কোভিড টীকাকরণ সময়ের দাবী- এই নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। এই অতিমারী রুখতে প্রত্যেকের যে টীকা নেওয়া উচিৎ তাও একশো শতাংশ সত্য। সরকারের যে সকলের জন্য বিনামূল্যে টীকার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন তা নিয়েও কমবেশি সবাই একমত। কিন্তু বলপূর্বক কাউকে টীকা দেওয়া বা টীকাকরণকে বাধ্যতামূলক করা নিজের শরীরের ওপর মানুষের গোপনীয়তার অধিকারকে লঙ্ঘিত করে; যা একটি মৌলিক অধিকার বলে ভারতবর্ষের আইনে স্বীকৃত। আইনের ভাষায় একে "ট্রেসপাস টু পার্সন"-ও বলা হয় কারণ কোনও ব্যক্তির অনিচ্ছায়, তার শরীরে একটি ছুঁচের অনধিকার প্রবেশ শরীরের ওপর তার নিজের অধিকারকে লঙ্ঘিত করে।
মুশকিল হল অধিকার আন্দোলনের অনেক সমর্থকও এটা বুঝতে পারছেন না যে কাউকে বলপূর্বক টীকা দিলে বা টীকা নেওয়াকে বাধ্যতামূলক করলে ব্যক্তি মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়। একাধিক রাজ্য সরকার নানাবিধ নির্দেশিকা মারফৎ জানিয়েছে টীকা না নিলে দোকানদার, সবজি বিক্রেতা কিংবা ট্যাক্সি চালকরা কাজ করতে পারবেন না। কিঞ্চিৎ আইনের কচকচি মনে হলেও; কয়েকটি বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন। ভারতের সংবিধানের ১৯(১)(ছ) ধারা প্রত্যেক নাগরিককে নিজের পছন্দমত পেশা বেছে নেওয়ার মৌলিক অধিকার প্রদান করে। যদিও রাষ্ট্র চাইলে জনস্বার্থে এই অধিকারের ওপর কিছু যুক্তিসঙ্গত বিধিনেষেধ আরোপ করতে পারে। একই সঙ্গে আমাদের সংবিধানের ২১ নম্বর ধারা আমাদের জীবন এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার প্রদান করে। ওলগা টেলিস বনাম বোম্বে মিউনিসিপাল কর্পোরেশন মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল জীবনের অধিকারের মধ্যে জীবিকা অর্জনের অধিকারও অন্তর্ভুক্ত। কিছুদিন আগে রেজিস্ট্রার জেনারেল বনাম মেঘালয় রাজ্য মামলার রায়ে মেঘালয় হাইকোর্ট জানায় যে বাধ্যতামূলক বা বলপূর্বক টীকাকরণ গোপনীয়তার মত মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘিত করে। শুধু তাই নয়; টীকা না নিলে জীবিকা অর্জন করতে না দেওয়া (অর্থাৎ সবজি বিক্রি কিংবা ট্যাক্সি চালানো) সংবিধানের ১৯(১)(ছ) এবং ২১ নম্বর ধারা দ্বারা প্রদত্ত মৌলিক অধিকারকেও লঙ্ঘিত করে এবং এই বিধিনিষেধ যুক্তিসঙ্গত নয়। এই মামলার রায় দিতে গিয়ে মেঘালয়ে হাইকোর্ট ১০৭ বছর আগের আমেরিকার একটি মামলার রায়ের উল্লেখ করে। ১৯১৪ সালে শ্লোয়েনড্রফ বনাম সোসাইটি অফ নিয়ে ইয়র্ক হসপিটালস মামলায় কোর্ট জানায় প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক এবং সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন মানুষের অধিকার আছে তাদের দেহ নিয়ে কী করা হবে তা নির্ধারণ করার।
একই সঙ্গে মেঘালয় হাইকোর্ট ইংল্যান্ডের একটি মামলার রায়ের কথাও উল্লেখ করে। এয়ারডেল এনএইচএস ট্রাস্ট বনাম ব্ল্যান্ড মামলায় কোর্ট জানায় প্রাপ্তবয়স্ক কোনও ব্যক্তিকে বলপূর্বক 'ফ্লু'য়ের টীকা দেওয়া বেআইনি। কয়েকদিন পরে গুয়াহাটি হাইকোর্টও একটি মামলার রায়ে বাধ্যতামূলক টিকাকরণের বিষয়ে মেঘালয় হাইকোর্টের রায়ের সঙ্গে সহমত পোষণ করে। জীবিকা অর্জন করার জন্য যদি বাধ্যতামূলক ভাবে টীকা নিতে হয় তবে তা ভারতের সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারাকেও লঙ্ঘিত করে। সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারা স্পষ্ট ভাবে জানায় রাষ্ট্র প্রত্যেককে সমান ভাবে দেখবে এবং কোনও বৈষম্য করবে না। সেখানে টীকা নেওয়া ব্যক্তিদের জীবিকা অর্জন করতে দেওয়া এবং টীকা না নেওয়া ব্যক্তিদের জীবিকা অর্জন করতে না দেওয়া সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারাকেও লঙ্ঘিত করে।
নিজের এবং অন্যদের জন্য কোভিড টীকা নেওয়া অবশ্য প্রয়োজন। কিন্তু টীকাকরণের পিছনে একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের যে মূল উদ্দেশ্য থাকে; বলপূর্বক টীকা দিলে সেই মূল উদ্দেশ্যটিই ব্যাহত হয়। যদিও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক কোভিড টীকাকরণ বাধ্যতামূলক নয়; বরং ঐচ্ছিক। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধনও জানিয়েছিলেন কোভিড টীকাকরণ ঐচ্ছিক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বাধ্যতামূলক টীকাকরণের বিরোধিতা করেছে। তাদের মতে মানুষকে বুঝিয়ে টীকা নিতে উৎসাহিত করাই শ্রেয়।
যদিও প্রশ্ন কেবলমাত্র টীকা নিতে অনিচ্ছুক ব্যক্তিদের নয়। টীকা নিতে অনিচ্ছুক ব্যক্তির সংখ্যা সম্ভবত নগণ্য। অধিকাংশ মানুষই টীকা নিতে চান। কিন্তু যারা টীকা নিতে চাইছেন তাঁরা সবাই কি টীকা পাচ্ছেন? কোভিড টীকা উৎপাদনের ক্ষেত্রে গোটা বিশ্বে ভারতের স্থান এক নম্বরে। স্বাভাবিক ভাবে এটা আশা করা যেত যে ভারতীয়রা খুব দ্রুতগতিতে টীকা পাবেন। এদিকে তথ্য কিন্তু অন্য কথা বলছে। সংবাদমাধ্যমের দিকে নজর রাখলেই দেশের নানা স্থান থেকে টীকার অপ্রতুলতার ঘটনা দেখা যাচ্ছে। দ্য হিন্দু'র একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে জুন মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত ভারতের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের মধ্যে মাত্র ৩.৬% টীকার দুটি ডোজ পেয়েছেন। অর্থাৎ অতিমারী আটকাতে টীকাকরণের হার খুব একটা সন্তোষজনক নয়। সরকারি হাসপাতাল বা টীকাকেন্দ্র থেকে টীকা নিতে গেলেও সবসময় তা পাওয়া যাচ্ছে এমন নয়। দেশের অনেক রাজ্যেই টীকার অপ্রতুলতা দেখা যাচ্ছে। দিল্লীর উপমুখ্যমন্ত্রী কয়েকদিন আগেই ট্যুইট করে দিল্লীতে টীকার অপ্রতুলতার কথা জানিয়েছেন। মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন যে বিজেপি শাসিত রাজ্য বেশি টীকা পাচ্ছে। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশও বিজেপি এবং অবিজেপি রাজ্যের মধ্যে টীকার জোগান নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিভেদের অভিযোগ তুলেছেন। এমতাবস্থায় যদি একজন সবজি বিক্রেতা কিংবা একজন ট্যাক্সি চালকের জীবিকা অর্জনের জন্য কোভিড টীকা নেওয়াকে বাধ্যতামূলক করা হয় এবং সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টীকার অপ্রতুলতার জন্য টীকা না পেলে তাঁদের কাছে দুটো রাস্তা খোলা থাকে। সরকারি হাসপাতাল বা টীকাকেন্দ্র থেকে টীকা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা এবং ততদিন তাঁদের জীবিকা অর্জন বন্ধ রাখা অথবা বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে টীকা নেওয়া। যিনি সরকারি ভাবে বিনামূল্যে টীকা পেতে পারতেন; সেটাই তাঁকে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে কিনতে এক প্রকার বাধ্য করা হচ্ছে। এই প্রবণতা যে কতটা ভয়াবহ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রায়োগিক ভিত্তিতে দেখতে গেলেও বাধ্যতামূলক টীকাকরণ প্রচেষ্টা হিসাবেও অত্যন্ত অসফল। উদাহরণ হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলা যেতে পারে। সেখানকার একটি আদালত পরোক্ষ ভাবে টীকাকরণকে বাধ্যতামূলক করেছে। এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই টীকা বিরোধী আন্দোলন গতি পাচ্ছে। বলপূর্বক যে কোনও কিছু চাপিয়ে দিলেই তার বিরুদ্ধে ব্যাপক ভাবে জনমত গড়ে ওঠে। কোভিড অতিমারীতে মানুষের মধ্যে টীকা বিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠা মানুষের জন্যই ক্ষতিকারক।
ব্যক্তি স্বাধীনতা কিংবা মানবাধিকার আন্দোলনকে সমর্থন করা নানাবিধ সংগঠন এবং ব্যক্তিবর্গ অদ্ভুত ভাবে এই বিষয়টি নিয়ে নিশ্চুপ রয়েছেন। তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে বিনামূল্যে সার্বজনীন টীকাকরণের দাবীর সঙ্গে বলপূর্বক টীকা দেওয়ার বিরোধিতার কোনও দ্বন্দ্ব নেই। বাধ্যতামূলক টীকাকরণের বিরোধিতা মানেই "কোভিড বলে কিছু হয় না" জাতীয় অর্থহীন বক্তব্যের সমর্থন নয়। রাষ্ট্রের দ্বারা জোর করে মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করার লক্ষণ দেখা যাওয়ার পরেও শুধুমাত্র এই কারণে চুপ করে থাকা যায় না যে এখনও কাউকে হাত পা বেঁধে টীকা দেওয়া হচ্ছে না। নীতিগত অবস্থান সবক্ষেত্রেই অপরিবর্তিত থাকা প্রয়োজন। সরকারের তরফ থেকে সকলকে টীকা নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা দরকার। টীকা নিয়ে যে ভ্রান্ত ধারণাগুলি মানুষের মধ্যে রয়েছে সেগুলিকে দূর করা দরকার। কিন্তু বলপূর্বক টীকাকরণ সহ বলপূর্বক যে কোনও কিছু চাপিয়ে দেওয়ার "রাষ্ট্রীয় ইচ্ছা"টির সর্বৈব বিরোধিতা হওয়া প্রয়োজন; তা টীকা হোক কিংবা ভাষা অথবা মতাদর্শ।