এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • ফেরারি ফৌজ : ২য় পর্ব

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৪ নভেম্বর ২০২০ | ১৭৯০ বার পঠিত
  • (৫)

    ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’র এক সকাল

    নাঃ, বাড়িটার কিছু ভোল পাল্টেছে।
    বাগানের নারকোল গাছগুলো নেই। ওদের শেকড়ের চোরাগোপ্তা আক্রমণে নাকি পাঁচিলটা পড়ে গিয়েছিল। আছে সুপুরিগাছগুলো। তাতে সুপুরির গোছা ঝুলছে গলগন্ডের মত।
    বাগানে গোলাপগাছের সংখ্যা কিছু কমেছে। কোথায় সেই লতানে গোলাপগুলো এবং সাদা-হলুদ গোলাপের দল? আর বাঁশদ্রোণী বাজার থেকে কেনা চৌ এন-লাই গোলাপ! চৌ এবং তাঁর নামে রাখা গোলাপ সবই কবে বিবর্ণ হয়ে ঝরে গেছে।

    গ্রিল দিয়ে ঘেরা ছোট্ট বারান্দায় জনাপাঁচেকের মত বসার জায়গা। সেখানে বসে চশমা চোখে খবরের কাগজ পড়ছেন আশির ঘর ছোঁয়া ভদ্রলোকটি।। বাগানের গেট খোলার শব্দে চোখ তুলে তাকালেন। বড় আয়ত চোখজোড়ার তীব্র চাউনি একমুহুর্তে নরম হয়ে এল। এক্গাল হেসে বললেন--আয়! আয়! চা খাবি তো। কোলকাতায় কবে এলি? বৌমা? ছেলেমেয়েরা? সব ভালো তো?
    রমেন বোকা বোকা হাসি হাসে। মাথা হেলিয়ে সায় দেয়।সহজ হবার চেষ্টা করে।
    বাড়িটায় সদ্য রঙ করা হয়েছে। কিন্তু এই গ্রিল দিয়ে ঘেরা বারান্দাটা? রোজ রাত্তিরে যেখানে নিয়ম করে গোদরেজের সাত লিভারের তালা ঝোলানো হয়, এটাই না?
    রমেন গ্রিলের দরজাটা দেখে, তালাটায় হাত বুলোয়, তারপর কাকার দিকে তাকায়।
    কাকা আস্তে করে মাথা নেড়ে অন্য দিকে তাকান।

    কেন যে রমেন সেইসব পুরনো দিনের কথা মনে করে রেখেছে? কি লাভ? খুঁচিয়ে ঘা করা? চার চারটে দশক তো পেরিয়ে গেল।

    হ্যাঁ, কোলকাতা তখন দুঃস্বপ্নের নগরী। সিদ্ধার্থ রায়ের কোলকাতা। তখনও এমার্জেন্সি ঘোষণা হয় নি। বিরোধীদের কন্ঠস্বর শোনা যায় না। কারণ পাকিস্তানকে সফল ভাবে দু'টুকরো করেছেন ইন্দিরা গান্ধী। পশ্চিম পাকিস্তানের ফ্রন্টে খানসেনাদের তাড়া করে লাহোরের ইছোগিল খাল পর্য্যন্ত পৌঁছে গেছল ভারতীয় ফৌজ। আর ঢাকায় ইস্টার্ন কম্যান্ডের জেনারেল অফিসার ইন কম্যান্ডিং অর্জুন সিং অরোরার সামনে জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণ ও নব্বই হাজারের মত পাক সেনার যুদ্ধবন্দী হওয়ায় ভারতে নো-ননসেন্স ইমেজ সর্বজনস্বীকৃত। ইন্দিরা হয়ে উঠলেন এশিয়ার মূক্তিসূর্য।
    কিন্তু তার আগে? অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে এবং কোলকাতা থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ব্রডকাস্টিং করার অনুমতি দিয়ে ইন্দিরা তখন গোটা ভারতের এবং বিশেষ করে বাঙালীদের নয়নের মণি।
    ইস্টার্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ শুরু করার আগে দরকার ছিল নিজের ঘর ঠিক করা। বোমা-পাইপগান আর ছুরি নিয়ে পুলিশ ও জোতদারের গলাকাটার নেশায় মেতে ওঠা বালখিল্য বিপ্লবীদের শায়েস্তা করা। ফৌজ নামল বীরভূমে, নামল উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ পর্য্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের বর্ডার জুড়ে। সামনে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স, ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস্‌।
    সরানো হল বামেদের যুক্তফ্রন্ট সরকারকে, আরও কড়া এবং প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ চাই। অল্পদিনের রাষ্ট্রপতি শাসনের পর এলেন সিধুবাবু। উনি নাকি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের দৌহিত্র ও ক্রিকেটার পঙ্কজ রায়ের ভাইপো! নিজেও ব্যাট ধরেন, দুঁদে ব্যারিস্টার।
    নকশাল দমনে উনি যুব কংগ্রেসের ছেলেদের হাতে অস্ত্র তুলে দিলেন। শুরু হল শহরে খোলাখুলি এনকাউন্টার। বারাসত-আমতলার পথে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে রইল আটটি কিশোরের মৃতদেহ। কানে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করা হয়েছে।
    তারপর বাম-ডান সব দলগুলোকে একসঙ্গে নিয়ে জনসভা করে ঘোষণা করা হল যে বরানগর -সিঁথি এলাকা নকশাল মুক্ত করা হবে। বিশাল এলাকা জাল দিয়ে ঘিরে রাখল সিআরপির জোয়ানরা। বাইরের এলাকা থ্কেকে প্রফেশনাল কিলারদের এনে লেলিয়ে দেওয়া হল। কোন প্রেস ঢুকতে পেল না। ঘর ঘর থেকে টেনে বের করা হল দুঁদে নকশাল, খুদে নকশাল, হবু নকশাল, জবুথবু নকশাল সবাইকে। বাদ গেল না কচি-কাঁচা , মেয়েমদ্দ-বুড়োরাও। ঝাড়ে বংশে নিকেশ কর।
    মৃতদেহগুলোকে মুখে আলকাতরা মাখিয়ে ঠেলাগাড়ি করে গঙ্গার পাড়ে ডাম্প কর। লাশগুলো গঙ্গায় ফেলে দাও।
    যারা কপালজোরে পালিয়ে বাঁচল তারা বহুদিন সেই দিনের কথা মনে করে কেঁপে কেঁপে উঠত, ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে উঠত।
    কয়েক মাস। কোলকাতায় নকশালদের পুলিশ মারা প্রায় থেমে গেল। পাড়ায় পাড়ায় সিপিএম-নকশালদের এলাকা দখল নিয়ে কৌরব-পান্ডব যুদ্ধও থিতিয়ে এসেছে। কিন্তু খাল কেটে কুমির আনা হয়েছিল। দিল্লির প্রতিনিধি যে যুব কংগ্রেসের হাতে রাইফেল তুলে দিয়েছেন। ছেলেছোকরাদের হাত নিশপিশ করছে।
    এবার সিপিএমকে পাড়া ছাড়া করলে কেমন হয়! গোটা পাড়ায় সব ক্লাবগুলো দখল হবে, স্কুলকমিটি দখল হবে। মেয়েগুলো হয় ভয়ে সিঁটিয়ে দোরে খিল দেবে নয় ফুলচন্দন দিয়ে বীরের অভ্যর্থনা করবে।
    যেমন ভাবা তেমন কাজ।

    -নারকইলগাছ সবকয়টাই কাটা হইয়া গ্যাছে? শিকড় ছড়াইয়া পাঁচিল ভাইঙ্গা দিছিল?
    -- কইতে পার। কিন্তু আরও কারণ ছিল। কইতাছি।

    তখন এই পাড়ায় আমিই ছিলাম সিপিএম হিসেবে মার্কামারা। যদিও আমার রাজনীতি ডালহৌসি পাড়ায়। কিন্তু ওরা পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে চাইছিল, বুঝতে পারিনি।এত বছর এই পাড়ায় আছি, একবার পূজোয় সেক্রেটারি হলাম। সেদিনের ছেলেগুলো। হাফপ্যান্ট পরা দেখেছি।ওদের বাবা কাকারা সম্মান করত, বিপদে আপদে পরামর্শ নিত। হাতে বন্দুক পেয়ে ছেলেগুলো কেমন অচেনা হয়ে গেল। ওদের চোখের ভাষা পাল্টে গেল।
    দত্তগুপ্তের ছোটছেলেটা, আরে যার ডাক নাম ভ্যাবলা। ওর বাবা কংগ্রেসি, কিন্তু কখনও-, সে যাকগে। ছেলেটা পুকুরপাড় থেকে বন্দুক দিয়ে টিপ করে আমাদের গাছের নারকোল পাড়ছিল। আবার বন্ধুদের মধ্যে লক্ষ্যভেদের কম্পিটিশন করছিল।আমি বকলাম। এটা কি করছ, যদি কারো গায়ে গুলি লেগে যায়? ওরা হেসে উঠল। বললাম-- সাপের পাঁচ পা দেখেছ? এইসব বেআইনি অস্ত্র নিয়ে--।
    একটা বেপাড়ার ছেলে বলল-শুনুন, বেশি আইন দেখাবেন না, ফুটুন তো! না পোষালে অন্য পাড়ায় যান।
    -- মানে? এখানে আমাদের নিজেদের বাড়ি!
    --তো বিক্কিরি করে দিন। খদ্দের আছে।
    আমি পরের দিন লোক ডাকিয়ে সব নারকেল গাছ কাটিয়ে ফেললাম। সাতদিন এমনই কেটে গেল।

    ভোর পাঁচটা। আশি পেরনো সরযূবালা কৃষ্ণের অষ্টোত্তরশতনাম নেওয়া শুরু করেছেন।
    "উপানন্দ নাম রাখে সুন্দর গোপাল,
    ব্রজবালক রাখে নাম ঠাকুর রাখাল।"
    বাইরের ঘরে মশারির ভেতরে স্কুলে যাওয়া দুই নাতি পাশ ফিরে শুলো।ওদের মা সকালে উঠে রোজকার অভ্যেসমত দোক্তা দিয়ে পান সাজা শুরু করেছেন। এরপর উনুনে আগুন দিয়ে চায়ের জল চড়াবেন।
    সামনের দরজায় খটখট শব্দ।
    সাতসকালে কে এলো!
    সরযুবালা বারান্দায় এসে পাথর হয়ে গেলেন। ছয়টি ছেলে। দুজনের হাতে রাইফেল আর তিনজনের হাতে পাইপগান। একজন বাগিয়ে ধরেছে রামপুরি।কিন্তু ওদের নেতাটিকে উনি বিলক্ষণ চেনেন। পাড়ার পূজারি ব্রাহ্মণের ছেলে। চালু নাম বামনা বিভাস। গতবছর সামনের একটি নির্মীয়মাণ বাড়ির ভেতরে বোমা বাঁধার সময় কিছু বোমা ফেটে দুজন মারা যায়। বিভাস বেঁচে যায় --একটা হাত খুইয়ে। কোন পুলিশ কেস হয় নি। কাটা হাতে প্লাস্টিক সার্জারি করার খরচা তুলতে পাড়ায় জলসা হয়। শান্তিকাকু টিকিট কিনেছিলেন, শুনতে যান নি।
    বিভাস এখন কাটা হাতের সাপোর্টে ধরে রেখেছে একটি পাইপগান।
    -- দরজা খুলে দিন ঠাকুমা, তালা খুলুন।
    --কেন?
    -- ক্যান আবার কী! ভিতরে আসুম না? আমরা অতিথ!
    -- সাতসক্কালে! এমুন বেশে? কী কাম?
    -- কাম আছে। শান্তিদারে ডাকেন ।

    সরযুবালা কাঁপতে কাঁপতে ভেতরে গেলেন।
    --বৌমা! দ্যাখ আইয়া। আমার হাত পা কাঁপতে আছে। অরা তুমার শান্তিঠাকুরপোরে মারতে আইছে। সে তো ভেতরের ঘরে ঘুমাইয়া আছে।
    বৌমার উপস্থিত বুদ্ধি প্রখর। ব্যাপারটা আঁচ করে ভেতরে গিয়ে ঠাকুরপোকে ঠেলে তুললেন।
    -- অরা সামনের গেটা আটকাইয়া রইছে। আপনে এক মিনিটের মইধ্যে পায়খানার পিছনের গলি দিয়া পিছনের বাড়ির পাঁচিল ডিঙ্গাইয়া চাষীপাড়া দিয়া লায়েলকার মাঠে যান গিয়া। সেইখান থেইক্যা বাস ধইর‌্যা পার্কসার্কাসের বাড়ি। সময় নাই, লুঙ্গি-গেঞ্জি পইর‌্যাই যান গিয়া। ধরেন এই দশটা ট্যাহা।
    মা, এই নেন গেটের চাবি। আপনে ঘরের ভেতর বইয়া থাকেন। ঠাকুরপো যাওয়ার দশ মিনিট পরে বারান্দায় আইসা তালা খুল্যা দিবেন।
    বউমা গেলেন বারান্দায়।
    --কী ব্যাপার?
    --বৌদি, দরজা খুলেন।
    --ক্যান?
    --শান্তিদারে চাই।
    -- এইডা কী কথা? সাতসক্কালে বন্দুক লইয়া শান্তিদারে চাই! দরজা খুইল্যা দেন! এইডা কি মগের মুল্লুক!
    -- সাবধানে কথা কইয়েন বৌদি। এইডা আপনাগো সিপিএমের সরকার না। শান্তিদারে বাইর কইর‌্যা দ্যান।
    -- ঠাকুরপো নাই।
    --কোথায় লুকাইছে?
    --লুকাইব ক্যন? সেদিনের পুলাপান! ভদ্রভাবে কথা কও। শান্তিঠাকুরপো কাইল রাত্রে বাড়ি ফিরে নাই।
    - --কই গ্যাছে?
    -- আমি কি জানি! পার্টির কাজে নানান জায়গায় যাইতে হয়।
    -- আমাদের কাছে খবর আছে যে উনি কাইল রাত্রে এইবাড়িতেই ঘুমাইছেন।
    -- আচ্ছা? আমি কী মিছা কথা কইতাছি?
    -- দরজা খুইল্যা দেন। মিছা কি হাচা আমরা পরীক্ষা কইর‌্যা দেখুম।
    -- দাঁড়াও, তালার চাবি মা কই রাখছেন খুইজ্যা দেখি!
    অবশেষে সরযূবালা চাবি দিয়ে দরজা খুলে দিলেন। ওরা হুড়মুড়িয়ে বাড়িতে ঢুকল। দুটো দরজায় দুজন রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। পাইপগান বাহিনি একএকটা ঘরে ঢুকে মশারি তুলে তুলে দেখল। বাথরুম পায়খানা ছাদের চিলেকোঠা কিছুই বাদ গেল না।
    রাইফেল হাতে বেপাড়ার ছেলেটি বলল--চিড়িয়া ভাগল বা!

