কোভিড যেন সেই দুষ্টু বাচ্চা, আমরা যেমন ছোটবেলায় রোগা গাছের গুঁড়ি বা হাতের নাগালে পাওয়া শাখার ঝুঁটি ধরে বেদম ঝাঁকাতাম, টুপটুপ খসে পড়তো সাদা জামরুল বা লাল লিচু, তেমন ঝাঁকাচ্ছে জীবন বৃক্ষকে। খসে পড়ছে অমূল্য প্রাণ, আজ চলে গেলেন দুর্বারের প্রতিষ্ঠাতা ডঃ স্মরজিত জানা, আমি যাঁকে চিরকাল শুধু ডাক্তারবাবু বলেই ডেকেছি। মহামারি বিশেষজ্ঞের প্রাণ গেল মহামারিরই থাবায় !
ওপরের শিরোনামটি যার লেখা থেকে ধার করা, তিনি একজন যৌনকর্মী। হতভাগ্য মেয়েটি অনেক হাতবদল হয়ে শেষে সোনাগাছিতে থাকতে শুরু করে, আর দুর্বারের ছায়ায় যেন একটু জিরোতেও পারে। স্কুলে পড়তে পড়তে শিক্ষকের দ্বারা অনুরুদ্ধ হয়ে তার এ-ই আত্মকথন। আরো একটু উদ্ধৃত করি তাকে, "এখন এই (প্রজেক্টের) কাজে লেগে আমার ভালো লাগে।পাঁচটা লোক নিয়ে লীলাখেলা করতে ইচ্ছে করে না। এখন পাঁচটা বাড়িতে যাই,ওখানে পাঁচরকম মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে এবং গল্পগুজব করে বেশ ভালো লাগে। আবার এক-এক সময় চিন্তা করি, আমার জীবনটা যেন গাছের পাতার মতো"।
জীবনের এই আছি এই নেই ভাবটুকু, বিবর্ণতা, এখান থেকে ওখানে ওড়াউড়ি, উদ্দেশ্যহীনতা, সব অনুষঙ্গগুলি কেমন ঝাঁপিয়ে এলো শেষ লাইনটায়। মেয়েটির ভূলুণ্ঠিত হালকা শরীরটিও যেন চোখের পাতায় উঠে এলো !
এইসব সংবেদী মেয়েদের, তাদের শিশুদের জন্য কাজ করতেন স্মরজিত জানা আর তাঁর প্রতিষ্ঠিত দুর্বার মহিলা সমণ্বয় কমিটি। আরো ছিল তৃতীয় লিঙ্গ, রূপান্তরকামী, অন্য যৌনতার মানুষেরা। কমিটির প্রায় সব পদেই ছিলেন ভুক্তভোগী মেয়েরা, যাদের ওপর ঐ অঞ্চলে চূড়ান্ত অত্যাচার করাটাই ছিল রেওয়াজ। বাড়িউলি মাসি, পাড়ার গুন্ডা, উঠতি বড়লোক এমনকি ছোটখাটো নেতারাও এদেরকে শোষণ করতো যার প্রাণে যেমন চায়। অস্বীকার করার উপায় নেই, দুর্বারের অভিভাবকত্বে সে অত্যাচার,গুণগত ভাবে না হলেও, মাত্রায় কমে এসেছিল অনেক। এখন কি আবার ফিরে যাওয়া পূর্বাবস্থায় ? সেই আশঙ্কা খুবই হচ্ছে, কারণ যতোদিন দুর্বারে গেছি, তার অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নিয়েছি, মে দিবসে বা অন্য মিছিলে পথ হেঁটেছি দেহ- শ্রমিকদের সঙ্গে, নজরে পড়েনি এমন কেউ, যাকে মনে হয়েছে ডাক্তারবাবুর যোগ্য উত্তরসূরী। এটা অবশ্য আমার ভুলও হতে পারে। উনি নিজে প্রচ্ছন্ন থাকতেন, বরাবর এগিয়ে দিতেন অন্যদের, কিন্তু রাশ যেন হাতে থাকতো ওঁরই, এইরকমই যেন দেখেছি মনে হয়। সেনাপতির পতন হলে সম্মুখ সমরে নেতৃত্ব এবার নেবে কে ? এ তো যে সে যুদ্ধ নয়, একেবারে সমাজ, ধর্ম, মানসিকতার বিরুদ্ধে টিঁকে থাকার বিপুল লড়াই, অমর্যাদার হাত থেকে মর্যাদা ছিনিয়ে নেবার লড়াই, যাতে এই মেয়েরা পিষে যেতে পারে, যায়ও, যে কোনো মুহূর্তে ।
কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৯১ সালে। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সংস্থার স্বাস্থ্য প্রকল্পের অংশ হিসেবে। এইচআইভি নিয়ে কাজ। কাজটা করতে করতে ডাক্তারবাবু লক্ষ করেন এই মেয়েদের সন্তানরা স্কুলের সময়টুকু ধুলো মেখে রাস্তায় খেলে। এ তো তাদের ভবিতব্য, যখন মায়েরা বন্ধ দরজার ওপাশে পেশায় ব্যস্ত থাকে, তখনও। কিন্তু তাই বলে স্কুলের সময়েও ! আস্তে আস্তে ডাক্তারবাবু জড়িয়ে পড়তে থাকেন এই মা আর শিশুদের জন্য কল্যাণকর কাজে। তাঁর নিজের ভাষায়, "সেই ১৯৯২ সালে স্বল্প কিছু যৌনকর্মী যারা এইচ আই ভি কর্মসূচিতে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে যুক্ত হয়েছিলেন,তারাই প্রথম স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন, তারপর স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন এবং জন্ম দেন এক নতুন সম্ভাবনার"।
সরকারি প্রকল্প কেন শেষ অব্দি বেসরকারি হাতে, এই প্রশ্ন তুলে, সাথীরা দূরে চলে যান, ডাক্তারবাবু অকুতোভয়। নৈতিকতার প্রশ্নও ওঠে, কারণ দুর্বারের নীতি, যদি কোনো নারী স্বেচ্ছায় এই পেশা চালিয়ে যেতে চায়, তাকে নিরুৎসাহিত না করা। কিন্তু অনিচ্ছুক কাউকে জোর করা বা নাবালিকার ওপর জবরদস্তি বা পেশায় থাকা মেয়েদের ওপর অত্যাচার করা, এর সবগুলোই দুর্বারের নীতিবিরুদ্ধ। অনেকে পেশায় নিরুৎসাহ না করার ব্যাপারটি মেনে নিতে না পেরেও দূরে সরে গেছেন। তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ডাক্তারবাবু বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব।
কিন্তু কাজের মাঠে তিনি বিতর্কের অনেক ওপরে, একশ পার্সেন্ট সফল সংগঠক। ধুলোয় যারা খেলতো তাদের জন্য শুধু পড়াশোনার ব্যবস্থা নয়, বারুইপুরে বিরাট হস্টেল হলো। নাম 'রাহুল'। সেখানে নানা গাছপালা, ফুটবল খেলার মাঠ, বিশাল পুকুর। ফুটবলে রাহুলের ছেলেরা ম্যাঞ্চেস্টার একাদশেও জায়গা পেয়েছিল কয়েক বছর আগে। পড়াশোনাতেও পিছিয়ে নেই। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীতে। বেশ্যার সন্তানের জন্য হস্টেল হবে শুনে যারা তুমুল বাধা দিয়েছিল, তাদের সন্ততিরাই স্কুলে রাহুলের সহপাঠীদের মেনে নিয়েছিল। একদিন আমার প্রশ্নের উত্তরে ছেলেমেয়েরা সমস্বরে জানিয়েছিল, অন্তত স্কুলে কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ তাদের সঙ্গে করা হয় না।
কোভিডপূর্ব পয়লা মে-তে মিছিল করে এসে আমহার্স্ট স্ট্রিট নাচে গানে ভরিয়ে দিল যে ছেলেমেয়েরা তারা সবাই যৌনকর্মীর সন্তান। তাদের সংগঠনের নাম 'কোমল গান্ধার'। অনেক জায়গা থেকে আমন্ত্রণ পায় সংস্থাটি, অনুষ্ঠানও দেখবার মতো।
অত্যাচারের মাত্রা কী ছিল, শুনেছি মেয়েদের মুখে। যাদের মনে হবে জানা দরকার, তারা দুর্বারেরই প্রকাশিত বই "কখনও জিত কখনও হারে"র পাতা উলটে দেখতে পারেন। দেখার মতো ব্যাপার মেয়েদের জেদ। একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারা দুর্গাপুর, ডোমজুড়, কুলটি বা শিলিগুড়িতে। গোটা রাজ্য জুড়েই নির্যাতিত মেয়েদের পাশে দুর্বার।
