দুই বিধবা কাকিমা, ‘ইন্দেশের খুড়ি’ আর ‘টিকুরীর খুড়ি’কে ভাগাভাগি করে দিয়েছিল পঞ্চায়েতের মোড়লরা।
এই পর্যন্ত দেখেই আমাদের চলচিত্র তৃষ্ণা মিটে গেল। টিভির ভেতর থেকে উচ্চারিত আপন গ্রামের নাম শুনেই ভাবলাম, এত বিখ্যাত গ্রাম আমাদের! উত্তমকুমারও এই গ্রামের নাম জানে! আমাদের বিস্ময় আরও বাড়ল যখন জানতে পারলাম, চাঁপাডাঙা আসলে আবাডাঙা। কয়েকটা চেনা জায়গার নাম শুনে ছোটদের মনে হাজার প্রশ্ন।
- আবাডাঙা পালটে দিলেন কিন্তু ইন্দেশের নামটা পালটালেন না? কী ভাল!
- ‘তাহলে ‘ইন্দেশের বউ’ ‘টিকুরীর বউ’ সত্যি করে কেউ ছিল?
- গাঁ চেনাতে পাশাপাশি গাঁয়ের নাম জোড়ায় জোড়ায় বলে শুনিস না? একই নাম দুটো গাঁয়ের হলে কি হয়? তখন পাশের গাঁয়ের নাম বললে বুঝতে সুবিধা হয়। সেই জন্যেই বলে বড়া-ডোঙরা, বুনে-ডাঙ্গাল সেই রকম হল আমাদের ইন্দেশ-টিকুরী। ওই টানেটানেই ইন্দেশের বউ আর টিকুরীর বউ বলে দিয়েছে।
জল্পনা থেমে গেল একটা ধমক খেয়ে, ‘অনেক বই দেখা হয়েছে। এবার সব পড়তে বস গিয়ে। বইয়ে লেখা আছে। বই পড়, পড়লেই জানতে পারবি।’
(২)
সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘উপাসনা’ পত্রিকার শ্রাবণ মাসের সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তারাশঙ্করের গল্প ‘বড় বউ’। সে ১৯৩১ সালের কথা। গল্পটি তারাশঙ্করের সাহিত্য জীবনের প্রথম দিকের লেখা। লাভপুর থেকে প্রকাশিত ‘পূর্ণিমা’ বাদে ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’ এবং ‘উপাসনা’য় তারাশঙ্করের গুটিকয় গল্প প্রকাশিত হয়েছে ততদিন পর্যন্ত।
স্বাভাবিকভাবেই গল্পটিতে লাভপুর অঞ্চলের সমাজ জীবনের ছাপ অত্যন্ত স্পষ্ট। রাঢ়বঙ্গের কৃষকদের নিয়ে তারাশঙ্কের অনেকগুলি লেখার মধ্যে এই গল্পটি অন্যতম। দীর্ঘ তেইশ বছর পর তারাশঙ্কর ‘বড় বউ’ শিরোনামের গল্পটিকে আধার করে নির্মাণ করেছিলেন ‘চাঁপাডাঙার বউ’ উপন্যাস। বিনোদবিহারী চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ‘এশিয়া’র পূজা সংখ্যায় উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। সেবারেই ‘চাঁপাডাঙার বউ’ চলচ্চিত্রায়িত হয়।
