তিস্তা, রঙ্গিত, জলঢাকা ছাড়াও আরও যে কত অজস্র জলধারা আপন তালে বয়ে চলেছে পাহাড়ের আনাচে কানাচে, তার ইয়ত্তা নেই। সেই জলধারাদের প্রত্যেকেই নিজের মতো করে প্রভাবিত করেছে কাছাকাছি বাস্তুকে। জীবকুলকে। সর্বোপরি মানুষজনকে।
তেমনিই এক বাস্তুসমষ্টির নাম মালবুং গ্রাম। ঘিস নদীর তীরে নিভৃতে আটকানো পাহাড়ের গায়ে। কাছেই বইছে আর-এক নদী—রনকন। এসবের খবর কি তারা রাখেন যাঁরা তিস্তায় বোটিং করতে যান। রাখলে হয়তো দেখতেন স্মিত হাসি মুখে যে বিনয়ী ছেলেটি তাদের জলের ধারে গরম চা এনে দিল সেই ছেলেটি এসেছে ওই ঘিস নদীর তীরবর্তী গ্রাম মালবুং থেকে। কি পোখ্রেবুং অথবা পুবুং থেকে। যেদিনের শেষে ফিরে যাবে নিজের সেই দুর্গম গ্রামে। যেখানে অন্তহীন নেই-এর ভেতর দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে এক সমগ্র জনসমুদায়, তাদের নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি আর জীবনধারণের অন্য এক ধরন নিয়ে। এই বেঁচেবর্তে থাকা কোনো নতুন গল্প নয়। তারা আছে বহু কাল ধরে। যখন পাহাড় জমিন জরিপ হয়নি, সীমারেখা টানা হয়নি, তাদের অজান্তেই তাদের ভাগ্যরেখায় ঢ্যাঁড়া পড়েনি, সেই তখন থেকেই।
‘আমার শৈশবের উপত্যকা’। শিল্পী লৈন সিং বাংদেল। ১৯৭১। দার্জিলিং শহরের কাছে একটি চা-বাগান সংলগ্ন গ্রামে কাটে শিল্পীর শৈশব।
যেন এতকাল তারা লুকিয়ে লুকিয়ে বেঁচে এসেছে সেই গ্রাম নদী পাহাড় আঁকড়ে। কেউ তাদের খবর রাখেনি। তারাও পরোয়া করেনি কারও খবরদারির।
তারপর হঠাৎই ছুদেন নামে এক যুবক তাদের গল্প লিখে বই করে বসল। আর সকলকে জানিয়ে দিল তাদের কথা। তাদের ঘরের কথা। নদী পাহাড়ের কথা। আর তাদের মাটির কথা—ফাৎসুঙ্। আর সেই গল্প পড়ে আমরা অবাক হয়ে ভাবলাম, আরেব্বাস! এরাও ছিল!
গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের কলকাতা-কাঁপানো নেতারাও হয়তো ঠিকমতো জানতেন না এরাও ছিল। কিন্তু তারা সেই নেতাদেরই কথা শুনে, পড়ে, বুঝে নাবুঝে শামিল হয়েছিল লড়াইয়ে। গোর্খাল্যান্ড গড়ার আন্দোলনে। একেবারে মাটির স্তরে, মাঠে-ময়দানে পথে-ঘাটে জীবন দিয়ে লড়ার জন্য তৈরি হয়েছিল তারাও। কিন্তু তাদের আন্দোলনে শামিল হওয়ার মধ্যেও রয়ে গেছিল তাদের মৌলিক অবস্থানের টানাপোড়েন। এই টানাপোড়েনের বহুমাত্রিক দ্বন্দ্বই ধরা পড়েছে ছুদেন কাবিমোর উপন্যাস ফাৎসুঙ্-এ।
গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন আসলে তো কোনো সমমনোভাবাপন্ন ব্যক্তিবর্গের আড়ষ্ট কর্মসূচি ছিল না। এই আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত গণ-আন্দোলন যেখানে শামিল হয়েছিল ঘিস নদী রনকন নদীর মতো আরও অজস্র পাহাড়ি জলধারার বাসিন্দারা। বহিরাগতের চোখে যতই তাদের একরকম দেখাক, তারা আসলে ছিল ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষজন। বড়ো করে তারা গোর্খাল্যান্ডের দাবি জানালেও প্রত্যেকের বুকের গভীরে অনুচ্চারিত আলাদা আলাদা দাবি ছিল। প্রত্যেকের নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যকে বজায় রাখার আকাঙ্ক্ষা ছিল। এমনকি একে অপরের বিরুদ্ধে গোপনে ক্ষোভ পোষণ পর্যন্ত করত। তারই বেয়াড়া খণ্ডচিত্র ইতিউতি ফুটেছে কাবিমোর ফাৎসুঙ্ উপন্যাসের মধ্যে। লাছিরিংয়ের আক্ষেপের মধ্যেই ফুটেছে সেকথা—তিব্বতিরা ভুটানিরা ধাপে ধাপে শেষ করে দিয়েছে লেপচাদের।
কাবিমো দায়িত্ব নিয়ে তুলেছেন লেপচাদের কথা। তাই সেটা জানা গেল। অন্যদের কথা তেমন করে কেউ তোলেননি বলে হয়তো জানা গেল না। কিন্তু আমাদের জানা বা না জানা ব্যতিরেকেই সেই অন্য স্বর অবশ্যই বিরাজমান ছিল।
এই অন্য স্বরের অনুরণনেই অন্য মাত্রা ধারণ করে ফাৎসুঙ্। একটা চেনাজানা জগতকে যদি উলটে নিয়ে উলটো করে দেখা যায় তাহলে ধরা পড়ে তার অন্য মুখ। সেই অন্য মুখ ভালো কি মন্দ সেটা বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা সেই অন্য মুখ আসলে উলটো মুখ কি না।
হয়তো ফাৎসুঙ্ গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের অন্য মুখ উজাগর করেছে। কিন্তু সেই অন্য মুখ কোনোভাবেই উলটো মুখ নয়। শতাধিক বর্ষের এই আন্দোলনের রাশ নানা সময় নানাজনে ধরেছেন। আন্দোলনের মুখ হিসাবে আমরা পাল্টে পাল্টে যেতে দেখেছি নেতাদের মুখ। এমনকি প্রধান দলের নামনকশা পর্যন্ত গেছে বদলে বদলে। কিন্তু যাদের জোরে নেতাদের জোর, পার্টির জোর, তাদের কোনো বদল হয়নি। নাম না জানা সেই দুর্গম গ্রামগুলোর জীর্ণ মানুষগুলো তাদের সব জীর্ণতা সঙ্গে নিয়েই ভিড় বাড়িয়েছে মিছিলে সমাবেশে। বুক পেতেছে প্রতিপক্ষের উদ্যত অস্ত্রের সামনে। পার্টির ডাকে সাড়া দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে ছেলেমেয়েরা। তখন তারা কেউ প্রশ্ন তোলেনি কে গোর্খা আর কে গোর্খা নয়। কারণ গোর্খাল্যান্ড তো আসলে মাটি। সেই মাটির তিলককেই রাজতিলক করে, রানিতিলক করে শামিল হয়েছে তারা মাটির আন্দোলনে। তাই মাটির কথা আসলে গোর্খাল্যান্ডের কথা। গোর্খাল্যান্ডের স্বপ্নের কথা—ফাৎসুঙ্।
ছুদেন কাবিমো তার মাটির গল্প বলার জন্য যে ভঙ্গিটি নিয়েছেন তাতে ছোটোগল্পের গতি আছে। যে মাটির গল্প তিনি বলেছেন সেই মাটির বাস্তবিক মাত্রিকতা এক লপ্তে বড়ো করে সত্যিই দেখা যায় না। বাতাবি লেবু নিয়ে ফুটবল খেলার মতো একটুকরো জমিও সেখানে বিরল। সোজা এক ছুট লাগানোর পরিসরও নেই। এই ভৌগোলিকতার আমেজ কাবিমোর গল্পের চলনের পরতে পরতে লেগে আছে। পড়তে পড়তে এক বন্ধুর অস্থিরতার অনুভূতি জেগে ওঠে মনে। একই সঙ্গে ঘিস নদীর জলে পা ডুবিয়ে মালবুং গ্রামে যাওয়ার রাস্তায় আপনমনে হেঁটে যাওয়ার নৈসর্গিক প্রশান্তি জাগে।
মালবুং গ্রামটি মনে হয় লেপচাপ্রধান। উপন্যাসের নামটিও লেপচা শব্দ—ফাৎসুঙ্, মাটির কথা। ফলে লেপচা গ্রামের এক সুন্দর ছবি এখানে পাওয়া যায়। তবে সেই গ্রাম কোনোভাবেই কোনো বিচ্ছিন্ন গ্রাম নয়। তাদের জীবনধারণ ধর্মচর্চা জীবিকা রীতিরেওয়াজ কমবেশি অন্য গ্রামের মতোই। পার্থক্যগুলো অবশ্যই আছে। চরম জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতার মতো তিক্ত বিষয়ও আছে। কিন্তু সেটাও একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। লেপচা ভিন্ন অন্য গ্রামেও সেই ছবি আজও বর্তমান। আর এখানেই ফাৎসুঙ্ বাস্তবিকই মাটির গল্প হয়ে ওঠে। সে মাটির জাত ধর্ম নির্ধারিত হয় না তার বাসিন্দাদের জাত ধর্ম দিয়ে। বরং তা নির্ধারিত হয় সেই মাটির ঐতিহ্য আর পরম্পরা দিয়ে। তাই এত ছোটো ছোটো গ্রামগুলোর দার্জিলিংয়ের সামগ্রিকতায় মিশে যেতে কোনো বাধাই থাকে না। তাই ফাৎসুঙ্ প্রান্তিক হয়েও সামগ্রিকতায় উত্তীর্ণ হয়ে ওঠে শেষপর্যন্ত।
বাংলা অনুবাদের অনর্গলতা বেশ চমকপ্রদ। অনুবাদসাহিত্যে আড়ষ্টতা এমন একটি কাঁটা যা সহজে তুলে ফেলা যায় না। যিনি তা তুলে ফেলতে পারেন তিনি সার্থক অনুবাদক। শমীক চক্রবর্তী পেরেছেন। এক ভাষায় অন্য ভাষার গল্প পড়ার খচখচানি একেবারেই জাগে না পড়ার সময়।
ফুটনোট ব্যবহার করতেই হয়েছে। না করে উপায় নেই। আর তার মাধ্যমেই চমৎকার ভাবে যেন একটি পাঠ নেওয়া হয়ে যায় পাহাড়ের গ্রামগুলোর অভ্যন্তরীণ জীবনের। যে বিষয়গুলো মূল উপাখ্যানকে মৌলিকতা দান করেছে সেই বিষয়গুলোই অনুবাদেও ভিন্ন স্বাদের হদিশ দিয়েছে। এই স্বাদ হয়তো অন্য মাত্রা এনে দেবে পাহাড়ের রানির পর্যটন উপভোগ্যতায়। মাথা তুলে শুধু মেঘ পাহাড় দেখা নয়, চোখ নামিয়ে জল মাটি দেখারও অপরিহার্য আকাঙ্ক্ষা জাগাবে প্রাণে।
অনবদ্য আলোচনা। গল্প-উপন্যাসের আলোচনা ঠিক কেমন হওয়া উচিত, তার উদাহরণ হিসেবে এই আলোচনাটিকে ব্যবহার করা যেতে পারে।
উপন্যাসটি পড়তেই হবে।
হয়ত অপ্রাসঙ্গিক, তবু গুরুচণ্ডালীর পাঠকদের বিমলবাবুর নুন চা বইখানি পড়ে দেখতে অনুরোধ করি। অভাজনের কথা ভরসা না থাকলে বড় বড় লোকের রেকমেন্ডেশন দেওয়া রইল।
http://archives.anandabazar.com/archive/1120724/24edit4.html
আলোচনা পড়েই, বই টিকে পড়ার আগ্রহ জন্মালো।।নামের মধ্যে দিয়েই যেন মাটির মানুষ গুলোকে ছুঁয়ে ফেললাম