আজ আন্তর্জাতিক তথ্যের অধিকার দিবস। তথ্য। সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সরকারের যে কোনও নীতি নির্ধারণই হোক কিংবা কোনও সংগঠনের নির্মাণ; সবকিছুতেই তথ্যের ভূমিকা অপরিসীম। দুঃখের বিষয় হল আজ যে সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা এই দিনটি পালন করছি; সেই সময়ে এই দেশের সরকার তথ্যহীন। পরিযায়ী শ্রমিকের তথ্য থেকে অর্থনৈতিক তথ্য; বহু বিষয়েই সরকার তথ্যহীন। ২০০৫ সালে ইউপিএ-১ সরকারের সময়ে তৈরী হয় তথ্যের অধিকার আইন। রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্ট। যদিও পরীক্ষার ফল বেরোনোর পরেই মাঝেমধ্যে খাতার ফটোকপি পেতে আরটিআই শব্দটা শোনা যায়; কিন্তু এই আইনের গভীরতা অনেক বেশি। এই আইন প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্যই ছিল সরকারের সব মহলে দুর্নীতি দূর করা, স্বচ্ছতা আনা। আজ পনেরো বছর পরে ফিরে দেখার প্রয়োজন আছে যে ঠিক কতটা "স্বচ্ছতা" আমরা অর্থাৎ নাগরিকরা আনতে পেরেছি।
আমরা; যারা একটু আধটু রাজনীতি করি; তাদের কাছে পরিচিত একটি একটি শব্দ হল আরটিআই। রাইট টু ইনফরমেশন। তথ্যের অধিকার আইন। তথ্যের অধিকার আইনের ৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী; কতকগুলি ক্ষেত্র বাদ দিলে এই আইন বলে এই দেশের যে কোনও নাগরিক যে কোনও সরকারি দপ্তরের(রাজ্য এবং কেন্দ্র উভয়েরই) তথ্য জানতে চাইতে পারে। যে ক্ষেত্রগুলিকে এই আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল প্রতিরক্ষা বিষয়ক দপ্তর। যদিও মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা দুর্নীতির প্রশ্নে এই দপ্তরগুলিও আরটিআই এর উত্তর দিতে বাধ্য। এই আইনের সেকশন ৮, সাবসেকশন(১), ক্লজ(জে) মোতাবেক যে তথ্য এমএলএ কিংবা এমপি-দের থেকে আড়াল করা যায় না; সেই তথ্য কোনও নাগরিকের থেকেও আড়াল করা যায় না। দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী ভারতীয় নাগরিকরা বিনামূল্যে এবং দারিদ্রসীমার উপরে বসবাসকারীরা দশ টাকা দিয়ে আরটিআই এর আবেদন করতে পারেন। ইচ্ছাকৃত তথ্য না দিলে বা ভুল তথ্য দিলে বা তথ্য নষ্ট করলে দায়িত্বপ্রাপ্ত পাবলিক ইনফরমেশন অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতাও আছে ইনফরমেশন কমিশনের।
এইরকম একটি শক্তিশালী আইনের সত্যিই দেশের দুর্নীতি দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়ার কথা। কিন্তু প্রশ্ন থাকে আইনের রূপায়নে। এই আইনবলে কেন্দ্রীয় তথ্য আয়োগ এবং প্রতিটি রাজ্যে তথ্য আয়োগ তৈরি হয়। সেখানে নিযুক্ত করা হয় ইনফরমেশন কমিশনারদের। তাঁদের মধ্যে একজন থাকেন চিফ ইনফরমেশন কমিশনার। বিষয়টা অনেকটা ইলেকশন কমিশনের মতই। চিফ ইনফরমেশন কমিশনারের নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিরোধী দলনেতাদের(কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় জায়গাতেই) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট এবং ইনফরমেশন কমিশনের রায়ের পর এই আইন নিয়ে ধোঁয়াশা দূর হয়েছে, আইনের পরিধিও নির্ণায়িত হয়েছে।
ইনফরমেশন কমিশনই হোক কিংবা বিচারব্যবস্থা; গণতান্ত্রিক দেশে এই ধরণের স্বশাসিত সংস্থাগুলি এবং সরকারের মধ্যে দুর্ভেদ্য পাঁচিলের মত দূরত্ব থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু এই সময়ে দাঁড়িয়ে স্বশাসিত সংস্থাগুলির নিরপেক্ষতা নিয়েই বারবার প্রশ্ন উঠছে। ২০১৯ সালে তথ্যের অধিকার আইনের সংশোধনীর মধ্যে দিয়ে সরকার তথ্য আয়োগকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে।
দুঃখের বিষয় হল এই নিয়ে কোনও প্রতিবাদ আন্দোলন অবধি হয়নি। এর থেকে বোঝাই যায় যে দেশের সংখ্যাগুরু জনগণ পনেরো বছরেও এই আইনের গুরুত্ব বুঝে উঠতে পারেননি। অবশ্য কোনও সরকারই চাইবে না যে দেশের মানুষ এই আইন নিয়ে সচেতন হন। আমরা যারা একটুআধটু রাজনীতি করে থাকি; তাদেরও দোষ যে আমরা এই আইনের গুরুত্ব মানুষকে বোঝাতে পারিনি।
কেন্দ্র সরকারের তথ্য জানার জন্য অনলাইনেই আরটিআই এর আবেদন করা যায়। কিন্তু অধিকাংশ রাজ্য সরকার এখনও অনলাইনে আরটিআই এর আবেদন করার ব্যবস্থা করেনি। পশ্চিমবঙ্গও তাদের মধ্যে অন্যতম। ২০১৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর কেন্দ্র সরকার চিঠি দিয়ে প্রত্যেকটি রাজ্যকে অনলাইনে আরটিআই আবেদন করার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ জানায়। গতবছর প্রবাসী লিগ্যাল সেল সুপ্রিম কোর্টে একটি পিটিশন ফাইল করে এই নিয়ে। ১৪ অক্টবর জাস্টিস এন.ভি.রামানার বেঞ্চ ২৫ টি রাজ্যকে এই বিষয়ে তাদের মতামত দেওয়ার জন্য একমাস সময় দেয়। তার পরবর্তীতে এই কেস কোনদিকে এগিয়েছিল সেটা আর কোনও মিডিয়ায় কভার করেনি। কিন্তু আজও বহু রাজ্য সরকার অনলাইনে আরটিআই করার ব্যবস্থা চালু করেনি। একই সঙ্গে কেন্দ্র ও রাজ্যের ইনফরমেশন কমিশনে শূন্যপদ রয়েছে; যা পূরণ করতে কোনও সরকারেরই সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে না।
কিন্তু সমস্যা শুধু এখানেই শেষ নয়। আরটিআই অ্যাক্টিভিস্টদের ওপর হামলা এবং হত্যা এই দেশের আরটিআই আইন প্রণয়নের সামনে সবথেকে বড়ো বাধা। ২০১৯ সালে সেন্ট্রাল ইনফরমেশন কমিশনের দ্বারা প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ২০০৭ সাল থেকে ওই রিপোর্ট প্রকাশ পর্যন্ত ২০ জন আরটিআই অ্যাক্টিভিস্টকে হত্যা করা হয়েছে, ৪৫ জন আরটিআই অ্যাক্টিভিস্টের ওপর হামলা করা হয়েছে এবং ৭৩ জনকে হেনস্থা করা হয়েছে। এই কারণে বারবার দাবী উঠেছে ব্যক্তি পরিচয় গোপন রেখে আরটিআই করার পদ্ধতি তৈরি করার। কিন্তু তাও হয়নি। সর্বোপরি আরটিআই অ্যাক্টিভিস্টদের হত্যার মত মারাত্মক ঘটনায় সমাজে যতটা প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিৎ ছিল; তার একাংশও হয়নি। এর কারণটা সম্ভবত আরটিআই নিয়ে মানুষের অজ্ঞতা।
আরটিআই একটি সামাজিক আন্দোলন হিসাবে গড়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে। সেই পথেই আমাদের এগোতে হবে। আরটিআই করুন, অন্যকে আরটিআই করতে বলুন। তথ্যের অধিকার আপনার নাগরিক অধিকার। সেই অধিকারকে ব্যবহার করুন, সেই অধিকারকে রক্ষা করুন।