আমি চল্লিশ বছর আগে গাড়ি চালানো শিখেছিলাম, সে এক সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা । বাবার একটি স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড নামে দু-দরজার গাড়ি ছিল , সেইটাতে হাত পাকাই । যে ভদ্রলোক গাড়ি চালানো শিখিয়েছিলেন, তিনি প্রথম দিনে এসেই গাড়ির ফ্লোরে তিনটি লিভার দেখিয়ে বললেন, এই তিনটে লিভার,স্টিয়ারিং দেখ্চ , আর গিয়ার্ , এই, এদের সাহায্যে গাড়ি চালাতে হবে, এইভাবেই গাড়ি চলে । গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলের একপাশে চাবি ঢুকিয়ে মোচড় দিলে গাড়ি কঢ়াঙ করে আওয়াজ করে উঠবে; এতে বোঝা যাবে যে গাড়ির মোটর চলতে শুরু করেছে । তখন বাঁ পা দিয়ে ক্লাচ চিপে ফ্লোরের দিকে নিয়ে গিয়ে ফার্স্ট গিয়ার পজিশনে গিয়ার এনগেজ করে একটু একটু করে এক্সিলারেটরে চাপ দিতে হবে আর একই সঙ্গে ক্লাচ ছাড়তে হবে,তখন গাড়ি চলতে শুরু করবে । এই সমস্ত কথা বলে তিনি আমাকে গাড়ি চালানো শেখাতে শুরু করলেন ।
সে কি সহজ কাজ! একবার গাড়ি ধক করে এগিয়ে যায় তো তিনি এই গেলো গেলো, আরে আরে, করে আর্ত রব তোলেন, আমিও সে কথা শুনে এক্সিলারেটর থেকে পা তুলে নিই , আর ইঞ্জিনবন্ধ হয়ে যায় । ক্লাচ, ব্রেক , এক্সিলারেটর, পা , মাথা, চোখ , কান, সব এক করে, তাদের কো অর্ডিনেশন যে কি সাংঘাতিক জটিল কি বলব । ঢাকুরিয়া লেকের ধার তখনও পর্যন্ত দুপুর বেলার দিকে বেশ নির্জন থাকতো, খুব বিশেষ বাঁক নিতে হতো না , কাজেই সপ্তাহ খানেকের মধ্যে মোটামুটি স্থিত অবস্থা থেকে সমানে সামনের দিকে এক ডিরেকশনে গাড়ি চালু করতে আর চালাতে শিখে গেলাম ।
এই করে হাঁটি হাঁটি পা পা করে সবে গিয়ার টিয়ার টেনে গাড়ি চালাতে শিখেছি, একদিন কায়দা করে চালাতে গিয়ে বাঁক নিতে গিয়ে মারলাম বাড়ির গ্যারাজের দেওয়ালের গায়ে, গাড়ির বনেট তুবড়ে সামনের আলো ভেঙেচুরে সে এক কান্ড । তাকে সারাতে বিস্তর খরচ হলো । কয়েকটা দিন নিজের ওপর রাগে দুঃখে মুহ্যমান হয়ে রইলাম, আমার দ্বারা আর এ জীবনে গাড়ি চালানো হল না । কিন্তু গাড়ি চালানোর মাস্টার মশাই ছাড়বেন কেন? তাঁর রুজি রোজগারের ব্যাপার । তারপর আমার পিতৃদেব সমানে বলে যেতে লাগলেন, আরে , ওসব ভাবছিস কেন? কত লোক গাড়ি চালিয়ে একসিডেন্ট করে! এই আমাকে দ্যাখ না! আমিই তো তোর বয়েসে গাড়ি চালিয়ে একটা গরুকে ধাক্কা দিয়ে সে কি কান্ড । তাঁকে বোঝানো যায় না যে ঐসব কথা শুনলে আমার ভয় আরো জাঁকিয়ে বসে (কলকাতায় তখন রাস্তায় আকছার গরু বাছুর দেখা যেত; বিস্তর গোয়াল আর গোয়ালা ছিল নানা জায়গায়) । সে যাই হোক, গাড়ি চালানোর হাত থেকে আমার নিস্তার হলো না , আবার "মাস্টার মশাইয়ের " সঙ্গে গাড়ি চালাতে শুরু করলাম ।
এইবার তিনি আমাকে কলকাতা শহরের রাস্তায় গাড়ি চালাতে শেখানোর উদ্যোগ নিলেন । আমাকে বললেন বড় রাস্তার বাঁ দিক ঘেঁষে গাড়ি চালাতে হবে। তখন কলকাতার বড় রাস্তায় , অন্তত সাদার্ন এভিনিউর রাস্তায় লোকে সাইকেল চালাতো, আর সে সব সাইকেল ও রাস্তার বাঁ দিক ঘেঁষেই যায় । সে আবার আরেক গেরো, আমি ধীরে ধীরে গাড়ি চালাই । তখনও ঠিক হাত সড়গড় হয়নি, আর রাজ্যের গাড়ি পেছন থেকে হর্ন দেয় । একদিন এক সাইকেল-চালক যুবক পাশ দিয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে গাড়ির বনেটের ওপর ধাঁই করে একটা চাপড় মেরে হাসতে হাসতে কি একটা বলে চলে গেলো । আমি মাস্টার মশাই কে জিজ্ঞাসা করলাম, "এটা কি হলো?" তিনি হাসতে হাসতে বললেন, "এ হে, ব্যাপারটা বুঝতে পারলে না? তুমি এতো ধীরে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছো যে সাইকেল চালক গাড়িকে হারিয়ে জিতে গেছে, এ কথা তোমাকে জানিয়ে গেলো", একথা বলে তিনি কলকাতা শহরে গাড়ি চালানোর অলিখিতসূত্র সম্বন্ধে আমাকে জ্ঞান দিলেন । বুঝলাম, এ শহরে যে যত বড় গাড়িচালায়, তার তত দেমাক!
গল্প গুলো এই জন্যে করছি যে, আজ থেকে যদি বছর চল্লিশ বা তার কিছু পরেও, গাড়ি যে নিজে নিজে চলতে পারে, চলার সময় সারথীকে জানিয়ে দিতে পারে যে সামনে গাড়ি আছে বলে নিজে নিজে ধীরে চলতে শুরু করে, এমনকি একটা গিয়ারের সাহায্যেই যত ইচ্ছে জোরে গাড়ি চালানো যেতে পারে, এই কথা কাউকে , এমনকি আমার গাড়ি চালানোর মাস্টার মশাইকে অন্তত বিশ্বাস করানো অসম্ভব ছিল । এমনকি , আর কিছু না হোক, গাড়ির গিয়ার্ ও যে নিজে থেকে মানুষের নিয়ন্ত্রণ ব্যতিরেকে পরিবর্তন করা যায়, এই ব্যাপারটিও তিনি, এবং তিনি কেন , অনেকেই বুঝে উঠতে পারতেন না । তাছাড়া গাড়ি চালাতে গেলে যে পেট্রল বা ডিজেল না হলেও চলে, খুব সম্ভব বিশ্বাস করা দূরে থাকে, হা হা করে হাসাহাসি করতেন হয়তো ।
অথচ গাড়ি,উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত, আমাদের আধুনিক সভ্যতার এবং চলমানতার একটি অন্যতম প্রতিভূ । চাকার আবিষ্কার যদি মানব সভ্যতা কে বদলে দিয়ে থাকে, তাহলে মানুষের সচলায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাহনদের এবং তাদের ক্রমবিবর্তন নিয়ে দু চার কথা বলার জন্যেই এই ব্লগ পোস্টগুলোর অবতারণা । আমরা একটু দেখি যে গাড়ি কতটা বদলে গেছে, আর কি কি বদলে যায় নি । গত কয়েক বছরে গাড়ির টেকনোলজি যে কত বদলে গেছে! এখন গাড়ি যত না "গাড়ি" , তার থেকে তাকে ঢের বেশি চলমান কম্পিউটার বলাটাই সুপ্রযুক্ত ।
কি করে এলো এই পরিবর্তন? কি আসতে চলেছে?
(চলবে >>>)
পড়ছি, চলুক।