এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  পড়াবই  প্রথম পাঠ

  • ঐন্দ্রজালিক মুহূর্তে ননসেন্স অনুভবের অ-লোক-সম্ভব স্পর্শে মগ্ন

    সুমিতা চক্রবর্তী
    পড়াবই | প্রথম পাঠ | ০১ নভেম্বর ২০২০ | ৫৫৮৪ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • সুকুমার রায়। ৩০ অক্টোবর ছিল তাঁর জন্মদিন। দেশ-সচেতন, সমাজ-সচেতন, সমকাল-সচেতন, বিজ্ঞানমনস্ক এই স্রষ্টার লেখাগুলি নিরন্তর নতুনভাবে পাঠ করে চলেছেন বিদ্বজ্জনেরা। তাঁর লেখালিখি নিয়েই বাংলার বিশিষ্ট মনীষীদের চর্চায় সমৃদ্ধ একটি সংকলন। পড়লেন লেখক ও শিক্ষাবিদ সুমিতা চক্রবর্তী


    বাঙালির একটি দুর্নাম এই যে, নিজেদের সমাজে আবির্ভূত অনেক বিশিষ্ট মানুষকেই তাঁরা বিস্মৃত হয়েছেন। কিন্তু যাঁদের ভুলিনি তাঁদের মধ্যে সুকুমার রায় অন্যতম। তার একটা কারণ হল মাত্র ছত্রিশ বছরের (১৮৮৭-১৯২৩) জীবৎকাল হলেও উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের এক প্রতিভাসম্পন্ন পরিবারের উত্তরাধিকার তিনি পেয়েছিলেন। উপরন্ত তাঁকে ঘিরে ছিল উনিশ-বিশ শতকের প্রগতিমনস্ক, সুশিক্ষিত, সংস্কৃতিমান ব্রাহ্মসমাজ।




    সুকুমার রায়। শিল্পী: গণেশ পাইন।

    দ্বিতীয় কারণ তাঁর প্রতিভার অ-সাধারণত্ব। অল্প কথায় সেই গভীর ও ক্ষুরধার; বৈচিত্র্যময় ও বহুব্যাপ্ত; মননঋদ্ধ, মানবিক ও উদার প্রতিভার স্বরূপ উন্মোচন করা সহজ নয়। সুকুমার রায় একইসঙ্গে ছিলেন স্বদেশীয় অথচ আন্তর্জাতিক; বিজ্ঞানমনস্ক অথচ রোমান্টিক। তিনি ছিলেন দেশ-সচেতন, সমাজ-সচেতন, সমকাল-সচেতন, অথচ কালোত্তীর্ণ প্রতিভার অধিকারী। তাঁর প্রতিভার কদর করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে ‘কল্লোল’-পর্বের সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৮), মণীশ ঘটক (১৯০২- ১৯৭৯)। জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮ – ১৯৭৪) এবং সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৪-১৯৭৮) তাঁর অনুরাগী। সেই সঙ্গে একেবারে সাম্প্রতিককালের বিদ্বজ্জনেরা তাঁকে নিরন্তর নতুনভাবে পাঠ করে চলেছেন। আর, এই সময়ের বালক, নাবালক এবং সাবালকেরাও সুকুমার রায়ের লেখার মুগ্ধ পাঠক।




    পাগলা দাশু বইটির প্রথম মুদ্রণে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা।

    সুকুমার রায়কে নিয়ে একটি সংকলন-গ্রন্থ তাপস ভৌমিকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ‘কোরক’ প্রকাশনা সংস্থা থেকে। সেই সংকলনে উল্লিখিত লেখকদের অনেক লেখাই পাওয়া যাবে। কিন্তু স্বাভাবিক যে, এর আগে যা লেখা হয়েছে তা সবই এই সংকলনে নেই। তবু অন্তত আরও দুটি লেখা এই সংকলনে থাকলে ভালোলাগত। একটি হল—বুদ্ধদেব বসুর ‘সাহিত্যচর্চা’ (প্রকাশ ১৯৫২) গ্রন্থের অন্তর্গত ‘বাংলা শিশুসাহিত্য’ নামক বিস্তৃত প্রবন্ধের তিন সংখ্যক পরিচ্ছেদটি—যেটি সুকুমার রায়কে নিয়েই লেখা। আর একটি ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে বিমল রায়চৌধুরীর সম্পাদনায় ‘দৈনিক কবিতা’ পত্রিকার ‘সুকুমার রায় সংকলন’-এর অন্তর্গত রাজলক্ষ্মী দেবীর (১৯২৭ - ২০০৫) প্রবন্ধ। এই সংখ্যায় পরিমল গোস্বামী ও দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলোচনা, সেই সঙ্গে সুধীরকুমার চৌধুরীর (১৮৯৭ - ১৯৮৩) স্মৃতিকথাও উল্লেখযোগ্য। অবশ্য আগেই বলেছি সব লেখা দেওয়া সম্ভব নয় কোনো সংকলনেই। আরও একটি সুকুমার রায় বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রস্তুতি পর্ব’ পত্রিকার—বিশ শতকের আট-এর দশকের মাঝামাঝি। সেই সংখ্যাটি সম্প্রতি পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল ‘কারিগর’ প্রকাশনা থেকে ২০১৩-তে। সেটিও এখন পাওয়া যায় না। তাতে ছিল সুশোভন সরকারের (১৯০০- ১৯৮২) একটি লেখা।

    এই প্রসঙ্গগুলির উল্লেখ করলাম ‘কোরক’–এর ‘নানা সুকুমার’ গ্রন্থটির সমালোচনা করবার উদ্দেশ্যে নয়। কিন্তু সুকুমার সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ যাঁদের আছে তাঁরা এই সূত্রগুলি থেকে আরও কিছু উপাদান পেতে পারেন।

    এই সংকলনে কী পেলাম সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রথমে পুনর্মুদ্রিত লেখাগুলিতে চোখ রাখি। কয়েকজনের লেখা স্মৃতি-কথন যেমন—বিমলাংশুপ্রকাশ রায়, মাধুরীলতা মহলানবিশ, অজয় হোম এবং শোভনলাল গঙ্গোপাধ্যায় (১৯১০ – ১৯৯০)। তিনজনের লেখায় সুকুমার রায়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিভিন্ন প্রসঙ্গ আছে। কিন্তু শোভনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখাটি ব্যক্তিগত পরিচয়ের বাইরে থেকে শ্রুত-স্মৃতিকথা। লেখাটিতে অবনীন্দ্র-দৌহিত্র শোভনলালের ব্যক্তিগত স্মৃতির বুনোট আছে। তাঁর ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকোর বাড়ির ‘বিচিত্রা’র বৈঠক; ‘বিচিত্রা’ ক্লাবের ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ নাটকে কেদারের ভুমিকায় সুকুমার রায়। তখন শোভনলালের বয়স সাত-আট। পুনর্মুদ্রিত লেখাগুলির মধ্যে আছে ৩০/১০/১৯৪৩–এ দিলীপকুমার গুপ্তকে লেখা জীবনানন্দ দাশের একটি চিঠি। তিনি লিখেছেন—“আমি কোনও স্বদেশী বা বিদেশি সাহিত্যিকের লেখায় ঠিক এই ধরনের লেখার পরিচয় পাইনি।” সৈয়দ মুজতবা আলী-র ‘ধূপছায়া’ (১৯৫৮) রচনা-সংকলনের অন্তর্গত ‘সুকুমার রায়’ লেখাটির কথা একটি প্রসঙ্গের জন্য উল্লেখ করছি। আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আলী সাহেব সুকুমার রায়ের নাটক সম্পর্কে বাস্টার কিটন (১৮৯৫-১৯৬৬) আর চার্লি চ্যাপলিনের (১৮৮৯-১৯৭৭) অভিনয়ের কথা বলেছেন। সেই সঙ্গে বলেছেন যে, সুকুমার রায়ের মতো হাস্যরসিকের সন্ধান তিনি পাশ্চাত্য সাহিত্যেও পাননি। কিন্তু একজন জার্মান সাহিত্যিকের নাম তিনি উল্লেখ করেছেন—“একমাত্র জর্মন সাহিত্যের ভিলহেলম বুশ সুকুমারের সমগোত্রীয়—স্ব-শ্রেণী না হলেও। ঠিক সুকুমারের মতো তিনি অল্প কয়েকটি আঁচড় কেটে খাসা ছবি ওতরাতে পারতেন। তাই তিনিও সুকুমারের মতো আপন লেখার ইলাসট্রেশন নিজেই করেছেন।”

    অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ভিল্‌হেল্‌ম বুশ (১৮৩২-১৯০৮)-এর কিছু কিছু সচিত্র ছড়াকে বাংলায় ভাষান্তরিত করে ছবিসহ আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। ‘থীমা’ থেকে ২০০০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত বইটির নাম ‘মাক্স ও মোরিৎস এবং আরো চিত্রকথা’। এবং আশ্চর্য, বইটির ভূমিকায় অলোকরঞ্জন সুকুমার রায়ের নামও করেছেন—“সুকুমার রায়ের (১৮৮৭ - ১৯২৩) খেয়ালি জীবন-শিল্পীরা যখন মই নিয়ে মাদল বাজাতে বাজাতে দুরূহ পরিস্থিতি অনায়াসেই পার হয়ে যায়, বুশের ছড়া-ছবিতে আমরা দেখি ‘দুজন ফাজিল, জোয়ান ফুর্তিবাজ/ মই বেয়ে কেন চলছে দুজনে আজ ?’ এরা আসলে পাগলা দাশুর চেয়ে হাজার গুণ বেশি দজ্জাল বালক, মাক্স ও মোরিৎস।”

    (আগ্রহী পাঠক ‘Max and Maurice: Juvenile History in Seven Tricks. Wilhelm Busch. Translator Charles T. Brooks’ বইটি নিখরচায় পড়তে বা ডাউনলোড করতে এই আলোচনার শেষে দেওয়া লিঙ্ক দেখতে পারেন—সম্পাদক নীলাঞ্জন হাজরা)





    ভিল্‌হেল্‌ম বুশ। ফটোগ্রাফ ও আত্মপ্রতিকৃতি।


    মাক্স উন্ড মোরিৎজ়। শিল্পী: ভিল্‌হেল্‌ম বুশ।

    সুকুমার রায়ের মতোই বুশ নিজের ছড়ার সঙ্গে ছবি আঁকতেন। যদিও সুকুমার রায় ১৮৬৫-তে প্রকাশিত বুশ-এর বইটি দেখেছিলেন কি না সন্দেহ। আবার দেখতে পারেন না এমনও নয়। তিনি ১৯১১ -তে ফটোগ্রাফি ও প্রিন্টিং টেকনোলজি শেখবার জন্যই ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন, ‘রয়্যাল ফটোগ্রাফি সোসাইটি’-র সদস্য হয়েছিলেন।

    সুকুমার রায়ের লেখার আলোচনায় বারবার উঠে আসে নার্সারি রাইম, লুইস ক্যারল (১৮৩২-১৮৯৮), এডওয়ার্ড লিয়ার (১৮১২-১৮৮৮), আর্থার কোনান ডয়েলের (১৮৫৯-১৯৩০) নাম—তার পশ্চাদ্‌পট হিসেবে সুকুমার রায়ের ইংল্যান্ড-বাস এবং তাঁর বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যাপারটি মনে রাখতে হবে। ‘নানা সুকুমার’ বইটিতে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের প্রবন্ধে সুকুমারের উত্তমর্ণদের নিয়ে চমৎকার আলোচনা আছে। সেই বিস্তৃত বিবরণ থেকে একটি মাত্র তথ্যই উপস্থিত করছি। ইংল্যান্ড-এর দুজন কবি—টমাস হুড (১৭৯৯-১৮৪৫) এবং হিল্যের বেলক (১৮৭০-১৯৫৩) দুজনেই যথাক্রমে ‘Ode to the Camelopard’ এবং ‘The Camelopard’ নামে দুটি কবিতা লিখেছিলেন (কবিতা দুটি এই আলোচনার শেষে দেওয়া হল—সম্পাদক নীলাঞ্জন হাজরা)। ‘ক্যামেল’ ও ‘লেপার্ড’ শব্দদুটির সমম্বয়ে গঠিত এই ‘ক্যামেলোপার্ড’ শব্দটি ‘খিচুড়ি’ কবিতার বকচ্ছপ, জিরাফড়িং, গিরগিটিয়া ইত্যাদি শব্দ মনে করিয়ে দেয়।




    খিচুড়ি কবিতার সুকুমার রায়ের আঁকা ইলাস্ট্রেশন।

    যদিও এই বইটিতে সুকুমার রায়ের বেশ কয়েকটি মূল্যবান প্রতিকৃতি আছে। শিল্পীরা হলেন, সত্যজিৎ রায়, গণেশ পাইন, নির্মলেন্দু মণ্ডল, ঈশা মহম্মদ, প্রণবেশ মাইতি, রবীন দত্ত, শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য, প্রকাশ দাস। তা সত্ত্বেও সুকুমার রায়ের আঁকা ছবি—যাকে ইলাস্ট্রেশনই বলতে হবে হয়তো—নিয়ে কোনো নিবন্ধ সংকলনটিতে নেই। বইটিতে আছে, চণ্ডী লাহিড়ী, দেবব্রত ঘোষ, পূর্ণেন্দু পত্রী, সমীর সরকারের অলংকরণ।

    সুকুমার রায়ের ভাষার অসামান্য কারিগরি মননশীল পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। এই দিকটি নিয়ে দীপ্তিময় আলোচনা করেছেন পলাশবরণ পাল। সুকুমার রায়ের শব্দ-চয়নের সঙ্গে অর্থ ও ভাবের সংগতি নিয়ে লিখেছেন প্রসাদরঞ্জন রায়। সুকান্ত চৌধুরী ‘কবি সুকুমার রায়’ প্রবন্ধটিতে প্রধানত তাঁর ননসেন্স কবিতাকে তুলে ধরেছেন। কিন্তু ননসেন্স কবিতার বাহন রূপে শব্দার্থের বিভিন্ন দ্যোতনা, শব্দের উচ্চারিত ধ্বনির অভিনবত্ব এবং শব্দবাহিত চিত্ররূপের অদ্ভুত কল্পনা-বিস্তার নিয়েও তাঁকে আলোচনা করতেই হয়েছে। এই প্রবন্ধগুলি সুকুমার রায়ের ভাষা সম্পর্কে নতুন ভাবনার দিক খুলে দেয়। ‘অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস’ থেকে ১৯৮৭-তে প্রকাশিত সুকুমার রায়ের কিছু কবিতার সুকান্ত চৌধুরী কৃত অনবদ্য অনুবাদ পাঠকেরা পড়ে দেখতে পারেন।

    সুদেষ্ণা চক্রবর্তীর লেখা ‘প্রাবন্ধিক সুকুমার রায়’ নিবন্ধটির একটু উল্লেখ করতে চাই। সুকুমার রায়ের মধ্যে একজন উৎকৃষ্ট প্রাবন্ধিকের দৃষ্টিকোণ, তথ্যসন্ধান ও বিশ্লেষণী শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর প্রবন্ধ আকারে বড়ো নয়, তার কারণ সেগুলি এমনই বাহুল্য-বর্জিত যে, একটি বাক্যও সরিয়ে নেওয়া যায় না। তিনি সাহিত্য ও শিল্প বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন; দর্শন ও বিজ্ঞান বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। সেই সঙ্গে সমাজ, বিশেষত ব্রাহ্ম-সমাজের গতি-প্রকৃতি, সংকট-সমস্যা, হিন্দু-সমাজের সঙ্গে ব্রাহ্ম-সমাজের সম্পর্ক নিয়েও লিখেছেন। ব্যাকরণ ও বর্ণমালা; শব্দ ও অর্থের সংলগ্নতা ও বি-লগ্নতা বিষয়ে সুকুমার রায়ের অনেক প্রাথমিক ভাবনা পরবর্তী কালের ইউরোপীয় ভাষাতত্ত্ববিদদের লেখায় সমারোহের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিশোর-পাঠ্য ও বয়স্ক-পাঠ্য—এই দুটি ভাগে তাঁর প্রবন্ধগুলিকে রাখলেও তাঁর অধিকাংশ লেখার মতোই কিশোর-পাঠ্য প্রবন্ধগুলিও বয়স্কদেরও পাঠযোগ্য। সুদেষ্ণা চক্রবর্তী দেখিয়েছেন—ভাষার সঙ্গে সামাজিক ক্ষমতা-চাপের অভিপ্রায় কীভাবে মিশে যায়, তা সুকুমার রায়ের প্রবন্ধে ফুটে উঠেছে। এই একই অভিপ্রায় ‘অ্যালিস থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস’ (১৮৭১)-এ লুইস ক্যারল যেভাবে দেখিয়েছেন তার চমৎকার একটি উদ্ধৃতি তুলে দিয়েছেন সুদেষ্ণা।

    সুকুমার রায়ের সৃষ্টি-প্রতিভার যে দিকটি সকলকেই আলোড়িত করে তা হল তাঁর ‘ননসেন্স’ রচনা। ননসেন্স বলব কাকে? ‘সেন্স’ শব্দটি এখানে ‘চেতনা’ অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে না, হচ্ছে যুক্তি অর্থে। কিন্তু যুক্তিবিহীন হওয়া মানুষের পক্ষে আদৌ কি সম্ভব? মানব-মস্তিষ্কের অন্যতম লক্ষ্মণই হল চিন্তন-জগতের যৌক্তিক পরিকাঠামো গড়ে তোলা। শিশু এবং অপ্রকৃতিস্থ মানুষেরও থাকে নিজস্ব যুক্তির জগৎ। যাকে আমরা ননসেন্স রচনা বলতে অভ্যস্ত তার অনেকটাই ঠিক ননসেন্স নয়। সুকুমারের ননসেন্স রচনার আলোচনায় এই ভাবনাটি খুব বেশি আসে না। ‘আবোল তাবোল’ সামনে রেখেই সংক্ষেপে এখানে দু-একটি কথা বলি।





    ‘কাঠবুড়ো’কে দেখে আমরা হাসলেও প্রকৃতি-বিজ্ঞানীরা হাসবেন বলে মনে হয় না। ‘নোটবই’ কবিতার জিজ্ঞাসু ভদ্রলোকটি সন্ধানী গবেষক চরিত্রেরই রকমফের। ‘খুড়োর কল’ কি হাসির কবিতা? নাকি মানুষের লুব্ধতার প্রতি কশাঘাত! ব্রিটিশ শাসনের কালে ‘একুশে আইন’ আর ‘বাবুরাম সাপুড়ে’ কবিতার কি বিশেষ তাৎপর্য ছিল না? ‘সৎপাত্র’ কবিতার বিয়েতে ভাংচি দেওয়া মানুষটি, ‘হাতুড়ে’ কবিতার ডাক্তার, ‘কাতুকুতু বুড়ো’র মতো জোর করে লোক হাসাতে চাওয়া তথাকথিত কমেডিয়ান, ‘কিম্ভূত’ কবিতার নিজস্বতাবিহীন এবং অন্যের ‘মতো’ হওয়ার নিরন্তর চেষ্টায় খেলো হয়ে যাওয়া মানুষ, ‘হাত-গণনা’ কবিতার জ্যোতিষী আমরা কি সবসময়ই চারিদিকে দেখছি না? ‘বুড়ীর বাড়ী’ কবিতায় হাসির আড়ালও নেই। হতদরিদ্র বৃদ্ধার জীর্ণ ঘরের ছবিটি অবহেলিত মানুষের প্রতি সুখী-সমাজ এবং তথাকথিত ‘কল্যাণমূলক’ রাষ্ট্রের ঔদাসীন্য সূচিত করে। এডওয়ার্ড লিয়ার–এর লিমেরিকগুলিও অনেকক্ষেত্রে ব্যক্ত করে মানুষের অভাব, সামাজিক অসাম্য, বিভিন্ন ধরনের সংকট এবং উৎপীড়ন।








    ‘কাঠবুড়ো’, ‘নোটবই’, ‘খুড়োর কল’, ‘একুশে আইন’ ও ‘হাতুড়ে’ কবিতাগুলির সুকুমার রায়ের আঁকা ইলাস্ট্রেশন।

    এমন মনে হয়, ননসেন্স হওয়া মানুষের নিজস্ব-স্বভাব নয়। কোনো কোনো শিল্পী অসাধারণ কল্পনার শক্তিতে কোনো কোনো ঐন্দ্রজালিক মুহূর্তে এই ননসেন্স অনুভবের অ-লোক-সম্ভব স্পর্শে কিছুক্ষণের জন্য মগ্ন হতে পারেন। সেই সুররিয়ালিস্টিক মুহূর্তে উচ্ছলিত হয়ে উঠতে পারে কোনো কবিতা। সুকুমার রায়ের প্রতিভা অনন্যসাধারণ ছিল বলেই তিনি এরকম কয়েকটি কবিতা লিখতে পেরেছেন। তার একটি হল—‘শব্দকল্পদ্রুম’ নাটকে বৃহস্পতির মন্ত্র—‘হলদে সবুজ ওরাংওটাং’। আর-একটি হল ‘হ য ব র ল’-এর ন্যাড়ার গান—‘মিশিমাখা শিখিপাখা আকাশের কানে কানে’। আর-একটি হল ‘আবোল তাবোল’-এর ‘মাসি গো মাসি পাচ্ছে হাসি / নিমগাছেতে হচ্ছে শিম/ হাতির মাথায় ব্যাঙের ছাতা / কাগের বাসায় বগের ডিম।’ কিন্তু ‘আবোল তাবোল’-এর অনেক কবিতাতেই রীতিমতো সামাজিক সেন্স প্রকাশ পেয়েছে। ‘আবোল তাবোল’-এর পরে প্রকাশিত বইগুলির কবিতায় অনেক সময় ছোটোদের জন্য নীতিকথাও শুনতে পাই।

    ‘কোরক’ থেকে প্রকাশিত ‘নানা সুকুমার’ সংকলনটি আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। সেই সঙ্গে জাগিয়ে তুলেছে অত্যন্ত জরুরি একটি ভাবনা—সুকুমার-চর্চার এখনও অনেক পথ বাকি।




    নানা সুকুমার
    সম্পাদক – তাপস ভৌমিক
    কোরক
    মুদ্রিত মূল্য: ১৭৫ টাকা


    বইটির প্রাপ্তিস্থান — দে বুক স্টোর (দীপু), গুরুচণ্ডা৯ বইঘর
    বইটি অনলাইন কেনা যেতে পারে এখানে

    বাড়িতে বসে বইটি পেতে হোয়াটসঅ্যাপে বা ফোনে অর্ডার করুন +919330308043 নম্বরে।

    ---


    নিখরচায় পড়ুন বা ডাউনলোড করুন https://archive.org/details/MaxAndMoritzMaxAndMaurice/mode/2up

    ODE TO THE CAMELEOPARD
    THOMAS HOOD


    Welcome to Freedom's birth-place—and a den!
    Great Anti-climax, hail!
    So very lofty in thy front—but then,
    So dwindling at the tail!—
    In truth, thou hast the most unequal legs!
    Has one pair gallop'd, whilst the other trotted,
    Along with other brethren, leopard-spotted,
    O'er Afric sand, where ostriches lay eggs?
    Sure they were caught in some hard uphill chase,
    Those hinder heels still keeping thee in check!
    And yet thou seem'st prepared in any case,
    Tho' they had lost the race,
    To win it by a neck!

    That lengthy neck—how like a crane's it looks!
    Art thou the overseer of all the brutes?
    Or dost thou browse on tip-top leaves or fruits—
    Or go a bird-nesting amongst the rooks?
    How kindly nature caters for all wants;
    Thus giving unto thee a neck that stretches,
    And high food fetches—
    To some a long nose, like the elephant's!

    Oh! had'st thou any organ to thy bellows,
    To turn thy breath to speech in human style,
    What secrets thou might'st tell us,
    Where now our scientific guesses fail;
    For instance of the Nile,
    Whether those Seven Mouths have any tail—
    Mayhap thy luck too,
    From that high head, as from a lofty hill,
    Has let thee see the marvellous Timbuctoo—
    Or drink of Niger at its infant rill;
    What were the travels of our Major Denham,
    Or Clapperton, to thine
    In that same line,
    If thou could'st only squat thee down and pen 'em!

    Strange sights, indeed, thou must have overlook'd,
    With eyes held ever in such vantage-stations!
    Has seen, perchance, unhappy white folks cook'd,
    And then made free of negro corporations?
    Poor wretches saved from cast-away three-deckers—
    By sooty wreckers --
    From hungry waves to have a loss still drearier,
    To far exceed the utmost aim of Park—
    And find themselves, alas! beyond the mark,
    In the insides of Africa's Interior!

    Live on, Giraffe! genteelest of raff kind!
    Admir'd by noble, and by royal tongues!
    May no pernicious wind,
    Or English fog, blight thy exotic lungs!
    Live on in happy peace, altho' a rarity,
    Nor envy thy poor cousin's more outrageous
    Parisian popularity;
    Whose very leopard-rash is grown contagious,
    And worn on gloves and ribbons all about,
    Alas! they'll wear him out!
    So thou shalt take thy sweet diurnal feeds --
    When he is stuff'd with undigested straw,
    Sad food that never visited his jaw!
    And staring round him with a brace of beads!

    ---

    THE CAMELOPARD
    HILAIRE BELLOC


    The Camelopard, it is said
    By travellers (who never lie),
    He cannot stretch out straight in bed
    Because he is so high.
    The clouds surround his lofty head,
    His hornlets touch the sky.
    How shall I hunt this quadruped?
    I cannot tell! Not I!
    (A picture of how people try
    And fail to hit that head so high.)
    I'll buy a little parachute
    (A common parachute with wings),
    I'll fill it full of arrowroot
    And other necessary things,
    And I will slay this fearful brute
    With stones and sticks and guns and slings.


    ---
    ‘সুকুমার রায়’ তথ্যচিত্রটি দেখা যেতে পারে এখানে। পরিচালনা: সত্যজিৎ রায়।


    গ্রাফিক্স: স্মিতা দাশগুপ্ত
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • পড়াবই | ০১ নভেম্বর ২০২০ | ৫৫৮৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ প্রতিক্রিয়া দিন