    ভেতর থেকে কাজের মাসি চা নিয়ে এল।
    --এক চুমুক খেয়ে দ্যাখ, খাঁটি দার্জিলিং!
    -- বাঃ, পেলে কোথায়?
    -- বাঘাযতীনের মোড়, ঢাকা স্টোর্স।
    সেই ঢাকা স্টোর্স? রমেনের চোখের সামনে অর্ধশতাব্দী আগের কালো কালো নেগেটিভ ছবিগুলো আস্তে আস্তে ডেভেলপ হয়।
    শান্তিকাকু বুঝতে পারেন, সামান্য হেসে বলেন-- তিনি আর নেই। এখন ভাইপোরা বসে। কিন্তু বিজনেস ভাল বোঝে।
    সাইকেলে করে একজন এসে গণশক্তি দিয়ে যায়।না, ঠিক যায় না, দাঁড়িয়ে থাকে। শান্তি খেয়াল করলেন।
    -- ও, আজ মাসের পয়লা?
    তারপর ঘরের ভেতরে গিয়ে কিছু টাকা নিয়ে ফিরে আসেন। ভদ্রলোক রসিদ কেটে খুচরো মিলিয়ে চলে যান।
    শান্তি কাগজটা এগিয়ে দিয়ে হাসেন--নে, একটু নেড়েচেড়ে দ্যাখ। তোরা তো আজকাল এসব পড়িস না! তবু দেখ। মাগো বাংলা, হ্যাঁগো বাংলার চেয়ে সত্যিকথা একটু বেশিই পাবি।
    রমেন কাগজটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে।
    -- পাতা দু'একটা কমেছে মনে হচ্ছে।
    -- হতে পারে। বিক্রি কমেছে, বিজ্ঞাপন কমেছে-- পাতার আর দোষ কি! তবে এই তো শেষ নয়, প্রথমবারও নয়। আগেও হয়েছে, ঘুরে দাঁড়িয়েছি। এরাও ঘুরে দাঁড়াবে।
    --- এরা দাঁড়াবে মানে? তুমি দাঁড়াবে না?
    -- আমি? আমি শেষ হয়ে গেছি। আশি বছর পেরিয়ে আর নতুন করে কিছু করা যায় না। এখন এরা কী চায় তাও বুঝি না, আর কী চাওয়া উচিত তাও না। এখন বসে পড়েছি , তারপর শুয়ে পড়ব, শেষে চোখ বুঁজব।
    শান্তি শব্দ করে হেসে ওঠেন।
    -- হ্যাৎ! কী যে আবোলতাবোল বল!
    -- আবোলতাবোল না, এখনও মাথা চোখ কান ঠিকই কাজ করছে।
    -- সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তাই জিগাইতাছি কী করন এখন?
    --কী কইলি? কী করন? তা হইলে ঢাকাইয়া চুটকিটা মনে কর! মনে আছে? না হিন্দিমিন্দি শিখ্যা ভুইল্যা গেছস?

    শান্তির চোখে দুষ্টু হাসি ঝিকমিক করে। সেই হাসি রমেনের মধ্যে সংক্রমিত হয়। সে ছোট বাচ্চার মত দুলে দুলে বলতে থাকেঃ
    'রামধন! কী করন?
    বাবু চন্দন পেহি।
    আচ্ছা? পেহ ! পেহ ! পেহ!'
    -- বুঝলি! আমার পার্টিও এখন জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব-টিপ্লব বলে না। শুধু আগামী ইলেক্শনে জিতে ক্ষমতায় আসতে হলে কার কার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে হবে সেই অংক কষে চলেছে। পেহ! পেহ! পেহ! পাবলিকের যেন আর কোন সমস্যা নেই। তাই পাবলিকও ধীরে ধীরে--
    শান্তি কথাটা শেষ করেন না।
    রমেন প্রথম যৌবনে শোনা একটি গানের কলি গুনগুন করে-- আ অ্যাম বিগিনিং টু ফরগেট ইয়ু, লাইক ইয়ু ফরগট মি!
    --- তুমি মেম্বারশিপ রিনিউ করাও নি?
    --নাঃ!
    -- কেমন যেন ক্লান্ত লাগে। দলটা দিন দিন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট হয়ে যাচ্ছে, শুধু নামে কমিউনিস্ট। ওই ক্ষমতায় আসলে একটু পেনশন বাড়াবে, মাগগিভাতা বাড়াবে, কন্ট্রোলে চাল-গম-চিনি দেবে, খেটে খাওয়া মানুষদের জন্যে একটু বীমা করে দেবে। লেবার ল' এর বজ্রআঁটুনি খানিকটা ফস্কা গেরো হবে। এর চেয়ে বেশি দূরে এদের চোখ যায় না। বৃটিশ লেবার বা জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের চেয়ে বেশি-- ছেড়ে দে, ওদের সমান কিছু করাও মুশকিল।
    -- এবার আমি উঠব। আমার আগের বইপত্তর কিছু আছে? থাকলে নিয়ে যাব।

    --সেসব বই আজকে কোন কাজে লাগবে?
    শান্তির চোখে অপরিসীম ক্লান্তি।

    রমেন একটু সংকুচিত হয়। এই ভদ্রলোক একদিন হাতে ধরে অন্যরকমের বই পড়তে শিখিয়েছিলেন।
    এমিল বার্নসের পরে মরিস কনফোর্থের তিনটে ভল্যুম। জোর দিয়ে বলেছিলেন-- তিন নম্বরটা মন দিয়ে পড়। থিওরি অফ নলেজ, জ্ঞানতত্ত্ব। দর্শনের সার।
    বাংলাস্কুলের ছাত্তর রমেনের দাঁত ভেঙে গেল।সেই দেখে বাংলায় ইউরোপীয় ও ভারতীয় দর্শনের প্রাথমিক বই জোগাড় করে দিলেন।
    -- ভয় পাবি না। ছাপার অক্ষরে যারা এসব লিখেছে তারা নমস্য হলেও তোর আমার মতই মানুষ। খিদে পেলে সাপটে খায়, পেট খারাপ হলে কাপড়ে চোপড়ে হয়।
    রমেন হায়ার সেকেন্ডারি দেবে।ক্লাস এগিয়ে চলেছে, কিন্তু বাজারে কেশব নাগের অংকের বই পাওয়া যাচ্ছে না। রোজ তাগাদা দেয়।
    ও কাকা! আজও পেলে না? হোমটাস্ক করব কি করে?ক্লাসে প্রপার্টিজ অফ ট্রাংগল, সাইন ল, কোসাইন ল-- কী সব হয়ে যাচ্ছে, নাগাল পাচ্ছি না যে!
    অবশেষে অফিস পাড়া থেকে এল কেশব নাগ। খুলেই চক্ষু চড়কগাছ!
    -- এ যে ইংরেজিতে লেখা। আমি বুঝবো কি করে! আর আমি তো পরীক্ষার ফর্মে বাংলা মিডিয়ম লিখেছি। বোর্ডের পরীক্ষায় প্রবলেম হবে না?
    -- দূর! ইচ্ছে করে এনেছি। কলেজে গিয়ে সবই ইংরেজিতে পড়তে হবে, এখন থেকে অভ্যেস কর। অংক পরীক্ষাটা ইংরেজিতে দিবি, বুঝলি হাঁদারাম?

    --দু'দুবার সিআরপি রেইড করল। তাই সব বই সরিয়ে ফেলতে হল, এর বাড়ি, তার বাড়ি। তোর বই আমার বই-- সব। এমার্জেন্সি উঠলে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে আর কোন বইয়েরই হদিস পেলাম না।
    -- আচ্ছা, তুমি নাকি এমার্জেন্সিতে গৌরকিশোর ঘোষ ও জ্যোতি দত্তের সঙ্গে একই সেলে ছিলে? ওদের কথা একটু বল না! কেমন করে সময় কাটাতে? খুব আড্ডা দিতে?
    শান্তি হাসেন।
    -- একদিনে অত সব হবে না। তবে যদি এখানেই বাথরুমে গিয়ে মাথায় দু'ঘটি জল ঢেলে আমার সঙ্গে পাত পেড়ে বসে ভাত খেয়ে নিস তো কিছু বলতে পারি। খাবি তো বল? মৌরলা মাছের ঝাল রেঁধেছি।

    রমেনের মন এক আশ্চর্য বিষাদে ছেয়ে যায়। একদিন এই ছাদই তার স্বাভাবিক আশ্রয় ছিল। সকাল-বিকেল-রাত্তির যখনই বাড়িতে ঢুকবে তখনই আসনপিঁড়ি হয়ে বসে দু'থালা ভাত মেরে দেবে, এই তো দস্তুর ছিল। খাঁটি বাঙাল!
    কিন্তু এখন সময়ের সঙ্গে শেকড় কত জায়গায় ছড়িয়ে গেছে, ভাবলে অবাক লাগে। নাঃ, ওকে এবার উঠতে হবে।
    শান্তি বুঝতে পারেন। তাই আর এক কাপ চায়ের ফরমাস করেন।
    -- শোন, গৌরবাবু জমিয়ে গল্প করতে পারতেন। ব্রজদার গুল্পসমগ্র পড়েছিস? কোলকাতার লন্ডন হওয়ার গল্প এর কাছে লাগে না! তবে আমি জানতে চাইতাম ওঁর প্রথম জীবনের বামপন্থী পর্যায়ে রেলের ট্রেড ইউনিয়ন করার গল্প। জানিস তো, উনি দার্জিলিং আসাম বেল্টের ট্রান্স-হিমালয়ান রেলওয়ে ইউনিয়ন, চা-বাগানের শ্রমিক আন্দোলন এসবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওঁর সাগিনা মাহাতো চরিত্র সেই সময়ের অনুভবের ফসল।
    তারপর উনি কী করে কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে এম এন রায়ের চ্যালা হলেন, মানে র‌্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট আর কি! জানিস, শুধু বাঙালী বুদ্ধিজীবি শিবনারায়ণ রায় আর গৌরবাবু ন'ন, হিন্দিবলয়েরও কিছু ইন্টেলেকেচুয়াল এদের দলে ভিড়ে ছিলেন।
    -- হ্যাঁ, একজনের নাম জানি, কবি হীরানন্দ বাৎসায়ন ' অজ্ঞেয়'। আমি উঠছি, কিন্তু জ্যোতির্ময় দত্তের কথা কিছু বললে না? বুদ্ধদেব বসুর এই জামাইটি লোক কেমন?
    -- কেন, তুই জানিস না?
    -- আমি কী করে জানব? আমি তো তখন নাকতলার থার্ডস্কীম পাড়ায় নতুন তৈরি 'কবিতা ভবন' এর ছাদে সন্ধ্যেবেলায় বালব জ্বালিয়ে কিছু তরুণকে কবিতা পড়তে দেখতাম, অবশ্য দূর থেকে। আমাদের মত উচ্চিংড়ের দল তখন কাছে ঘেঁষতে পারে?
    -- লোক মন্দ ছিলেন না, বেশ আমুদে। তবে একবার আমার সঙ্গে লেগে গেল। হয়েছে কি, উনি বেশ আহ্লাদ করে বললেন-- এই যে সাদার মধ্যে লাল পোলকা ডট্‌ দেওয়া শার্টটি আজ পরেছি ওটা আমার মেয়ে শনিবার দিন দেখা করতে এসে দিয়ে গেছে। ওরই জামা, আমায় পরতে দিয়েছে। আমার হাড়পিত্তি জ্বলে গেল। বললাম-একদম ফালতু কথা বলবেন না, মশাই!
    কতকাল আগের কথা। আজকাল তো ছেলেরা হরদম এরকম শার্ট পরে।

    (৬)

    " আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে"

    রিকশা থেকে নেমে থই পাই না। চাষীপাড়ার পুকুরের পাড় ঘেঁষে থকথকে কাদা আর কচুগাছের ঝোপের পাশ দিয়ে যে একচিলতে পায়ে চলা পথ ছিল সেটার কোন চিহ্ন নেই। একটা বেশ পাকাপোক্ত পিচঢালা রাস্তা, সাপের জিভের মত দুভাগ হয়ে গেছে। শংকরের বাড়িটা এখানেই কোথাও ছিল না? ওদের বাড়িটা ছিল ছোট, একটেরে। সামনে মথুর সর্দারের বাড়ি। সম্পন্ন চাষী পরিবার ।পাশের দু'তিনটে বাড়িও ওদেরই। গোটা পরিবারে মোট একুশটি ভোট। তাই ইলেক্শনের আগে মথুর সর্দারের ওজন বেড়ে যেত। কংগ্রেস , সিপিএম-- সবারই মিষ্টি মিষ্টি কথা। কিন্তু সে বাড়িটাও উধাও। একটা ক্লাবঘর। তাতে ঘাসফুলের চিহ্ন আঁকা। তবে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে দু'একটা ছোট ছোট লালপতাকা বাঁধা, রোদে জলে কেমন ফিকে হয়ে ঘাড় গুঁজে রয়েছে।
    ক্লাবের সামনে গুলতানি করা ছেলেদের জিগ্যেস করতেই দেখিয়ে দিল পাশের চারতলা ফ্ল্যাটবাড়িটা-- ওটাই মথুরপরিবারের। কিন্তু আমিতো খুঁজছি শংকরদের বাড়ি, যেটা মথুরদের পেছনে ছিল। সেটাও পাওয়া গেল। সেটা ভেঙেও ফ্ল্যাট উঠছে। কাঠামোটা দাঁড়িয়ে গেছে। তাতে দো'মেটের কাজ চলছে। শেষ হয়ে দখল পেতে অন্ততঃ একবছর।
    ততদিন শংকরের পরিবারও মথুর সর্দারদের অ্যাপার্টমেন্টের একটি ফ্ল্যাটে থাকছে।
    সিঁড়ি দিয়ে উঠে ফ্ল্যাটের গায়ে নেমপ্লেট দেখে বেল টিপতেই দরজা খুলে দিল সদ্য যৌবনের দেহলিতে কদম রাখা এক তরুণী। আমি সসংকোচে নাম বললাম। মেয়েটির ভ্রূপল্লবের ধনুকের ছিলায় টান পড়ল। একটু বিরক্ত মুখে বলল-- বাবা বাড়ি নেই। একটু বেরিয়েছে।
    -- কখন আসবেন?
    উত্তরে চোয়াল শক্ত হল।
    তা জেনে তুই কী করবি রে শালা?

    আমি নিরুপায়।
    --- তোমার মা আছেন? একটু ডেকে দেবে? বলবে রমেনকাকু এসেছেন।
    মাঝবয়সী মহিলা এসে আমাকে দেখে নমস্কার করে বললেন -ভেতরে আসুন।
    সোফায় বসে জল আর বিস্কুট খেতে খেতে চারদিকে তাকিয়ে দেখি।
    ভদ্রমহিলা বুঝলেন।
    -- ও শ্রীকলোনী বাজারে গেছে, আধঘন্টা হল; এক্ষুণি এসে পড়বে। আপনাদের গল্প অনেক শুনেছি।আমি একটু রান্নাঘরে যাই। চা না কফি?
    যান্ত্রিক ভাবে শেষের অপশনটার নাম বলি। আর অনুরোধ করি ব্যস্ত না হতে।
    উনি সহজ ভঙ্গীতে হেসে বললেন- কোন সংকোচ করবেন না, খিদে পেলে বলবেন। কেক খাবেন? আমার মেয়ে বানিয়েছে। কাল আপনার বন্ধুর জন্মদিন ছিল। আজকের খবরের কাগজগুলো এই রইল। আর টিভি চালিয়ে দিচ্ছি। আমি আসি।
    অন্যমনস্ক ভাবে চ্যানেলগুলো ঘোরাই, বার্সেলোনার পুরনো ম্যাচ, ক্রিকেটে শচীন-সৌরভ-দ্রাবিড়ের গৌরবগাথা, মফঃস্বলের কলেজে শাসকদলের ছাত্র ইউনিয়নের রক্তচক্ষু। রাজনৈতিক নেতাদের বাঁধাগতের বিবৃতি।

    সেদিন বাংলা বন্ধ। নেতাজী সুভাষ রোডে ছ'নম্বর বাসের রুটে মোড়ে মোড়ে পিকেটিং। আজকে অফিস যাওয়া চলবে না, কাকু বাড়ি ফিরে যান।
    আমি, শংকর, বিমলেন্দু আরও কয়েকজন মহানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছি। রথতলা থেকে সেকেন্ড স্কীম, সুর্যনগর, বাঁশদ্রোণী হয়ে নেতাজিনগর।
    বাস বিশেষ চলছে না। যে দুটো বেরিয়েছিল তারা গোটা দুই পেটো আর আধলা ইঁট পড়তেই সুড়সুড়িয়ে গড়িয়া ডিপোতে ঢুকে গেছে।
    কিছু ছেলে সাইকেলচারীদের চাকার হাওয়া খুলে দিচ্ছে।
    -- হাসপাতাল ? ওষুধের দোকান? রোগী কই? ওসব চালবাজি চলবে না। আসলে সাইকেল করে অফিস যাবেন! আরে এত বেশি প্রভুভক্ত কুকুর হবেন না। প্রতিবাদ করতে শিখুন। শিরদাঁড়া সোজা করুন। বাঙালী খালি তেল মারতে শিখেছে। এইজন্যেই আমাদের কিস্যু হয় না।
    সিগ্রেট ধরিয়ে তিনজনে ভাগাভাগি করে টানি।
    -- হ্যাঁরে, মেশোমশাই আজ কী করছেন?
    শংকর অন্যদিকে তাকায়। তারপরে কলকে ফাটানো গোছের ব্যোমটান দিয়ে সিগ্রেটটা প্রায় শেষ করে দিয়ে বলে-- বাবা, কাল রাত থেকেই রাইটার্সে রয়ে গেছে। আগামী কাল ফিরবে।
    -- কেন রে?
    -- আরে গতবারের ঘটনাটা মনে নেই? আমি বোঝালেও বুঝবে না। গোঁ ধরে বসে আছে।
    আমরা চুপ মেরে যাই।
    ওর বাবা বীরেশবাবু কংগ্রেসি ইউনিয়নের সদস্য। গত বাংলাবন্ধের দিনে ছেলের কথা না শুনে পায়ে হেঁটে নাকতলা থেকে রাইটার্সে গেছলেন ডিউটি করতে। ঢুকতে পারেন নি। গেটে বাম ইউনিয়নের কিছু পিকেটার্স ওঁকে আটকে দিয়ে দুয়ো দিয়েছিল। মুখে গালে থুতু দিয়ে নকশা করে বলেছিল-- চন্দনের ফোঁটা দিয়ে সাজিয়ে দিলাম।
    বীরেশবাবু বাড়ি ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। স্ত্রী কান্নাকাটি করেছিলেন। ডাকাবুকো বড় মেয়ে চেয়েছিল বাবাকে নিয়ে যাদবপুর থানায় যেতে। নতুন ওসি সীতেশ ঝা নাকি খুব কড়া! বীরেশ রাজি হন নি। বললেন-- ওরা যে আমার পাশের টেবিলে বসে! একসাথে চাকরি জয়েন করেছিলাম , সেই বছর কুড়ি আগে।
    এবার আমরা ওঁর বাড়ি গিয়ে বলেছিলাম-- ছাড়ুন না মেশোমশায়! কত লোক সি এল নিচ্ছে, বাড়িতে বসে আছে। সন্ধ্যেবেলা পদ্মশ্রীতে সিনেমা দেখতে যাচ্ছে।
    উনি রেগে গেলেন।
    তোমরা বুঝবে না। তোমরা অন্ধ। নেহেরুর দেশগড়ার স্বপ্ন নিয়ে কিছু ভেবেছ? ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া পড়েছ? আর মেয়েকে লেখা চিঠিগুলো? না। তোমরা পড়বে মাওয়ের রেডবুক। যে চীন আমাদের দেশ আক্রমণ করল, পেছন থেকে ছুরি মারল, এখনও বারোহাজার বর্গমাইল জমি দখল করে রয়েছে সে তোমাদের প্যারাডাইস। আর সলিল চৌধুরিরও মাথা খারাপ। কী যেন একটা গান লিখেছে?
    বিমলেন্দুর ফাজিল স্বভাব। আমার চোখের ইশারা দেখেও দেখল না। দু'কলি গেয়ে উঠলঃ
    বলিষ্ঠ দুই হাতে তুলে নাও হাতিয়ার
    রক্তের নিশান ওড়াও।
    মহাচীন আর ভিয়েতনামের পথে আজ
    মুক্তির কদম বাড়াও।
    কারখানা প্রান্তরে নগরে ও বন্দরে
    গ্রামে গ্রামে বিপ্লবের---।

    -- থামো! ঢের হয়েছে।
    এক ধমকে ওকে চুপ করিয়ে দিলেন বীরেশমেশো।
    আমি বিরক্ত। বিমইল্যার যদি কুন আক্কল থাকে!

    উনি ক্লান্ত কন্ঠে বিড়বিড় করতে লাগলেন-- এগুলো গান নয়, লোক খ্যাপানো। ছেলেছোকরাদের মাথা খাওয়া। নিজে তো দিব্যি বোম্বে গিয়ে করে খাচ্ছেন। এদিকে এরা লেখাপড়ার পাট তুলে দিয়ে--।

    কলিংবেলের আওয়াজটা কি বিচ্ছিরি! ক্যারক্যার করে বেজে উঠেছে। উঃ, একটা ডি ডং লাগালে ভালো হত না?
    বৌদি দরজা খুলে দিয়েছেন। দু'হাতে দুটো থলে নিয়ে শংকর ঢুকেছে। তালঢ্যাঙা মানুষটি, তায় দুটো ভারি থলে। বেশ মজার দেখাচ্ছে।
    -- আজকে চারাপোনাই আনলাম। জ্যান্ত। আর কচুশাক এনেছি, নারকোল দিয়ে, ভালো কাটোয়ার ডাঁটা পেয়ে গেলাম।
    -- ওসব হবে’খন। আগে দেখ কে এসেছে!
    ড্রইংরুমটা এল শেপের হওয়ায় ও আমাকে আগে খেয়াল করেনি। কয়েক সেকেন্ডের নৈঃশব্দ। ও চোখ কুঁচকে মন দিয়ে দেখছে।
    আমি বিব্রত। এসে কি ঠিক করিনি? ও কি খুশি হয় নি?
    ওর হাতের মুঠো আলগা হয়ে বাজারের থলিটা মাটিতে পড়ে গেল।

    স্খলিত পায়ে একটু টলমলিয়ে আমার দিকে এক'পা দু'পা করে এগিয়ে আসছে ছ’ফুটিয়া এক বালক চেহারার মানব, দাড়িগোঁফ নেই। কিন্তু মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো সাদাচুল বলে দিচ্ছে বয়েসের হিসেব।
    --রমেন? তুই রমেন? কতকাল পরে!
    বৌদির চেহারায় টেনশন, প্রায় কান্না কান্না ভাব। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। এর মধ্যেও খেয়াল হয় যে মহিলা স্বামীর কাঁধ পর্য্যন্ত।
    আমি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। দু'পা এগিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরি। আমার পাঁচ -সাত উচ্চতায় মাথাটা প্রায় ওর বুকের মধ্যে; ও কিছু বিড়বিড় করে চলেছে।
    ওকে ধরে সোফায় বসিয়ে দিই। মহিলা এক গ্লাস জল ও একটা সাদা ট্যাবলেট ধরিয়ে দিয়েছেন। একটু একটু করে খাও, তাড়াহুড়ো কর না।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৪ নভেম্বর ২০২০ | ১৭৯০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন