মানুষের স্থাবর থেকে জঙ্গম হয়ে ওঠার ইতিহাস, মানুষের সভ্যতার ইতিহাস, চাকার আর গাড়ির ইতিহাস।
হরপ্পা - মহেঞ্জোদারো র কথা মনে হলেই আমার মনে হয় সেই ষাঁড় চালিত রথটির কথা।
(মোহেঞ্জোদারোর খেলনা রথ)
হলই বা খেলনা রথ, তবুও তো রথ | বড়দের নিশ্চয়ই অমন একটা রথ ছিল।
মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের সারথ্য আর রথ না হলে শ্রীমদ্ভাগবৎ গীতার অবতারণাই হয় না | মহাভারতে মহাযুদ্ধের ট্র্যাজিক নায়ক কর্ণের পতনের মূলেও বেচারার রথের চাকার মাটিতে প্রোথিত হওয়া | না হলে কর্ণেরও পতন হয় না, আর কর্ণ বেঁচে থাকলে মহাভারতের যুদ্ধের কি পরিণতি হতে পারত তাই বা কে জানে?
বুদ্ধদেব যেমন! রাজপুত্র সিদ্ধার্থের রাজপুরী থেকে মহানিষ্ক্রমণের নেপথ্যে সারথী চন্নার সঙ্গে তাঁর কণ্ঠক নামে অশ্বচালিত শকটে নগর পরিভ্রমণ। না হলে রাজপুত্র যদি শুধু ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে পথ চলতেন, কেই বা তাঁকে দেখাত জরাগ্রস্ত বৃদ্ধের বেদনা, কোথায় বা তিনি দেখতেন মৃত মানুষের পশ্চাতে মানুষের আর্তনাদ, কোথায়ই বা তাঁর চোখে পড়ত সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর আনন্দে অবগাহন, যা দেখার পর তিনি রাজপ্রাসাদ ছেড়ে অরণ্যচারী হলেন। তার পর অবিশ্যি বুদ্ধদেব পদব্রজে কুরুজাঙ্গাল থেকে কুশীনগর সর্বত্র বিচরণ করেছেন, তিনি বিস্তর হেঁটেছেন, কিন্তু তাঁর গাড়ির কথা কেউ লেখেন নি।
মহানিষ্ক্রমণ আর গাড়ির সূত্রে ইতিহাসের "কি হতে পারত" বললে আমার বাঙালী মননে একজনের কথাই মনে হয়, তিনি নেতাজী সুভাষচন্দ্র! যখন ছোট ছিলাম, প্রতি ২৩ শে জানুয়ারী নিয়ম করে ছোটবেলায় নেতাজী ভবনে বাবা নিয়ে যেতেন, আর তিনি নেতাজী ভবনে প্রবেশ করেই নেতাজীর সেই বিখ্যাত জার্মান Wanderer W24 গাড়িটির সামনে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। এই সেই গাড়ি যাতে করে নেতাজী ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে চলে গেছিলেন। নেতাজীর আরো অনেক কিছুর মধ্যে এই যে অ-বৃটিশ ইউরোপীয় গাড়ীর ব্যবহার, সেটিরও কি তাৎপর্য নেই? নেতাজীর অবিশ্যি আরো একটি গাড়ি ছিল, সেটিও বৃটিশ নয়, আমেরিকান গাড়ি স্টুডিবেকার প্রেসিডেন্ট, তবে সে গাড়ি চড়ে তিনি সেদিন যান নি, কারণ সে গাড়িকে চট করে চেনা যেত। এখানে একটা কথা বলা যেতে পারে, স্টুডিবেকার কোম্পানী আমেরিকান হলেও সে কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা আদতে জার্মান। কে জানে, ওয়ানডারার গাড়ি না থাকলে নেতাজীর হয়ত নিষ্ক্রমণ হয়ত হত না, আর কে জানে ভারতের ইতিহাসের মোড় ঘুরতেও পারত অন্য দিকে। সুভাষচন্দ্র আর ঘরে ফেরেন নি, উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে যে Wanderer কোম্পানী ১৯৪৫ সালে পাততাড়ি গুটোয় | বছর তিনেক হল আউডি কোম্পানী সে গাড়িকে সারিয়ে আবার জনসমক্ষে হাজির করেছে।
(এই নেতাজীর সেই গাড়ি, Wanderer24, যে গাড়িতে করে তাঁর এলগিন রোডের বাড়ি থেকে মহানিষ্ক্রমণ, সূত্র: https://www.telegraphindia.com/west-bengal/the-great-escape-car-story/cid/1395099)
আর রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথের যখন পঁচিশ বছর বয়েস, তখন কার্ল বেঞ্জ ইনটারনাল কমবাশন ইঞ্জিনযুক্ত গাড়ি বের করেছেন, রবীন্দ্রনাথের ৩৬ বছর বয়েসে ভারতে প্রথম গাড়ি আসে। ১৯৩৮ সালে রথীন্দ্রনাথ বিলেতের হামার (Humber) কোমপানীর ১৯৩৩ সালের মডেলের দুটি গাড়ি কেনেন, সম্ভবত ৩৫০০ সিসির ছ-সিলিণ্ডার গাড়ি হামার স্নাইপ মডেলের। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে পড়লাম গাড়িটি রবীন্দ্রনাথের এত পছন্দের ছিল যে তিনি নিজে সেখানে শীতলপাটি বিছিয়েছিলেন। তবে রবীন্দ্রনাথ ট্রেন, রেলগাড়ী, বা এরোপ্লেন নিয়ে যতটা লিখেছেন, মোটর গাড়ী নিয়ে সেভাবে তাঁর লেখা আমি পড়িনি অবশ্য।
এই সব গল্পের কথা বলতে বলতে চাকা আর গাড়ি আবিষ্কারের কথাটা বলা হল না। পরের বার।
"নেতাজীর অবিশ্যি আরো একটি গাড়ি ছিল, সেটিও বৃটিশ নয়, আমেরিকান গাড়ি স্টুডিবেকার প্রেসিডেন্ট, তবে সে গাড়ি চড়ে তিনি সেদিন যান নি, কারণ সে গাড়িকে চট করে চেনা যেত"
গাড়িটা ছিলো বোধ হয় শরত বোসের।
ঠিক।
বাঙালীর গাড়ি বিলাস নিয়ে আরো লেখা চাই আপনার কাছে।