চেরি টম্যাটো গাছগুলোর দিকে চোখ পড়তেই দেখি কয়েকটা হলুদ রঙের টম্যাটো ফুলের ডগায় কচি সবুজ টম্যাটো উঁকি দিচ্ছে। কতক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে আছি জানি না হঠাৎ গালে একটা কনকনে ঠান্ডা নরম পালকের মতো কীসের যেন ছোঁয়া পেয়ে সম্বিৎ ফিরল। দেখি পেঁজাতুলোর রোঁয়ার মতো তুষারকণা উড়ে বেড়াচ্ছে বাতাসে, যেন কোন্ অদৃশ্য ধুনুরি তুলো ধুনছে শীতের নতুন লেপ বানাবে বলে। এই মরসুমের প্রথম স্নো-ফল। চারপাশটা কেমন ধূসর আবছা হয়ে গিয়েছে। অমনি কোথা থেকে একগাদা মনখারাপ দলা পাকিয়ে উঠে আসতে থাকল বুক থেকে গলা পর্যন্ত। আর কী আশ্চর্য, অমনি যেন ওই হলুদ ফুলে উঁকি দেওয়া ও সবুজ চেরি টম্যাটোর মতো মনের মধ্যে কে যেন বলে উঠল—খিচুড়ি-ই-ই-ই!
ম্যাকিনি। কলিনকাউন্টি। টেক্সাস। মার্কিনমুলুক। দাঁড়িয়ে আছি বাড়ির বারান্দায়।
দিনের শুরুটা হয়েছিল আর পাঁচটা দিনের মতোই। নিজের শহর, মা-বাবা, আত্মীয়, বন্ধুদের থেকে অনেক দূরে ভিনদেশে আরও একটা দিন। রোজকার গতানুগতিক জীবনে বেঁচে থাকার জন্য সবাইকেই কিছু না কিছু রসদ খুঁজে নিতে হয়। কলকাতায় তেমন রসদ প্রচুর। এই যেমন কোনো বৃষ্টিভেজা বিকেলবেলায় ইচ্ছে হতে পারে লক্ষীনারায়ণ সাউয়ের তেলেভাজা খেতে খেতে বাগবাজারের গঙ্গার জলে বৃষ্টির ফোঁটাদের হুটোপাটি দেখার। কিংবা হয়তো অনেকদিন খবর নেওয়া হয়নি এমন কোনো আত্মীয়ের বাড়ি ফোন না করেই গিয়ে হাজির হওয়ার। আবার কোনোদিন বন্ধুদের সঙ্গে বসে চিলেকোঠায় আড্ডা দেওয়া। ওই সন্ধ্যা বা বিকেলগুলোর দিকে তাকিয়েই গোটা দিনের কাজ হাসিমুখে করে ফেলা যায়।
কিন্তু এদেশে তেমন রসদের জোগান খুব কম। আজও প্রতিদিনের মতোই সকালের কাজের পর্ব সমাধা করে চায়ের কাপটা নিয়ে বাগানে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। এটা আমার আকাশ দেখার সময়, একান্তই নিজের। সৃষ্টিকর্তা এই দেশে বৃষ্টিটা খুব মেপে দেন। তবে শীতে বরফ দেন অকৃপণ হস্তে। আজ আবার সকাল থেকে পেঁজা তুলোর মতো তুষারপাত হচ্ছে। ধীরে ধীরে তুষারপাতের বেগ বাড়ছে। আর একটু পরেই বাড়ির সামনের রাস্তাটার পিচকালো রং ঢেকে গিয়ে সাদা হয়ে যাবে বরফে।
এমনও দিনে তারে রাঁধা যায়।
মানে ওই খিচুড়ির কথা বলছি আর কি। যদিও খিচুড়ি খাওয়ার জন্য তিথিনক্ষত্র দেখার দরকার পড়ে না, যে-কোনোদিনেই তারে খাওয়া যায়, তবু বৃষ্টির দিনে যেন তার স্বাদ আরও খোলতাই হয়। এটা বোধহয় বাঙালির জিনে ঢুকে গেছে। কিন্তু এখানে তো মন-কেমন-করা বিকেল মানেই মেঘ করেছে নয়। এখানে বৃষ্টি নয়, আমার মন কেমন করায় এই অন্তহীন তুষারপাত—সব হিম হয়ে যাবে এবার। গরম ধূমায়িত খিচুড়ি ছাড়া এর আর কোনো উপশম নেই, ডাক্তারবাবু!
আমার আবার পেঁয়াজ দিয়ে রাঁধা মুসুরডালের ল্যাটকা খিচুড়ির থেকে পাঁচমিশালি সবজি দেওয়া ‘জগাখিচুড়ি’ মানে গোবিন্দভোগ চালের তৈরি নিরামিষ ভোগের খিচুড়িটাই বেশি ভালোলাগে। যাঁরা রান্না করতে, এবং খেতেও, ভালোবাসেন, তাঁরা বুঝবেন রান্না তো আর কেবল পেট ভরানোর যন্ত্রবৎ আয়োজন নয়, আজকের মতো দিনে তা হয়ে উঠতে পারে ‘আইস ব্রেকার’ জাহাজের মতো মনের মধ্যে জমতে থাকা একটা বরফ কেটে এগিয়ে যাওয়ার বিপুল তোড়জোড়।
কাজেই মনের মধ্যেই একটা তালি মেরে, হাত কচলে লেগে পড়লাম—হঠাও মন-কেমন করা। ফ্রিজ খুলেই দেখি আনাজপাতি দিব্যি মজুত আছে খিচুড়ির মতো—বাগানের কুমড়ো, আলু, গাজর আর ফুলকপি তো আছেই সেইসঙ্গে কড়াইশুঁটি আর স্নো-পি। স্নো-পি? ভাবছেন, ওরেব্বাস, সে আবার কী মার্কিনি সবজি? বিলকুল নয়। আমরা ছোটোবেলায় এনতার খেয়েছি, অরণ্যশুঁটি নামে। প্রতিবছর সরস্বতী পুজোর আগের দিন আমাদের বাড়িতে এই অরণ্যশুঁটি খেতেই হয়। তুষারপাতের কারণে পচে যায় বলে গত সপ্তাহে কয়েকটা আদাগাছ আগে ভাগে তুলে নিয়েছিলাম। সেই সঙ্গে কাঁচালঙ্কাও। সব মিলিয়ে ডালে চালে বসিয়ে দেব।
দু-কাপ গোবিন্দভোগ চাল আর এককাপ সোনামুগ ডাল ভালো করে ধুয়ে পরিমাণ মতো জল, নুন, সামান্য হলুদ আর কয়েকটা তেজপাতা দিয়ে মাইক্রোওয়েভে ঢুকিয়ে দিলাম সিদ্ধ হতে। এরা যতক্ষণে সিদ্ধ হচ্ছে ততক্ষণে আনাজ কাটা হয়ে যাবে। ওদিকে খিচুড়ির সঙ্গে সঙ্গত করতে কয়েকটা পম্পেনো মাছের পিস ধুয়ে নুন হলুদ মাখিয়ে রাখা আছে। পম্পেনো শুনেই আবার অথৈ জলে পড়বেন না। এও আমাদের খুব চেনা—রূপচাঁদা।
আমার মা-কে দেখি এই ধরনের নিরামিষ পাঁচমিশালি সবজি দেওয়া খিচুড়ি বা ভোগের খিচুড়ি বানালে সবসময় মুগডালটা আগে শুকনো খোলায় একটু ভেজে নিতে। ডাল ভাজার গন্ধ বেরোলে সেই ডাল ধুয়ে, কড়া ধুয়ে তবে খিচুড়ি বানাতে। আমি বাপু অতো তরিজুত করে বানাই না। চাল ডাল আগে সেদ্ধ করে নিয়ে আনাজ হালকা ভেজে ওতেই মশলা কষে সেদ্ধ করে রাখা ডাল চাল ওতে দিয়ে একটু ফুটিয়ে নিই, নামানোর আগে মন খুলে কিছুটা গাওয়া ঘি আর সামান্য ভাজা জিরের গুঁড়ো দিয়ে দিই। লক্ষ করে দেখেছি যে-কোনো পুজোপার্বণে অসংখ্য লোকের জন্য তাড়াহুড়ো করে বানানো ওই ভোগের খিচুড়ির কী অপূর্ব স্বাদ হয়। শালপাতার গন্ধের সঙ্গে মিশে সেই ধূমায়িত খিচুড়ির স্বাদ যেন বহু গুণ বেড়ে যায়। সঙ্গে পাঁচমিশেলি লাবড়া চচ্চড়ি—আহা ভাবলেই জিভে জল... টলটল। আজ অবশ্য খিচুড়িতে অনেক সবজি আছে বলে লাবড়ার বদলে মাছভাজা।
যাঁরা পরম করুণায় ভাবছেন, আহা বেচারা মার্কিন মুলুকের বাঙালি। কোথায় বেলা-অবেলায়, ছুতোনাতায় নানাকিসিমের মাছ পাতে পড়বে? তা নয় চারবেলা মাংস চিবিয়ে মলো! তাঁরা বিলক্ষণ ভুল ভাবছেন। এদেশে কলকাতার মতো সব মাছই পাওয়া যায়। দেশি মাছগুলো বেশির ভাগই আসে বাংলাদেশ থেকে। রুই, কাতলা, ইলিশ, ভেটকি, এমনকি কাজরী, আমোদি, পুঁটি, মৌরলা, বোগো—এমনকি একদিন হাজির হয়ে দেখুন খাসা লোটে মাছের বড়া খাইয়ে দেব! তবে আমরা টাটকা সামুদ্রিক মাছই বেশি কিনি, পম্পেনো, বাসা, সিবাস, আর জ্যান্ত ক্যাট ফিশ। পম্পেনো মাছটা কলকাতায় থাকতে অনেকবার খেয়েছি। আমার শ্বশুরমশাই আনতেন গড়িয়া বাজার থেকে। শাশুড়িমা কখনও সর্ষেবাটা দিয়ে, কখনও কালোজিরে কাঁচালঙ্কা দিয়ে ঝাল করতেন আবার কখনও জিরে টম্যাটো কাঁচালঙ্কা দিয়ে পাতলা রসা তাতে নামানোর আগে সামান্য ধনেপাতা কুচি। হায় পম্পেনো, তোমার মার্কিন গুমর আর রহিল না!
ম্যাকিনি শহরটা একটু অন্যরকম। আমেরিকার বড়ো শহর বলতে যে ছবিটা চোখে ভাসে অর্থাৎ নিউইয়র্ক, শিকাগো বা ওয়াশিংটন ডিসির মতো ঝাঁ-চকচকে কংক্রিটের জঙ্গল এখানে নেই। তার বদলে আছে অনেক ফাঁকা জায়গা আর নিশ্বাস নেওয়ার মতো মুক্ত বাতাস। এই অঞ্চলের পুরোনো বাসিন্দাদের একটা অংশ জন্মগত ভাবে ল্যাটিন আমেরিকান। এদের হিস্প্যানিক বলেও ডাকা হয়। হিস্প্যানিকরা প্রথাগত জীবনযাপনে বিশ্বাসী তাই আজও এদের একটা বড়ো অংশ চাষ আর পশুপালন করেই জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বড়ো বড়ো চাষের জমি আর তার মধ্যে বিভিন্ন গবাদি পশু যেমন গোরু, ঘোড়া, শুয়োরের খামার। অনেক ইংরেজি সিনেমাতে যেমন দেখায় অনেকটা তেমনই। এরা মাটির অনেক কাছের মানুষ। বোধহয় চাষ-আবাদ আর পশুপালন করে বলেই এদের সাথে আমাদের খাওয়া-দাওয়ার এত মিল।
প্রথমবার যখন এখানকার একটা মেক্সিকান সুপারমার্কেটে যাই, চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল এদের মশলাপাতি আর সবজির বাহার দেখে। শুধু লঙ্কাই যে কতরকমের আছে গুনে শেষ করা যাবে না। বিচিত্র সব নাম—পোবলানো, সেররানো, হাবানিয়েরো… হালাপেনো আর কায়েন তবু চেনা।
এদেশেও যে আমাদের দেশের মতোই এতরকমের শাক, ওল, নানারকমের কচু, তেঁতুল, ধনেপাতা এমনকি পিঠে বানানোর জন্য মিষ্টি আলুও পাওয়া যায় তা না দেখলে কি কখনও বিশ্বাস করতাম!! পিঠের কথা বলতেই নিশ্চয়ই গুড়ের কথা মনে পড়ছে? সে-ও আছে, আখের গুড়। আর মেক্সিকান দোকান যখন চিজ পাওয়া যাবে না তা কি হয়?
আমাদের চেনাপরিচিত দু-একরকমের চিজ ছাড়াও এরা নানারকমের এবং স্বাদের চিজ বানায়। এই হিস্পানিক দোকানগুলোতে একধরনের তিন লেয়ারের দুধের কেক পাওয়া যায়—Tres Leches, হোলমিল্ক, এভাপোরেডেট মিল্ক আর কনডেন্সড মিল্ক দিয়ে বানানো এই কেক অসম্ভব সুস্বাদু। হালফিলে প্রচলিত ‘মালাই কেক’ বোধহয় তারই দেশি সংস্করণ।
বাইরে এখন আরও তীব্র বেগে পেঁজা তুলোর মতো তুষার ঝরে পড়ছে। গাছের পাতা বা মাটি ছোঁয়ামাত্র জলকণায় পরিণত হচ্ছে। খুব কাছ থেকে দেখলে বোঝা যায় প্রতিটা তুষারকণার নির্দিষ্ট আকার ও গঠনবৈচিত্র্য আছে। ভাবতেও অবাক লাগে, কলকাতায় বৃষ্টিবাদলার দিনে আমরা খিচুড়ি দিয়ে বর্ষাবরণ করি আর এখানে জানুয়ারি মাসের হাড়-কাঁপানো ঠান্ডায় তুষারপাতের খুশিতে খিচুড়ি রাঁধার তোড়জোড় চলছে।
খিচুড়ি এমনি একটা খাবার যা কখনও দেবতাকে উৎসর্গ করা হয় আবার কখনও দরিদ্রনারায়ণের সেবায় লাগে। শুনেছি ১২৭২ বঙ্গাব্দে একবার অনাবৃষ্টির কারণে গ্রামবাংলার দরিদ্র মানুষের জন্য অন্নসত্রের আয়োজন করেন বিদ্যাসাগরের মা ভগবতী দেবী। রাত দশটা অবধি দোরগোড়ায় নিরন্ন মানুষের লাইন থাকত। সকলকে খিচুড়ি বিলিয়ে তবে বাড়ির লোকে অন্নগ্রহণ করতেন। যেসব দরিদ্র অথচ সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজন লজ্জায় আসতে পারতেন না, বিদ্যাসাগর মশায় নিজে তাঁদের বাড়ি গিয়ে রাতের দিকে রান্না করা খিচুড়ি নয়তো চাল ডাল দিয়ে আসতেন, তাদের সম্মান রক্ষার্থে সবাইকে বলে রাখতেন তাদের নাম যেন খাতায় লেখা না হয়। হিন্দু পেট্রিয়টে ১২৭৩ সালের ১৫ শ্রাবণ এই হৃদয়স্পর্শী সেবাব্রত সম্বন্ধে লেখা হয়েছিল “বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মাতা প্রত্যহ ৪৫০০ লোককে অকাতরে, অকুণ্ঠিত চিত্তে অন্ন দান করিতেছেন।”
গল্প করতে করতে আনাজ কাটা শেষ। ওদিকে আবার মাইক্রোওয়েভও সোচ্চারে জানান দিয়েছে সেও ডালে-চালের একটা হিল্লে করে দিয়েছে। এবার গরম তেলে আগে ডুমো ডুমো করে কাটা ফুলকপিগুলো ভালো ভাবে ভেজে তুলে নিয়ে বাকি আনাজগুলো দিয়ে পরিমাণ মতো নুন দিয়ে নেড়ে চেড়ে কিছুক্ষণ ঢাকা দিয়ে রাখা। তারপর, হালকা নরম হয়ে এলেই আদা আর জিরেবাটা, টম্যাটো, কাঁচালঙ্কা দিয়ে কষিয়ে নিয়ে ডাল-চাল সেদ্ধটা ঢেলে কিছুক্ষণ ফুটিয়ে নিলেই হল। গ্যাস অফ করে ঘি আর ভাজা জিরের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখার পালা যতক্ষণ না মাছভাজাটা হচ্ছে।
মাছটা ভাজা হলেই খেতে ডাকব, খিচুড়ি আবার গরমাগরম না খেলে জমে না!
খুব ভালো লেখা
ধ্যাৎ!! লক্ষীনারায়ণ সাউ'এর দোকানের তেলেভাজা খেতে খেতে বাগবাজারের গঙ্গার জলে বৃষ্টির ফোঁটা কি করে দেখবেন? কেনার পরে ও তেলেভাজা তো গ্রে ষ্ট্রীট পেরোনোর আগেই ফুরিয়ে যায়!! :))
সম্বিতবাবু বলেছেন ,লেখায় একটা দুটো করে ভুল ইচ্ছাকৃতভাবে রেখে দেওয়া একটি টেকনিক বটে,পাঠকের মন্তব্য পাওয়ার জন্য। দতা,ধুমায়িত বানানটিও কি সেই জন্যই ? নাকি গুরুতেও আবাপ র বানান বিধি চালু হয়েছে ?
জমজমাটি লেখা। খিচুড়ির স্বাদ গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে ছত্রে ছত্রে।