এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  উৎসব  শরৎ ২০২০

  • কলকাতা ও তাহাদের কথা

    সৈকত চট্টোপাধ্যায়
    ইস্পেশাল | উৎসব | ৩১ অক্টোবর ২০২০ | ৩৪৮০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)

  • কলকাতা চরিত্র

    কয়েক বছর আগে প্রকাশিত ঠিকানিয়া নামক ক্ষীণকায় উপন্যাসটিতে (লেখক: শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়) কলকাতা শহরের বাসিন্দা তিন বন্ধু কোন এক অবিশ্বাস্য রূপান্তরের আশায় কলকাতা শহর থেকে বেরিয়ে পড়ে। একজনের চাকরি নেই, অন্য দু'জনের কল সেন্টারে চাকরি, গ্রামের স্কুলে কোনক্রমে ইংরেজী শিখে কলকাতায় এসে ইংরেজী বলায় কিছুটা দক্ষ হয়ে কল সেন্টারের চাকরিতে তারা ঢুকে পড়েছিল। তারা তিনজনেই তাদের চারপাশের থেকে পিছিয়ে পড়েছে, চারপাশের গতির তুলনায় তারা শ্লথ হয়ে পড়েছে, নিজেদের মনে করে মাছের কড়াইতে ছোট ট্যাংরা মাছের মতো, অফিস পাড়া দেখে মনে হয় সিংহের পাল যার মধ্যে তাদের মতো দু'একটা জেব্রা ধরা পড়ে গেছে। একজন মদের নেশায় থাকে, অন্য দু'জনের কবিতা লেখার ইচ্ছে ছিল কিন্তু কল সেন্টার থেকে ফিরে এসে ভোরবেলা পাথরের মত ঘুমিয়ে পড়ার আগে কবিতা তার দরজায় যেন আঁচড় কাটছে শুধু, তার কাছে পৌছতে পারছে না, এইরকমই একজন ভাবে। দৈনন্দিন তাদের কাছে ব্যর্থতার বলে মনে হলে কিছু পাওয়ার আশায় ট্রেনে চেপে বসে, আগেও যেমন করেছিল। একরাত ট্রেনে চেপে বাংলার উত্তর দিকে ঠিকানিয়া নামক এক পাহাড়ী জায়গায় পৌছয়, যে স্থান বা শহরটি - তারা ক্রমশঃ বুঝতে পারে - ইঞ্জিনীয়ার শাসিত কৃত্রিম এক শহর, যেখানে রাস্তায় গাড়ি ছাড়া লোক দেখা যায় না, লাইব্রেরীতে বই পড়ার বদলে মানুষ টিভি স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থাকে, পাহাড়ের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা চারটি বিশাল লম্বা বাহুর ওপরে যেন শহরটি গড়ে উঠেছে যার কিছু জায়গায় শুধুই একলা বয়স্ক মানুষ অথবা বিধবাদের বাস ! সেই শহরেই তারা খোঁজ পায় পর্তুগীজ ভাষায় লেখা এক পুরোন পাণ্ডুলিপির যেটি লেখা হয়েছিল ১৬৩২ সাল নাগাদ যখন পর্তুগীজরা মুঘলদের সাথে যুদ্ধে হেরে ব্যান্ডেল থেকে দক্ষিণে সুন্দরবনের দিকে চলে গেছে । পান্ডুলিপিতে ছিল জুজে নামের পর্তুগীজদের জাহাজের ক্যাপ্টেনের আত্মবিবরণী যে ঘোড়ায় চড়ে জলকাদাময় দেশে ঘুরে বেড়ায়, ডন কিহোতে উপন্যাসটি যে তখন পড়ছিল, যে মহান পর্তুগীজ সম্রাটের পৃথিবী জয়কারী সেবকের চেয়ে ঢের বেশী যেন কবিমনের মানুষ যে তার দেশে ফিরে যেতে চায়; আর জুজের সাথে ছিল ব্রুনো নামে এক কিশোর যার ব্যান্ডেলেই জন্ম, বাবা পর্তুগীজ ও মা বাঙালী, বড় হওয়া গীর্জার সাহায্যে। ব্রুনোর বয়ানে জানা যায় জাহাজের আর এক লস্কর পেদরোর হাতে জুজের খুন হয়ে যাওয়ার কাহিনি এবং সেই জায়গায় তিন বন্ধু পান্ডুলিপিটি পড়া শেষ করে। তারা জুজে ও ব্রুনোর মধ্যে দিয়ে, সাহেব ও তার কালো সঙ্গীর মধ্যে দিয়ে, ব্রুনোর বাংলা ভাষার জ্ঞান না থাকা আর ব্যান্ডেলে থাকার সময়ে পর্তুগীজ এলাকার বাইরের জল - জমি - শস্য - গ্রাম থেকে ব্রুনোর বিচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে যেন নিজেদের আর কলকাতা শহরের প্রবণতাগুলিকেও বুঝতে পারে; সেই একই রকমের গ্রাম থেকে শহরে আসা, গ্রাম ও কলকাতা শহরের দ্বন্দ আর নিজের ভাষাকে ক্রমশঃ ভুলে যাওয়া। খুব বড় মাপের কোন লেখা নয় এই উপন্যাসটি, কিন্তু নিছক বাস্তবতার অনুসারী হয়নি লেখাটি, সম্পূর্ণ বানিয়ে তোলা এই লেখাটি কয়েকটি বিশেষ বিষয়কে উপন্যাসের অভিমুখ করেছে। পান্ডুলিপিতে জুজের লেখার মধ্যে দিয়ে কবিমনের এক মানুষ আর তার সৈনিক জীবনের দৈনন্দিনের দ্বন্দকে প্রকাশ করেছে (যে দ্বন্দ তিন বন্ধুর জীবনেও আছে), ইতিহাসের ঘটনাকে বীজ হিসেবে ব্যবহার করে ইতিহাস আর বর্তমানের মধ্যে যোগ টেনেছে, ঐতিহাসিক উপন্যাস তো কদাপিই নয় বরং ইতিহাস আর তার তত্ত্বকে, বাংলায় উপনিবেশবাদের প্রথম দিনগুলিকে ব্যবহার করেছে বর্তমানের চরিত্রদের জীবনে, কলকাতা শহরেও ঐ তিন জনের জীবনের পরাধীনতাই যেন নির্দেশিত হয়েছে। ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল যে রূপান্তর সেরকম খুব কিছু ঘটেনি, ঘটা সম্ভবও নয় কারণ তাদের জীবন সম্পূর্ণত তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয় (যেমন নয় জুজের জীবনও), কলকাতা থেকে বেরিয়ে যে ঠিকানিয়ায় পৌছল, সেই জায়গায় তো টেকনোলজির প্রতাপেরই প্রমাণ, কিন্তু একেবারে যে রূপান্তর ঘটেনি সেও বলা যায় না কারণ সেই টেকনোলজির শহর থেকে, ভবিষ্যতের শহর থেকে ইতিহাস আর বর্তমানের বৈশিষ্ট্যগুলি তিন বন্ধু বুঝতে পারে, কলকাতা শহরে তাদের অস্তিত্বের রকমটা ঠিক কীরকম সেই জ্ঞান তারা পায়, উপন্যাসটি এই অনির্দিষ্টতায় শেষ হয় যখন তারা ঠিক করে যে ঠিকানিয়া ছেড়ে পরের দিন কলকাতায় ফিরে আসবে।

    এই উপন্যাসটি পড়ার সময়েই আমার মাথায় এসে যাচ্ছিল উদয়ন ঘোষের লেখা কোলকাতা সোনারতরী গল্পটির প্রসঙ্গ। ঠিকানিয়া উপন্যাসটিতে আমি লক্ষ্য করছিলাম কলকাতা শহরের দাপটে সেই শহরের বাসিন্দাদের চরিত্র বদলে যাওয়ার কথা, শহরটিই যেন তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে, আর উদয়ন ঘোষের গল্পটিতে কৃষ্ণকান্ত কলকাতার দাপটকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করে, শহরের ইতিহাস আর বর্তমানের ত্রুটি খুঁজে বের করে কলকাতার সাথে তর্ক জোড়ে, ঠিকানিয়া উপন্যাসের তিন বন্ধুদের থেকে আরো বেশী করে সরাসরি কৃষ্ণকান্ত যেন কলকাতা শহরের প্রবণতাগুলি বুঝতে পেরেছিল ! কৃষ্ণকান্ত ছিল মুর্শিদাবাদের কাছে জিয়াগঞ্জের চালের আড়তদার, পঞ্চাশোর্ধ, জীবনে সে কলকাতায় যায়নি, গল্পটি রাতের ট্রেন ধরে তার প্রথমবার কলকাতা যাওয়ার আগে তার মথার ভেতরে ঘটছে, তার সাথে তার স্ত্রী দুর্গা আর দুর্গার মাস্টার সুনীলও কলকাতা যাবে। কৃষ্ণকান্ত সন্ধ্যের অবকাশে ভাঙের পাতা দিয়ে তৈরী এক ভেষজ খেয়ে নেশাক্রান্ত আর হ্যালুশিনেশনের মধ্যে সে মুর্শিদাবাদ আর কলকাতা, এই দুই শহরকে প্রতিপক্ষ খাড়া করে। কলকাতা লর্ড ক্লাইভকে জায়গা দিয়েছে, কলকাতা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবিধে নিয়ে বাবু সেজেছে, কলকাতা ইংরেজদের মদত দিয়েছে, কলকাতাই হিন্দু-মুসলমান করেছে, পার্টিশনের সময়ে কলকাতাই মাথা ঘামিয়েছে খুলনা না মুর্শিদাবাদ কে যাবে ভারতে কে পাকিস্তানে, কলকাতা কোন দিকে যাবে এই প্রশ্ন যখন উঠেছে তখন কলকাতা ভয় পেয়েছে, এইসবই ছিল কৃষ্ণকান্তর কলকাতার বিরুদ্ধে অভিযোগ। অন্যদিকে মুর্শিদাবাদ ইংরেজদের বশংবদ হয়নি, মুর্শিদাবাদের কৃষ্ণনাথ রায় তো লাট সাহেবের বিবিকেও তুলে নিয়ে এসেছিলো যে ঘটনা ইংরেজরা চাপা দেয়, সেই বিবি যেখানে থাকত সে জায়গার নাম হল লেংরিবিবির হাতা, কলকাতা বাবু সেজেছে কিন্তু কৃষ্ণনাথ রায় বাবু সাজেনি, সে বা তার বংশধরেরা কলকাতা যায়নি; ইতিহাস টেনে এনে কৃষ্ণকান্ত কলকাতার সাথে তর্ক করে। উপরন্তু কলকাতা তো সব নেয়, কলকাতাই মুর্শিদাবাদ থেকে বাংলার রাজধানী কেড়েছে, কলকাতাই মুর্শিদাবাদের মানুষকে লোভ দেখিয়ে টেনে নেয়, সেই তিন গ্রামের সময় থেকে শুরু করে কলকাতা যেন এক রাক্ষস যে সব গ্রাস করে, গ্রাস করে তিলোত্তমা হয়, কলকাতার দ্রষ্টব্য স্থানের ছবিঅলা ক্যালেন্ডারে মফস্বল ভরে যায়, কলকাতা মফস্বলের চেতনাও যেন গ্রাস করে ! গল্পটির মধ্যে আইরনি আছে বলে মনে করি, কৃষ্ণকান্তর মধ্যে যেন ডন কিহোতেসুলভ মনোভাব ছিল যে স্বপ্ন দেখত কিন্তু বাস্তব যে অন্যরকম সে বোঝেনি, তার স্কুল ফাইনাল পাস বউ দুর্গার গায়ে কলকাতার প্রভাবে ব্লাউজ ওঠে, সে নভেল পড়ে, সে কলকাতা গিয়ে আরো পড়তে চায়, সুনীলমাস্টার সেসবের ব্যবস্থা করে দেবে আর সেই সন্ধ্যেতে কৃষ্ণকান্তর মৌতাত এমনই জমে ওঠে যে সে ঘুমিয়ে পড়ে ট্রেন ফেল করে কিন্তু দুর্গা আর সুনীলমাস্টার তাকে ডেকে না তুলে যুগলে কলকাতা যাত্রা করে, কৃষ্ণকান্ত বেশী রাতে জেগে উঠে বুঝতে পেরে রেগে ওঠে, দেওয়াল থেকে কলকাতার চিহ্ন ক্যালেন্ডারগুলো ছিঁড়ে নামাতে থাকে, শেষ পর্যন্ত হাওড়া ব্রীজের ছবিঅলা ক্যালেন্ডারটি টানটান হয়ে অক্ষত থাকে। সেই হাওড়া ব্রীজ পার হয়ে কৃষ্ণকান্ত কলকাতা যাবে, সেই শহরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য যেন। কিন্তু কৃষ্ণকান্ত হেরে গেছে, অনেকদিনই কলকাতা শহরের কাছে হেরে গেছে, মফস্বলকে হারিয়ে দিয়ে কলকাতা ক্রমাগতই ফুলে উঠেছে, কলকাতার সাথে কৃষ্ণকান্তর তর্ক আর লড়াইয়ের কোন মানেই নেই, ডন কিহোতেপ্রতিম কৃষ্ণকান্তর (সাঞ্চো পাঞ্জা ধরা যাবে হয়ত তার চাকর ঈশ্বরকে, সেও ঘুমিয়ে পড়েছিল সেই সন্ধ্যেতে !) কলকাতার সাথে যুদ্ধটা যেন হাওয়াকলের সাথেই লড়াই !

