বইটা পড়তে দিয়েছিল আমার এক বন্ধু। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে তরুণ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত যোগ দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য পরিষেবায়, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এক প্রত্যন্ত গ্রাম বেলপুকুরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সে প্রায় এক নেই-রাজ্যের দেশ। বইটি এক নাছোড় ডাক্তারের গল্প যিনি তাঁর প্রথা বহির্ভুত পন্থায় ভোল পালটে দেবেন সেই নেই-রাজ্যের।
বেলপুকুরের সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হওয়ার কথা ছিল শুধু জ্বর, কাশি, চুলকানির চিকিৎসা তাও সেসবের এমন সব ওষুধ সেখানে মজুত যা কলকাতার হাসপাতালে ততদিনে বাতিলের পর্যায়ে চলে গেছেন। অনিরুদ্ধ বাবু যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছন তখন সেখানকার বিদ্যুৎ সংযোগ পর্যন্ত কাটা গিয়েছে বিল বকেয়া থাকার কারণ যা অনেক চিঠি-চাপাটির পরেও ফেরত আসে নি। এর প্রতিকারের জন্য অনিরুদ্ধবাবু ৮ কিমি দুরের বিদ্যুতকেন্দ্রে গিয়ে বোঝেন নিয়ম মাফিক কাজ করলে বিদ্যুৎ সংযোগ ছ’মাসেও আসবে কিনা সন্দেহ! তিনি ফিরে এসে, একটি স্থানীয় ছেলেকে দিয়ে তিরিশ মিটার তার কিনে আনেন আর সোজা ট্রান্সফর্মারে জুড়ে দেন – চারবছর পরে আলো আসে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। এরপরে আরও এক বছর যায় বিদ্যুৎ দপ্তরের নজরে বিষয়টি আসতে। তারপর লাইন কেটে দেবার হুমকি, ডাক্তারবাবুর পালটা হুমকি কিছুদিন চলার পরে বিদ্যুৎ দপ্তরের বোধদয় হয় আর নিয়মমাফিক বিল আসা শুরু হয়।
এর পর ডাক্তারবাবু যা করলেন তা আরো চমকপ্রদ। সর্দি, কাশির বাতিল ওষুধে চলা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অস্ত্রোপচার শুরু করলেন। কাজটা সহজ ছিল না মোটেই। যন্ত্রপাতির অভাব ছিল, ছিল যোগ্য সহকারীর অভাব, এমনকি একটু জটিল অপারেশনের পরে রোগী রাখার ব্যবস্থাও ছিল না। এই সব সমস্যার সমাধান ডাঃ সেনগুপ্ত করলেন প্রথা বহির্ভুত চিন্তার মাধ্যমে। প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করলেন সুযোগ্য সহকারীর দল যাদের অনেকেই সরকারী কর্মীও নন, স্বেচ্ছাসেবক মাত্র, উদ্ভাবন করলেন নতুন প্রোটোকল, এমনকি স্থানীয় ছুতোরকে দিয়ে বানিয়ে নিলেন অপারেশন করার আলো – বেলপুকুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রমরম করে চলতে লাগল নানান অপারেশন। এই সবের মাঝে নিজের প্রশিক্ষণের দিকটিকেও ক্রমাগত ঘষামাজা করে গেছেন ডাক্তারবাবু। অচেনা অস্ত্রোপচারের আগে কলকাতায় গিয়ে পড়াশুনো করেছেন লাইব্রেরিতে, কথা বলেছেন বন্ধু আর শিক্ষকদের সঙ্গে, এমনকি কিছু কিছু জটিল অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে সঙ্গে রেখেছেন তাঁর স্ত্রীকে যিনি নিজেও একজন চিকিৎসক। মনের জোর, প্রত্যয় আর সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে অসাধ্য সাধনের নানান গল্প ছড়িয়ে আছে বইটির পাতায় পাতায় যা না পড়লে বিশ্বাস করা কঠিন।
প্রায় আট বছর বেলপুকুরে কাটান ডাঃ সেনগুপ্ত, তার পর যোগদান করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাজে, বেলপুকুরের শিক্ষাকে আরো বৃহত্তর বৃত্তে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াসেই হয়ত বা। আমার কাছে বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল শেষ অংশটি যেখানে ডাঃ সেনগুপ্ত তাঁর এই অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার নির্যাসটুকু ভাগ করে নিয়েছেন আমাদের সাথে। বইয়ে বর্ণিত বিভিন্ন অভিজ্ঞতা এক তরুণ, আদর্শবাদী ডাক্তারের ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে। কিন্তু শেষ অংশটিতে এসে যেভাবে তিনি তাঁর বিশেষ অভিজ্ঞতাকে সাধারণ নীতির দিকে নিয়ে গেছেন তা তাঁর চিন্তার গভীরতার পরিচায়ক ।
তিনি যে নীতিগুলি বলেছেন সেগুলো এরকমঃ
১। আমিই মালিক, আমিই করছি এই ভাবনা সকলের মধ্যে জরুরি।
২। স্কুলে কখনো ভুল নয় – চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে মূল নীতিগুলি রোগীকে সুস্থ করে তোলার জন্য জরুরি সেগুলোর সাথে কখনই আপস নয়। অন্যদিকে যেগুলো দেখনদারির জন্য ভালো বা যেগুলোতে আরেকটু সুবিধে হতে পারে সেগুলো বাদ দেওয়া যেতে পারে।
৩। প্রত্যেক কর্মীকে কিছু বেশী দাও – টাকা পয়সা নয়, তার কাজের স্বীকৃতি। প্রত্যেকের মধ্যে এই বিশ্বাস চাড়িয়ে দেওয়া জরুরি যে, সে ওই টিমের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, একজন অধস্তন কর্মচারি মাত্র নয়।
৪। ঝুঁকি নাও কিন্তু তার পেছনে একটা হিসেব থাকতে হবে। যে রোগীকে সীমিত সামর্থে অপারেশন না করে রেফার করলে রাস্তায় মরে যাবে, তার অপারেশন করলে আর কত ক্ষতি হবে? কিন্তু মাথায় রাখতে হবে ঝুঁকি নেওয়া, কিন্তু অবিবেচনা নয়।
৫। এ কোন সমাজসেবা নয় – করছি কারণ করে তৃপ্তি পাচ্ছি।
৬। ‘না, হবে না’ – বলার লোকেদের তাড়াও। কান খোলা রাখো সেই সব বিরূদ্ধ মতের জন্য যার মধ্যে প্রকৃত অসুবিধার কথা আছে, তারপর সেই অসুবিধা দূর করার চেষ্টা কর।
ওপরে বর্ণিত ছটি পয়েন্ট ডাঃ সেনগুপ্ত তাঁর বেলপুকুর পর্বের মূল শিক্ষা (যাকে ইংরিজিতে বলে take away)। আর এখানেই বইটা এক তরুণ ডাক্তারের অসাধ্য সাধনের রোমাঞ্চকর আখ্যানের বেশী হয়ে ওঠে, ভরসা জাগায় আমার এবং আমার মত আরো অনেকের মনে যাঁরা চিকিৎসক নন, কিন্তু সরকারী প্রতিষ্ঠানের নানান লাল ফিতের ফাঁস এড়িয়ে খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে চাইছেন, চাইছেন নতুন কাজের স্বপ্ন দেখতে, হয়ত অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পেরেও যাচ্ছেন কিছুটা। আমাদের সবার গল্প এত নাটকীয় নয় হয়ত, মানুষের জীবন-মরণও নির্ভর করে না সব সময় আমাদের সবার ওপর (আবার করেও, কারণ এই বইয়ের পাঠক তালিকায় চিকিৎসকরাও আছেন নিশ্চয়ই)। কিন্তু আমাদের ছোট, ছোট কাজ সমাজকে এগিয়ে দেয় নিশ্চিত ভাবেই বা আরো সঠিকভাবে বললে আমাদের উন্নত মানুষ করে তোলে।
আমাদের সমাজে সরকারী কর্মীরা সাধারণ ভাবে এবং বিশেষভাবে চিকিৎসকরা নিন্দিত হন। অনেক সময় তার কারণও থাকে। কিন্তু তবুও যে আমাদের দেশটা এখনো মোটের ওপর চলছে তার কারণ অনিরুদ্ধবাবুর মত অনেক, অনেক লোক এখনো নিরলস কাজ করে চলেছেন কোন অতিরিক্ত আর্থিক পুরস্কার ছাড়াই। এই সূত্র ধরেই আরো বড় একটা আলোচনার অবতারণা করা যেতে পারে।
বার্লিনের পাঁচিল যখন ভাঙ্গে তখন আমি স্কুলের ছাত্র। তবু আমার কলেজ জীবনেও কলকাতার মধ্যবিত্ত সমাজে অন্তত সোভিয়েত ব্যবস্থার প্রতি একটা বিশ্বাস বিদ্যমান ছিল, যার মূল কথা মানুষ নয়, প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থাই আসল। তার ওপর আমি অর্থনীতির ছাত্র, যার (অন্তত কলেজে যা পরানো হয়) মূল কথাই হল মানুষের আচার আচরণ সবই আর্থিক পুরস্কার বা ইনসেন্টিভ নির্ভর। প্রথাগত অর্থনীতির সাথে সমাজতান্ত্রিক ভাবনার মূল পার্থক্য হল সেই ইনসেন্টিভের উৎস -- এই ইনসেন্টিভ রাষ্ট্র থেকে আসছে না বাজার থেকে তার ওপর নির্ভর করে ব্যবস্থার ধরণটি কী! কিন্তু মোদ্দা কথাটা একই – মানুষের আগে ব্যবস্থা। কমিউনিজম এলে মানুষের চরিত্র পাল্টাবে এরকম একটা কথা বোধহয় মার্ক্স সাহেবও বলেছেন কিন্তু সেটা ঠিক কিভাবে হবে তা নিয়ে আমরা ছাত্রজীবনে অন্ততঃ খুব নিশ্চিত ছিলাম না। আমি এখনো নিশ্চিত নই, অন্যদের কথা বলতে পারব না। মানুষের নীতিবোধ পরিবর্তনের প্রায়োগিক প্রচেষ্টা হিসেবে বোধ হয় মাও এর সাংস্কৃতিক বিপ্লব কে ধরা যায়, কিন্তু তার ভয়াবহ পরিণামের কথা ভেবেই বোধকরি আমার ছাত্রজীবনে এই নিয়ে খুব আলোচনা শুনি নি। আমি মার্ক্সীয় তত্ত্ব খুব গভীর ভাবে জানি এমন দাবি করা ঠিক হবে না, সেই আলোচনা আমার উদ্দেশ্যও নয়। আমি বলতে চাইছি আমার ছাত্রজীবনে আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল এটাই যে কোন পরিবর্তনের জন্য প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তন দরকার। এই ধারণাটি খুব একটা ভুল নয়। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলাম শুধু ব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠান নয় মানুষের নীতিবোধ সমাজ সংগঠনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে অর্থনীতির জ্ঞানের পরিধি বাড়ার পর দেখলাম অর্থনীতির মূলধারায় এ বিষয়টি স্বীকৃত এবং বহুল আলোচিত একটি ধারণা যদিও সামাজিক নীতিবোধের পরিবর্তন একটি কঠিন ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। সেই পরিবর্তনে প্রযুক্তিগত (যেমন শিল্পবিপ্লব) বা প্রাতিষ্ঠানিক (যেমন ঔপনিবেশিকতা) বড় বড় পরিবর্তনের পাশাপাশি বিভিন্ন মানুষের অভিজ্ঞতা বা ভাবনা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে – ইতিহাসের শিক্ষা এটাই। আজকের সামাজিক নীতিবোধ যখন সারাক্ষণ ভোগ এবং আরো ভোগের শিক্ষা দিচ্ছে, অনিরুদ্ধবাবুর অভিজ্ঞতার আখ্যান তখন তার বিপ্রতীপে একটা প্রতিরোধ তৈরি করে। এই বইটি আমাদের বলতে পারে নিরবিচ্ছিন্ন ভোগের থেকে জীবনে অনেক বেশী পরিপূর্ণতা আনতে পারে স্বপ্ন দেখা এবং তা রূপায়ণের সাহস; যারা এখনও স্বপ্ন দেখেন বইটি তাদের সেই স্বপ্ন দেখার সাহস জোগাতে পারে।
সবশেষে বলি, অনিরুদ্ধ বাবুকে আমি চিনি না। এই বইটি পড়ার আগে তাঁর নামও শুনি নি। তবু অনেক বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহকে বইএর আকার দেওয়ার জন্য তাঁকে অজস্র ধন্যবাদ। সব প্রজন্মের মানুষকে গতানুগতিকের বাইরে অন্যরকম ভাবার সাহস যোগাবে এই বইটি ।
এক গাঁয়ের ডাক্তারের গল্প
ডাঃ অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত
গুরুচন্ডালি প্রকাশনা।
গপ্পো টা আসেনিতো
লেখা কই?
একটু সমস্যা হয়েছে। গল্পটা এক্ষুনি দিতে পারছি না। আসলে গল্পটা একটা কাগুজে পত্রিকায় দিয়েছিলাম। লকডাউনের কারণে দেরি দেখে ভেবেছিলাম তারা হয়তো আর বের করবে না। তাই এখানে দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা জানালো যে পত্রিকাটি একটু দেরিতে হলেও বেরোবে। তাই এখান ন থেকে সরিয়ে দিলাম। খুব ই দু:খিত।
একটা অন্য লেখা লিখছি। সেটা দু একদিনের মধ্যে দিচ্ছি ।
গল্পটা ভালো লাগলো। সার্থকনামা।
@dc এটা সেরা ছিল
নতুন লেখা দিলাম!
অনিরুদ্ধ বাবুর বইটি আমার সংগ্রহে আছে। আমি গল্পগুলি তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করি। আমার ধারণা যারাই পড়বেন তারাই উপভোগ করবেন।
অনির্বাণ বইটির আলোচনা প্রসঙ্গে সামাজিক ব্যবস্থা এবং ব্যক্তি স্বার্থের দ্বন্দের প্রেক্ষাপট অল্প পরিসরে খুুুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছে। বর্তমানে সমাজের ভোগবাদী মানসিকতা থেকে উত্তরণের উপায় হিসাবে অনিরুদ্ধবাবুর প্রথা বহির্ভূত চিন্তাগুলির গুরুত্ব তুলে ধরেছে।
খুবই ভালো লাগলো অনির্বাণের লেখাটা।