একটি পরিবারের দুই ভাইকে নিয়ে লেখা গল্প ‘বড়-বউ’। তারা বনেদি সরকার বংশের ছেলে। গ্রামের জমিদার হলেও দান ধ্যান ও সত্যবাদীতার জন্যে তাদের পূর্বপুরুষদের সুনাম ছিল। কিন্তু এই প্রজন্মে সে সব পালটে গিয়েছে। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় সেতাব স্বভাবে ক্রুর, কৃপণ এবং মিথ্যাচারী। অন্যদিকে ছোটভাই মহাতাপ বিষয়বুদ্ধিহীন, নেশাড়ু তবে সে অতিমাত্রায় সরল। এই দুই ভাই এবং সেতাবের স্ত্রী, এই তিনজন চরিত্র নিয়েই মূলত গড়ে উঠেছিল ছোটগল্প, ‘বড় বউ’।
উপন্যাসে কাহিনির মূল সুর একই রাখলেও প্রেক্ষাপটে অনেকখানি বদল আনলেন তারাশঙ্কর। সেতাব ও মহাতাপের চরিত্র বৈশিষ্ট্য একই রেখে তাদের একটি সম্পন্ন কৃষক পরিবারের মানুষ হিসেবে দেখালেন। পাশাপাশি আরও কিছু চরিত্রকে উপস্থিত করলেন। তার ফলে গ্রাম বাংলার কৃষক জীবনের দৈনন্দিন যাপনের একটি সামগ্রিক ছবি ফুটে উঠল। মহাতাপের স্ত্রী মানদা অর্থাৎ ছোটবউয়ের উপস্থিতি স্বল্প পরিসরে হলেও তা হল বর্ণময়। স্বামীর আচার আচরণের জন্যে তার মনে অভিমান ঘনায় শরতের মেঘের মত আবার অল্পেই তা ঝরে পড়ে। বড়বউয়ের স্বভাবগুণ অপরিবর্তিত রাখলেও প্রশস্ত পরিসরে চরিত্রটিকে পরিপূর্ণ করে তুললেন।
ছোটগল্পের ‘পদ্মাবউ’ আর ‘গোলাপবউ’ হল প্রতিবেশীর দুই বিধবা খুড়ি ‘ইন্দেশের বউ’ আর ‘টিকুরীর বউ’। তাদের ভাসুরের দুই ছেলে শিবকেষ্ট আর রামকেষ্ট চরিত্র দুটি উপন্যাসে নতুন। ‘ইন্দেশের বউ’ নিতান্তই একটি পার্শ্বচরিত্র হলেও, পঞ্চায়েতের বিচারে অসন্তুষ্ট ‘টিকুরীর বউ’ এর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একদিকে সে তৎকালীন সময়ের স্বামী সন্তানহীনা বৃদ্ধার পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানের প্রতীক। অন্যদিকে ব্যর্থ মনোরথ, প্রতিহিংসা পরায়ণ বৃদ্ধা যে তার কুটিল বুদ্ধি প্রয়োগ করে পঞ্চায়েতের মোড়লের জীবন দুর্বিষহ করে তুলে শোধ নিতে পারে, সে তারও দৃষ্টান্ত।
পারিবারিক গল্পটির পাশাপাশি এসেছে গ্রাম বাংলায় দুর্গাপুজো আগমনের ছবি। প্রকৃতির সেজে ওঠা এবং বারোয়ারি চণ্ডীমণ্ডপের ভূমিকা এসেছে সাবলীলভাবে। উৎসব-অশান্তি এবং ভাঙা-গড়া এই দুই বিপরীত বৈচিত্র্য যেন হাত ধরাধরি করে এগিয়ে গিয়েছে।
(৩)
পরে কোনও এক সময় লাঘাটায় কুয়ে নদীর সাঁকোর উপর দাঁড়িয়ে উত্তর দিকে আঙুল দেখিয়ে বাবা বলেছিলেন, লাভপুর থেকে উত্তরদিক গুনুটিয়ার রাস্তা। গুনুটিয়ায় ময়ূরাক্ষী নদীর ঘাট নিয়ে তারাশঙ্কর ‘তারিণী মাঝি’ গল্প লিখেছিলেন। সেই গুনুটিয়া যাবার রাস্তাতেই পড়ে আবাডাঙা।
পরবর্তী দিনে তারাশঙ্করের গল্প পড়তে গেলেই গল্পে পাওয়া স্থানগুলি আসলে কোন গ্রাম তা উদ্ধার করাটা কেমন নেশার মত হয়ে গিয়েছিল। কিছু গ্রাম তিনি আসল নামেই উল্লেখ করেছেন। যে সব ক্ষেত্রে নাম পালটে দিয়েছেন, তাও খুব খুঁটিয়ে লক্ষ করলে বোঝা যেত। তাঁর লেখায় মস্তলি হয়েছে গোপতলি, মহুগ্রাম হয়েছে মহাগ্রাম, বাকুল হয়েছে আটকুল, বিপ্রটিকুরী হয়েছে বিপ্রহাট। গ্রামের ভৌগলিক অবস্থান অথবা বর্ণিত চরিত্র লক্ষ করলেই সব যেন পরিষ্কার হয়ে যেত। সাহিত্যের সঙ্গে নিজের ক্ষুদ্র গণ্ডির চারিপাশের ইতিহাস, তা যতই অকিঞ্চিৎকর হোক না কেন, জানতে পারার একটা মজা ছিল। সেই সব গ্রামগুলির বেশিরভাগই অবশ্য লাভপুর সংলগ্ন গ্রাম। লাভপুর থেকে তাদের দূরত্ব দেড়, দুই বা আড়াই মাইলের মধ্যে। বাকুল, ভালাস, মহুগ্রাম, বামনিগ্রাম, ধনডাঙা, মস্তলি তাই বার বার এসেছে তাঁর লেখায়। সব লেখা যে এই অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ তাও নয়। তাঁর গল্পের পটভূমি বিস্তার লাভ করেছে ময়ূরাক্ষী ছাড়িয়ে মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে। সে লেখাই একদিন সব গণ্ডি ভেঙে হয়ে উঠেছে গোটা দেশের গল্প। একটি গ্রামের নাম বা তার ভৌগলিক অবস্থান সাহিত্যের বিচারে বড় হয়ে ওঠেনি। বড় কথা হল যাদের কথা তিনি লিখেছেন, যে সামাজিক চিত্র তিনি এঁকেছিলেন তা কতখানি সত্যি হয়ে উঠেছে! উপন্যাসটি প্রকাশিত হবার তিরিশ বছর পরের কথাই যদি ধরি, তাহলে দেখতে পাই লাভপুরের উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সব দিকেই একই রকম ছবি। আদিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে যে কোন একটি গ্রামের গল্প আসলে আবাডাঙার গল্প। তাই আবাডাঙা যদি চাঁপাডাঙা না হয়ে অন্য কিছু হত তাতেও কাহিনির কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি হত না।
রাঢ় বাংলার জনজাতির একটি বড় অংশ সদগোপ চাষি। সম্পন্ন চাষিদের প্রচলিত নাম মোড়ল। সেতাব এবং মহাতাপ দুই ভাই তাই ‘বড় মোড়ল’ এবং ‘ছোট মোড়ল’। ব্যক্তিগত জীবনেও দেখেছি, আমার ঠাকুরদারা দুই ভাই আজও গ্রামে ‘বড় মোড়ল’ এবং ‘ছোট মোড়ল’ নামেই পরিচিত। দু’জনের কেউই কোনকালে পঞ্চায়েতের মোড়ল ছিলেন না। যারা বংশ পরম্পরায় আমাদের কিরসেন, ‘বড় মোড়ল’ নাম তাদেরই দেওয়া। বড় মোড়লের ভাই হিসেবে ছোটদাদুর নাম হয়েছিল ছোট মোড়ল। এখনও অনেকেই পাড়ার এই প্রবীনতম মানুষ দুটির আসল নাম জানে না।
এই অঞ্চলে বৈবাহিক সম্বন্ধও হত পাশাপাশি গ্রামের মধ্যেই। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সুবিধামত নতুন বউ একটি ডাকনাম পেত। সাধারণ কৃষক পরিবারে তা হত বউটির বাপের বাড়ির গ্রামের নামে। অভিজাত পরিবারে একটু বাহার দিয়ে হত ‘রাঙ্গা বউ’, ‘আতর বউ’ ইত্যাদি।
গল্প থেকে উপন্যাসে এসে যখনই চরিত্রগুলির সামাজিক অবস্থান পরিবর্তন হল সঙ্গে সঙ্গে ‘পদ্মা বউ’ ও ‘আতর বউ’ হল ‘ইন্দেশের বউ’ আর ‘টিকুরির বউ’। এই সূক্ষ্ম পরিবর্তনটি লক্ষ করার মত।
সেই আশির দশকে গ্রামের পরিবারগুলি সবই ছিল যৌথ পরিবার। একই পরিবারের মানুষগুলি স্বভাবে চরিত্রে, আচারে আচরণে ছিল বৈচিত্র্যে ভরপুর। কেউ কুটিল কেউ সরল। কেউ কৃপণ, কেউ উদার। কেউ চরম নিষ্ঠুর, কেউ আবার প্রচণ্ড পরোপকারী। উপন্যাসে যেমন এক ভাই গলায় গামছা দিয়ে পাওনা আদায় করছে আর অন্য ভাই অবলীলায় দান করছে, ঠিক তেমন। ফলে পরিবারগুলিতে দ্বন্দ্বের শেষ ছিল না। পারিবারিক কোন্দল ছিল খাওয়া ঘুমনোর মত নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।
শেষ পর্যন্ত একটা সময় পর সেই পরিবারগুলো ভেঙে ছোট হত। হাড়ি ভিন্ন হওয়াকে বলা হত ভিনু হওয়া। এই ভিনু হওয়াটা কিছুতেই সুষ্ঠু স্বাভাবিক ভাবে হত না। মহাভারতের মত এক সুদীর্ঘ পর্ব পেরিয়ে তবে সমাপ্তি। পারিবারিক গোপনীয়তার গণ্ডি ভেঙে দিয়ে নিজেরাই তখন মেতে উঠত একটা কদর্য খেলায়। ঝগড়া আর গালাগালির তোড়ে চালে কাক চিল বসার অবকাশ পেত না। অবশেষে পাঁচজন বিশিষ্ট মানুষের উপস্থিতিতে ভাগাভাগি হত। বাড়ি, জমি, খামার, পুকুর, পুকুরপাড়, গাছপালা এসবের ভাগ সব পক্ষের পছন্দ মত করতেই কেটে যেত দীর্ঘ সময়। তারপর আসত বাসনকোসন ও আসবাবপত্র ভাগাভাগি। কুলো-ডালা, শিল-নোড়া, জাঁতা-জাঁতি ছাড়াও মাটি থেকে শুরু করে পেতল কাঁসার বাসনপত্রের মত হাজারটা দ্রব্যে ভরে উঠত উঠোন। সেইটেই ভাঙন পর্বের শেষ দৃশ্য। আপনজনেদের সম্পর্কে মনের মধ্যে সঞ্চিত হিংসা, রাগ বিদ্বেষ এমন গলগল করে বেরিয়ে আসত, মনে হত, এমন শত্রু হয়েও এরা এতকাল এক বাড়িতে ছিল কীভাবে? ভয় হত, সুযোগ পেলে এরা হয়ত একে অন্যকে প্রাণে মেরেই দেবে। তারপর ক’মাস যেতেই কোনও না কোনও পারিবারিক বা সামাজিক উৎসব আসত, তখন সেই যুযুধান দুই পক্ষ আবার কোনও এক জাদুবলে এক হয়ে যেত।
(৪)
‘চাঁপাডাঙার বউ’ উপন্যাস ভাঙনের কাছাকাছি গিয়ে আবার এক হয়ে যাওয়ার কাহিনি। নয় বছর বয়সে বিয়ে হয়ে বাড়িতে এসেছিল ‘বড়বউ’। দেওর মহাতাপ তখন আট বছরের বালক। তাই তারা পরস্পরের বাল্যসঙ্গী। ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্ক নিবিড় ভালোবাসা ও ভরসার সম্পর্কে পরিণত হয়েছিল। সেই ছিল ছোটবউ মানদার রাগের কারণ। গ্রামের পাঁচজনে বউদি-দেওর সম্পর্ক নিয়ে পাঁচ কথা বলতে শুরু করায় সেতাবেরও মনে সন্দেহ জাগে। একথা শুনে বড়বউ রাগ করে তার স্বামীকে বলত, ‘ইতর’। বলত, পটোয়ারি-জালিয়াতি বুদ্ধিতে এই সম্পর্কের হিসেব বোঝা যায় না।
ছোটবউ কথায় কথায় তাদের সম্পর্ক নিয়ে মহাতাপকে চিমটি কাটত। মহাতাপ ক্রুদ্ধ হয়ে বউকে মারতে যেত। উদ্দাম মহাতাপকে একমাত্র বড়বউই পারত শান্ত করতে। ক্রমশ দুই দম্পতির ভেতর ভুল বোঝাবুঝি বাড়তে লাগল। বিফল মনোরথ ঘোঁতন এবং টিকুরীর খুড়ির কুটিল চালে সে ভুল বোঝাবুঝি পৌঁছল চূড়ান্ত পর্যায়ে। মহাতাপের মুখে বউ-ভাগের কথা শুনে সেতাব নিঃসন্দেহ হল যে, লোকে যা বলে তাই সত্যি। সে সিদ্ধান্ত নিল বড়বউকে ত্যাগ করে সে আবার বিয়ে করবে।
বড়বউয়ের বিদায় নেবার দিনে ভোরবেলা সেতাব দেখল, সে গোপনে মহাতাপের সঙ্গে দেখা করতে গেল। সন্দেহ পরায়ণ সেতাব পিছু নিল। সে অবাক হয়ে দেখল, চালাকি করে সেতাব তার ভাইকে যতটুকু ফাঁকি দিয়েছে, তাই সাধ্যমত মিটিয়ে দিচ্ছে বড়বউ, গোপনে নিজের জমিয়ে রাখা টাকা দিয়ে। টাকার লোভ মহাতাপের কোনোদিনই ছিল না। সে টাকা ফিরিয়ে দিল। জানাল, সেও গৃহত্যাগ করবে।
আড়াল থেকে আরও একজন দেওর ও বউদির কথোপকথন শুনছিল। সে ছোটবউ মানদা। সেই কথোপকথনেই সব ভুল বোঝাবুঝির শেষ হল। একদিকে উৎসবের শেষে নতুন সকাল এল। অন্যদিকে সব ভ্রান্তি দূর হয়ে মিলে গেল মানুষে মানুষে সম্পর্কের মাধুর্যের খোঁজ।
তারাশঙ্করের অন্য উপন্যাসগুলির মত এই উপন্যাসের বিশাল কোনও ব্যাপ্তি নেই। নেই গুঢ় কোনও সমাজতত্ত্ব। কয়েকজন মানব-মানবীর মানসিক জটিলতা, ভুল বোঝাবুঝি এবং তার নিরসনই এই কাহিনিটির কেন্দ্রবিন্দু। উপন্যাসের শেষে একটি নাটকীয় দৃশ্যের মধ্যেই খুলে গেল সমস্ত ভুল বোঝাবুঝির জট। কাহিনির সমাপ্তিকে তাই সেকালের সাহিত্য সমালোচকরা সিনেমা-গন্ধী বলে নিন্দা করেছিলেন। এর বেশি কোনও ত্রুটি এই উপন্যাসে তাঁরা খুঁজে পাননি।
চাঁপাডাঙ্গার বউ (হার্ডকভার)
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশক: অবসর প্রকাশনা সংস্থা
দাম: ১০৬ টাকা
বাড়িতে বসে বইগুলি পেতে হোয়াটসঅ্যাপে বা ফোনে অর্ডার করুন +919330308043 নম্বরে।