নিজেও একবার বুঝেছিলাম কী অসম্ভব ভালো এদের নেটওয়ার্ক, কী অবিশ্বাস্য দ্রুততায় কাজ করে এদের রেস্কিউ টিম। এক দরদী স্নেহময় প্রধান শিক্ষিকা তাঁর পলাতকা ছাত্রীটিকে খুঁজে দেবার জন্য দুর্বারকে অনুরোধ জানাতে বলেছিলেন। আমি ডাক্তারবাবুর ফোন নম্বরটি তাঁকে দিই ও নিজেও অনুরোধ করি। বিপদের ভার না বুঝেই যে গৃহত্যাগী হয়েছিল সেই সরলমনা মেয়েটিকে বাড়িতে ফিরিয়ে এনে দিয়েছিল দুর্বারের স্থানীয় শাখা।
এনআরসির মোকাবিলায় প্রায় সব মেয়েদেরকে দিয়ে আদালতে হলফনামা পেশ করিয়েছে দুর্বার। নামধাম ঠিক নেই, কাজ চালানো ছদ্মনামের আড়ালে, স্বামী বা বাবার নাম, বাড়িঘর কিছুই ঠিক নয় যাদের, তাদের হাতে ঐ হলফনামাই লড়বার একমাত্র অস্ত্র। লক ডাউনের সময় চাঁদা তুলে মেয়েদের রেশন দিয়েছে দুর্বার। কিছু টাকা যোগাড় করে ডাক্তারবাবুকে পাঠাতে পেরেছিলাম ঠিকই, কিন্তু সহৃদয়া সহযোদ্ধাকে টাকা দিতে গিয়ে শুনতে হয়েছিল, দুর্বার তো বড়লোক এনজিও। বাইরে থেকে টাকা আসে। হয়তো আসে, হয়তো সংগৃহীত টাকাও যথেষ্ট হচ্ছিল না, এতো বড় বিপদ এই লকডাউন। এ-ই পেশায় প্রতিষ্ঠিত অনেক মেয়ে এক টুকরো সাবান কেনবার পয়সাও জোটাতে পারেনি। দুর্বারের কর্মকাণ্ড এতো ছড়িয়ে গেছে, এতো বড় হয়ে গেছে সংগঠন, হয়তো অপ্রতুলতার সঙ্গে তাকে যুঝতে হচ্ছিল। এই অতিমারি ভাগ্যের হাতে মার খাওয়া মেয়েগুলিকে মারতে শুরু করেছে প্রথম ঢেউয়ের সময় থেকে, এবার তারা সেই লড়াইতে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল।
আমরা এই মেয়েদের ঘৃণা করি, সমাজের পাঁক বলে ভাবি। ডাক্তারবাবু আর তাঁর দুর্বার মহিলা সমণ্বয় কমিটি মাত্র ২৪ বছরের সময়সীমায় আমাদের এই নজর অনেক পাল্টেছিলেন। নারী, মা এবং মানুষ, যৌনকর্মী জীবনের এই তিন অধ্যায় নিয়ে গুরুতে এবং অন্য জায়গাতেও অনেক লিখেছি। ডাক্তারবাবুর সদিচ্ছায় ব্যক্তিগত ভাবে এই লড়াইকে খুব কাছ থেকে দেখতে পেরেছি। তাই আমি এই নারীদের অত্যন্ত সমীহ করি। আদ্যন্ত লড়াকু না হলে এইরকম একটি নিষ্ঠুরতম পেশায় টিঁকে থাকা অসম্ভব, আরো অসম্ভব সমমনাদের নিয়ে এইরকম একটি সংগঠনে সামিল হওয়া ও তাকে এইভাবে সফল করে তোলা।
এদের সংগ্রামী জীবনের পাশে এই আতুপুতু, সখী ধরো ধরো মধ্যবিত্ত জীবনকে রাখলে বোঝা যায় কতটা ফাঁকি দিয়ে আমরা কতটা বেশি নিই। বোঝা যায় কেন আমাদের ফেসবুকীয় বিপ্লব গোটাটাই মেকি, আর আমরা এই ফাঁপা মানুষেরা ডঃ স্মরজিত জানার পাহাড়ের মতো ব্যক্তিত্বকে কেন পাওয়ার যোগ্য নই।
খুব মনে পড়ছে হীরার কথা। মুক্তোর মতো তার লেখার ছাঁদ, স্বামীর মৃত্যুর পর রাজনৈতিক নেতা এক আত্মীয়ের লালসার বলি হতে হতে সে ঠিক করে লুটেই যখন নেওয়া হবে, তখন বিনে পয়সায় কেন ! তারপর থেকে তার অধিষ্ঠান সোনাগাছিতে। জীবনে এতো ওলট-পালট হয়ে গেল, কিন্তু ডায়েরি লেখায় তার ছেদ পড়েনি। মনে খুব ইচ্ছে, কেউ বই করে বার করুক তার জীবনের কথা। ভেবেছিলাম ডায়েরিটি জেরক্স করিয়ে নিয়ে আসব। দু এক পাতা উল্টেছি, এমন সময় খবর এলো তার বাঁধা খদ্দের তাকে না পেয়ে চেঁচামেচি করছে। হীরা দৌড়ে চলে গেল ডায়েরিটা আঁচলের তলায় লুকিয়ে। তারপর কোভিডের বাড়বাড়ন্তে আমারই আর যাওয়া হল কই !
আজ হীরাদের আকুল হয়ে কাঁদার দিন। ডঃ স্মরজিত জানা আজ চলে গেছেন।
আপনার তর্পণে মাথা নত করলাম।এতো হৃদয় দিয়ে সমস্ত প্রেক্ষিত গুলিকে দেখেন যে আপনার প্রতিটি লেখার জন্য সতৃষ্ঞ অপেক্ষা থাকে।
অমরকে আর মারবে কে বলো? ডা. স্মরজিত জানার মৃত্যু নাই। "দুর্বারের" স্ফুলিঙ্গ দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ুক।
প্রতিভাদিকে সাধুবাদ, এই গুণিজনকে চিনিয়ে দেওয়ার জন্য।
করোনাক্রান্তির পর গুরুচণ্ডা৯ হয়তো হীরার দিনপঞ্জি থেকে জীবনের গল্প প্রকাশ করবে।
মহামারীতে এতোটাই অনিশ্চিত জীবন! তবু আশানদী প্রবাহমান। ❤️
স্বরজিৎকে চিনি তখন থেকেই তখন ড্রাগ একশান ফোরামের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন স্থানে প্রচার করছে। ওর সারা জীবনের সঞ্চয় বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান। তোমাকে সেলাম।
33 বছরের পরিচয় উৎস মানুষের সূত্রে। স্মরজিৎদার লেখা থেকে বা আলোচনা থেকে অনেক শিখেচি । অনেক পুরোনো কথা মনে পরছে।
33 বছরের পরিচয় উৎস মানুষের সূত্রে। স্মরজিৎদার লেখা থেকে বা আলোচনা থেকে অনেক শিখেচি । অনেক পুরোনো কথা মনে পরছে।
ডা, জানা কে প্রনাম জানাই।
শ্রদ্ধা রইল। সাংবাদিক চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্যের সূত্রে দুর্বার সম্পর্কে কিছুটা জেনেছিলাম।
সোনাগাছির এইচ আই ভি প্রোজেক্ট নিয়ে রেডিওর একটি ফিচার করতে ওই এলাকায় একবার যেতে হয়েছিল, সম্ভবত '৯২ সাল সেটা। দুর্বার কাজ শুরু করেছে তখন। দেখেছিলাম ওখানকার মেয়েরা কী ভীষণ শ্রদ্ধা করে ডাঃ জানাকে। আমাদের অনেকে বলেছিল নিরাপত্তার জন্যে সঙ্গে পুলিশ নিয়ে যেতে, বলেছিল দেহব্যবসায়ে যুক্ত মেয়েরা মিডিয়ার লোকের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলবেও না। ডাঃ জানাকে সেকথা জানাতে কোন মন্তব্য করেননি সেদিন। শুধু বলেছিলেন, "আপনারা আসুন তো।" গিয়ে বুঝেছিলাম, ওঁর নামটাই ওখানে সেরা ছাড়পত্র, সেরা সুরক্ষা।
ক্রমশঃ ক্ষীয়মান শ্রদ্ধেয় মানুষদের একজন ছিলেন ড. জানা। ব্যক্তিগত পরিচয় ছিলো না তাঁর সঙ্গে। এই লেখাটি তাঁকে আরও একবার গুণমুগ্ধদের কাছে নিয়ে এলো। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর কাজ আমাদের সত্যকে চিনিয়েছে। আশা রাখবো, উপযুক্ত উত্তরাধিকারীরা তাঁর স্মৃতিকে উজ্জ্বল রাখবেন। নতজানু নমস্কার রইলো তাঁর প্রতি।
কুর্নিশ জানাই ড.স্মরজিৎ জানা কে।