এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • ফেরারি ফৌজঃ ৮ম পর্ব

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২০ ডিসেম্বর ২০২০ | ২৮২৯ বার পঠিত
  • তৃতীয় ভাগ

    আঠের বছর বয়েসের গদ্য

    'তোমাতে নই, আমাতে নই বিষয়ে আমি লিপ্ত,
    লাগাম ছেঁড়া পাগলঘোড়া তিনটে ভীষণ ক্ষিপ্ত।
    বিজন মাঠ, বধ্যভূমি
    ধরতে গেলাম, তখন তুমি
    সরে দাঁড়াও অশ্ববাহন এবং বলদৃপ্ত,
    রক্তে নাচাও মাতাল ঘোড়া তিনটে ভীষণ ক্ষিপ্ত।'
    -----শক্তিপদ ব্রহ্মচারী

    (১)

    ফেরারি ফৌজের রোল কল?
    ডেকচিতে ফুটন্ত ভাত উথলে উঠেছে। বিজনদা উঠে গিয়ে ঢাকনা তুলে দুটো ভাত টিপে আবার চাপা দিল।
    --আর দু-তিন মিনিট; তার পরেই নামিয়ে দেব।
    --ঠিক আছে; কোন তাড়া নেই।
    শংকর অন্যমনস্ক ভাবে বলে বিজনদার তামাকের প্যাকেট থেকে এক চিমটি তুলে হাতের তেলোয় ডলতে থাকে। আমি মাদুরের কোণা থেকে একটা কাঠি বের করে দাঁত খোঁচাতে থাকি। দরজার ফাঁক দিয়ে জুন মাসের দুপুরের একচিলতে রোদ্দুর মেজেতে মৌরসীপাট্টা নিয়ে বসে আছে। উঠোনের জলের বালতির ওপর বসে একটা কাক ডাকছে।মাঝে মাঝে ঠোঁট দিয়ে খোঁচা মেরে জল খাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
    ওটা বিজনদার বাসন ধোয়ার বা কাপড় কাচার জল। ভাবছি কাকটাকে তাড়িয়ে দেব কি না, ব্যাটা নিজেই বোর হয়ে উড়ে গেল।
    বিজনদা ভাত বাড়ছে, সেই মুসুর ডাল, বাগানের গন্ধলেবু, আলুসেদ্ধ আর ডিমের বড়া। আমার কোন অসুবিধে হয় না। আমাদের চিনেমাটির প্লেটে দিয়ে নিজে কাঁসার কানিওঠা থালায় নিল, বাঙাল ভাষায় বলে--কাঁসার বেলি। এই বয়সেও অনেকটা ভাত খায় বিজনদা, এবং কাঁসার থালায়।
    আমি জানি থালাটার গায়ে বিজনদার মায়ের নাম লেখা আছে--সরোজিনী। এই থালাটা ছোড়দি ওকে দিয়ে গেছে। মায়ের নাকি সেইরকমই ইচ্ছে। শেষকাজের সময় বিজনদা পুরুলিয়ার জেলে।
    শংকর ভাল করে খায় --ডাল দিয়ে মেখে, লেবু চটকে, একটু হাপুস হুপুস করে। আজ কিন্তু খাওয়ায় মন নেই। কিছু একটা ভাবছে। অন্যদিন হলে আমার ডিমের বড়ার থেকে খামছে অন্ততঃ একটা তুলে নিয়ে নির্বিকার মুখে চিবোতে থাকত--যেন ওটাই স্বাভাবিক। আজকে আমি গোটা ডিমটাই খেয়ে নিলাম-- ও যেন দেখেও দেখল না।
    হাত-টাত ধুয়ে আবার মাদুরে ফিরে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছি কি বিজনদা গামছা এনে আমাদের হাত মুখ মুছিয়ে দিল।
    উঃ , এখনও সেই বড়পিসিমাগিরি!
    শংকর আবার তামাক ডলে কাগজ পাকিয়ে একটা সরু ফানেলের মত করে তাতে কাঠি দিয়ে ঠুসতে লাগল। আমি নিজের প্যাকেট খুলে একটা ধরিয়ে অন্যটা বিজনদার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।
    আগে আমরা ইচ্ছে করে একটা কাঠির থেকেই তিনজন ধরাতাম-- কুসংস্কারের বেড়া ভাঙতে হবে যে!
    এখন ওসব নিয়ে ভাবি না। জানি, কোন লাভ নেই।
    বিজনদা একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল-- এবার?
    --এবার কী?
    -- তোরাই বল, আমি খালি জিগ্যেস করছি।
    -- রমেন হিসেব দেবে। ও ফেরারী ফৌজের আটজন ঘোড়সওয়ার চিত্রগুপ্তের লেজার খুলবে--শালা ব্যাংকের ফোতো ক্লার্ক!
    -- কেন? তুই বলবি না কেন?
    -- ফেরারি ফৌজ প্রোজেক্টটা ওর, আমার পিতৃদেবের নয়। ওই বলুক।
    আমি কাশতে থাকি, উঠে গিয়ে উঠোনে পেয়ারা গাছের গোড়ায় একদলা থুতু ফেলি। তারপর মাথা নেড়ে বলি--হক কথা। হিসেব আমিই দেব। সোজা হিসেব। শুনে নাও, ভুল হলে ধরিয়ে দিও।
    আটজন ঘোড়সওয়ার।
    দু'জন-- রণক্ষেত্রে শহীদ।
    একজন-- দলত্যাগী, রেনেগেড।
    একজন-- কর্কটরোগে প্রয়াত।
    একুনে চারজন।
    হাজির ও সাক্ষাৎ হইয়াছে-- বাকি চারজন।
    এই অবশিষ্টদের ব্যালান্সশিট নিম্নরূপঃ
    একজন--শিল্পপতি, বাড়ি গাড়ি ও ব্যাংক ব্যালান্সের মালিক।
    একজন-- অবসরপ্রাপ্ত সংসারী; দুর্বল হার্ট। কিন্তু স্বাস্থ্যের ব্যাপারে বেপরোয়া।
    বাকি দুইজন-- পত্নীপরিত্যক্তা, এক্কাগাড়ির সওয়ার।
    --ব্যস্‌?
    --ব্যস্‌।
    --- তাহলে? ব্যাক টু স্কোয়ার এ?
    বিজনদা যেন খেলনা কেড়ে নেওয়া বাচ্চা।
    শংকর নড়ে চড়ে বসে। নিভে যাওয়া পাকানো সিগ্রেটটা মেজেতে ঘষে ঘরের কোণায় ছুঁড়ে দেয়।
    -- আমি বলি কি আমরা অতীত হাতড়ে দেখি--কেন আমরা পথে নেমে ছিলাম। গোড়া থেকে--মানে বিপ্লবের বুলি কপচেও কেন সেই ডাকাতের দলে ভিড়েছিলাম? সবাই নিজের নিজের কথা বলবে, আলাদা করে। রমেন শুরু করুক। আর খালি গল্প বললে হবে না। কোন যুক্তি দিয়ে জাস্টিফাই করা না, পিওর ফ্যাক্ট বলবে আর শেষে বলতে হবে আজকে কে কী ভাবছে; নাকি ভাবাভাবির দিন শেষ?
    নে, শুরু কর শালা!
    আমাকে অবাক করে বিজনদা বলে ওঠে-ধ্যোর বাল!
    আমরা তিনজনেই হেসে ফেলি।

    -- শংকর কী বললি? আমরা বিপ্লবের বুলি কপচে কেন ডাকাতের দলে ভিড়েছিলাম? ডাকাতের দলে? না তো।
    -- না বললেই হল? আমাদের খাওয়া পরা চলত কী করে? বাপের হোটেলে? বাপের হোটেলে খেয়ে বিপ্লব? তোর, আমার, বিজনদার জন্যে প্রতি মাসে একটা করে সাদা খাম ধরিয়ে দেওয়া হত না? তার উপর নাম ও নামের পাশে টাকার অংক লেখা থাকত না? যেমন আমার খামের উপর লেখা থাকত--" শংকর--১৩৫/-"। এগুলো তাহলে কী?
    -- আমরা ছিলাম প্রফেশনাল রেভোলুশনারি--পেশাদার বিপ্লবী। একেবারে লেনিনের ' কী করিতে হইবে' (What is to be done) মেনে। ওগুলো ছিল আমাদের মাসিক বেতন বা ওয়েজ।
    বিজনদা মুখ খোলে-- এর মধ্যে লেনিনকে নিয়ে টানাটানি কেন?
    --বাঃ! সব ভুলে গেলে? তুমি ছিলে সেকশন কম্যান্ডার। তাই তুমি পেতে ১৫০/-।
    --সেটা কি লেনিন ঠিক করে দিয়েছিলেন ?
    -- কথা ঘুরিও না। "কী করিতে হইবে" লেখায় উনি বোঝান নি যে বিপ্লব করতে হলে আগে দরকার পেশাদার বিপ্লবী সংগঠন। কারণ বিপ্লব কোন অ্যামেচার ন্যাকামো ভাব-ভালবাসা নয়। এটা ফুল টাইম ব্যাপার আর --।
    --- আর জনতার অন্ধ ভীড় দিয়ে অরাজকতা হয়, বিপ্লব হয় না। এর জন্যে চাই প্রশিক্ষিত রেভোলুশনারি। তাই আমরা--।
    --তাই আমরা ডাকাতির পয়সায় হোটেলে খেতাম, এক কামরা ঘরের ভাড়া দিতাম, ট্রাম-বাস--ট্যাক্সি চড়তাম?
    --ডাকাতির পয়সায়? ওভাবে কেন বলছিস! আমরা তো মার্সেনারি নই। পেশাদার সৈনিক মজুরি নেবে না? মাওয়ের গণমুক্তি ফৌজের সৈনিকদের বেতন দেওয়া হত না? তাই কুয়োমিন্টাংদের সৈন্যরা দলত্যাগ করে লালফৌজে যোগ দেয় নি? আর তুই বলছিস ডাকাতের দল?
    --শোন শংকর! আজ আমরা অতীত; মানছি হেরে যাওয়া অতীত। তাই বলে নিজেদের ছোট করতে হবে কেন? আত্মগ্লানি আত্মকরুণা ভাল কথা নয়। খেয়াল করে দ্যাখ,--আমাদের সংগঠনের নাম ছিল আরসিসিআই বা রেভোলুশনারি কম্যুনিষ্ট কোঅর্ডিনেশন অফ ইন্ডিয়া। আমাদের নেতা যাঁকে তোমরা কোনদিন দেখনি-- আর দেখতেও পাবে না-- ছিলেন অনন্ত সিং। হ্যাঁ, সেই চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের খ্যাতিপ্রাপ্ত অনন্ত সিং-- মাস্টারদা সূর্য সেনের ডানহাত, মিলিটারি স্ট্র্যটেজিস্ট।
    বিজনদাকে এবার লেকচারে পেয়েছে। টিউশনের ছেলেদের বোঝানোর মত করে বলতে থাকে।
    -- সূর্য সেনের ফাঁসি হল, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণে প্রাণ দিলেন। অনন্ত সিংয়ের কালাপানি হল। দেশ স্বাধীন হলে উনি আন্দামান থেকে অন্য অনেকের মত কমিউনিস্ট হয়ে ফিরে এলেন। পার্টির টেকনিক্যাল কোরের দায়িত্ব পেলেন।
    --হ্যাঁ হ্যাঁ; সবটা বল। উনি পার্টির মধ্যে একটি সমান্তরাল গোপন সংগঠন গড়ে তুললেন--নাম ছিল আওয়ার স্ট্যান্ড বা ও-এস। কিছু ডাকাতি করলেন--স্বদেশী গুপ্ত সংগঠনের কায়দায়। কমিউনিস্ট পার্টি প্রমাদ গুনল। আসলে যদ্দিন পার্টি নিষিদ্ধ ছিল ততদিন এসব বেশ কাজে দিয়েছিল। তখন উনি ষাটের দশকের শেষের দিকে একটা ডাকাতের দল গড়লেন--- এমএমজি বা ম্যান-মানি-গান।

    --ফের ডাকাতের দল! ম্যান-মানি -গান নামটা বিদ্রূপাত্মক, আমাদের বিরোধীদের দেওয়া। আমাদের আসল নাম তো বললাম-- আরসিসিআই।
    -- সে যাই বল, বাংলাবাজারে আমাদের সবাই এম-এম-জি বলেই জানে। আর স্বদেশী যুগের মত ডাকাতির পয়সায় সংগঠন চালানো!
    -- কেন? খালি স্বদেশী কেন? লেনিনের পার্টি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের চালাতে, আর্মস জোগাড় করতে এবং গোপনে ইসক্রা পত্রিকা চালাতে ডাকাতি করত না? এন বাউম্যানরা করেন নি? মন্তিস্লাভস্কির "বসন্তের দূত রুক" বইটি আমাদের অবশ্য পাঠ্য ছিল না? স্তালিন বাকু ও জর্জিয়ায় ডাকাতি করতেন না? অবশ্যই ব্যক্তিস্বার্থে নয়; পার্টি ও বিপ্লবের স্বার্থে; কোন সাধারণ মানুষের থেকে কিছু ছিনিয়ে নেওয়া হয় নি। ট্রেজারি ও জমিদারদের খাজনা --!

    --- হ্যাঁ, স্তালিনের প্রথম জীবনে ওইসব কাজকম্ম ওয়েল ডকুমেন্টেড। কিন্তু আজ মনে হয় ডাকাতিটা ডাকাতিই। নিজের পোঁদ ছোঁচাও কি অন্যের; হাত নোংরা হবেই । তাই যদি বলি যে আমরা ভেড়ার পালের মত অনন্ত সিং নামের এক প্রাক্তন স্বাধীনতা সংগ্রামীর বিপ্লবের ভাঁওতায় ভুলে ডাকাত দলের খোঁয়াড়ে ঢুকেছিলাম সেটা কি খুব ভুল বলা হবে?
    -- বিজনদা! শংকর কি ঠিক বলছে? আমাদের মাসিক ওয়েজ কি ডাকাতির টাকায়? আর অনন্ত সিং কোথায়? আমাদের সিক্রেট সংগঠনের চিফ তো "ওল্ড গার্ড" বা অবিনাশ।
    -- অনেকটা ঠিকই বলেছে। অবিনাশই অনন্ত সিং। ওঁর সঙ্গে দেখা করতে পারত শুধু টপ তিন জন। সিক্রেসির উপর উনি খুব জোর দিতেন।
    আর আমাদের ওয়েজ আসত সদর স্ট্রিট পোস্টাপিস রবারির টাকায়-- যেটা ১৯৬৮ সালে হয়েছিল। পরে ১৯৬৯ সালে স্টেট ব্যাংক ডাকাতির সময় আমরা অলরেডি অনন্ত সিংয়ের দল থেকে আলাদা হয়ে গেছি।
    -- আচ্ছা? আমি এগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। শুধু কিছু শুনেছিলাম, বীরুর কাছ থেকে। মনে হচ্ছে শংকর জানে, হয়ত ও ছিল। এখানে খুলে বলুক। পাপস্খালন বা আত্মার শুদ্ধিকরণ হোক!
    শংকর কিছু ভাবে। তারপর হঠাৎ উঠে বাইরে যায়।
    আমি চুপ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকি। বিজনদা চায়ের জল চড়ায়।
    চা ছাঁকার আগেই শংকর ফিরে আসে। পাড়ার দোকান থেকে দু'প্যাকেট সিগারেট কিনে এনেছে। মাঝখানে একটা প্যাকেট রেখে ধোঁয়া ছেড়ে জানলার দিকে তাকিয়ে বলে-- আজ এতদিন পরে সব গুছিয়ে বলা বেশ কঠিন। তবে চেষ্টা করব। ভুল হলে দাদা ধরিয়ে দেবে।
    প্রথমে সদর স্ট্রিট পোস্টাফিসের ডাকাতি।

    ২)
    সদর স্ট্রীটের সেই সকালটা
    ==================
    ১৯৬৮ সালের জুলাই মাস; বর্ষাকাল। কিন্তু গত দু'দিনে একফোঁটা বৃষ্টি হয় নি। ভ্যাপসা গরম আরও বেড়েছে। তাই ছেলেছোকরার দলটা যে একঘন্টার মধ্যে বার কয়েক কোল্ডড্রিংকে গলা ভেজাবে, তাতে আশ্চর্যের কি ?
    পার্ক স্ট্রিট ও সদরস্ট্রীটের মোহানার উল্টো দিকে কোণের দোকানটায় চা'-লেড়ো বিস্কুট, ঘুগনি, পাঁউরুটি আলুর দম, ওমলেট সবই পাওয়া যায়। আর কোণের দিকে রাখা আছে কোকাকোলার বোতল।
    কিন্তু পাঁচজন ছোকরার দলটি বসেছে দোকানের বাইরে ফুটপাথ ঘেঁষে রাখা বেঞ্চ আর দুটো কাঠের টুলে।
    --- এক প্যাকেট পানামা দিন তো?
    দোকানদার প্যাকেট এগিয়ে দিতে দিতে ভাবে-- এরা ঠিক সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে সিগ্রেট ফুঁকতে আসা ছাত্র নয়।আধঘন্টা ধরে বসে আছে। কিন্তু কথা কম। মুচকি চাপা হাসি আর কিছু অঙ্গভঙ্গী। এপাড়ায় কি কখনও আগে দেখেছে? মনে করতে পারছে না। দুজন এই গরমেও ফুলশার্ট পরে আছে। আর একজনের সোনালি চুল। তা এই সাহেব পাড়ায় অমন দু-একজন এখনও দেখা যায়।
    ওর পাশের ছেলেটি ঘড়ি দেখছে। বেলা সাড়ে নয়। এবার ও চোখ তুলে সোনালি চুলের দিকে তাকাল। সোনালি চুল আস্তে করে চোখের পাতা নামাল।
    অন্য একজন এর মধ্যেই দোকানাদারের পয়সা মিটিয়ে দিয়েছে।
    সোনালি চুল ও ঘড়িদেখা ছেলেটি এবার টুল থেকে উঠে রাস্তায় নেমেছে। একটু ক্যাজুয়াল ভাবভঙ্গী; রাস্তার এ'পাশ ও'পাশ দেখছে। কিন্তু বাঁদিকে তাকিয়ে হটাৎ ওদের ঘাড় টানটান। অন্ততঃ একশ ফুট দূরে একটি চশমা পরা ছেলে রাস্তার ধারে একটা খালি সন্দেশের বাক্স মত নামিয়ে দিয়ে আস্তে করে হেঁটে পাশের গলিতে মিলিয়ে যাচ্ছে।
    ওরা জানে যে এর মানে ওই চশমুদ্দিন প্রায় একশ ফুট দূরে একজনকে একটা সবুজ রুমাল মাটিতে ফেলে আবার ঝেড়েঝুড়ে তুলে নিতে দেখেছে। আর সবুজরুমাল দেখেছে রাস্তার ক্রসিং এ ধুতিপরা একজনকে ছাতা খুলে রাস্তা পার হতে হতে ছাতাটা আবার বন্ধ করতে। তার মানে ছাতাওলা দেখেছে--। নাঃ, এই চিন্তার সূতোর লাটাই দ্রুত গুটিয়ে সোনালি চুল পেছন ফিরে বাকিদের দিকে তাকাল।
    অন্য ছেলেগুলোও যেন আড়মোড়া ভেঙে ওর পেছন পেছন এগিয়ে গেল।
    দোকানদারের চোখে পড়ল যে দু'জন অনেকটা কোল্ডড্রিংক ছেড়ে গেছে। আরে, একটা বোতল তো খোলাই হয় নি। কিন্তু পুরো পয়সা তো আগাম দিয়ে দিয়েছে।

    নাঃ , ও এমন ভাবে দাঁও মারবে না। বারো আনার জন্যে এমনি করলে ধম্মে সইবে না। ও পয়সা ফেরত দিয়ে দেবে।
    -- ও ভাই! শুনছেন? এদিকে দেখে যান।
    কিন্তু ভাই-ভাইপোরা কিছুই শুনছেন না। কারণ, একটা লালরঙা গাড়ি, পেছনে তারের জাল, এসে সদর স্ট্রিট পোস্ট অফিসের সামনে থেমেছে।
    গাড়ির সামনে ড্রাইভারের পাশে বন্দুকধারী একজন রক্ষী। আর পেছনে জাল ঘেরা জায়গায় একটা বড় ক্যাশবাক্সের সঙ্গে আরও দুজন সশস্ত্র গার্ড হেলান দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে।
    এবার ওরা প্রতিবারের মত ভেতর থেকে বন্ধ দরজাটা খুলে বাক্স নিয়ে নামবে। কিন্তু ওরা আর নামতে পারল না।

    দরজাটা খুলে একজন চেন ও তালা লাগানো বড়সড় ট্রাংকের মত বাক্সটাকে ঠেলে দরজার সামনে খালি এনেছে তক্ষুণি দু'জন ছোকরা ওর পেটে ও গলায় ছোঁয়াল পাইপগান । আর একটু হোঁৎকামত তৃতীয়জন ট্রাংকটা টেনে মাটিতে নামাল। সিকিউরিট গার্ডের কিছু করার নেই। এত কাছ থেকে বন্দুক চালানো যায় না।
    কিন্তু দ্বিতীয়জন অবস্থা এঁচে নিয়ে খাঁচাটার কোনার দিকে সরে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে সোজা গুলি চালিয়ে দিল। গুলি সোনালি চুলের কম্যান্ডারের কানের পাশ দিয়ে সোঁ করে বেরিয়ে গেল। মুহুর্তের মধ্যে পাইপগানের জোড়া গুলি লেগে রক্ষী গাড়ির ফ্লোরের মধ্যে ধপাস করে পড়ল। পিঠ দেয়ালে , জামাটা রক্তে ভিজে উঠছে।
    এদিকে সামনের গেটে ড্রাইভার কানের পাশে ঠান্ডা ধাতব নলের ছোঁয়ায় নেতিয়ে পড়েছে। কিন্তু ওর পাশে বিপরীত দরজার দিকে বসে থাকা রক্ষী জালি লাগানো জানলার গায়ে ঠেকিয়ে রাখা মাস্কেটটিশর ট্রিগারে সকলের অজান্তে চাপ দিল। ফল হল উল্টো।আগুনের রূপোলি ফুলকি ঝলসে উঠল, তবে গুলি কারো গায়ে লাগল না।

    এবার পেছনের গেট থেকে সোনালিচুলো কম্যান্ডার এসে জালির গায়ে নল ঠেকিয়ে ঘোড়া টিপল। রক্ষীর হাতে গুলি লাগতেই ও কাতরে উঠল। এই অভাবিত ঘটনায় রাস্তার দুধারের দোকানপাট নিমেষে বন্ধ হয়ে গেল। পার্কস্ট্রীটে সাত সকালে শ্মশানের স্তব্ধতা।
    ইতিমধ্যে ডাকগাড়িটির হাত পাঁচেক দূরে থেমেছে একটি কালো অ্যাম্বাসাডর। তার চালক সিট থেকে নড়েনি, ইঞ্জিন বন্ধ করে নি। তবে সঙ্গীটি নেমে এসে খুলে ফেলল অ্যাম্বাসাডরের ডিকি।
    এই পাঁচজনের দলটি দ্রুত হাতিয়ে নিল তিনটি মাস্কেট। ডিকির মধ্যে উধাও হয়ে গেল ট্রাংক আর ওদের পাইপগান। তিনজন উঠে বসল অ্যাম্বাসাডরের পেছনের সিটে।
    কিন্তু গাড়িটি স্টার্ট নিয়ে আটকে গেল। কিশোর ড্রাইভার নার্ভাস হয়ে গেছে, ক্লাচ - একসিলেটর-ব্রেক এর কোঅর্ডিনেশন ঠিক হচ্ছে না। অভিজ্ঞ সঙ্গীটি ওকে সরিয়ে পাকা হাতে স্টিয়ারিং ধরল। গাড়ি একটু বাঁক নিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল তার উল্টোদিকে বেরিয়ে গেল।
    রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুজন--হাতে তিনটি দখল করা মাস্কেট, ওগুলোরগুলির বেল্ট রয়ে গেছে আহত রক্ষীদের কোমরে। এভাবে গেল দেড় মিনিট। গলির মধ্যে থেকে উঠে এসেছে একটি ফিয়েট। তাতে চালান হয়ে গেল মাস্কেটগুলো। এবার পেছনের সিটে সওয়ার হয়ে মিলিয়ে গেল শেষ দুই অশ্বারোহী।
    গোটা অপারেশন সম্পন্ন হল সাড়ে চার মিনিটে।

    আধঘন্টা পরে সাইরেন বাজিয়ে এম্বুলেন্স ও বিশাল পুলিশ বাহিনী যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছল তখন সদর স্ট্রিট পোস্ট অফিসের সামনে লালচে গাড়িটিকে ঘিরে মানুষের জটলা।
    এম্বুলেন্স কর্মীরা দ্রুত হাতে দুই আহত সুরক্ষা গার্ডকে স্ট্রেচারে করে তুললেন। পুলিশের একটি দল পোস্ট অফিস ঘিরে ফেলল। চশমা পরা একজন অফিসারের নেতৃত্বে একটি ছোট দল ভেতরে পোস্ট মাস্টার, স্টাফ ও অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান নিতে ব্যস্ত হল। আর একটি দল ডাকগাড়ির ড্রাইভার, অক্ষত সুরক্ষা গার্ড ও রাস্তার ওপারের চায়ের দোকানের মালিককে ইন্টারোগেট করবে বলে কালো গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে গেল।

    সেই সময় গড়িয়ার কামডহরির কাছে একটি ঝিলের পাশে বিশাল নির্জন বাগানবাড়িতে এক টাকমাথা ধবধবে গায়ের রং ষাট পেরিয়ে যাওয়া ভদ্রলোক ওঁর স্টাডি রুমে একা একা দাবা খেলছিলেন। ওঁর পরনে সাদা ফতুয়া ও বার্মিজ ধরণের লুঙ্গি। পায়ের কাছে একটি দেশি কুকুর অলস ভঙ্গিতে গা ছেড়ে দিয়ে থাবা চাটছে।
    বই দেখে বটভিনিক ও টালের একটি বিখ্যাত গেমের ওপেনিং চালগুলোকে বদলে বদলে নতুন ভাবে খেলছিলেন। কিন্তু আজ খেলায় মন নেই। মাঝে মাঝে কান খাড়া করে কিছু শোনার চেষ্টা। ঘন্টা দুই কেটে গেল।
    এমন সময় হঠাৎ পোষা কুকুরটা গরর্‌ করে উঠল। উনি প্রায় লাফিয়ে উঠে জানলা দিয়ে দেখলেন যে দারোয়ান গেট খুলে দিচ্ছে আর বাগান পেরিয়ে এদিকে হেঁটে আসছে সোনালি চুল।উনি নিজেকে সংযত করলেন।
    গম্ভীর মুখে বললেন--রিপোর্ট!
    --- সাকসেসফুল। এভরিথিং ওকে।
    -- ভেহিকল্স্‌?
    -- ওকে, ইন দ্য হাভেন। নেমপ্লেট কালার চেঞ্জড্‌।
    -- এনি ক্যাজুয়ালটি?
    -- টু গার্ড্স ইন্জিওর্ড, নট ফ্যাটাল; নান অ্যাট আওয়ার সাইড।
    লম্বা মানুষটি বেঁটে সোনালিচুলোকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেলেন।

    ৩)

    পিদিমের সলতে পাকানোর আগে

    -এঃ বর্ণনাটা এক্কেবারে হুইলারের দোকানের শস্তা থ্রিলারের মত হয়েছে। বিজনদার কপালের কিছু রেখা গভীর হল।

    শংকর গম্ভীর হয়ে জানতে চায় ভুল কী বলেছে, বিশেষ করে ও যখন কোন সাহিত্যিক নয়। স্কুল কলেজের ম্যাগাজিনেও কখনো খাপ খোলে নি।

    -- এ হল বাজারি পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টের মত। বাইরের থেকে দেখা একটি ডাকাতির বর্ণনা;-- এতে ধরা পড়েনি ছেলেগুলোর আবেগ, যারা জানত যে ওরা যে কাজটি করতে যাচ্ছে তাতে মরে যাওয়ার বা ধরা পরার বা টর্চার হয়ে জেলে পচার সম্ভাবনা খুব বেশি। তবু ওরা এই কাজে নেমে পড়ল। অভিজ্ঞতা নেই, তবু। ওরা বিশ্বাস করেছিল যে যা করছে সেটা নিজের বা নিজের পরিবারের জন্যে নয়, বৃহত্তর আদর্শের জন্যে। জানত ওরা কেউ ডাকাতির ভাগ পাবে না। কারণ ওরা পেশাদার ডাকাত ছিল না, বরং অনেকটা অগ্নিযুগের স্বদেশী বিপ্লবীদের মত। তাই পই পই করে বলা ছিল যে যেন কোন মানুষের প্রাণ না যায়।

    --- তাই নাকি? কে বারণ করেছিল? ওল্ড গার্ড? অবিনাশ? তবু ১৯৬৯ এর রাসেল স্ট্রিট স্টেট ব্যাংক ডাকাতির সময় নিরীহ চৌকিদার তোরণ বাহাদুরের প্রাণ গেল।

    বিজনদা চুপ মেরে যায়। বোঝে, কথা আর এগোবে না। কিন্তু কী করে এদের বোঝাবে পঞ্চাশ বছর আগের সেই দামাল ছেলেগুলোর আবেগ।

    বীরু আবৃত্তি করত-- 'জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য,
    চিত্ত ভাবনাহীন।'

    হ্যাঁ, সেই অপারেশনের আগের দিন রাত্তিরে বেহালার সত্যেন রায় রোডের একটি বাড়িতে খাওয়া দাওয়া হয়েছিল। তারপর সবাই মিলে গান গেয়েছিল। বীরু আবৃত্তি করেছিল 'বন্দীবীর'। ও কি একটাই কবিতা জানত? শেষে ঘুমুতে যাওয়ার আগে সবাই একসঙ্গে এবং আলাদা আলাদা করে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরেছিল। অনেকটা আজকের দিনে ক্রিকেটের মাঠে ফিল্ডিং করতে নামা দলের মত।

    তফাৎ একটাই,-- ওরা বুঝেছিল অনেকের সঙ্গেই হয়ত এই শেষ দেখা।একবার এ রাস্তায় পা বাড়ালে এভারেস্টের চুড়োয় পতাকা তোলার দিন হয়ত থাকবে হাতে গোণা কয়েকজন।

    চিফ কম্যান্ডারের মনে এ নিয়ে কোন সন্দেহ ছিল না। হাসতে হাসতে সহজ ভঙ্গীতে বলেছিল-- লং মার্চের দু'হাজার লী পথ পেরিয়ে মাও যখন ইয়েনানের গুহায় পৌঁছুলেন তখন ওঁর বাহিনীর সৈনিকের সংখ্যা কয়েকহাজার থেকে কমতে কমতে মাত্র ছ'শো। তবু সেটা চিয়াংয়ের বিরুদ্ধে রণনীতিগত জয় ছিল। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াল লালফৌজ। হারিয়ে দিল আগে জাপানকে, তারপর বিশাল কুয়োমিন্টাং ফৌজকে।যখন ১৯৪৯ সালে তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে বিজয় উৎসব হচ্ছে তখন গণমুক্তি ফৌজের সদস্য কয়েক লাখ। কাজেই ইতিহাসের উপরে ভরসা রাখো।

    পরের দিনের পোস্টাফিস অপারেশনের কম্যান্ডার সোনালী চুলো হ্যান্ডসাম ছেলেটি একটু গলা তুলে বলল-- কমরেড্স্‌! আমাদের নাম আগামী দিনে ইতিহাসে লেখা থাকবে। আমরা হয়ত সেদিন দেখব না, কিন্তু আমাদের দেশ, পাড়া, পরিবারের লোকজন আমাদের নিয়ে গর্ব করবে।

    কেন?

    কারণ, আমরাই সেই হাতে গোণা লেনিনের প্রফেশনাল রেভোলুশনারি ---যারা চাকরি খুঁজি নি, ক্যারিয়ারিজমের রাস্তায় হাঁটি নি, বা ওই একগাদা বাক্যবাগীশ নকশালদের মত দেয়ালে দেয়ালে রং দিয়ে ' বন্দুকের নলই রাজনৈতিক শক্তির উৎস--মাও' লিখে নিজেদের কী -হনু-রে ভাবি নি।

    আমরা সোজা বন্দুকের নলকেই হাতে তুলে নিয়েছি। কালকের অভিযান রাষ্ট্রশক্তির ভিৎ কাঁপিয়ে দেবে। আর আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ ওল্ড গার্ড এর কাছে -- উনি আমাদের এই সুযোগ দিয়েছেন বলে।

    কৃতজ্ঞতা ? তা তো বটেই। ওরা সবাই কৃতজ্ঞ অবিনাশের কাছে।

    বিশেষ করে বীরু। গত কয়েক মাস ওর যেন একটা ঘোরের মত কেটেছে।

    ওঁর একটা গাছপালায় ঘেরা পুকুরওলা বাগানবাড়িতে তিনমাস ধরে ওরা অপারেশনের অভ্যাস করেছে। ওঁর কন্ডাক্ট করা মেন্টাল কন্ডিশনিং এর ক্লাস করেছে। বাড়িতে ছোট করে সদর স্ট্রিট পোস্টাফিসের ডামি মডেল বানিয়ে ডামি কার ও আর্মস ইউজ করে শ্যাডো প্র্যাকটিস করা হয়েছে।

    তার আগে সিনিয়র চারজন রেকি করেছে দু'মাস ধরে। পায়ে হেঁটে মেপে নিয়েছে থানা থেকে পোস্ট অফিসের দুরত্ব, গাড়ি চালিয়ে স্টপ ওয়াচ ধরে দেখেছে থানায় খবর গেলে গাড়ি নিয়ে পুলিশের দল কতক্ষণে পোস্ট অফিসে পৌঁছতে পারে। বারবার মিলিয়ে দেখা হয়েছে মাসে কতদিন এবং সপ্তাহে কোন কোন দিন ক্যাশ নিয়ে সরকারি ভ্যান পোস্ট অফিসে আসে।

    তারপর তৈরি করা হয়েছে অপারেশনের ব্লু-প্রিন্ট, অল্টারনেটিভ প্রিন্ট। কোর টিমের চারজন এতে হাত লাগিয়েছিল। কিন্তু অবিনাশ ছ'বার লালকালিতে দেগে দিলেন প্ল্যানের কোথায় কোথায় খামতি আছে।

    এর পর শুরু হল রিহার্সাল। প্রথমবার গোটা অপারেশনটায় লাগল পঁয়তাল্লিশ মিনিট, ওরা বুঝতে পারে নি। কিন্তু অবিনাশ স্টপ ওয়াচ ধরেছিলেন। বললেন যে এই সময়টাকে অভ্যাসের মধ্য দিয়ে চার মিনিটে নামিয়ে আনতে হবে।

    ওরা হতাশ হয়ে বসে পড়েছিল। বুঝে গেছল এ অসম্ভব। কিন্তু অনন্ত সিং অন্য ধাতুতে তৈরি। ধরে ধরে পাখিপড়া করে বোঝালেন যে কোথায় কোথায় সময় বাঁচানো যায়। পুরো ব্যাপারটা নির্ভর করছে টিমএর কোঅর্ডিনেশন ও টাইমিং এর উপর। ওদের দেখতে বললেন -- দ্য গ্রেট ট্রেন রবারি সিনেমা ও বাউম্যানের জীবনী। দেখালেন বাউম্যান কতবার কী কী ভুলের জন্যে ধরা পড়েছিলেন আর কীভাবে মারা গেলেন।

    হ্যাঁ, একমাসের পরে সময় কমে পনের মিনিটে দাঁড়াল, কিন্তু আর কমছিল না। তখন উনি টিম বদলে দিলেন। যারা সাপ্লাই ও সিগন্যালিংর এর দায়িত্বে ছিল তাদের থেকে কয়েকজনকে আনা হল মূল অপারেশনে এবং কয়েকজনকে ফেরত পাঠানো হল সিগন্যালিংয়ে।

    হাতে হাতে ফল। তিনমাসের মাথায় সময় কমে দাঁড়াল সাড়ে চারমিনিটে। উনি বললেন--যথেষ্ট, এতেই হবে।

    ইতিমধ্যে বীরু ছেড়ে দিয়েছিল ওর কাকার বাড়ি। কাকাকে বলল--তোমরা বুঝবে না। আওয়ার প্রোগ্রাম ইজ ডেথ, আওয়ার ট্রিস্ট ইজ উইথ ডেথ। ফর ইয়োর টুমরো, উই আর গোয়িং টু গিভ আওয়ার টু-ডে!

    কাকা আর একটাও কথা বলেন নি।

    আর কী আশ্চর্য, ‘ওল্ড গার্ড’ এর পরিকল্পনা ফলে গেল। সমস্ত অপারেশনটাই নিখুঁত; আমাদের একজনও আহত হয় নি । অবশ্য সিকিউরিটির দু’জন গুলি খেয়েছে, কিন্তু সেটা গুরুতর নয়, হাসপাতালে সেরে উঠছে।

    টাকাপয়সা ঠিক জায়গায় রাখা আছে, তার খুঁটিনাটি আমাদের মত চুনোপুঁটিদের জানার কথা নয়—তাই জানি না । তবে প্রতিমাসের এক তারিখে সেল কম্যান্ডারদের হাত দিয়ে সবাই পেয়ে যায় একটি সাদা খামের ভেতরে কিছু কড়কড়ে নোট। আমিও পাই – খামের উপর সুন্দর হাতের লেখায় কালি দিয়ে ইংরেজিতে লেখা—‘রমেন, ওয়েজ ১৩০/-‘।

    আমাদের মাসিক খরচা। আমরা ঘর-পরিবার ছেড়ে বিপ্লব করতে এসেছি, আমরা পেশাদার বিপ্লবী, যেমনটি লেনিনের ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ বইয়ে বলা আছে। আমরা সৈনিক, তাই মাইনে পাই । কিন্তু স্যালারি নয়, ওয়েজ—অর্থাৎ মজুরি। আমরা তো ভাড়াটে সৈনিক বা মার্সেনারি নই , আমরা ভবিষতের গণমুক্তি ফৌজের সৈনিক । আমরা শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থের প্রতিনিধি।

    নিজেদের জামাকাপড় নিজেরা কাচি, কিন্তু রান্নাবান্না করি না । শস্তায় ভাত-ডাল-মাছের টুকরো লেবু চটকে মেখে খাই—পাইস হোটেলে। একজোড়া ভাল জামাকাপড় রাখি –টেরিলিনের শস্তা শার্ট ও টেরিকটের প্যান্ট। ঠিক দশটা নাগাদ নিজেদের শেল্টার থেকে বেরিয়ে যাই। আর বেশ রাত্তির করে ফিরি। লোকজন ভাবে কোথাও সেলসম্যানের কাজ করি—‘বেচুবাবু’ শব্দটি অর্ধশতাব্দী আগে কোলকাতার মুখের ভাষায় চালু হয় নি ।

    তা বেশ, সারাদিন কী করি?

    অনেক কিছু। প্রধান কাজ হচ্ছে নতুন সৈনিক রিক্রুট করা। নিজেদের চেনাপরিচয়, বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়দের ভেতর থেকে। একদিন নয়, দু’দিন নয়; দিনের পর দিন । খরচা হয় নানান ভাবে। নতুন হলেও- হতে -পারে রিক্রুটদের চা আর চার্মিনার সিগ্রেট খাওয়ানো; বাসের ভাড়া নিজের খাইখরচা ইত্যাদি। ভাল রেস্পন্স পেলে পরের স্টেজে সেলের ইনচার্জের সঙ্গে বৈঠক। প্রসেসটি আরও এগিয়ে গেলে ওর স্বতন্ত্র থাকার ব্যবস্থা করা, ওর গ্রুপ, মেন্টর এবং কাজের এলাকা ঠিক করা।

    আমি রমেন কখন যেন নিজের স্মৃতির অ্যালবাম হাতড়াতে শুরু করেছি।

    ৪) রমেনের স্মৃতির কোলাজঃ

    ছ'মাস পর স্টেটস্‌ম্যান পত্রিকায় একটি রিপোর্ট বেরুল।
    -সদর স্ট্রীট ব্যাংক ডাকাতি চিন্তায় ফেলেছে। লালবাজারের তাবড় তাবড় গোয়েন্দারা হতভম্ব। পার্ক স্ট্রীট থানা এত কাছে , তবু এত দু:সাহস!
    আর হলিউড ফিল্মের মত এমন প্রিসিশন, কয় মিনিটে অপারেশন শেষ! এতো পাকা প্রফেশনালদের কাজ, এরা কারা?
    পুলিশের ইনফর্মাররা সমস্ত ক্রাইম ডেন চষে ফেলেছে। পুরনো দাগীদের ধরে এনে আড়ং ধোলাই দিচ্ছে, কিন্তু কেউ জানে না এটা কার কাজ। এই প্রক্রিয়ায় অনেক পুরনো ফেরারের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, অনেক পুরনো বন্ধ ফাইল খুলছে, কিন্তু আসলীদের কোন পাত্তা নেই। হাওয়ায় গন্ধ নেই, চার লাখ টাকা নিয়ে কর্পূরের মত উবে গেল ছোঁড়াগুলো।

    ভবানীপুরের নন্দন রোডের কাছে একটি টেবিলে তিনটি ছেলে খাচ্ছে,-- তন্দুরী রোটি আর তড়কা ডাল। একজন হাত ধুয়ে কাউন্টারে টাকা দিতে গেল। কিন্তু ছোটটি শেষ রুটির টুকরোয় কামড় দিয়ে কচকচিয়ে পেঁয়াজকুচি আর লংকার ছুঁচলো মুখ চিবিয়ে জড়ানো আওয়াজে বললো-- উঁহু, উই গো ডাচ!
    বাইরে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওরা গাঁজা পার্কে ঢুকে ঘাসের ওপর বসলো।
    সিনিয়র যুবক রোগা ক্যাংলা কেলটে ছেলেটাকে বল্লেন-- রমেন, এ' মাসের ওয়েজ নাও।
    ব্যাগ থেকে একটি সাদা কাগজের খাম বের করে দিলেন ওর হাতে।
    ওতে লেখা Ramen- wage Rs.130/-.
    ও খাম খুলে দেখে নিল তাতে আছে তেরোটি দশ টাকার নোট।
    সিনিয়র বল্লেন-- শোন, তুমি তো পরিবারের সঙ্গে থাক। বিছানা আর খ্যাঁটনের চিন্তা নেই তাই তোমার ওয়েজ কম। এদিয়ে গোটা মাস চালাতে হবে। বিভিন্ন মিটিংয়ে যাওয়ার খরচ, চা জলখাবারের খরচ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার খরচ, আর তুমি কাউকে রিক্রুট করলে তাকে এন্টারটেন করার খরচ- এতে হয়ে যাবে।
    রমেন মাথা নাড়ে।
    হ্যাঁ, গড়িয়াহাটে নির্মলা বলে একটা নতুন রেস্তোরাঁ খুলেছে।
    তাতে মশলা দোসা, ওনিয়ন দোসা ৬৫ পয়সা, কফি ৩০ পয়সা আর দুটো পানামা সিগ্রেট । শালা, রোজ একটাকায় স্বর্গসুখ। এতে তিরিশ টাকা গেল। ট্রাম-বাস আর হন্টনে সারা মাসে যাবে ৫০ টাকা-- এখনো ৫০ টাকা বাকি।
    কতদিন যে কফিহাউসের আড্ডায় যাওয়া হয় নি। এবার একদিন যাবে।
    মৌলানা আর প্রেসিডেন্সির বন্ধুদের, ছোট চিকি, বড় চিকি, স্নেহাংশু, সবাইকে ডেকে, সব্বাইকে কফি-কোল্ড কফি পাকোড়া খাওয়াবে। কবি তুষার রায়কে ডেকে কফি খাইয়ে ওনার মজাদার সব গল্প, ফট-সন্দেশের গল্প শুনবে।
    আর নাকতলার বন্ধুরা কি দোষ করল!
    গড়িয়া কলেজের পাশে কাঠের বেঞ্চিওলা পোঁদে-গরম ঠেক, আর বাস স্ট্যান্ডের পাশে পাখার নীচে গদিওলা পোঁদে -আরাম ঠেক!
    আর গীতশ্রী! কোন দিন কি সাহস করে ওকে বলতে পারবে কাফে-ডি- অনিল এ চল?
    ও তো একদিন কলেজে সবার সামনে জিগ্যেস করেছিল--- তুমি কি মনে কর নক্সালবাড়ির লাল আগুন একদিন সারাদেশে ছড়িয়ে যাবে?
    -- হ্যাঁ, যাবে। একদিন নিশ্চয়ই যাবে।
    -- সেই আগুনে পুড়বে কারা? মাও সে তুং এর বাচ্চা যারা।

    -- তোমার কাকা কংগ্রেসের নেতা, তুমি তো এসব বলবেই। একটু ভাবো, পড়াশুনো কর, তাহলে বুঝবে।
    -- হ্যাঁ, তোমরা তো খুব পড়াশুনো করছ, লজ্জা করে না!
    এই তোরা শোন! এই ছেলেটা না স্কটিশে ইকনমিক্সে ভর্তি হয়েছিল। এ'বছর ড্রপ নিয়ে গড়িয়া কলেজে আমার এক ইয়ার নীচে ম্যাথস্‌ নিয়ে ভর্তি হয়েছে। আজেবাজে রাজনীতি করলে এইরকমই হয়।
    রমেন বলতে চাইল-- না, গীতশ্রী! রাজনীতি নয়, ওটা অজুহাত। সত্যি কথাটা আমার কমরেডরাও জানেনা। আমি শুধু তোমার জন্যে কলেজ বদলেছি, শুধু তোমাকে রোজ দেখতে পাব বলে।
    কিন্তু বলতে পারলো না। ভালবাসার চেয়ে রাজনীতি বড়। কংগ্রেসী বাড়ির মেয়েকে বিপ্লবী রাজনীতিতে কনভিন্সড্‌ না করে তার সঙ্গে প্রেম করা যায় না।

    -- রমেন, কি ভাবছ? শোন, রোববার দিন বিকেল তিনটেয়, চিড়িয়াখানায়, বাঁদরের খাঁচার সামনে।

    ভবানীপুরে হাজরা মোড়ের কাছে বড় রাস্তার ওপর কটা দোকান ঘর, পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। দোতলায় একটি সওদাগরি অফিস। তাতে তাক ভর্তি নানারকম ফাইল। গোটা কয় টেবিল-চেয়ার।দুটো রেমিংটন টাইপরাইটার। রোববারের সকাল দশটা।
    টেবিল ঘিরে ওরা জনা ছয়, একজন সদ্য কলেজ পেরোনো মেয়ে। মেয়েটি বড় গম্ভীর, কখনো হাসে না।রমেন জেনে গেছে ওকে ডাকতে হবে রীনাদি বলে।
    ফলে বাকি ছেলেগুলোর একটু ইল্লি হয়। ওরা চায় মেয়েটি একটু হাসুক, সহজ হোক।
    রমেনের কানে ফিসফিস করে সুকান্ত বলে-- ভাবটা দেখ, যেন বিপ্লবের জন্যে উৎসর্গীকৃত প্রাণ। শালা, বিপ্লবীরা ডাউন-টু-আর্থ হয় না? পরশু চিড়িয়াখানার মিটিংয়ে আসেনি। জিগ্যেস কর , ভারি গম্ভীর সব কারণ বলবে। আসলে ওর একজন লাভার আছে। সে অন্য গ্রুপে। তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।
    -- তো কি হয়েছে? প্রেম করা কি প্রতিবিপ্লবী কাজ?
    -- ধ্যেৎ, তাই বলেছি? কিন্তু ভড়ং না করে সত্যি কথাটা বললেই পারে।
    ওরা সবাই অপেক্ষা করছে ওদের গ্রুপ লীডার মিথিলেশের জন্যে। উনি সদ্য জন্ডিস থেকে সেরে উঠেছেন। আজ ডাক্তার দেখিয়ে আসবেন। রমেনের মনে ব্যাপক কৌতূহল। আজই প্রথম দেখবে ও মিথিলেশকে। ও জানে পোস্ট অফিস ডাকাতিতে মিথিলেশের বিশেষ ভূমিকা ছিল। যদিও এই নিয়ে কেউ কোন কথা বলে না, তবু, যদি একটু গল্পটা জানা যায়! ব্যাপারটা কিরকম করে ঘটেছিল।
    রমেন ছটফট করে উঠে জানালার কাছে যায়, নীচে ট্রাম-বাস-ট্যাক্সির চলাচল দেখতে থাকে।
    পেছন থেকে সুকান্ত বলে -- ছটফট করছিস কেন? জানলা দিয়ে মেয়ে দেখছিস? ওদিকের ফুটপাথে কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ কাঁধে মেয়েটিকে দ্যাখ, ঠিক যেন ""গৃহদাহ'' ফিল্মের সুচিত্রা সেন।
    -- তাহলে এদিকের ফুটপাথে সদা স্কার্ট পরা মহিলাটি হলেন "দীপ জ্বেলে যাই''।
    ওরা হেসে ওঠে। রীনা এইসব অপোগন্ডসুলভ হরকতে একটু বিরক্ত ভাব দেখান।
    --- আরে, ঐযে ট্রাম থেকে নেমেছে ওকে চিনি। আমাদের পাড়ায় চারু মার্কেটের গলিতে থাকে।
    -- কোনজন?
    -- ধ্যুৎ, ওই যে ভাগলপুরি গাই!
    -- মানে?
    -- উ: এটাও জানিস না?
    সুকান্ত মানে বোঝায়। রমেনের দন্তবিকশিত হয়।
    --জানো সুকান্তদা, আমারও না একটা ভাগলপুরি গাই জুটেছিলো, এখন কেটে গেছে। পাড়ার ডাক্তার আমার শরীর ভেঙে যাচ্ছে দেখে বলছে নিয়মিত এক পো' করে দুধ খেতে, পয়সা কোথায়? ইস্‌, তখন যদি বলতো!
    ওদের ফ্যাকফ্যাক হাসিতে রীনা ভারি বিরক্ত হয়ে বলেন-- বেটার লাফ উইথ আস, নট অন আস্‌। হাসির গল্পটা আমরাও একটু শুনি।
    আতংকিত রমেন চোখের ইশারায় না-না করে ওঠে। কিন্তু সুকান্ত যেন দেখেও দেখলো না।
    --- রীনাদি, জানেন রমেন কী বলছে? আর ভাগলপুরি গাই ছেলেরা কাকে বলে জানেন?
    রীনার চেহারা রাগে বেগুনি হয়।
    রমেন দুহাত জোড়ে।
    --বিশ্বাস করুন, আমি ঠিক ওভাবে বলিনি। এটা সুকান্তদা বাড়িয়ে বলছে। আর এসবের সঙ্গে আপনার কোন সম্পর্ক নেই।
    -- আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না রীণাদি। এই রমেন বয়সে সবচেয়ে ছোট, কিন্তু মহাবিচ্ছু, একেবারে ধানীলংকা।
    -- না রমেন, এসব সহ্য করা যায় না। আমরা কি বখামি ইতরামি করতে ঘরদোর ছেড়ে এখানে এসেছি?
    রমেনের চেহারা কাঁদো-কাঁদো। মুখদোষে মার গলে! কেন যে এত কথা বলে ও, একটু চুপ করে বসতে পারে না। ওকে আজ দল থেকে বের করে দেবে? তাহলে ওর যে বিপ্লব করা হবে না। ঠিক আছে, এরাই সব নাকি? প্রেসিডেন্সি কো-অর্ডিনেশন আছে, লোকায়ন আছে।
    দরজা খুলে যায়। মিথিলেশ এসেছে। ফর্সা একহারা চেহারা, গালে হাল্কা চাপ দাড়ি। আরে, একে তো রমেন চেনে। বছর দুই আগের সিপিএম এর ছাত্র ফ্রন্টের ডাকসাইটে নেতা, বেহালায় বাড়ি।
    মিথিলেশ ব্যাগ নামিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ে। সিগ্রেট ধরায়।
    --এ’জায়গাটা আমরা টিউটোরিয়ালের জন্যে ভাড়া নিয়েছি, তা তোমাদের বইখাতা কোথায়? সবাইকে একটা অংক-সিভিক্সের বই আর একটা পুরনো খাতা আনতে বলেছিলাম না?
    সবাই বাধ্যছেলের মত কাজ করে।
    কিন্তু, দরজাটা এবার বেশ জোরে খুলে যায়।
    দরজা আটকে দাঁড়িয়ে একজন চল্লিশ পার রাশভারী ভদ্রলোক, হাতে একটি গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ। অবাক বিস্ময়ে বলেন-- হু আর ইউ? এখানে আমার অফিসে ছুটির দিনে কি করছ? চাবি কোথায় পেলে?

    মিথিলেশের স্মার্টনেস গায়েব। থতমত খেয়ে বলে --আমরা আপনার কোম্পানির অমিতকুমারের থেকে অনুমতি নিয়েছি। রোববার-রোববার এখানে সিলেক্টেড স্টুডেন্টদের জন্যে স্পেশাল টিউটোরিয়াল চালাই।
    -- তুমি কি মাস্টার!
    -- হ্যাঁ।
    --তাহলে সিগ্রেট খাচ্ছ কেন? আর তোমার এই সব ছাত্র? মাস্টারের সামনে সিগ্রেট খাচ্ছে! আমি অমিতের সঙ্গে কথা বলবো।
    গজগজ করতে করতে উনি বেরিয়ে যান। আমরা ভাবি- যাক, শালা খোচর তো নয়।
    রীনা চৌধুরির রমেনের ব্যাপারে অভিযোগটাকে মিথিলেশ বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না। রমেনকে বেশি চ্যাংড়ামি করার জন্যে বকলেন বটে, কিন্তু ও দেখলো ওনার চোখ দুটো হাসছে।
    -- আমরা এবার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পড়বো লেনিনের "হোয়াট ইজ টু বি ডান্‌''--- কী করিতে হইবে।
    বিশেষ চ্যাপ্টারগুলো মার্ক কর, সবাই। তাতে বলা হয়েছে " পেশাদার বিপ্লবী'' বা প্রফেশনাল রেভল্যুশনারিদের কথা। আমরা সংক্ষেপে বলি PR ।
    আমাদের সংগঠনের লক্ষ্য এই পি আর তৈরি করা, ওদের নিয়ে কাজ করা।

    হতভম্ব রমেন হাত তোলে।

    --এক মিনিট; আমি জানতে চাই গণসংগঠনের ব্যাপারে আমাদের দল কী ভাবছে?

    মিথিলেশের চোখের পাতা পড়ে না।

    আমরা গণসংগঠনে বিশ্বাস করি না। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে গণসংগঠনে পুলিসের Mole সহজে ঢুকতে পারে। তাই আমরা বিশ্বাস করি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনে, এবং তা হবে অবশ্যই পেশাদার বিপ্লবীদের।

    -- কিন্তু, কিন্তু-- আজ অবদি যা শুনে দেখে এসেছি, মানে যেমন ধরুন কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা মেহনতী জনতার বিভিন্ন ফ্রন্ট আগে বানায়-- যেমন ছাত্র, ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষকসভা, মহিলা সংগঠন।
    --এগুলো লেনিনের বক্তব্যের গৌণ দিক। শুধু এই দিকটাকেই হাইলাইট করে সংশোধনবাদীরা জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। আমরা লেনিনের শিক্ষার বিপ্লবীদিকের ওপর জোর দিচ্ছি।
    এবার সুকান্ত বলেলেনিন যে বলেছিলেন গিভ মি টুয়েলভ প্রফেশনাল রেভলুশনারি , অ্যান্ড আই উইল আপটার্ন দ্য হোল ওয়ার্ল্ড, সেটা কখনো এইসব সিপিআই-সিপিএম বলে? না। ওরা ভয় পায়।

    কী জানি বাবা, লেনিন কবে এইসব অলুক্ষুণে কথা বলে গেছেন।
    -- রমেনকে আজ ওই দুটো বই পড়তে দাও--‘কী করিতে হইবে’ আর দুই ভল্যুমে এম মন্টিস্লাভস্কীর লেখা "বসন্তের দূত রুক'', অনুবাদ অশোক গুহ।
    -- রুক কে?
    --- রুক ছিলেন লেনিনের বলশেভিক কোরের সিক্রেট পার্টি সংগঠনের প্রাণপুরুষ, এন বাউম্যান। ১৯০৫ এর ব্যর্থ বিপ্লবে মারা যান। উনি বহুবার ধরা পড়েছেন, আবার পালিয়েছেন। জারের পুলিশ ওনাকে তন্ন তন্ন করে গোটা রাশিয়া খুঁজে বেড়াত।
    --- এমনি কারো নাম তো শুনিনি!
    -- কোত্থেকে শুনবে? এগুলো তো ওরা প্রচার করে না, করলে ওদের বিপদ। তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? এই দেখ, "হোয়াট ইজ টু বি ডান'' এর উৎসর্গপত্রে এন বাউম্যানের নাম। ইসক্রা পত্রিকার গুপ্তপ্রেস উনি চালাতেন।
    -- আচ্ছা? আমাদের বিপ্লব নিয়ে ধ্যানধারণা খানিকটা ওই অনুশীলন-যুগান্তর দলের চিন্তার মত নয়?
    দু'জন হেসে ফেলে।-- বেড়ে বলেছিস, লাগসই।

    মিথিলেশ গম্ভীর হয়ে বলে-- অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের সম্বন্ধে হালকা ভাবে কথা বলবে না। মানছি, ইতিহাস শুধু বিজয়ীদের মনে রাখে। কিন্তু সাময়িক ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন মানেই তাঁদের চিন্তা ভুল, এমন তো নয়! আসলে আমরাই তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরী--- সরকারি কমিউনিস্টেরা নয়।
    অফিসটিতে তালা লাগাবার সময় ঠিক হল এখানে আর বৈঠক করা ঠিক হবে না।

    রমেন মন দিয়ে পড়ে ফেলে ''বসন্তের দূত রুক''। চমৎকার রোম্যান্টিক লেখা, থ্রিল ও সাসপেন্স এ ভরা।
    সেই সাইবেরিয়ার প্রান্তর দিয়ে ট্রেন ছুটে যাওয়ার সময় পুলিশের স্পাইকে তাসের জুয়োয় আটকে দিয়ে বাথরুম থেকে বরফের ওপর লাফিয়ে পালিয়ে যাওয়া আবার পার্টি সমর্থক ডেন্টিস্টের বাড়িতে শেল্টার নিতে গিয়ে তার যোগসাজসেই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া!
    আর ১৯০৫ এর পেট্রোগ্রাডের সেই অভ্যুত্থান! তার প্রস্তুতি! শ্রমিকদের হাতিয়ারবন্দ করা!
    এবং ব্যর্থতা; শেষে ব্ল্যাক হান্ড্রেড এর ভাড়াটে গুন্ডার হাতে বাউম্যানের মৃত্যু। এরপর পেত্রোগ্রাদের রাস্তায় বিশাল শোকমিছিল। রমেনের চোখের পাতা ভিজে যায়।
    তবে কিছুদিন পরে বুঝতে পারে ওর সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে যখন ইস্ক্রাপন্থীরা গুপ্তপ্রেস দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন তখন্‌কার একটি বর্ণনা।
    একটি গাঁয়ের ঘরে সেই গোপন ছাপাখানা। একটি মেয়ে আর দুজন কর্মী আগামী সংখ্যার প্রকাশন নিয়ে ব্যস্ত। সব প্রায় ঠিক। কিন্তু লেনিনের একটি বাইরে থেকে পাঠানো ছোট প্রবন্ধ এখনও এসে পৌঁছয়নি যে। বিশেষ দূত এক মহিলা সেসব নিয়ে আসবেন।
    অবশেষে সেই মহিলা পৌঁছে গেলেন। বাইরে তুষার বৃষ্টি। মোটা মত মহিলা শীতে কালিয়ে গেছেন।উনি ওনার কোট খুলতে লাগলেন। আর রোগা হতে থাকলেন। ভেতরে গায়ে গায়ে বেঁধে এনেছেন গোপন ইস্তেহার। কোট নামাতেই উনি হয়ে গেলেন একহারা সুন্দরী মহিলা। আর কি কান্ড! বাউম্যান দৌড়ে গিয়ে তাঁকে চুমো খেতে লাগলেন। আসলে তিনি বাউম্যানের স্ত্রী, হেডকোয়ার্টারের গোপন কর্মী। ওঁদের দেখা হল এক বছর পর।
    রমেন এবার রোমাঞ্চিত। তাহলে বিপ্লবী হতে গেলে আনন্দমঠের সন্ন্যাসী হতে হবে না! রোম্যান ক্যাথলিক পাদরীশও নয়! রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা যেমন মাছমাংস খান, তেমনি সত্যিকারের কমিউনিস্ট বিপ্লবীরাও বেশ রসে বশে থাকেন।
    --দূর বোকা! মার্ক্সের ছিলেন জেনী, এংগেলসের এক আইরিশ বিপ্লবী মহিলা। লেনিনের ক্রুপ্‌স্‌কয়া, স্তালিনের তো মেয়েও ছিল। আর মাও?
    -- ওনার তো চারটে বউ।
    -- বাজে বকিস না! প্রথম বিয়ে তো বাল্যবিবাহ-পুতুলখেলা। দ্বিতীয় বউকে ফাঁসিতে লটকে দেয়া হলে মাও সারারাত কেঁদে কবিতা লিখেছিলেন-- I have lost my proud poplar!
    ----বেশ, কিন্তু তৃতীয় বউ? কাব্যে উপেক্ষিতা? লং মার্চের সাথী, অতগুলো বাচ্চার মা। শেষে অপেরার হিরোয়িন ল্যাং পিং এর সঙ্গে দেখা হতেই আগের জনকে তালাক! ধম্মে সইবে? মেয়েটা তো প্রায় আদ্দেক বয়সের।
    -- ওতো লাভ ম্যারেজ, বয়সের কথা কোত্থেকে আসছে?
    --ছো: লাভ ম্যারেজ! মাও তখন নয়াচীনের একমেবাদ্বিতীয়ম! উনি চাইলে কোন মেয়ে না করবে?
    -- এসব চীপ বুর্জোয়া অপপ্রচার!
    মিথিলেশ বলে-- এইসব অনর্থক তক্কাতক্কি! এসব চীনের পার্টি ও জনগণ বিচার করবে? আমাদের কি মাথাব্যথা? বরং এই ম্যাপটাকে দেখ, ফোর্ট উইলিয়মের। রমেন, ভাব তো কোথায় কোথায় এল এম জি বসালে ফোর্ট উইলিয়মের চারদিকে ঘেরাবন্দী করে অন্তত: দশঘন্টার মত ফোর্ট উইলিয়ম থেকে সৈন্যেরা বেরোতে না পারে।

    রমেন ভ্যাবাচাকা খায়। ফোর্ট উইলিয়ামের ম্যাপ! মানে?
    আমরা কি ইস্টার্ন কম্যান্ডের ঘাঁটি দখল করতে যাচ্ছি? কবে? এই ক'জন মিলে!এ কোথায় এসে পড়েছি? পাগলাগারদে?

    --এই আমাদের মেইন প্রোগ্রাম, ক্যালকাটা আপসার্জ! কোড নেম--‘ক্যাল আপ’।
    ও ভাবতে থাকে।
    কি করে এদের সঙ্গে জুটলাম!
    গত বছর স্কটিশ চার্চ কলেজের ইকনমিক্স ডিপার্টমেন্টের এক সিনিয়র স্টুডেন্টে বাসবদার বাড়িতে যাওয়া হয়েছিল, কিছু বইয়ের লেনদেন এবং আড্ডা।
    উনি তখন ভারতে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের জায়গায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তত্ত্বের প্রবক্তা।
    ওনার মতে নকশালরাও সিপিএম এর ব্যুরোক্র্যাটিক কালচার নিয়ে এগোচ্ছে। তাই ওদেরও কোন ভবিষ্যৎ নেই। আর চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব যে ভাবে এগোচ্ছে তাতে মনে হয় এখন বুড়ো মাওয়ের ডেভলাপমেন্ট জৈবিক নিয়মেই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন কমরেড চিয়াং চিং হলেন (মাওয়ের চতুর্থ স্ত্রী, পরে দেং জিয়াও পিং এর আমলে চারচক্রের প্রধান হিসেবে বন্দী এবং সম্ভবত: জেলেই প্রয়াত) বিশ্ববিপ্লবের নেতা ইত্যাদি ইত্যাদি।
    রমেন সব সময়েই নতুন কথা এবং মাইনরিটি ভয়েসের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাই সে ভরদুপুরে হাজির দক্ষিণ কোলকাতায় শওঁর সরকারি চাকুরে বাবার ফ্ল্যাটে। গিয়ে দেখে সেখানে আরেকজন তরুণের সঙ্গে ওঁর তুমুল তর্ক চলছে। তার মধ্যে কিছু কথাবার্তা কোডে হচ্ছে, যার মানে বোঝা ওর অসাধ্য। সে যাই হোক, একসময় রমেন উঠে দাঁড়ায়।
    সেই অন্য ছেলেটিও, অনেকটা বক্সার মহম্মদ আলির মত দেখতে, উঠে দাঁড়ায়। বলে- চল, বাস স্টপ অব্দি একসঙ্গে যাই।
    সিনিয়র দাদাটির সঙ্গে মহম্মদ আলির চোখে চোখে কথা রমেন দেখতে পায় ।

    তৃতীয় দিন কলেজের ক্যান্টিনে মামুর দেয়া কাগজের আগুনে রমেন চার্মিনার ধরাচ্ছিল, বাসব ওর পিঠে হাত রাখল।
    -- নীচে রাস্তায় চল, তোর সঙ্গে কথা আছে।
    ও চমকে উঠলো। কথা ঘোরানোর চেষ্টায় বললো--দেখেছ বাসবদা, এখন থেকে চার্মিনারের প্যাকেট দাম বেড়ে ২৮ পয়সা হয়ে গেছে। আর ভেতরে একটা পাতলা সাদা কাগজও জোড়া হয়েছে। বিজিত বলছিল-- চারুবালা আজকাল সায়া পরা শুরু করেছে।
    -- বাজে কথা ছাড়্‌। সেদিন আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় গিয়েছিলি? সোজা বাসস্টপ তো যাসনি। ওই ছেলেটা নিশ্চয় তোকে বিবেকানন্দ পার্কে নিয়ে গেছল। তারপর চা-সিগ্রেট খাইয়েছে আর তোকে বলেছে বাসব জিগ্যেস করলে এসব অস্বীকার করতে।
    রমেনের হাওয়া বন্ধ। ও তোতলাতে থাকে।
    -- শোন, ন্যাকামো বন্ধ কর। তুই কী বলবি আর কী বলবি না—সব জানি! ও আমার পুরনো বন্ধু। যা বলছি মন দিয়ে শোন। ও একটা ফ্যাসিস্ট অর্গানাইজেশনের সঙ্গে যুক্ত। ওরা ইয়ং ছেলেদের নিয়ে খুব ভাও দেয়। লেনিন-স্তালিন-বাউম্যান-জেরজিনস্কি আওড়ায়। তারপর ক্যাল-আপ এর কথা বলে।
    -- ক্যাল-আপ?
    -- হ্যাঁ, হ্যাঁ, ক্যালকাটা আপসার্জ। বিপ্লবের এমন গেঁড়ে ব্লু-প্রিন্ট কোথাও পাবি না। এদের কোন ইডিওলজিক্যাল কথাবার্তা বলতে শুনতে পাবি না। শুধু স্টেনগান, এল এম জি, মর্টার এইসব। এদের লং মার্চের বোকা-- প্রোগ্রাম আর মাওয়ের ইয়েনান অব্দি কয়েক হাজার লি লং মার্চ একদম আলাদা ব্যাপার। তোকে নিশ্চয়ই আবার কোন পার্কে বা সিনেমা হলের সামনে দেখা করতে বলেছে? খবর্দার যাবি না।
    -- সত্যি কথা বলতে কি, কালকেই বিকেল সাড়ে তিনটেয় ভিক্টোরিয়ার সামনে দেখা করার কথা।
    -- এদের কাজকম্মো সব পঞ্চাশ বছর আগের অনুশীলনী, যুগান্তর দলের মতন।
    --- বাসবদা, এদের তাত্ত্বিক নেতাটি কে?
    -- পরে কখনও জানতে পারবি। এক বিগড়ে যাওয়া প্রাক্তন বিপ্লবী। ছোটবেলায় ভূতের গল্পে পড়িসনি তান্ত্রিকবাবার পিশাচসিদ্ধ হবার সাধনা করতে গিয়ে নিজেই পিশাচ হয়ে যাওয়া? প্রায় সেইরকম।

    না, আমি সেদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখতে পূর্ব নির্ধারিত জায়গায় যাইনি। বেশ কিছু মাস কেটে যায়। ওদের কথা প্রায় ভুলে গেছলাম। কিন্তু তাহলে কী করে আজ ওদের সঙ্গে বসে আছি?

    জানি, বসে আছি বিজনদার জন্যে। এমন ভালমানুষ বিজনদা, সবার জন্যে ভাবে। ওকে না বলা মুশকিল। ও আমার পেছনে অনেক টাইম ইনভেস্ট করেছে। রাজনৈতিক পন্ডিতিতে কাঁচা, কিন্তু কোন ভড়ং নেই। আমি বিজনদাকে ভালবাসি।

    আর কিছু? বলে ফেল; মনের অগোচরে পাপ নেই।

    হ্যাঁ, আমি বুঝি যে আমার ভেতরে একটা আমোদগেঁড়ে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ছেলেমানুষ লুকিয়ে আছে। ওই বন্দুক তুলে নেওয়ার স্বপ্ন! অন্য পার্টিগুলিতে আগে সমর্থক হও, তার পরে এজি গ্রুপ মেম্বার, তারপর ক্যান্ডিডেট মেম্বারশিপ।এতগুলো ধাপ পেরিয়ে তবে ফুলটাইম মেম্বার। শালা! যেন মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, গ্র্যাজুয়েট হয়ে তারপর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট।

    আর এখানে সোজা গণমুক্তি ফৌজের সদস্য। এমন সুযোগ কি ছাড়া যায়? একদিন অলিভ গ্রীন ইউনিফর্ম পরে স্টেনগান ঝুলিয়ে নাকতলায় ফিরব, সেদিন সবার চোখ ট্যারা হয়ে যাবে।

    তোমার ওই ‘সবার’ মধ্যে গীতশ্রীও আছে তো? ভাগ শালা!

    --রমেন, কি ভাবছ? শোন, তোমার চেনা কোন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আছেন? এই পেন্সিলে আঁকা ডায়াগ্রামটা নাও। আমি এর একটা প্ল্যান এলিভেশন আর আইসোমেট্রিক ভিউ চাই--ভাল করে ড্রয়িং শীটে আঁকা । যদি কিছু অল্পসল্প খরচা লাগে তাহলেও চলবে।
    রমেন একনজর দেখে বাড়ানো কাগজটা। তাতে সিলিন্ড্রিক্যাল একটি ফিগার, তার গোলাকার মুখটাতে গোটা পাঁচেক ফুটো।
    এটা কি কোন এলএমজি বা অমনি কোন অস্ত্রের ড্রয়িং? আবার তাকে বিশ্বাস করে কাজটা দেয়া হয়েছে! রমেন রোমাঞ্চিত বোধ করে। বিশ্বাসের সম্মান রাখতেই হবে। ও আশৈশব ল্যাবা আতাক্যালানে বটে, কিন্তু কারো বিশ্বাসের বাড়ানো হাতের সঙ্গে ধোঁকা! না:, নিজের কাছে ছোট হয়ে যাবে যে!
    সত্যি? তাহলে হায়ার সেকেন্ডারির সময় মিত্রার ব্যাপারটা কি হল?
    না, ওকে তো ঠকানো হয় নি। কিন্তু ও নাকতলা ছেড়ে হুগলী চলে গেলে আমার আর কী করার আছে।

    -- অ্যাই রমেন! ওঠ, আমরা যাই। এখন বড়দের মধ্যে ক্যাচাল হবে। তুই-আমি এসবের মধ্যে কেন থাকবো? চল, ধর্মেন্দ্র-আশা পারেখের নতুন ফিল্ম "শিকার'' এসেছে মেনকায়।
    হেলেন আছে, আর আশার "পর্দে মেঁ রহনে দো''--- টপ দিয়েছে।
    শচীন ওর দিকে হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে।
    রমেনের চটকা ভাঙে, দেখে ঘরের মধ্যে আবহাওয়া বেশ গরম। রীনা চৌধুরির মাসের ওয়েজ পুরো খরচা হয়ে গেছে। হাতে আরো বারো দিন।
    দলনেতা মিথিলেশ ওয়েজ বাড়াতে বা অ্যাডভান্স দিতে একেবারে রাজি নয়।
    -- আপনি এত কথায় কথায় ট্যাক্সি চড়লে এই ওয়েজে পোষাবে না। বাসে সবাই যাতায়াত করছে। ট্যাক্সি এমার্জেন্সিতে। আপনার রোজই এমার্জেন্সি হয় কি করে! কী এমন রাজকাজ?
    খোঁচা খেয়ে রীনা চৌধুরি প্রায় ব্যাগ গুছিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছিলেন।
    -- আপনি মেয়েদের সমস্যা বোঝার চেষ্টা করছেন না। সবসময় ভীড়ের বাসে আমি উঠতে পারি না।
    শচীন ও রমেন বেরিয়ে যায়।
    রাস্তায় শচীন ওকে বোঝায়।
    -- দেখ্‌, আমরা যখন তখন পয়সা ওড়াতে পারিনা। লোকের চোখ টাটাবে; তারপর পুলিশের খোচরের কানে যাবে।
    -- আর পোস্ট অফিস ডাকাতির মামলা সলভড্‌ হয়ে যাবে।

    ওরা দুজনে হাহা করে হেসে ওঠে।
    -- দেখ, আমরা ক্রিমিনাল নই। আমরা রাজনৈতিক ডাকাত। আদর্শের জন্যে। অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের মত।
    আমরা এই পয়সায় লাক্সারি করতে পারি না। মাগীবাজি করতে পারিনা।
    -- তা আজ যে সিনেমা দেখবো? হিন্দি ফিল্ম?
    -- ৬৫ পয়সার সাধারণ সীটে বসবো, ব্যালকনিতে নয়। এটুকু কিছু না। আমেরিকান থ্রিলারগুলো পড়ে দেখবি সব সাকসেসফুল ডাকাতরা ধরা পড়ে বেধড়ক পয়সা খরচ করতে গিয়ে আর রন্ডীবাজি করতে গিয়ে।
    ভালকথা, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন নিয়ে সিনেমাটা দেখেছিস?
    -- না:, কিন্তু প্রীতিলতার জীবনী পড়েছি, সুর্য্য সেনের জীবনীটাও।
    -- "চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ'' দু'খন্ডে, --পড়েছিস? অনন্ত সিংয়ের লেখা। পড়ে ফ্যাল, ঠকবি না।
    -- রীনাদির ব্যাপারটা কী বলতো? মিথিলেশদা একটু হার্শলি বিহেভ করছে না কি?
    -- ঠিক করছে। রীনা ওর লাভারের সঙ্গে ফাট দেখিয়ে ট্যাক্সি করে ঘুরবে সংগঠনের পয়সায়? ওর ওয়েজ বাড়াতে হবে? এটা কোন কথা হল? আমাদের লাভার নেই তো কি আমরা ফালতু! বন্দুক ধরবো আমরা আর--।
    শোন, রীনা হল মিথিলেশের শালী, কিন্তু ওদের মধ্যে খাড়াখাড়ি আছে। কারণ মিথিলেশ যখন রীনার বড় বোনকে বিয়ে করতে যায়, তখন রীনা বাধা দিয়েছিল।
    -- কেন?
    -- মেয়েদের সাইকোলজি তুমি কি বুঝবে, তুমি এখনও বাচ্চাছেলে!

    শচীন হা-হা করে হেসে ওঠে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২০ ডিসেম্বর ২০২০ | ২৮২৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন