সকাল সাড়ে আটটা। কাঁচা রোদ লেগে আছে পিচের রাস্তায়। পাতলা কাঁচের আস্তরনের মতো। ফোটা দুধ আর উনুনের ধোঁয়ার গন্ধ রোজ একটা অদৃশ্য জাল বোনে এখানে। আটকে ফেলে আমাদের।
ভাবির চায়ের দোকান। জীবনের ছোট ছোট টুকরোগুলো জড়ো হয় রোজ।
আমি আর সোনালী।
আমরা হাঁটছি। আমাদের হাত ছুঁয়ে যাচ্ছে একে অপরের হাতে। এই ছোট্ট হাঁটাটাই আমাদের ব্যায়াম… মনের…আমাদের দিনের শুরু। আমাদের নিজস্ব ছায়াপথ।
দোকানে ভিড়।
একটা ছোট্ট জটলা।
ধোঁয়া ওঠা কেটলি।
বাতাসে হালকা শব্দ। কোনো দাঁড়ি-কমা নেই। শুধু মিষ্টি কিছু শব্দ।
ট্যাক্স কনসালট্যান্ট। আবার নাট্যকার। জিএসটি। রিটার্ন। ফাইল। কিন্তু কথা শুরু করলেই মনে হয় নাটকের ডায়লগ।
বইপোকা। ঝুলো শার্ট আর সরু পাজামা। বিপ্লব। সিস্টেম পচে গেছে? নাঃ! শব্দজব্দে মুখ গুঁজে থাকে সে। মাঝে মুখ তুললেই বোঝা যায় কোন গল্পের পোঁটলা খুলবে এবার।
মাছ ব্যপারী। আজকাল আঙুলে ছুঁয়ে থাকে ক্যামেরার সাটার। পুরোনো আঁশটে গন্ধ… ইলিশের দর… বরফের অভাব…এসব এখন অতীত।
বই প্রকাশক। চিন্তিত। কাগজের দাম বাড়ছে। শেষ হয়ে যাচ্ছে সব।
অবসরপ্রাপ্ত ভদ্রলোক। হাঁটুর ব্যথা। পুরোনো দিনের গল্প। কেউ শোনার নেই।
পুরোহিত। খড়ম নয়, নাইকি পায়ে। পঞ্জিকা উল্টোন মোবাইলে। শুভ লগ্ন খুঁজছেন নিজের বিয়ের।
সবাই বলছে। বলেই চলেছে। একযোগে। শব্দগুলো ধাক্কা খাচ্ছে ছেঁড়া ক্যানভাসের চালে।
ফিরেও আসছে। ট্যাক্সের হিসাবে মিশে যাচ্ছে গল্পের চরিত্র। মাছের দরের নিচে চাপা পড়ছে পুরেনো হাঁটুর ব্যথা। কেউ শুনছে না।
সোনালী ভাঁড়টা হাতে নিল। গরম।
হঠাৎ।
একজন। খারাপ খবরটা দিয়েই দিলো।
হাল্কা হাঁপিয়ে।
চায়ের কেটলির পাশে বসে।
কথাগুলো পাথরের মতো শান্ত।
"দাঁবাবু চলে গেলেন। মোড়ের মাথার বাড়ি। নেই। কাল বিকেলে। হার্ট।"
শব্দ মরে গেল।
মুহূর্তে।
একটা বিশাল শূন্যতা গ্রাস করল ভাবির দোকানটাকে।
ট্যাক্স কনসালট্যান্টের মুখ খোলা। সংখ্যাগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেলো।
রিটায়ার্ডের হাত হাঁটুতে স্থির হয়ে গেলে। কোথায় যেন কার গল্প চলছিলো। থেমে গেলো নাকি!
পুরোহিতের মোবাইল থেকে পঞ্জিকাটা হারিয়ে গেলো।
সোনালী আমার হাত ধরল। জোরে নয়। হাল্কা। মৃদু।
তবু কে যেন তার নখ বসালো আমার চামড়ায়… ঠিক যার নীচেই আমার হার্টটা এখনও তাল দিচ্ছে।
মাটির ভাঁড়ে চা ঠান্ডা হচ্ছে।
ধোঁয়া উঠছে।
সোজা উপরে।
বাতাস নেই।
শুধু নীরবতা। ভারী। বুকের ওপর চেপে বসা পাথরের মতো ভারি। আমরা কেউ নড়ছি না।
শুধু কয়লার আঁচ জ্বলছে, চিতার আগুনের মতো—নিঃশব্দ, নিশ্চিত, শান্ত অপেক্ষায়….
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।