এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  পড়াবই  মনে রবে

  • সতীশ ডোম অথবা তারাশঙ্করের নিতাই কবিয়াল

    নীতা মণ্ডল
    পড়াবই | মনে রবে | ২৪ জুলাই ২০২২ | ১৫৯৬ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • (১)


    ধরা যাক সময়টা একশ বছর আগের। তার চেয়ে বিশ কি ত্রিশ বছর কমিয়েও দেওয়া যেতে পারে। সেই সময় রাঢ় বাংলার প্রান্তিক গ্রাম লাভপুর আকার আয়তনে ছোট হলেও বৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল। গ্রামের সীমানা বেয়ে চলে গিয়েছে রেললাইন। কাছাকাছি জংশন স্টেশন আমোদপুরের সঙ্গে লাভপুরের যোগাযোগ ছোট লাইনের মাধ্যমে। জংশন থেকে বড় লাইন জুড়েছে বৃহত্তর দুনিয়ায়। ছোট লালরঙের আপিস ঘর শোভিত স্টেশনটাই যেন বহির্বিশ্বের সঙ্গে লাভপুরের যোগাযোগের সিংহদুয়ার। তারই মাধ্যমে বাইরের আলো-বাতাস অথবা নিত্যনতুন খবরের ঢেউ এসে পৌঁছয় এই পল্লী অঞ্চলে। স্টেশনকে কেন্দ্রে রেখে একদল মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের জীবনযাপন আর পাঁচজন গ্রামবাসীর তুলনায় অন্যরকম। তারা কেউ স্টেশনমাস্টার, কেউ পয়েন্টস ম্যান, কেউ চা-বিক্রেতা, কেউ কুলি, কেউ আবার নির্ভেজাল অলস ভবঘুরে অথবা ভিখারি।

    সেকালের লাভপুর স্টেশনের কিছু ছবি পাওয়া যায় প্রবীণ মানুষের স্মৃতিচারণায় আর পাওয়া যায় তারাশঙ্করের অসংখ্য ছোটগল্প ও উপন্যাসে। সেই রচনাগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ‘কবি’। গল্পটির পটভূমি এই স্টেশন এবং কেন্দ্রীয় চরিত্র স্টেশনের কুলি।

    চারিপাশের অনেকগুলি গ্রামে যাতায়াতের জন্য নিকটতম স্টেশন তখন লাভপুর। সেখান থেকে আশপাশের গ্রামগুলিতে যাওয়ার উপায় ছিল গোরুর গাড়ি নতুবা পায়ে হাঁটা। কাজেই ট্রেন আসার সময় হলেই মোট বওয়ার জন্য দু-চারজন কুলি সেখানে মজুত থাকত। সেই কুলিদের একজন ছিল সতীশ ডোম। যারা তাকে দেখেছিলেন, তাদের মতে আচার আচরণে সে যে স্বতন্ত্র ছিল তা বলাই বাহুল্য। স্বভাব-রসিক মানুষটির শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা অথবা কথার মধ্যে ইংরাজি শব্দ প্রয়োগ করায় বিশেষ আগ্রহ ছিল। অন্য কুলিরা যখন ছয় পয়সা মজুরী হাঁকত, সতীশ চাইত, ‘টু আনাস’।

    তারাশঙ্কর ‘কবি’ গল্পে সতীশের পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে যে বিবরণ দিয়েছেন তা পুরোপুরি সত্যি। কুখ্যাত চোর, তারাশঙ্করের অনেকগুলি ছোটগল্পের চরিত্র শশী ডোম ছিল সতীশের মামা। পারিবারিক কলঙ্কের পেশা থেকে নিষ্কৃতি পেতেই সতীশ এসেছিল স্টেশনে কুলিগিরি করতে।

    এই অঞ্চলে শীতকাল জুড়ে নানা মেলা হয়। একেকটা সময় এক এক গ্রামে মেলা। মেলাগুলির অন্যতম আকর্ষণ কবিগান ও ঝুমুর গান। সতীশ সেসবের খবর রাখত। সে ছিল কবিযশঃপ্রার্থী। তাই মাঝেমাঝেই উধাও হয়ে যেত। কুলিগিরি ফেলে হাজির হত মেলায়। সুযোগ পেলেই দোহারকি করত। ফিরে এসে সেসব অভিজ্ঞতার কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে আনন্দ পেত।

    স্টেশনে চায়ের দোকানটি পরিচিত ছিল ‘বেনে মামার দোকান’ নামে। চায়ের দোকানে আড্ডা ছিল বাতে পঙ্গু দ্বিজপদর। দ্বিজপদ ছিলেন তারাশঙ্করের বাল্যবন্ধু। সতীশ যখন তার গল্পের ঝুলি খুলে বসত দ্বিজপদ প্রায়ই একটা ঘুঁটের মধ্যে ফুটো করে দড়ি পরিয়ে ‘মেডেল’ বলে ঝুলিয়ে দিত তার গলায়। তাকে ‘কপিবর’ বলে সম্বোধন করত। গানবাজনার প্রতি সতীশের সহজাত টান তারাশঙ্করের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। হয়ত সতীশ অনুভব করত সে কথা। তাই দ্বিজপদর রসিকতায় আহত হলেও তারাশঙ্করকে দেখে আনন্দে বিগলিত হত। সে আশা করত তার গান ও গাওনা সম্পর্কে তারাশঙ্কর জানতে চাইবেন। তারাশঙ্কর কখনও কখনও জানতেও চাইতেন। কোনও সময় জানতে না চাইলে সে নিজেই রসিয়ে রসিয়ে নানান পৌরাণিক উপমা সহযোগে তার অভিজ্ঞতার বিবরণ দিত। তার বিশ্বাস ছিল এর মর্যাদা তারাশঙ্করই বুঝবেন। যেমন,

    “রসিকের কথা রসিক জানে
    বংশী বাজে বৃন্দাবনে।”

    বেনে মামার চায়ের দোকানে দুধ বেচতে আসত প্রতিবেশী গ্রামের রুইদাস সম্প্রদায়ের একজন কিশোরী। মেয়েটি সহজ সরল চঞ্চলা। সে সর্বদা তার ননদ সম্পর্কে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকত। কথায় কথায় বলত, ‘ঠাকুরঝি রাগ করবে’, ‘ঠাকুরঝি বকবে যি’ অথবা ‘ঠাকুরঝিকে না শুধিয়ে বলতে লাড়ব’। মেয়েটির এই ঠাকুরঝি আতঙ্কের জন্যে সতীশ তাকে ডাকতে শুরু করেছিল ‘ঠাকুরঝি’ বলে। তারাশঙ্কর লক্ষ করেছিলেন তাতে মেয়েটির কোনও আপত্তি ছিল না। সে ওই নামেই সাড়া দিত। মাঝেমধ্যে তার আসতে দেরি হলে সতীশ অপেক্ষা করতে করতে অধীর হয়ে উঠত।

    দুধ আসে নি, কাজেই যারা চা খেতে আসত, সকলেই অপেক্ষা করত কিন্তু সতীশ স্থির থাকতে না পেরে এগিয়ে যেত। তাকিয়ে থাকত ঠাকুরঝির আসার পথের দিকে। তারপর একসময় তার চোখে পড়ত দূরে একটা জায়গায় হঠাৎ জেগে উঠল ‘স্বর্ণশীর্ষ কাশফুল’। ঠাকুরঝির মাথার উপর ঝকঝকে করে মাজা কাঁসার ঘটির উপর সূর্যের আলো পড়ে সোনার মতো ঝলমল করে উঠত।

    স্টেশনের কাছে ছিল একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ। তারাশঙ্কর সেই গাছের আড়াল থেকে সতীশ আর ঠাকুরঝিকে লক্ষ করতেন। তখনই তাঁর কানে আসে সতীশ ও ঠাকুরঝির রহস্যালাপ।
    ‘হয়ত সতীশ বলত, বাবা রে বাবা, আসতে পারলে-
    ঠাকুরঝি রসিকতার ধার না ধেরে উত্তর দিত, ঠাকুরঝি ভিন গাঁ যেয়েছেন। এল, তা-পরেতে এলাম কিনা!
    যদি সতীশ বলত, আমার চোখ ক্ষয়ে গেল পথের পানে চেয়ে।
    ঠাকুরঝি সরল বিশ্বাসে বিস্ময় প্রকাশ করে বলে উঠত, চায়ের নেশা বেজায় নেশা, লয়?’

    এই সমস্ত টুকরো টুকরো ঘটনা এবং সতীশ যথা সময়ে হয়ে উঠেছিল ‘কবি’র কাঠামো। ‘আপন মনের মাধুরী’ মিশিয়ে তারাশঙ্কর ‘কবি’র নায়ক নিতাইকে নির্মাণ করেছিলেন। লেখকের ভাষায়, ‘আমাদের গ্রামে বাউরিদের মধ্যে, ডোমেদের মধ্যে কত কবি আছে। তাদেরই একজনকে নিয়ে আমার মানস সরোবরে স্নান করিয়ে আমার কবি উপন্যাসের নায়ক হিসেবে অভিষেক করেছি।’


    (২)


    তারাশঙ্করের সাহিত্য পাঠ করতে করতে যখন আবার একজন স্বভাবকবি মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়, তখন থমকে দাঁড়াতেই হয়। নাম তার সতীশ। মনে হয়, ‘কেমন যেন চেনা চেনা! কোথায় দেখেছি!’ সেই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা অথচ উচ্চারণ দোষে বিকৃত। ‘আমাদের পাড়ায় আসতেই হবে’ না বলে, সে বলে, ‘আমাদের পাড়ায় আজ একবার পদাপ্পন করতেই হবে’। তার কথার সুর স্মৃতিতে ঘা দেয়। এ তো সেই! যে ‘রাগ’ না বলে বলতে চাইত ক্রোধ কিন্তু মুখ থেকে বেরিয়ে আসত, ‘কোধ।’ মনে হয় ‘কবি’র ‘নিতাই’ ফিরে এসেছে ‘গণদেবতা’র সতীশ হয়ে।

    ‘গণদেবতা’র অসংখ্য চরিত্রের মধ্যে বেশ কিছু চরিত্র স্বমহিমায় জ্বলজ্বল করে। তাদের মধ্যে একজন সতীশ বাউরি। সে গ্রামের ব্রাত্যপল্লীর মাতব্বর। পরিশ্রমী ও আত্মবিশ্বাসী। নিজের জমি না থাকলেও তার নিজস্ব হাল আছে। অন্যের জমি ভাগে চাষ করে। উপরন্তু সে ‘মাঠ আগলদার’ অর্থাৎ পাকা ধানে খেত ভরে উঠলে ধান চুরি আটকাতে সে মাঠ পাহারা দেয়। কথা বলে বিজ্ঞের মতো। পাড়ার সকলের প্রতিনিধি হয়ে এগিয়ে যায়। জীবিকায় সতীশ আর নিতাইয়ের কোনও মিল নেই। মিল আছে তাদের মৌলিক স্বভাবে, রুচিতে বা পছন্দে। সতীশ মুখে মুখে গান বাঁধে। ঘেঁটুগান, ভাসানগান ও বোলান গান।

    গ্রামের ভদ্রলোকেদের সমাজে যেমন চণ্ডীমণ্ডপ, তেমন সতীশদের ধর্মরাজতলা। সন্ধ্যের পর সেখানে আসর বসে। মীমাংসার নামে ঝগড়াঝাঁটি, খিস্তি-খেউর বা অশ্লীল কথার বন্যা যেমন বয় তেমনি ঢোলের বাজনা সহযোগে গানের আসরও বসে। সতীশ গ্রামের ঘটনাগুলি ছড়ার আকারে ছন্দ মিলিয়ে গান বাঁধে। ওদের পূর্বজরাও তাই করত। যেমন রেললাইন বসার সময় ওরা গান বেঁধেছিল,
    ‘সাহেব রাস্তা বাঁধালে;
    ছ’মাসের পথ কলের গড়ি দণ্ডে চালালে।’

    ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে পাঠশালার পণ্ডিত দেবনাথ ঘোষের জেলে যাওয়া একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। দেবুপণ্ডিত যখন জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফেরত আসছেন, সেই সময় তাঁর চোখ দিয়ে লেখক চারিপাশকে দেখিয়েছেন এক অপূর্ব বর্ণনায়। সেখানেই আছে সতীশদের পাড়ার বিবরণ, ‘বড় বকুল গাছের পাশে বাউরি পাড়া বায়েন পাড়া।’

    দেবু পণ্ডিতের ফিরে আসার দিনের ঠিক একবছর তিনমাস আগে তাঁকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। সেই অবিচারের সাক্ষী ছিল গোটা গ্রাম। সেবার অগ্রহায়ণের শেষ ও পৌষের শুরুতে জমি জরিপ আইন মোতাবেক সেটলমেন্টের লোকজন এসে হাজির হয়েছিল। মাঠের প্রতি টুকরো জমি মাপ করে তার বিবরণ সহ, স্বত্ব নির্ধারণ হবে। তখন মাঠ ভর্তি পাকা ধান। গ্রামবাসী ভয় পেয়েছিল। পাকা ধানের উপর লোহার শেকল টেনে মাপ হবে! পরে নিত্যনতুন নোটিশ ও হুকুমের জ্বালায় তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হবার যোগাড় হয়েছিল।

    এরই মাঝে একটা তুচ্ছ ঝামেলা হয়ে গিয়েছিল দেবু পণ্ডিতের সঙ্গে একজন কানুনগোর। সে দেবুকে ‘তুই’ সম্বোধন করতে দেবুও তাকে ‘তুই’ বলেই জবাব দিয়েছিলেন। এই ছিল কানুনগোর রাগের কারণ। সে তার রাগ মেটাতে নোটিশের পর নোটিশ পাঠিয়েছিল দেবুর কাছে। দেবুর তরফ থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে ডেপুটি ডেকে পাঠায় তাঁকে। সে ডাকেও সাড়া না দেওয়ায় তাঁর নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আসে। গ্রামের পাঁচজন এই খবরে হতবাক হয়ে যায়। তারা দেবুর জেলযাত্রা আটকানোর জন্যে পরামর্শ করে। উঠতি বড়লোক ও মাতব্বর শ্রীহরি পাল কানুনগোর কাছে নতি স্বীকার করতে বলে দেবুকে। একরোখা দেবু তা অস্বীকার করেন এবং শিশুপুত্র ও যুবতী স্ত্রীকে রেখে জেলে যান।

    গ্রামে ঢোকার মুখে চণ্ডীমণ্ডপেই গ্রামের প্রবীণদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে দেবুর। বাড়ির সামনে মেয়েরা তাঁকে শাঁখ বাজিয়ে বরণ করে। গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা দেখা করতে আসে। বিগত সময়ে গ্রামে কে কে মারা গিয়েছে, কতজন জন্ম নিয়েছে, কার সঙ্গে কার বিবাদ নতুন করে শুরু হয়েছে, সমস্ত খবর পুঙ্খানুপুঙ্খ দিয়ে যায় তারা। আসে মাতব্বর শীহরি পাল ওরফে ছিরু পাল। সে দেবুকে চণ্ডীমণ্ডপে ডাকে। জানায় তার কীর্তিকাহিনীর কথা। গ্রামে নতুন স্কুলঘর হবে। দেবু বন্ড লিখে দিলে স্কুলের চাকরি তাঁরই থাকবে। শ্রীহরির প্রস্তাবে অসম্মতি জানিয়ে চণ্ডীমণ্ডপ ছেড়ে আসার মুহূর্তেই সতীশ এসে দাঁড়ায় দেবুর সামনে, ‘আমাদের পাড়ায় একবার পদাপ্পন করতে হবে।’

    মুখে আপত্তি জানালেও দেবুকে যেতে হয়। গিয়ে দেখেন ব্রাত্যপল্লীর মানুষেরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে আসর পেতে অপেক্ষা করছে। অভ্যর্থনা শুরু হয় গানবাজনার মাধ্যমে। ঢোলের বাজনার সঙ্গে ঘেঁটুগান। রচনা করেছে সতীশ। দেবুর গুণমুগ্ধ সতীশ যা চাক্ষুষ করেছিল তারই নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছে তার গানে।

    ‘দেশে আসিল জরীপ!
    রাজা-পেজা ছেলে-বুড়োর বুক ঢিপ ঢিপ
    হায় বাবা, কি করি উপায়?
    প্রাণ যায় তাকে পারি- মান রাখা দা-য়!
    পিয়ন এল, আমিন এল, এল কানুনগো,
    বুড়ো শিবের দরবারে মানত মানুন গো।
    বুঝি আর মান থাকে না।
    ...
    পণ্ডিত মশায় দেবু ঘোষ তেজিয়ান বিদ্বান,
    জানের চেয়েও তার কাছে বেশী হল মান।
    ও সে আর সইতে পারে না।।
    কানুনগো কইল ‘তুই’, সে করে ‘তুকারি’
    আমার কাছে খাটবে না তোর কোন জুরি-জারি
    দেবু কারুর ধার ধারে না।।
    দেবু ঘোষের পাকা ধানে ছেকল চল্লিশ মন,
    টেনে নিয়ে চলে আমিন ঝন-ঝন-ঝন
    ও সে কারুর মানা মানে না।।
    দেবু ঘোষে বাঁধল এসে পুলিশ দারোগা,
    বলে, কানুনগোর কাছে হাত জোর করগা।
    দেবু ঘোষ হেসে বলে ‘না’।।
    থাকিল পেছনে পড়ে সোনার বরণ নারী,
    ননীর পুতলী শিশু ধুলায় গড়াগড়ি।
    তবু ঘোষের মন টলে না।।
    ফুলের মালা গলায় দিয়ে ঘোষ চলেন জেলে,
    অধম সতীশ লুটায় এসে তাঁরই চরণ-তলে
    দেবতা নইলে হায় এ কাজ কেউ পারে না।।’

    জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পাওয়ার পর ‘গণদেবতা’ উপন্যাসের প্রতি পাঠকের প্রচুর উৎসাহ দেখা গিয়েছিল। সেই সময় সঙ্গীতজ্ঞ জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের অ্যাকাডেমি থেকে গণদেবতার গানগুলি রেকর্ডিং করে দিল্লীতে নিয়ে যাবার জন্যে তারাশঙ্করের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারাশঙ্করের দশজন নাতিনাতনি সেই গানে অংশ নেন। জরীপ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে উল্লিখিত গানে মূল গায়ক একজন। বাকিদের কাজ ছিল ধুয়ো দেওয়া। দুএক পঙক্তি করে মূল গান আর ঘুরে ফিরে ধুয়ো, ‘হায় বাবা কী করি উপায়’।

    গানটির সুর তারাশঙ্কর নিজে শিখিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর নাতিনাতনিদের। লম্বা গান এবং একঘেয়ে সুর। গানের বৈশিষ্ট্য মেনে সেই একঘেয়েমিকে তিনি সযত্নে বজায় রেখেছিলেন।
    তারাশঙ্করের সঙ্গে সতীশের যোগাযোগ ছিল আমরণ। তারাশঙ্কর লাভপুরে গেলে তাঁর ‘ধাত্রীদেবতা’ গৃহের আঙিনা ভরে উঠত তাঁরই সাহিত্যের জীবন্ত চরিত্রদের ভিড়ে। তারা খোঁজখবর নিতে আসত। নিত পরামর্শ। তবে বেশিরভাগই আসত আর্থিক সাহায্যের জন্যে। সেই সময়েরই একটি দৃশ্যের বিবরণ পাওয়া যায় তারাশঙ্করের পুত্র সরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণায়, ‘... ফেরার দিন হাজির হলাম লাভপুরে। দূর থেকে দেখতে পেলাম আমাদের বাড়ির সামনের বসার জায়গাটা লোকে লোকারণ্য। দেখা যাচ্ছে ওপাশে বসে আছে ‘কবি’র নিতাই কবিয়াল অর্থাৎ সতীশ ডোম ...’।

    সূত্রঃ
    ১। কবি; তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
    ২। ক’টি ছায়া ও একটি গল্প; (প্রবন্ধ) তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
    ৩। গণদেবতা; তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
    ৪। আমার সাহিত্যজীবন; তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
    ৫। ছবি আঁকতেন কাঠের ক্যানভাসে; কাঞ্চনকুন্তলা মুখোপাধ্যায়; আনন্দবাজার-রবিবাসরীয়; ২১ এপ্রিল ২০১৯।
    ৬। সাকিম-লাভপুর; তারাশঙ্কর শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি; সরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।

    তথ্যঋণঃ
    ডাঃ সুকুমার চন্দ্র (লাভপুর)।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • পড়াবই | ২৪ জুলাই ২০২২ | ১৫৯৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • &/ | 151.14.***.*** | ২৫ জুলাই ২০২২ ০৪:৫৬510278
  • লেখাটা খুব ভালো লাগল। 'কবি' উপন্যাসটি অসাধারণ। তার চলচ্চিত্রায়িত রূপটিও সুন্দর।
  • আশিস। | 110.224.***.*** | ২৭ জুলাই ২০২২ ০৬:৪১510401
  • খুব ভালো লাগলো। 
  • আশিস। | 110.224.***.*** | ২৭ জুলাই ২০২২ ০৬:৪১510402
  • খুব ভালো লাগলো। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন