এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  সমাজ  বুলবুলভাজা

  • ভিন্নায়ন: খোলা বাজারের পৃথিবীতে গ্রহান্তর

    দেবসত্তম পাল
    আলোচনা | সমাজ | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ৩৭৪১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • বিচ্ছিন্নতা আর অপরীভবন- এ দুইই সমসময়ের পৃথিবীর বৈশিষ্ট্য। তাকে উপলব্ধি করতেই হয়, না-চাইলেও। ক্রিসমাসের ছুটিতে কিশোরবয়স্ক ভারতীয়দের প্যারিস বেড়াতে যেতে দেখলে যদি মনে পড়ে যায় স্কুলবেলার বন্ধুর পড়া ছেড়ে রিক্সাওয়ালা হয়ে যাবার কথা, তখন সংকট ঘনীভূত হতে থাকে। সে সংকট আত্মের। আত্মসংকট থেকেই মানুষের অনুসন্ধান শুরু। এ লেখা অনুসন্ধানের।

    আমি অর্থনীতিবিদ নই, সমাজতাত্ত্বিক-ও না। তাই ফ্রি মার্কেট ইকোনোমি, বা যাকে চলতি বাংলায় বলে “খোলা বাজার অর্থনীতি” - তার সঠিক মূল্যায়ন, বা আমাদের সমাজজীবনে তার কী প্রভাব পড়ে - তা নিয়ে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে যাওয়াটা আমার পক্ষে নিতান্তই ধৃষ্টতা। কাজেই ওই বিষয়ে গবেষণাভিত্তিক আলোচনা, এই লেখার উদ্দেশ্য একেবারেই নয়। বরং আমার গবেষণাজীবনের (অর্থনীতি থেকে অনেক দূরবর্তী একটি বিষয়ে) প্রথমদিকের একটা ছোট্ট অভিজ্ঞতার কথা এই লেখায় বলব। এর বেশ কয়েক বছর পরে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এই অভিজ্ঞতার ফলস্বরূপ আমার মনে যে অদ্ভুত এক আপাত বিভ্রান্তিকর উপলব্ধি হয়েছিল তার সঙ্গে খোলা বাজার অর্থনীতির কী যোগাযোগ। সেই উপলব্ধির কথাই আজ এখানে বলার চেষ্টা করব।

    ছোটবেলায় শুনতাম “বাংলাদেশে বাজার খোলা”। বলা বাহুল্য যে এর মানে তখন বোধগম্য হত না। ভাবতাম যে, এ কী অদ্ভুত কথা! বাজার তো আমাদের-ও খোলাই থাকে, নইলে আর মাছ-মাংস, শাক-সব্জি কেনা হচ্ছে কোত্থেকে? আমার ছোটবেলা কেটেছে উত্তরবঙ্গের এক ছোট মফসসল শহরে। আমাদের বাড়িতে আমরা টেরেস্ট্রিয়াল অ্যান্টেনা দিয়েই বাংলাদেশ টেলিভশন (বিটিভি) ধরতে পারতাম, রংপুরের ট্রান্সমিশন। অবশ্য অ্যান্টেনার মুখ একটু অন্যদিকে ঘোরাতে হতো। বিটিভি-তে প্রচারিত বেশ কিছু ভালো ভালো ইংরেজি অনুষ্ঠান আমাদের খুব প্রিয় ছিল। সেইসব অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে আসতো বিভিন্ন বিজ্ঞাপন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই যে একটা বিজ্ঞাপন খুব মন টানতো সেটা ছিল কোকা-কোলার। স্টপ মোশন পদ্ধতিতে তোলা কিছু অ্যানিমেটেড দৃশ্য: ঘন নীল ঝিলমিল সমুদ্রের বিচ, ঝকমকে সূর্য, বালি, ভলিবল - আর তার সঙ্গে ভীষণ মন টানা একটা গান, তাও কিনা বাংলায়! এখনো মনে আছে সেই গান: 

    “আকাশে তারা জ্বলবে, পাখিরা গাইবেই।
    সবার জীবনে তৃষ্ণা থাকবেই।
    তৃষ্ণা মেটাতে এই তো আসল,
    আনন্দময় সবসময় কোকা-কোলা যে-এ-এ!” 

    ভীষণ ইচ্ছে করত কোকা-কোলা খেতে। মনে হত কোকা-কোলা না খেলে যেন জীবনটাই বৃথা! কিন্তু বাড়ির গুরুজনেরা তখন আমাদের সেই প্রবলতম সাধ ইচ্ছে থাকলেও মেটাতে অপারগ ছিলেন। কারণ, অবশ্যই, আমাদের দেশের বাজার তখন খোলা ছিল না। তার কয়েক বছর পরেই অবশ্য আমরাও কোকা-কোলা পেয়েছি! কোকা-কোলার গোপন রেসিপির সেই রেসিপির নৈসর্গিক স্বাদে রসনাকে আপ্লুত করতে পেরে ধন্য হয়েছি। আর তার সঙ্গেই শুনতে পেয়েছি নচিকেতার সেই অমোঘ বাণী, যা আজ আমাদের দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর নন-পারফর্মিং অ্যাসেট-এর অবস্থা দেখে মনে হয় যেন এক চরম সত্যি:
    “আনন্দ, কী আনন্দ! এসে গেছে কোকা-কোলা/গেছে সব দেনার দায়ে,
    বাকি আছে কাপড় খোলা।”

    তারপর যে ঘটনা আমাকে মার্কিন ধনতন্ত্রচালিত মুক্ত বাজার অর্থনীতির জৌলুষের এক পাহাড়প্রমাণ সুনামির সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো, সেটা ঘটেছিলো এমন একটি দেশে, ভূগোলকে যার অবস্থান আমাদের দেশের ঠিক বিপরীত পৃষ্ঠে। না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়। মেক্সিকো দেশের এক প্রমোদনগরী কানকুন-এ। 

    প্রমোদনগরীই বটে!

    শুধুমাত্র কয়েকটা মানুষের সমুদ্রবেলায় ভ্রমণ, উন্মুক্তদেহে স্নান আর রোদ পোয়ানোর জন্য যে একটা আস্ত শহর বানিয়ে ফেলা যায় - তা কানকুন-এ এসে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। গোটা শহর-জুড়ে শুধু হোটেল আর হোটেল। মাইলের পর মাইল ঝাঁ-চকচকে রাস্তা, আর তার দুপাশে এই হোটেলগুলো। এহেন আন্তর্জাতিক হোটেল চেইন নেই, যারা সেখানে পসরা সাজিয়ে বসেনি। দেশের ইংরেজি দৈনিকগুলোর তৃতীয় পাতার সৌজন্যে অনেকগুলো নামই চিনতে পারলাম। কিছু নামের সঙ্গে মনে পড়লো সেই হোটেল চেইনের “এয়র/এয়রেস”-দের ছবি, যেগুলো সেই তৃতীয় পাতায় দেখেছি।

    সেই হোটেলগুলো যেন হোটেল নয়, এক একটা রাজপ্রাসাদ! গগনচুম্বী! বিশ্বব্যাপী! প্রত্যেকটাতেই অন্তত কয়েক হাজার ঘর হবে, তার মধ্যে কিছু রয়েছে বিশাল বিশাল সুইট, কিছু বা ডুপ্লেক্স, মানে দ্বিতল ঘর। আছে বিলাসবহুল পাঁচটা ঘরের পেন্টহাউস বা অত্যাধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট-এর মতো কন্ডোমিনিয়াম। গ্রাউন্ড ফ্লোরে আছে হরেক রকমের রেস্তোরাঁ, তাতে আছে পৃথিবীর সমস্ত ধরনের খাবারদাবার আর পানীয়। আরো আছে বিরাট ব্যাংকোয়েট হল - যার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা এতটাই যে তার ভেতরে আমাদের একটা প্রমাণ সাইজের তিনতলা বাড়ি এঁটে যায়। যে হোটেলের ভেতরে আমার ঢোকার সৌভাগ্য হয়েছিল, সেখানকার ব্যাংকোয়েট হলের ভেতরের কারুকার্য দেখলে মনে হতো যেন সত্যিই মধ্যযুগের কোনো বিরাট ধনী ইউরোপিয় সম্রাটের প্রাসাদপুরীর ভেতরে এসে পড়েছি। 

    এইরকম এক রাজপ্রাসাদে আসতে পেরেছিলাম আমার গবেষণার সুবাদেই। আমার এই কানকুন-যাত্রা হয়েছিল বিখ্যাত এক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে। কারণ আমার লেখা একটি গবেষণাপত্র এই কনফারেন্সে প্রকাশিত হওয়ার স্বীকৃতি পায়, আর তাই আমায় মেক্সিকো-মুলুকে পাড়ি দিতে হয় সেই গবেষণাপত্রের রেজাল্টগুলো অন্যান্য গবেষকদের সামনে প্রস্তুত করার জন্য। আমি তখন আই.আই.টি. বম্বে-তে
    পিএইচ.ডি.-র প্রথম বর্ষের ছাত্র। মুম্বইয়ে থাকার দরুন তখন আমি গগনচুম্বী অট্টালিকা বা বিলাসবহুল আন্তর্জাতিক কুইজিনের রেস্তোরাঁ - এসব মিলিয়ে ঐশ্বর্যের আস্ফালনের সঙ্গে বেশ পরিচিত। কিছুটা প্রত্যক্ষ, তবে অনেকটাই দূর থেকে আঁচ পেয়ে পেয়ে। কিন্তু কানকুনে এসে ঐশ্বর্যের যে বিস্ফোরণ দেখতে পেলাম, তার কাছে মুম্বইয়ের আস্ফালন বলতে গেলে প্রায় কিছুই না।

    সেখানকার মানুষদের দেখেও কম অবাক হইনি। গোটা শহর-জুড়েই যেন শুধু ভ্রমণকারীদের ভিড়। আর তাঁরা সবাই, যাকে বলে “বিচ-রেডি”। অতি স্বল্পবাস তন্বী, সেরকমই স্বল্পবাস সুঠামদেহী যুবক। তাঁদের দেহে পোশাক থাকুক বা না থাকুক চোখে আঁটা রোদ-চশমা। অধিকাংশ-ই মনে হয় যুক্তরাষ্ট্রনিবাসী, মানে ইংরেজি বলার ধরনে বোঝা যায়, তবে পশ্চিম ইউরোপিয়-ও আছেন, আছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়-ও। তবে শ্বেতাঙ্গ ককেশিয়ান ছাড়াও অন্যান্য চেহারা-র মানুষজনের উচ্চারণে বোঝা যায় তাঁরাও মার্কিনমুলুকনিবাসী। আমার এই সন্দেহ, যে অধিকাংশ ভ্রমণকারীই যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিম ইউরোপিয়, আরো দৃঢ় হলো যখন দেখলাম রাস্তায় রাস্তায় পে-ফোনের বুথগুলিতে ওই দুই জায়গার জন্য আই.এস.ডি. কল-এর রেট-এ বিশাল বিশাল ছাড়ের বিজ্ঞাপন। ভ্রমণকারীদের সবাইকেই ভীষণ সুন্দর দেখতে, এবং সবাই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। ঠিক যেন মনে হয় রূপকথার এক রাজপুরীতে চলে এসেছি; এমনই রাজপুরী যেখানে সবাই রাজপুত্র আর রাজকন্যে! কিছু বয়স্ক, বা প্রৌঢ় মানুষ-ও আছেন। তাঁরাও পাল্লা দিয়ে ফ্যাশনদুরস্ত  হয়ে এসেছেন। 

    তবে এই মানুষগুলোর পোশাক-আশাক বা দেহের বাহ্যিক সৌষ্ঠবের চেয়েও বেশি যেটা নজর কেড়ে নেয় তা হলো তাঁদের কথা বলা এবং আচরণ। সবাই যেন অনবরত কথা বলে চলেছেন একে অপরের সঙ্গে। এবং এমনভাবে হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছেন যেন তাঁরা তাঁদের নিজেদের বাড়িতেই রয়েছেন, ভিনদেশে বেড়াতে এসেছেন এমনটা নয়। যুবকযুবতীরা সর্বসমক্ষে পোশাক পরিবর্তন করতে কুন্ঠিত নয়। সবাই একে অপরের সঙ্গে ভাব আদান প্রদান করে চলেছে অনর্গল, কেউ বলছে সে কোনো আরেকজন মানুষের প্রতি কতটা যৌন আকর্ষণ বোধ করে, কেউ বা বলছে তার বস কতটা খারাপ, কেউ বা জানাচ্ছে সে তার নতুন বইয়ের পাণ্ডুলিপিখানা মোটামুটি শেষ করে এনেছে, এবার শুধু সম্পাদকের উত্তরের অপেক্ষা। কেউ কেউ কথা বলছে কাছে কোন রেস্তোরাঁয় মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো সুশি পাওয়া যায় এই নিয়ে, আবার এক পানীয় বিশারদ বলছেন টেকিলার কত ধরন হয় এবং কোন সময়ে কোন টেকিলা পান করা উচিত তা নিয়ে। সবাই তাঁদের কথা বলতে ব্যস্ত, তাঁদের খুব সাধারণ জীবনটাও যেন এক একটা উপন্যাসের বিষয়বস্তু। এবং সবাই তাঁদের জীবন নিয়েও ব্যস্ত। তাঁরা তাঁদের পেশাদারি জীবনে এগিয়ে যেতে ব্যস্ত, এবং তার সঙ্গে নানান ধরনের ভোগ্যবস্তু আহরণের জন্য ব্যস্ত। মনে হয় যেন তাঁদের কাছে এই আরোহণ ও আহরণ-এ কোনো কুণ্ঠা নেই, বরং এটাই যেন দুনিয়ার নিয়ম।

    কনফারেন্সের চেহারাটা অবশ্য একটু অন্যরকম, তবে খুব বেশি নয়। এখানে যেমন বিচ-রেডি পোশাকে বেশি মানুষ নেই (একেবারে যে নেই তা নয়), ইংরেজি ছাড়া অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষ অনুপাতে একটু বেশি। কিছু ভারতীয় বা উপমহাদেশিয় চেহারার মানুষও দেখলাম, তবে তাঁদের গলায় ঝোলানো ব্যাজ দেখে জানলাম যে তাঁরাও যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রতিনিধি হিসেবেই কনফারেন্সে যোগ দিয়েছেন। তবে অনর্গল কথা বলার এখানেও কোনো ব্যত্যয় দেখতে পেলাম না। সবাই সবার সঙ্গে কথা বলে চলেছেন, দেখে মনে হয় যেন সবাই সবাইকে চেনেন। সবচেয়ে বেশি যেটা চোখে পড়ে তা হল অল্পবয়সী গবেষকেরা আলোচনা করে চলেছে একটু বয়স্ক অধ্যাপকগোছের মানুষদের সঙ্গে। অনেক বড় গবেষক, যাঁদের পেপার পড়েছি, তাঁদের দেখলাম এইসব ছোট ছোট জটলায় মধ্যমণি হয়ে রয়েছেন। কৌতূহলী হয়ে দেখতে গিয়ে শুনতে পেলাম এসব জটলায় সেসব জিনিস নিয়েই আলোচনা চলছে যেগুলো নিয়ে আমরাও আই.আই.টি.-তে পড়াশুনো করি। খুব অবাক হলাম এই দেখে যে, যে সব তত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা ভাবি যে “এইসব তাত্ত্বিক কাজ করে আর কী হবে? মানুষের কি কিছু উন্নতি হবে এতে?” - সেইসব তত্ত্ব নিয়েই  বিশ্বের গবেষকরা এমন গুরুগম্ভীর আলোচনায় বসে যাচ্ছেন! তরুণ-তরুণী গবেষকদের উৎসাহ দেখে একেবারেই মনে হচ্ছে না যে তারা আমার মতো এইসব বিষয়ের আপাত অব্যবহার্যতা নিয়ে এতটুকুও বিব্রত। অল্পবয়সী গবেষকরা জেনে নিচ্ছে এই বিষয়গুলির মধ্যে কোনটার ওপর কীভাবে গবেষণা করার প্রস্তাবে সরকারি বা বেসরকারি অনুদান সহজে পাওয়া যায়। আবার প্রতিষ্ঠিত গবেষকরা সন্তর্পণে নিজেদের গবেষণার আইডিয়া গুছিয়ে নিচ্ছেন, খুব মাপজোক করে খোলসা করছেন সেইসব আইডিয়া, পাছে বড়সড়ো অনুদান বেহাত হয়ে যায়! 

    এই কনফারেন্সগুলোতে একটা ব্যাংকোয়েটের আয়োজন করা হয়। কনফারেন্সের রেজিস্ট্রেশন ফির মধ্যে এই ব্যাংকোয়েটের মাশুলও ধরা থাকে। সেই ব্যাংকোয়েটে এমন অঢেল খাদ্য পানীয়ের আয়োজন দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। অবাক হয়েছিলাম এই দেখেও যে প্রায় সমস্ত অংশগ্রহণকারীই প্রয়োজনে কী দারুন ফ্যাশনদুরস্ত হতে পারে। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বেশ কয়েকজন আমেরিকাবাসী আমারই  সমবয়সী তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে এক টেবিলে খেতে বসার। তাদের বিভিন্ন আলোচনা আমিও শুনতে পাচ্ছিলাম। এখানেও উপলব্ধি করেছিলাম যে কেউই চুপচাপ বসে নেই, সবাই অনর্গল কথা বলে চলেছে। আমাদের টেবিলের একজন বলছে তার বাবা তাকে বলে দিয়েছেন “গো ইজি অন দ্য বুজ, ড্যুড।” আরেকজন বলছে যে এই ডেমোক্র্যাটরা ভাতা দিয়ে দিয়ে দেশটাকে গরিব বানিয়ে ছাড়বে। তো আরেকজন বলছে রিপাব্লিকানদের ফরেন পলিসি একদম প্রশ্নাতীত নয়। কেউ বলছে, স্ট্যাটিসটিক্স অনুসারে এরোপ্লেনে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা হয় টেক অফ আর ল্যান্ডিংয়ের সময়ে, তাই অটোপাইলট আসলে মানুষ পাইলটের চেয়ে বেশি পটু, তাই ফ্লাইটগুলো পুরোপুরি মেশিন দিয়ে চালানোই উচিত। সেই শুনে কেউ বা হেসে গড়িয়ে পড়ছে, আবার কেউ বা প্রতিবাদ করে উঠছে। কেউ জানাচ্ছে এই কানকুন-এ আসার পথে তার নাকি কোন এক টেক কোম্পানি-র সি.ই.ও.-র সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিলো, সে ওই সি.ও.কে বলেছে যে তাঁর কোম্পানি এই এই ডিসিশনগুলো খুব ভুল নিয়েছে, একজন শেয়ারহোল্ডার হিসেবে তার জবাবদিহি চাইবার অধিকার আছে। কারও এক স্কুলের বন্ধু চাকরি ছেড়ে দিয়ে সাইকেল নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়েছে, তাকে স্পনসর করছে এক বিখ্যাত সাইকেল তৈরির কোম্পানি আর তার ভ্রমণকাহিনী ও আনুষঙ্গিক ছবি কোন ম্যাগাজিন কোম্পানি কিনবে বলেছে, ইত্যাদি।

    এ যেন এক অদ্ভুত স্বপ্নের জায়গা! যতই টিভিতে বা সিনেমায় দেখি না কেন, চাক্ষুষ না দেখলে বিশ্বাস হয় না এরকম জায়গা পৃথিবীতে আছে। যেখানে সমস্ত পরিকাঠামো ভীষণ রকমের ভালো, আর মানুষজন ভীষণ রকমের ব্যক্তিস্বাধীন। এরকম একটা জায়গায় আসতে পেরে, একে চাক্ষুষ করতে পেরে আমার ধন্য হওয়ার কথা ছিল, আপ্লুত হওয়ার কথা ছিল। দেশে ফিরে এইসব গল্প করে, ছবি দেখিয়ে খুব বারফাট্টাই মারার কথা ছিল। কিন্তু সেসব কিছুই হল না। উল্টে এক অদ্ভুত বিষাদ যেন আমায় ঘিরে ধরে ছিল। আমার এই উপলব্ধির কথাই এই লেখার শুরুতে বলেছি। 

    তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। এই বছরগুলিতে আমি বহুবার বোঝার চেষ্টা করেছি যে আমার কেন এরকম বিপরীত মনের অবস্থা হয়েছিল। অনেক ভেবেও আমি এর কোনো সদুত্তর পাইনি। কিন্তু, এই অল্প কিছুদিন আগে হঠাৎই চোখে পড়লো খুব বড়মাপের একজন বিদেশি লেখকের একটি লেখায়, যা পড়ে আমি একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! মনে হল যেন আমার সে সময়কার মনের কথা ঠিক অন্তর্যামীর মতো লেখক বুঝে নিয়ে অসামান্য পটুতার সঙ্গে তাঁর লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন। লেখাটা বরং আমি উদ্ধৃতই করি এখানে। লেখকের নামটা এখন বলছি না, একটু পরে আমি সেটা বলবো।

    “You become aware of a colossal idea; you sense that here something has been achieved, that here there is victory and triumph. You even begin vaguely to fear something. However independent you may be, for some reason you become terrified. ‘For isn’t this the achievement of perfection?’ you think. ‘Isn’t this the ultimate?’ Could this in fact be the ‘one fold?’ Must you accept this as the final truth and forever hold your peace? It is all so solemn, triumphant, and proud that you gasp for your breath”

    এক ভীমসেনী কল্পনার মাধ্যমে এখানে এমন কিছু অর্জন করা হয়েছে যা বিজয়েরই শামিল। এই অর্জিত নিখুঁত উৎকর্ষ এমন-ই যা দেখে অবাক হতে হয়, আবার তারই সঙ্গে একটা ভয় যেন গ্রাস করে। মানবসমাজের এই অর্জিত পরিপূর্ণতা দেখে যেন শ্বাসরোধ হয়ে যায়।

    কিন্তু কেন? কিসের জন্য এই শ্বাসরোধকারী ভয়?

    প্রথম বিশ্বে অর্জিত ব্যক্তিজীবনের এই পরিপূর্ণতা, এবং ভোগ্বিলাসিতার এই প্রাচুর্য কীভাবে সম্ভব হল? এর উত্তর হিসেবে যেটা আমরা প্রায়শই শুনে থাকি তা এইরকম: এসব তো সেই এক কল্পনার-ই ফসল যার নাম খোলা বাজার অর্থনীতি, তাই না? তাহলে বরং আসুন আমরা একটু সেই চিন্তাটাকেই খতিয়ে দেখে নিই যার ফলস্বরূপ আমরা অনেকেই আজ মেনে নিই যে, হ্যাঁ, খোলা বাজার অর্থনীতির ফলেই এই অত্যাশ্চর্য কাণ্ড সম্ভব হয়েছে। ধনতন্ত্র আর খোলা বাজার অর্থনীতির অন্যতম মূল ধারণা হলো এই যে, প্রত্যেক মানুষ সর্বক্ষণ চেষ্টা চালিয়ে যাবে যাতে আরো ধন-সম্পত্তি অর্জন করা যায়, যাতে সেই অর্জিত সম্পত্তি আবার নিবেশ করে ধন-সম্পত্তি আরো বাড়িয়ে নেওয়া যায়, এবং তার সঙ্গে সবাই সবসময় চাইবে যে উপরিটুকু দিয়ে যেন আরো আরো ভোগ্যবস্তু (বা আজকের দিনে ভোগ্য অভিজ্ঞতা) আহরণ করা যায়। প্রত্যেক মানুষ যদি এইভাবে এগিয়ে যেতে চায়, তাহলে ফলস্বরূপ সমস্ত সমাজ এগিয়ে যাবে এক চরমতম কল্পসমাজে যেখানে সবাই ধনী, সবাই রাজা! 

    কেমন অদ্ভুত লাগছে না ব্যাপারটা? সবাই মিলে কী করে একসঙ্গে বড়লোক হয়ে যেতে পারে? কেউ যদি মুনাফা করে, তাহলে লাভ-ক্ষতির নিয়ম মেনে কাউকে নিশ্চয়ই লোকসানের ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে, তাই না? কিন্তু, মজার কথা হলো ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়। একটু তলিয়ে দেখা যাক। 

    ধরুন এক কল্পিত পৃথিবীতে আমি একজন চাকুরিজীবী। আমি ব্যাঙ্কে হাজার টাকা গচ্ছিত রেখেছি। আমার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে অপিরিচিত শ্রীযুক্ত রাতুলবাবু রান্নাবান্নায় ভীষণ পারদর্শী। তাঁর স্বপ্ন একটা রেস্তোরাঁ খোলার, কিন্তু, দুঃখের বিষয়, তাঁর কাছে প্রয়োজনীয় মূলধন নেই। তাই তিনি সেই ব্যাঙ্ক, যেখানে আমি আমার হাজার টাকা গচ্ছিত রেখেছি, সেই ব্যাঙ্ক থেকে হাজার টাকা ধার নিলেন, এই শর্তে যে এক বছর পর রাতুলবাবু সুদাসলে দুহাজার টাকা ব্যাঙ্ককে ফেরত দেবেন। ব্যাঙ্কের নিয়ম হলো সেই দুহাজার টাকা থেকে নিজে পাঁচশো টাকা রেখে আমাকে আমার হাজার টাকা ফেরত দেওয়া এবং তার সঙ্গে সুদ হিসেবে পাঁচশো টাকা দেওয়া। এই পাঁচশো টাকা সুদের আশ্বাস পেয়ে আমি আবার কী করলাম? না আমি ব্যাঙ্কে আরো পাঁচশো টাকা রেখে দিলাম। ব্যাঙ্কে তাহলে থাকলো আমার অ্যাকাউন্টে দুহাজার টাকা। ব্যাঙ্ক আবার সেই টাকার জোরে ইসমাইলবাবুকে ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান খোলার জন্য ঋণ দিলো দুহাজার টাকা, শর্ত যে এক বছর পর ইসমাইলবাবু সুদাসলে চার হাজার টাকা ব্যাঙ্ককে ফেরত দেবেন। নিয়ম অনুযায়ী ব্যাঙ্ক নেবে হাজার টাকা, আর আমি ফেরত পাবো তিন হাজার টাকা। এবার আসুন হিসেব করি, কার কাছে কত টাকা থাকল। রাতুলবাবু আর ইসমাইলবাবু মোট কত লাভ করলেন সেই হিসেবে যাচ্ছি না, শুধু ধরে নিই যে তাঁরা তাঁদের শর্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। তাহলে ব্যাঙ্ক মোট পেলো দেড় হাজার টাকা, আর আমার অ্যাকাউন্টে তিন হাজার টাকা। তাহলে মোট সাড়ে চার হাজার টাকা। অথচ ব্যাঙ্কে যে টাকা সশরীরে গচ্ছিত থাকল এই পুরো ব্যাপারটা চলাকালীন, তা কিন্তু মোটে দেড় হাজার টাকা। শুধুমাত্র রাতুলবাবু আর ইসমাইলবাবুর কর্মক্ষমতার জোরে এবং ব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় আমি প্রায় কিছু না করেই দেড় হাজার টাকা আয় করে ফেললাম! ব্যাঙ্ক-ও আয় করলো দেড় হাজার টাকা!

    এই যে শরীরী দেড় হাজার টাকা থেকে অশরীরী তিন হাজার টাকা জন্ম নিল, এই ভেলকির নামই বাজার। 

    বুঝতেই পারছেন যে পৃথিবীর বাজারটা এই কল্পিত বাজারের যে গল্পটা আমরা শুনলাম তার থেকে কয়েক কোটি গুন জটিল, তবে মোটের ওপর ব্যাপারটা অনুরূপ। অবশ্যই নিবেশের ধরনধারণে অনেক রকমফের আছে - যেমন লগ্নি হতে পারে ব্যাঙ্কের মারফত, বা মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে, বা আবার হতে পারে সরাসরি স্টক মার্কেটে। তারওপর সুদের যেরকম চড়া হারের কথা গল্পে দেখলাম, বাস্তবে তা অনেকটাই কম, তবে মাথায় রাখতে হবে যে নিবেশকারীর সংখ্যাও বাস্তবে অনেক অনেক বেশি। এই যে নিবেশকারীদের এবং উদ্যোগীদের যুগপৎ মুনাফা যেখানে সবাই অংশীদার, অর্থাৎ, একজনের ভাগে কেকের বড় টুকরো অন্যকে কম দিয়ে নয়, বরং সবারই ভাগে বড় টুকরো কারণ কেকটাই যেন বড় হয়ে গিয়েছে - অর্থনীতির পরিভাষায় এরই নাম “গ্রোথ”।

    স্টক মার্কেটের মাধ্যমে সমস্ত উদ্যোগের বিকেন্দ্রীকরণ শুরু হয় হল্যান্ডে, সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে। একে একে ওলন্দাজদের পথ অনুসরণ করে ইংরেজ এবং ফরাসিরাও। এর ফলে পৃথিবীতে বাণিজ্যিক এবং ঔপনিবেশিক শক্তির এক আমূল স্থানান্তরণ লক্ষ্য করা যায়। এর আগে পর্যন্ত বিশ্বের বাণিজ্য - সে মশলাপাতি থেকে শুরু করে ক্রীতদাস পর্যন্ত -  দাপিয়ে বেড়াতো স্প্যানিশ ও পর্তুগীজরা। কিন্তু এই সমস্ত উদ্যোগ চালনা করার জন্য উদ্যোগীদের মুখ চেয়ে থাকতে হতো স্পেন ও পর্তুগালের সম্রাটদের ওপর, মানে রাজকোষের ওপর। তাই সমস্ত উদ্যোগের শুরু হওয়া-নাহওয়া নির্ভর করতো সম্রাট/সম্রাজ্ঞী বা তাঁদের মন্ত্রী-আমলাদের মর্জির ওপর। অন্যদিকে রাজকোষের ধনসম্পত্তি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও সম্রাট/সাম্রাজ্ঞীরা অত্যন্ত বেশি সতর্ক থাকতেন, পাছে  কষ্টার্জিত রাজস্ব ভুল উদ্যোগের পেছনে ঢেলে গচ্ছা যায়, তাহলে বিলাসব্যসন হবে কী করে! স্টক মার্কেট আসায় যখন এই মূলধনের উৎস রাজকোষ থেকে সরে এসে জনসাধারণের হাতে চলে এলো, তখন উদ্যোগীরা যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। উদ্যোগের সূচনা আর কোনো ব্যক্তির (অর্থাৎ, সম্রাটের/সম্রাজ্ঞীর) মর্জির অধীন থাকলো না। তার ওপর লগ্নি যেহেতু অনেক মানুষের, তাই লোকসানও অনেকের ওপর বন্টিত, ফলে লোকসানের মাথাপিছু পরিমাণ কম। তাই উদ্যোগীরা অনেক স্বাধীনভাবে ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগে অগ্রসর হতে পারলেন। 

    এই বিকেন্দ্রীকরণ পৃথিবীর ইতিহাসে এক আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছিলো। ফরাসি বিপ্লব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনতার ঘোষণা, ইংরেজ-ফরাসি-ওলন্দাজদের ঔপনিবেশিক শক্তির অকল্পনীয় বিস্তার - এইসব কিছুরই পেছনে রয়েছে বাজারের উদ্ভাবন। 

    একটু আগে যে উদ্ধৃতিটা আমরা দেখেছি তার লেখক হলেন রাশিয়ার সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ফিয়োদর দস্তয়েভস্কি। ১৮৫১ সালে লন্ডনে এক বিরাট প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় পশ্চিম ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের মাহাত্ম্য উদযাপন উপলক্ষ্যে। প্রদর্শনীটি হয়েছিল “ক্রিস্টাল প্যালেস” নামে এক সুবিশাল অট্টালিকায় (৯,৯০,০০০ বর্গফুট জুড়ে বিস্তৃত; মানে প্রায় এক হাজারটা প্রমাণ সাইজের দুই বিএইচকে ফ্ল্যাটের সমান জায়গা)। এহেন কর্মকাণ্ড দেখে দস্তয়েভস্কির কী মনোভাব হয়েছিল তা-ই তিনি ব্যক্ত করেছেন উদ্ধৃত লেখাটিতে। কিন্তু, কোন ভয়ের কথা বলছিলেন তিনি?

    দস্তয়েভস্কির কথা অনুসারেই, সমাজজীবনের এই উৎকর্ষ যেন সম্ভব হয়েছে মানুষেরই চেষ্টায়, মানুষেরই কল্পিত এক অর্থব্যবস্থার মাধ্যমে। অথচ এই সামান্য কল্পনার প্রভাবের ধাক্কাটা যখন আমরা প্রথম বিশ্বের কোনো দেশে দেখি, তা আমাদের এক্কেবারে নাড়িয়ে দেয়! এ তো মিশরের পিরামিড বা আগ্রার তাজমহল নয়, যার সৃষ্টির রহস্য সময়ের কুয়াশায় ঢেকে গেছে, এতো আমাদেরই সমসাময়িক, আমাদের মতো মানুষেরই সৃষ্টি। এই চিন্তা আমাদের বিস্মিত করে দেয়। সেই বিস্ময়ের রেশ আরো হাজার গুণ বেড়ে গিয়ে আমাদের যেন ভয় পাইয়ে দেয় - যখন আমরা ভাবতে বাধ্য হই যে, আমরা যারা সেই নিয়ম অনুসরণ করেও সেই পরিপূর্ণতার ধারেকাছেও পৌঁছুতে পারলাম না, তাদের কোথায় ভুল হলো? এ যেন এক জটিল ধাঁধাঁ যার উত্তর আমরা জেনে তো গেছি, কিন্তু সেই উত্তর আমরা নিজেরা অঙ্ক ক’ষে কিছুতেই পাচ্ছি না! একটু আগেই আমরা দেখেছি যে খোলা বাজার অর্থনীতিতে কীভাবে এক ভোজবাজিতে সবার ধনসম্পত্তি বেড়ে চলার কথা। একটা ব্যাপার, যা তখন আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ভাবিনি তা হলো: আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে রাতুল আর ইসমাইল তাঁদের শর্তপালন করেছিলেন। কিন্তু এই ধারণা কি সবসময় সত্যি? যে ব্যাপারটার ওপর এই ঘটনাটা হওয়া না-হওয়া নির্ভর করছে তা হলো এই, যে মানুষকে “রাতুলের রেস্তোরাঁ”য় খেতে থাকতে হবে, আর “ইসমাইলের ইলেকট্রনিক্স”-এ কেনাকাটা করতে থাকতে হবে, যত বেশি বেশি করে সম্ভব তত। এতেই রাতুল-ইসমাইলের লাভ, এতেই ব্যাঙ্কের ও নিবেশকারীর আয়, এতেই বাজারের স্বাস্থ্য। আর এই কারণেই দরকার যে সবাই নিবেশ করতে থাকুক বেশি বেশি করে, এবং তার সঙ্গে সবাই ভোগ্য পণ্য, ভোগ্য অভিজ্ঞতা আহরণ করতে থাকুক বেশি বেশি করে। শুধু তাই নয়, উদ্যোগীরাও একে ওপরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়ে আসতে থাকুন, যাতে কখনোই তাঁদের গ্রাহকের অভাব না হয়, এবং গ্রাহক যেন কখনোই না ভাবে যে, ‘নাঃ, অনেক হয়েছে, এবার আমার আর কেনাকাটার প্রয়োজন নেই, যা আহরণ করেছি আমি তাতেই সন্তুষ্ট।’

    এ যেন এক দৌড় যাতে প্রতিযোগী সবাই। আর লোকেরা দৌড়োচ্ছে বলেই আর সবাই তাদের দৌড়ের রশদ পাচ্ছে। মজার কথা হল, সবাই মিলে প্রতিযোগিতায় শামিল হলেও অঙ্কের এক আশ্চর্য হিসেবে দেখানো যায় যে অর্থনীতি এক সাম্যাবস্থা মেনে চলবে। উনবিংশ শতাব্দীর প্রবাদপ্রতিম দার্শনিক অ্যাডাম স্মিথ, যাঁকে খোলা বাজার অর্থনীতির জনক বলা হয়, এই আপাত অবিশ্বাস্য সাম্যাবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, যেন এক "অদৃশ্য হাত" বাজার অর্থনীতির রাশ ধরে রেখেছে। কিন্তু, প্রশ্ন হলো: যারা এই দৌড়ে পিছিয়ে পড়লো, তাদের কী হবে? যারা একবার পিছিয়ে পড়লো, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম তো এই দৌড় শুরুই  করলো অনেক পেছন থেকে। যারা রাজপুত্র-রাজকন্যে আর যারা কোটালপুত্র-কোটালকন্যে তারা নিশ্চয়ই এক জায়গা থেকে দৌড় শুরু করছে না! যারা এই আজন্ম অসম প্রতিযোগিতায় অংশ নিলো তাদের কী হবে? আমার সেই কনফারেন্স-এ দেখা নব্যগবেষকদের সর্বক্ষণ হোমড়াচোমড়াদের সঙ্গে আলোচনা করে যাওয়া থেকে শুরু করে কানকুনে ছুটি কাটিয়ে পরেরবার ছুটিতে প্যারিস যাওয়ার প্ল্যান, এবং সেই প্ল্যান সফল করার জন্য পেশাদার জীবনে আরো এগিয়ে যাওয়া - এসবই কি এই সর্বব্যাপী দৌড়ের উদাহরণ নয়?

    আবার সহ-প্রতিযোগীদের মতো হয়ে ওঠার বা তাদেরকে হুবহু অনুকরণের চেষ্টাও কি এই দৌড়েই টিকে থাকার জন্য এক অদম্য ইচ্ছের ফলস্বরূপ নয়? যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী, তাঁদের মার্কিন বাচনভঙ্গিতে ইংরেজি বলার দুর্দম্য চেষ্টা, বা কোন বছর কোন ওয়াইন-এর স্বাদ একটু কষাটে হয়ে গিয়েছিলো কারণ সেবার কর্মীরা স্ট্রাইক করায় সোভিনিয়ঁ আঙুরগুলো তুলতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো, এই তথ্য স্মরণ করে রেখে কোনো আসরে সময়মতো জানিয়ে দেওয়া - এও কি সেই দৌড়ে টিকে থাকার ইচ্ছেরই বহিঃপ্রকাশ নয়? কিন্তু এখানেও সেই আমরা যারা টিকে থাকতে পারলাম না, তারা কী করবো? 

    কানকুন যাত্রার অনেক বছর পরে একবার ক্রিসমাসের সময় নিউ ইয়র্কে ছিলাম। সেখানে দেখেছিলাম প্রচুর সংখ্যক তরুণ তরুণী স্যান্টা সেজে হৈ-হৈ  করতে করতে রেস্তোরাঁ বা ক্লাব-এর দিকে নাচতে নাচতে যাচ্ছে! সেই চরম ঠান্ডায় যখন বরফ পড়ছে, তার-ই মধ্যে প্রায় সমস্ত তরুণী স্যান্টাদের পোশাক যা ছিল তাতে কলকাতাতেও ঠান্ডা লাগবে, নিউ ইয়র্কে যেখানে বরফ পড়ছে সেখানে তো কথাই নেই। এই যে দৈহিক কষ্ট সহ্য করেও নিজেকে আকর্ষণীয় করে রাখতে চাওয়ার চেষ্টা, কারণ না করলে অন্য কেউ কোনো এক অজ্ঞাত খেলায় অগ্রাধিকার পেয়ে যাবে - এও কি সেই দৌড়েই টিকে থাকার ইচ্ছের আরেক চেহারা নয়? সেবার সেখানেই দেখেছিলাম এক তরুণী স্যান্টা রাস্তার ধারে বসে কাঁপা কাঁপা হাতে সিগারেট ধরে আছে আর হাউ হাউ করে অঝোরে কেঁদে চলেছে। অ্যাডাম স্মিথ সাহেবের “অদৃশ্য হাত” কি এই পিছিয়ে পড়াদের  সান্ত্বনা দিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদ দেয়? মাথায় হাত বুলিয়ে বলে দেয় কি যে, “ঠিক আছে, এরকম তো হতেই পারে”?

    আর এই পিছিয়ে যাওয়া কি শুধুই ব্যক্তি হিসেবে? যে দেশটাই কয়েক শতক পিছিয়ে থাকলো, তার বেলায় কি সেই এক-ই ফর্মুলা কাজ করবে? কানকুন-এ কনফারেন্সে ব্যাংকোয়েট টেবিলে উঠে এসেছিল একজনের স্কুলের বন্ধুর কথা, যে কিনা চাকরি ছেড়ে সাইকেল চেপে বিশ্বভ্রমণকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। মনে পড়লো আমার এক স্কুলের বন্ধুও সাইক্লিং-কে পেশা বানিয়ে নিয়েছিল। একটাই তফাৎ, কানকুনের বন্ধুর ছিল শুধু সাইকেল, সামনে গোটা বিশ্ব‌; আর আমার বন্ধুর ক্ষেত্রে সেটা সাইকেল রিক্সা, তার চেনা শহরের গণ্ডিতে আবদ্ধ। আর আমার বন্ধুকে চাকরি ছাড়তে হয়নি, তার অনেক আগেই, ক্লাস নাইন-এ পড়ার সময়েই সে পড়া ছেড়ে দিয়ে রিক্সা চালানো শুরু করে।

    ভাবছেন হয়তো এই পিছিয়ে পড়ার গল্পটা নিয়ে মিছেই আমি এতো কাঁদুনি গাইছি। হতেই পারে। তবে আমি এ ব্যাপারে প্রথম নই। আমার অনেক আগেই এই পিছিয়ে পড়ার কাহিনী নিয়ে তত্ত্ব আলোচনা করে গেছেন এক সময়ের বিরাট চিন্তাবিদরা। এর একটা ভারী সুন্দর নাম-ও আছে, জার্মান ভাষায়: “এন্টফ্রেমদুং”। ইংরেজিতে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় “এলিয়েনেশন”। মানে এক সমাজে থেকেও যেন এক ভিনগ্রহী হয়ে যাওয়া। বাংলায় এর সঠিক তর্জমা কী হয় আমি জানি না। ধরা যাক, আমরা বোঝার সুবিধার্থে বলছি “ভিন্নায়ন”। 

    “ভিন্নায়ন”-এর ধারণার উৎপত্তি যে জার্মানিতে তা কিন্তু নিছক কাকতালীয় নয়। উগ্র জাতীয়তাবাদে অন্ধ হয়ে জার্মানরা বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যে নির্মম হত্যা- ও ধ্বংসলীলায় মেতেছিল, তার পেছনে অন্যত‌ম কারণ হিসেবে মনে করা হয় একধরনের ভিন্নায়নজনিত সর্বগ্রাসী ক্ষোভ। আর এই ভিন্নায়নের জন্ম হয়েছিল ধনতন্ত্র-ঔপনিবেশিকতা-সাম্রাজ্যবাদ-এর ট্রায়াথ্লনে ইংরেজ-ফরাসি-ওলন্দাজ-দের থেকে জার্মানদের পিছিয়ে পড়ার ফলে। 

    এখন বুঝতে পারি যে সেবার কানকুনে গিয়ে আমি এই ভিন্নায়নেরই জালে পড়েছিলাম। সেখানে সবই আছে, একেবারে দস্তুরমতো, ঝাঁ-চকচকে, কিন্তু, আমি যেন থেকেও নেই। আমি যেন সব পেতে চাই, কিন্তু কোথায় যেন বাধে। আমার একইরকম পোশাক-পরিচ্ছদ, একই বুলি, একই পড়াশুনো, একই গবেষণা - তবুও আমি আর সবার থেকে দূরে, আর সবার থেকে ভিন্ন। দস্তয়েভস্কির লেখায় যেন এক ভিন্নায়িত মানুষেরই মনের গোপন
    অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা ভয়মিশ্রিত বিস্ময়বিষাদের অনুরণন ধরা পড়ে।

    আশ্চর্যের কথা এই যে, এই ভিন্নায়নের আরেক রূপ দেখতে পেয়েছিলাম সেই যাত্রায়ই, ফেরার পথে। মেক্সিকো থেকে মুম্বাই আসার পথে প্যারিস-এর শার্ল দ্য গল্ এয়ারপোর্টে কয়েক ঘন্টার লে-ওভার ছিল। মুম্বাইমুখী ফ্লাইট-এর অপেক্ষায় যখন বোর্ডিং গেটের সামনে বসে আছি তখন আবিষ্কার করলাম একদল কিশোর-কিশোরীকে। ভারতীয়। তারাও মুম্বাই ফিরছে। তাদের বয়স পনেরো-ষোলো হবে, কি বড়জোর সতেরো। তাদের কথাবার্তায় বুঝলাম তারা ক্রিসমাসের ছুটিতে বন্ধুরা মিলে প্যারিস বেড়াতে এসেছে। মনে পড়ল আমরা স্কুলের বন্ধুরা মিলে, অবশ্যই দু'জন মাস্টারমশাইয়ের তত্ত্বাবধানে, উত্তরবঙ্গের এক জঙ্গলে গিয়েছিলাম এক্সকারশন-এ (এখন বলে ফিল্ড ট্রিপ), যা কিনা আমাদের শহর থেকে গাড়িতে আধ ঘন্টার পথ। কখনো বা গিয়েছি কাছাকাছি পাহাড়ের নিচে কোনো নদীর চর বা ঝর্ণার ধারে পিকনিক করতে। কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি স্কুলের বন্ধুরা মিলে প্যারিস ঘুরতে যাওয়া যায়। এখন বুঝি আমাদের নিজেদের দেশেও আমরা অনেকেই অনেকের থেকে অনেকটাই ভিন্নায়িত।



    ছবি- উইকিমিডিয়া কমন্স
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ৩৭৪১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Kubir Majhi | 203.96.***.*** | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:২৩102743


  • অসাধারণ ভাল লেখা। লেখককে শ্রদ্ধা।

  • Kubir Majhi | 203.96.***.*** | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:২৩102742


  • অসাধারণ ভাল লেখা। লেখককে শ্রদ্ধা।

  • সুমন | 103.39.***.*** | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২৩:৪৪102750
  • অসাধারন। বেশি ভালো বললে আবার আপনার পছন্দ হবে না। এটুকু থাক। 

  • শান্তনু দত্ত। | 43.255.***.*** | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৮:৩৪103002
  • দেবসত্তম, তোমার লেখা একজন সর্বোচ্চ মানের মননশীল মানুষের পর্যবেক্ষণকে মনে করাল।তোমার কাছ থেকে এ রকম অনেক লেখার প্রত‍্যাাশা থাকল।সকালটা আনন্দময় করে দিলে।অনেক শুভকামনা।ভালো থেকো।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:

Crisis of Human, Capitalism, Capitalism Crisis, Religion of Man, Otherisation, Alienation, Filthy Rich, Rich Versus Poor, Greed of Human
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে প্রতিক্রিয়া দিন