    কলকাতা শহরে তিন বন্ধুর নিজেদের জীবনকে বুঝতে পারা অথবা কৃষ্ণকান্তর কলকাতার সাথে বিরোধ, দুই ক্ষেত্রেই শহরটি যেন এই চরিত্রগুলির কাছে হেঁয়ালি হয়ে দেখা দিয়েছিল। কল্পনা করা যেতে পারে এই হেঁয়ালির সাথে কলকাতা শহরের রূপটির সম্পর্ক আছে যে রূপটি দেখা যাবে শহরের মানচিত্রটিকে দেখলে । মনে আছে দীর্ঘদিন আগে পড়া সুবিমল মিশ্রর একটি গল্পগ্রন্থের প্রচ্ছদে - সামনের ও পেছনের দুই প্রচ্ছদ জুড়েই - কলকাতা শহরের ম্যাপ আঁকা হয়েছিল; শুধুই বহির্রেখা নয় বা শহরের প্রধান স্থাননামগুলিই নয়, শহরের ম্যাপটিতে স্থাননামের সাথে রাস্তাগুলিও আঁকা হয়েছিল। উত্তর থেকে দক্ষিনে ও পুর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত ছোট বড় রাস্তাগুলি একে অপরকে ছেদ করার ফলে শহরের ম্যাপটিকে দেখতে হয়েছিল একটি জালের মত ! সেই ম্যাপ দেখে কারোর মনে হতে পারে কলকাতা শহরটি - উত্তর দক্ষিণে লম্বাটে, পূর্ব-পশ্চিমে কম চওড়া শহরটি তার জালিকাটা রাস্তা ও জায়গাগুলি সমেত - যেন একটি বৃহদাকার জাল যে জালের মধ্যে কোন মানুষ পড়ে যেতে পারে, পড়ে গিয়ে কলকাতা শহরের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে! এরকম হয়ত পুরোটা নয় যে এই জালের কেন্দ্রে মিনোটরের মতো কেউ আছে যার কাজই হল এক এক করে কলকাতার মানুষদের শুধুই গ্রাস করে যাওয়া আর সেই কাজ থামানোর জন্য থিসিউসের ম্তো কারোর দরকার, শহরটা হয়ত অতখানি কুটিল বা বিভ্রান্তিকর নয়, বিভিন্ন মানুষ তো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে কলকাতায় এসেছে, অনেকেই জন্মাবধিই এই শহরে থেকেছে যে শহর তাদের আশ্রয় দিয়েছে, ফলে সব চরিত্রই এই শহরের মধ্যে হারিয়ে যায়নি, কেউ নিশ্চয়ই সেখানে নিজেকে খুঁজেও পেয়েছে। কিন্তু এমনও বোধ হয়, এই শহরের এক কালো আত্মা আছে যাকে পুরোপুরি বুঝে ওঠা যায়নি, যে নিজেকেও ক্রমাগত বদল করেছে, যে এক কুহক তৈরী করে যার নিয়ন্ত্রণে চরিত্ররা থাকতে বাধ্য হয়; মূলতঃ এই শহর হয়ত ক্রীতদাস -ক্রীতদাসীদের শহর হয়েই রয়ে গেছে, সেই সময় থেকেই যেদিন থেকে গ্রামগুলো শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে, ফলে কিছু মানুষ ও মানুষী এই শহরের কালো আত্মার গ্রাস থেকে চেষ্টা করেও মুক্ত হতে পারেনি। কখনও কোন চরিত্র এই শহরে হারিয়ে গেছে, কেউ হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে কলকাতাকে সন্দেহ করেছে, কোন চরিত্র মাথার ভেতরে এই শহরকে ধারণ করতে করতে ব্যতিবস্ত হয়ে উঠেছে, এইসবই দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগত হতে থেকেছে।

    কলকাতায় হারিয়ে যাওয়া / প্রভাত

    কলকাতা শহরে হারিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ এলে, প্রায় নিশ্চুপে কারোর একা একা হারিয়ে যাওয়ার কথা প্রসঙ্গ এলে জীবনানন্দ দাসের লেখা নিরুপম যাত্রা গল্পটির প্রভাতের কথা মনে পড়ে। গল্পটি শুরু হয়েছিল এইরকম একটি বাক্য দিয়েঃ
    বছর চারেক পরে কলকাতা থেকে দেশে ফিরছে - সম্বল একটা টিনের সুটকেস, রংচটা শতরঞ্জিতে মোড়া একটা বিছানা এবং মনিব্যাগে তিন টাকা সাড়ে ন আনা পয়সা।

    বাক্যটিতে ফিরছে ক্রিয়াপদটির ব্যবহার থেকে ধারণা হতে পারে সেই মুহূর্তেই প্রভাত বাস্তবিকই তার দেশে ফেরার যাত্রাপথে আছে, ট্রেন বা গাড়ীর মতো কোন যানের মধ্যে যেন, আর সেই যাত্রারই বর্ণনা দেওয়া হবে। ঠিক সেরকম যদিও ঘটেনি, প্রভাত আসলে দেশে ফেরার উদ্যোগ করছিল, চাকরির বিড়ম্বনা থেকে মুক্ত হয়ে সে কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবছে, সেরকমই শুধু ঘটে। শেষ পর্যন্ত প্রভাতের সম্বন্ধে যা জানা যায়, লক্ষ্য করি, ফিরছে ক্রিয়াপদের ঘটমান বর্তমান রূপটিই রয়ে যাবে কারণ প্রভাত শেষ অবধি বাস্তবিকই তার দেশে ফিরতে পারে না। একদিকে কলকাতা শহর আর অন্যদিকে তার দেশ - সেই দেশের প্রকৃতি, তার পরিবারের সদস্যরা, পরিচিত মানুষেরা আর দেশের বাড়িতে রয়ে যাওয়া কেতু নামে একটি কুকুর - এই দুই স্থানের মধ্যে সংসারের কর্তব্য সংগ্রাম নিষ্পেষিত বন্ধনাত্মা যুবক প্রভাত টানাপোড়েনে থেকে যেতে বাধ্য হয়। যাত্রাটি সত্যি সত্যি ঘটে ওঠে না, সেটি ঘটে তার কল্পনা আর মনোজগতে। এক নিরুপম বিচিত্র যাত্রার কথা প্রভাত ভেবেছিল যেখানে মাঠ প্রান্তরের সীমানায় জোনাকিমাখা বাতাসের ভিতরে ট্রেন এসে থামে, যার পরে স্টীমার ধরতে হয়। ফলে প্রভাত অনবরতই তার নিজের জায়গায় ফিরছিল, ফিরতে থাকে শুধু, ফেরাটা শেষ হয় না; তার চিন্তায় থাকে মাঠ, তেপান্তর আর সরীসৃপের মতো আঁকা বাঁকা নদী পেরিয়ে কলকাতা শহর থেকে তার দেশে ফেরার কথা, সেই দেশটা পূর্ববঙ্গের এক স্থানই ।

    রক্তমাংসকল্পনাপ্রবণতাময় হয়ে উপস্থিত থাকা আশিরনখ এক বাঙালী বিবাহিত যুবক, প্রভাত, তিরিশের দশকের বিশ্বব্যাপী মন্দার সময়ে উপনিবেশের প্রধান শহর আর সেই শহরের বাইরে বাংলাদেশের মধ্যে যে দুরত্ব সেই দুরত্ব অতিক্রম করতে পারেনা। চাকরি তার নেই, চার বছর টিউশনি করে মেসের খরচ চালিয়েছে কিন্তু জীবনের অনেকখানি অপমান আর গ্লানি সহ্য করেও পুরুষকারের কথা ভেবেই সে কলকাতা শহরে জীবনধারণের চেষ্টা চালিয়ে গেছে। এখন সে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছে তার বাড়িতে যা কলকাতা থেকে দূরে, সেই পাঁড়াগার মাঠপ্রান্তরের গভীর দাক্ষিণ্যের ভেতরে সে হাঁটতে থাকবে এরকমই সে ভেবেছিল, কলকাতা শহরে তার জীবনধারণের গ্লানি কাটানোর জন্যই, সে তো বুঝছে যে এই কলকাতা শহরে তো আকাশ বাতাস আলো রৌদ্র যেন এখানে লিমিটেড কোম্পানীর জিনিস ; কাদের বেশী শেয়ার - বড় বড় ডিভিডেন্ড টানে, বিধাতা জানেন - বিধাতা একাই টানেন হয়তো - কেমন একটা চিমসে দরিদ্রতা ধরা পড়ে যেন এখানে । কলকাতাবাসের চার বছরের শেষে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রভাতকে কিন্তু তিন মাস কাটিয়ে দিতে হয় একটা বদলির টিউশনি করে আর তার পরে আরো ছ'মাসের জন্য এক স্কুলে বদলির চাকরি নিয়ে । এইসব সে মেনে নেয়, এইসব ছেড়ে সে কলকাতা থেকে চলে যায় না, যেতে পারেনা কারণ প্রভাত জানে এইসবের প্রয়োজনীয়তা, কষ্ট সহ্য করেও জীবনকে সুবিন্যস্ত করে তোলার এইসবই একমাত্র উপায়, ফলে প্রভাত জীবিকা আর জীবনধারণের উপায় খোঁজার তাড়না দ্বারাও তো তাড়িত যে উপায়ের ব্যবস্থা একমাত্র কলকাতা শহরটিই তাকে করে দিতে পারে। সংসারের কথা ভেবে মেসে থেকে জীবনধারণ যখন কলকাতাতেই করতে হয়, মণিহারি দোকান দিয়ে সে তার দেশেই কাটিয়ে দেবে এই ভাবনাও যখন সফল হতে পারে না, প্রভাত যখন টালিগঞ্জ থেকে পায়ে হাঁটতে-হাঁটতে ট্রাম - বাস -ট্রাক - গ্যাস লাইটের একটা বিপুল উন্মাদনার ভেতর এসে পড়ে , তখন তার মনে হয় কী নিয়ে এই উন্মাদনা,এতে কার কী লাভ, কলকাতা শহরের এই যে চরিত্র তাকে প্রশ্ন করা, আবার অন্যদিকে তার টিউশনের ছাত্র সমীর যখন বলেছিল সে পুরুষ - মহিলার সম্বন্ধ নিয়ে একটা আলোচনা করছে, তখন প্রভাত জানিয়েছিল প্রেম বলতে তোমরা নর-নারীর নানারকম সম্পর্ক বোঝ - কিন্তু আমি ঢের জিনিস বুঝি - স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধই শুধু নয়; দেশের মাঠ , পথ, সেই ইস্ক্লের বাড়ি, অশ্বত্থ গাছটা, খোকা বা কেতু , ফলে সব মিলিয়ে প্রভাতের চেতনায় এই শহরটি, তার চরিত্র ও মানসিকতা আর সেই শহরের বাইরের মফস্বল বা দূর বাংলা, এই দুটি স্থানের মধ্যে যেন দুস্তর ব্যবধান, দুটি মহাদেশই যেন এতই সেই ব্যবধান। আর প্রভাতের মতো নাগরিক অস্তিত্ব বহনকারী যুবাটির কাছে সেই ব্যবধান গল্পটির প্রথম থেকে শুরু হয়ে শেষ পর্যন্ত ক্রমশঃ যেন চিরস্থায়ী হয়ে উঠবে,অনতিক্রম্য হয়ে উঠবে, এমনই অনতিক্রম্য যে ছয় মাস কেটে গেলেও সে কলকাতা ছাড়তে পারে না, আজ যাওয়া না হলেও কাল সে যাবে নিশ্চয়ই এই সে ভাবতে পারে, বাক্স - বিছানা গুছিয়েও সে সবই খুলে ফেলে , শেষ পর্যন্ত প্রভাত তার মেসেই জ্বরাক্রান্ত হয়ে মরে যায়, মরে যাওয়ার আগে তার শিশুসন্তানের জন্য কেনা বিস্কুট যা তখন নরম হয়ে গেছে তাই সে খায়, প্রভাতের মৃতদেহ সারা দিন মেসের ঘরেই পড়ে থাকে, রাতের বেলা মেসের বাবুরা সিগারেট আর পানের ডিবে নিয়ে নিমতলায় তাকে পোড়াতে যায় ! কলকাতা শহরের বিপরীতে তার দেশের মধ্যে প্রভাত দেখেছিল করুণা আর দাক্ষিণ্য, কিন্তু তার মৃত্যুতেও সে এই শহরের থেকে করুণাবঞ্চিত, অনেক কথা ভেবেও কোথাও কোন ছাপ না রেখে চুপে চুপে তার তলিয়ে যাওয়া; প্রভাত শুধু ফিরতেই থাকে কিন্তু ফেরাটা তার জীবনে সম্পূর্ণ হয় না, জীবনধারণের সুরাহা একমাত্র কলকাতা শহরটিতেই হয়ে উঠতে পারে বলে শহরটির যেন দাবীই আছে তাকে দাস বানিয়ে তোলার ও গ্রাস করে নেওয়ার।

    কলকাতায় হারিয়ে যাওয়া / বিন্দু

    কলকাতা শহরের বিপুল উন্মাদনার মধ্যে পড়ে গিয়ে প্রভাত প্রশ্ন করেছিল শহরের সেই প্রকৃতি নিয়ে, ফিরে যেতে চেয়েছিল তার দেশের বাড়িতে, তেমনি প্রভাতের কলকাতা বাসের কাছাকাছিই হয়ত, বিন্দু গ্রাম থেকে সেই শহরে এসে শহরের উন্মাদনার মধ্যেই পড়ে গিয়েছিল, সেও ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তারও সেই চেষ্টা সফল হয়নি। তাকেও শেষ পর্যন্ত কলকাতাতেই রয়ে যেতে হয়েছিল; শশী ভেবেছিল কলকাতার অনামী রহস্যই গাওদিয়ার বিন্দুকে গ্রাস করে নিয়েছে ।

    শশী ও বিন্দুর বাবা গোপাল তার দ্বিতীয় মেয়ে বিন্দুর বিয়ে দিয়েছিল কলকাতার বড়বাজারের ব্যবসায়ী নন্দলালের সাথে, কিছুটা ছলনা করেই । কাজের সূত্রে নন্দলাল গাওদিয়ায় এলে গোপাল তাকে বাড়িতে এনে আপ্যায়ন করে কিন্তু তারপর লাঠি নিয়ে লোক দাঁড় করিয়ে বিবাহিত নন্দলালের সাথে বিন্দুর বিয়ের ব্যবস্থা হয়। পুলিশ এসেছিল, নন্দলাল সে ব্যাপারে বেশ কয়েকজনকে পুলিশে দিতে পারত কিন্তু তা সে করেনি, তার বদলে বিন্দুকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে যায়, ত্যাগ সে বিন্দুকে করেনি কিন্তু তার নিজের বাড়িতে পরিবারের অন্যদের সাথে না রেখে বিন্দুর জন্য আলাদা বাড়ির বন্দোবস্ত করে আর বিন্দুর জন্য ঝি-চাকর -দারোয়ান আর গয়না দিয়ে বিলাসিতার ব্যবস্থা করেছিল। এতই সেই গয়নার আতিশয্য, বিন্দুকে দেখতে লাগত বাঈজীর মত ! শশী বোঝেনি যে নন্দলাল বিন্দুকে ত্যাগ না করে বিন্দুর জন্য ঐরকম আলাদা ব্যবস্থা করেছিল কেন, সে কি তার খেয়াল, কর্তব্যজ্ঞান অথবা বিন্দুকে নিয়ে নির্বিবাদে যা খুশী করা যায় বলে? বিন্দুও সুখে আছে কিনা সেও শশী বোঝেনি এক সময়ে, পুরো ব্যাপারটিকেই তার মনে হত কলকাতারই অনামী রহস্য যেন। আরো পরে শশী বিন্দুকে গ্রাস করে নেওয়া এই রহস্য সম্বন্ধে বুঝতে পারবে যখন বিন্দু তাকে জানাবে যে নন্দলাল বিন্দুকে স্ত্রীর মত ভালবাসে না, ভালবাসে রক্ষিতার মত! ভালবাসার সেই ধরণের জন্যই নন্দলাল বিন্দুর কাছে এলে যে ঘরে বসে সেই ঘরটিও সাজানো হয়েছিল অশ্লীল ছবি, চোখ ঝলসানো আলো আর আলমারি ভরতি মদের বোতল দিয়ে আর প্রথম দিন বিন্দু মদ খেতে না চাইলে নন্দলাল সাঁড়াশি দিয়ে দাঁত ফাঁক করে বিন্দুর মুখে মদ ঢেলে দিয়েছিল, বিন্দুকে পরে দাঁত বাঁধাতে হয়েছিল। শশী বিন্দুকে কলকাতার এই জীবন থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল গাওদিয়াতে, ভেবেছিল এতে বিন্দুর জীবন শান্ত হবে কিন্তু বিন্দুর মদের নেশা কাটেনি, সেই নেশার জন্য শশীর ওষুধের আলমারি থেকে ব্র্যান্ডি নিয়ে খেয়ে সে বমি করে ভাসিয়েছিল, গ্রামের লোকেরা সেই নিয়ে অকথ্য রটনা করেছিল । শশী বুঝেছিল যে বিন্দুর এই নেশা শুধু মদের নেশাই নয়, সাত বছর ধরে নন্দ কলকাতায় তার জন্য যে অস্বাভাবিক আর উত্তেজনাকর জীবনের আয়োজন করেছিল সে জীবন বিন্দুর জন্য এমনই অপরিহার্য যে সেইসব লজ্জাকর বিলাসিতা, সঙ্গীত ও উন্মত্ততার জন্য বিন্দুর মধ্যে দেখা দিয়েছিল বিকারগ্রস্ত বিরহ, গ্রামের নিস্তেজ আর বৈচিত্র‌্যহীন জীবনের চেয়ে কলকাতা শহরের জীবনই তাকে জড়িয়ে ফেলেছিল ঢের বেশী ! ফলে শশী গোপালের কথা মত বিন্দুকে কলকাতা ফিরে যাওয়ার কথা বললে বিন্দু আপত্তি করেনি, বিন্দু বলেছিল যে গাওদিয়াতে এসে সে এটাই ব্ঝেছে যে কলকাতায় ঐভাবে থাকা ছাড়া তার আরো কোন গতি নেই, মুক্তির কল্পনা সে আর করবে না । ক্রমশঃ নন্দলালের মনের পরিবর্তন হয়েছিল, সে বিন্দুকে তার পরিবারের মধ্যে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু বিন্দু সেই বাড়িতে যেতে রাজী হয়নি, তার জন্য নন্দর ব্যবস্থা করা বাড়িতেই সে রয়ে যায়।

    নন্দলালের আচরণ তো শুধুই ব্যক্তিমানুষের আচরণ নয়, তার আচরণের মধ্যে দিয়ে তো শশী কলকাতা শহরকে দেখতে পেয়েছিল। নন্দলাল বাজিতপুর থেকে গাওদিয়া আসবে এই খবর পেয়ে শশী গাওদিয়ার জমিদারের ভাইয়ের মোটর গাড়ি নিয়ে তাকে ঘাট থেকে তাদের বাড়িতে আনতে গেছিল যাতে নন্দ আর তাদের পরিবারের মধ্যে বিরোধের নিরসন হয়। কিন্তু শশী দেখেছিল যে নন্দ বাজিতপুর থেকে শুধু তার ও তার চাকরের জন্য দশজনের উপযুক্ত একটি নৌকো করেই গাওদিয়া আসেনি, উপরন্তু শশীর কথায় পাত্তা না দিয়ে পান ও জর্দা মুখে দিয়ে গায়ের দামী শাল খুলে রেখে আরো দামী শাল গায়ে দিয়ে সেই মোটরে চড়েই শশীর বাড়ীতে না গিয়ে জমিদারের বাড়ীতেই চলে যায় ! মোটরে চড়া তো নন্দলালের অভ্যাস, সে তো চড়ে গরুর গাড়ি, শশী এইরকম ভেবে নেওয়ার পরে চলে যাওয়া গাড়িকে দেখে এও ভেবেছিল কলিকাতা শহর। মোটরে চাপিয়া কলিকাতা শহর গাওদিয়ার দিকে চলে গেল। কলকাতার ব্যবসায়ী হওয়ার জন্য নন্দলাল অর্থ ও প্রতিপত্তি পায়নি শুধু, কলকাতা যোগ থাকার জন্যই গোপাল নন্দলালের সাথে ছলনা করে বিন্দুর বিয়ে দিয়েছিল, উপরন্তু বণিক সভ্যতার কলকাতাই নন্দলালের সেই চরিত্র তৈরী করেছিল যার জন্য সে বিন্দুকে গয়না দিয়ে মুড়ে দিয়ে রক্ষিতাসুলভ জীবন দিয়েছিল! শশীকে কুসুমের বাবা অনন্ত বলেছিল মানুষের জীবন পুতুল ছাড়া আর কিছু নয়, আড়াল থেকে কেউ একজন সেই পুতুলনাচ করাচ্ছে, শশী উত্তর দিয়েছিল তাকে একবার হাতে পেলে সে দেখে নিত, কিন্তু বিন্দুর জীবনে কলকাতা শহরটাই যেন প্রবল নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে নিয়তি থেকে বিন্দু উদ্ধার পয়নি, শশীরও ক্ষমতার বাইরে সেই শহরচরিত্রের বিরুদ্ধে কিছু করা অতএব বিন্দুর জন্যও সে আর কিছু করে উঠতে পারেনি! গ্রাম্য বালিকা বিন্দু তার বাবা গোপালের কূটবুদ্ধি আর কলকাতা শহরের মানুষের ব্যবহারে আর সেই শহরের আতিশয্য আর প্রাচুর্যে তার নিজের জীবন ক্ষয় করে ফেলে, গাওদিয়া ফিরে গিয়েও নিজেকে ফিরে পায় না, কলকাতারই জালে সে বাঁধা পড়ে গেছিল, নিজেকেই চাপা দিয়ে কলকাতা শহরেই রয়ে যেতে সে বাধ্য হয়। পাট রাখার ভেঙে পড়া আটচালার মতই নন্দর পাপের বোঝা বহন করে বিন্দুর দেহও ভেঙে পড়েছে, শশী শেষ পর্যন্ত সেই অনুমানই করেছিল।

    কলকাতার প্রতি সন্দেহ / সিদ্ধার্থ

    বিন্দু ও প্রভাত দু'জনেই অতএব কলকাতা শহরের সাথে এক বাধ্যতামূলক সম্পর্কে যুক্ত হয়ে পড়েছিল কিন্তু সেই সম্পর্ক তাদের জীবনের লাবণ্য শুষে নিয়ে দুজনকেই অবলুপ্তির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কয়েক বছরের ব্যবধানে সিদ্ধার্থ সেন কলকাতা শহরে নিজের লুপ্ত হয়ে যাওয়াকে ভয় পেয়েছিল, সন্দেহ করেছিল সে শহরটিকে। ১৯৪৬ সাল নাগাদ, সিদ্ধার্থ পূর্ববঙ্গের যে জায়গায় বাস করছিল সেই জায়গাটি বাসমতীর ক্ষেত বা চল্লিশ ক্ষেত নামে পরিচিত ছিল, সংক্ষেপে বাসমতীও বলা হত। শুধু সিদ্ধার্থই না, ঐ জায়গার আরো কিছু চরিত্রের মধ্যেই সেই সময় জুড়ে ক্রমাগত উৎকন্ঠা তৈরী হয়ে উঠছিল। বাসমতীর অধিবাসী সেইসব চরিত্রগুলি নিয়ে জীবনানন্দ দাসের বাসমতীর উপাখ্যান নামে যে উপন্যাস, সেই উপন্যাসে চরিত্রগুলি অন্ধকারের মধ্যে স্থানু হয়ে বসে থাকত । সেরকম অন্ধকারের কারণ ছিল অবশ্যই, সময়টা যখন দেশভাগ - পার্টিশনের অল্প কিছু আগে। তো চরিত্রগুলি - সিদ্ধার্থ সেন, তার স্ত্রী সুনীতি, সিদ্ধার্থের বাড়ীতে বাসকারী সিদ্ধার্থের পিসি ও ছাতুকাকা ও আর এক মহিলা টিনি মজুমদার, প্রভাতবাবু ও তার মেয়ে রমা (সিদ্ধার্থের ছাত্রী), গগনবাবু, কমলবাবু, ফাটা মহলনাবীশ, বনচ্ছবি আর আরো কিছু মানুষ যারা সবাই সেখানকার ব্রাক্ষ্ম সমাজের সদস্য যে সমাজটা ক্রমশঃ ভেঙ্গে যাচ্ছে, সময়টাই ভেঙে যাচ্ছে, ফলতঃ তারা অনবরতঃ কথা বলে, বিচার করে, কথাস্রোতের মধ্যে ডুবে থাকে, গড়েও তুলতে চায় সমাজটাকে বা আরো কিছু যেমন হাসপাতাল অথবা নাইট স্কুল, কিন্তু চাল আর তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার পরে যেহেতু তেল পাওয়া যায় না, অনেক সময়েই অন্ধকারের মধ্যেই তারা বসে থেকে কথা বলে, চিন্তা করে। অন্ধকারের পরিবেশটা সব সময়েই তাদের ঘিরে থাকছে, সন্ধ্যা বা রাতের অন্ধকারে হ্যারিকেন নিয়ে পথ হাঁটা অথবা ক্রমাগতই বাড়ি থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে নেমে পড়া তাদের দৈনন্দিনের অংশ, অথচ অন্যদিকে স্বাধীনতা আসছে, স্বাধীনতার সূর্য যেন জ্বলে উঠছে, খুব বেশী করে জ্বলে উঠলে কিরকম কী দাঁড়াবে সেসব যেন ঠাহর হচ্ছে না এঁদের, টাল সামলানো সমস্যার হয়ে পড়বে বলে মনে হচ্ছে । অঞ্চলে খ্রীস্টানদের মিশন আছে, সেখানে পাদ্রীরা কাজ করছে, এলাকায় মুসলমানদের পল্লী, হিন্দু মহাসভার উপস্থিতিও আছে, গরু হারিয়ে গেলে মুসলমানদেরই দায়ী করা হচ্ছে, তারা রুখে উঠছে সেই অভিযোগে,তারপর সব আবার শান্ত হয়ে যাচ্ছে, কলেজ কমিটির ক্লিক আর পলিটিক্স, জিরানডাঙায় কসাই বস্তিতে কলেরা ও তার সুরাহার জন্য সিদ্ধার্থদের কাজ, সময়ের এই দাগগুলিও উপন্যাসটি বহন করছে আর সিদ্ধার্থ নিজেকে স্থির রাখার জন্য, সময়ের সাথে সমঝোতায় আসার জন্যই যেন রোমান কবি লুক্রেশিয়াসের বই খুঁজে চলেছে যা সে পেয়ে উঠছে না।

    এর মধ্যেই কলকাতা শহরটা চরিত্রগুলোর চিন্তায় থাকে। অজস্র কথা আর বিচারের মধ্যে কলকাতা শহরটিও উপন্যাসের বিষয় হয়ে উঠেছে ​​​​​​​চরিত্রগুলির ​​​​​​​বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতেই। প্রভাতবাবু, সিদ্ধার্থ, ফাটা মহলানবীশ আর বনচ্ছবি, এই চারজন তাদের কথায় কলকাতা শহরটিকে নিয়ে মন্তব্য করছে, তাদের জীবনের সাথে কতখানি জড়িয়ে নেবে সেইসব বিচার করে। ফাটা মহলানাবীশ কলকাতায় ব্যবসা করেছে - ইঁট, চুণ, সুরকির ব্যবসা - ব্যাঙ্কে চল্লিশ হাজার টাকা জমেছে তার, আরো এক বছর ব্যবসার কাজ করলে আরো টাকা জমবে, কিন্তু সে মনে করে টাকায় শান্তি নেই, ফলে কলকাতা থেকে সে বাসমতীতেই চলে আসতে চায়, এখানে এসে ব্রাহ্মসমাজকে নতুন করে গড়ে তুলতে চায়, ধর্মের পথকেই সে ঐ বিক্ষুব্ধ সময়ে অনুসরণ করে চায়, মনে করেছিল সেই পথেই শান্তি পাওয়া যেতে পারে । বনচ্ছবি বুঝতে পেরেছিল ফাটা মহলনাবীশের এই মনোবৃত্তি, লক্ষ্য করেছিল যে সে যেন নিজের জীবনে ধর্মের মধ্য দিয়েই নিশ্চয়তা ও শান্তি খুঁজে পাচ্ছে, কিন্তু তাও সেই পথ বনচ্ছবির নয়, সেই পথে তার অতখানি বিশ্বাস নেই, বরং সিদ্ধার্থর মনোভাবই - ব্রাহ্ম সমাজের থেকে যে ক্রমশঃ দূরে সরে যাচ্ছে, সেই সমাজের যে আর ধর্মের খুঁটি ধরে বসে থাকার দরকার নেই এরকমই সে মনে করে - বনচ্ছবির চেতনার বেশী কাছে। বনচ্ছবির তখন অন্তত আর বাসমতীতে থাকার ইচ্ছে নেই, সে কলকাতা যাবে এমএ পড়তে, বিটি পড়ে কোন স্কুলে চাকরী নেবে, সেই চাকরী কলকাতায় অথবা বাসমতীতে কিনা সেও কিছু ঠিক করেনি সে, অতদূর ভেবে ওঠেনি। প্রভাতবাবু সিটি কলেজে পড়েছিলেন হেরম্ব মিত্রর আমলে, সরকারী চাকরীর প্রয়োজনে কলকাতায় যাতায়াত ছিল কিন্তু সেখানে সময় কাটাতে পারেননি বেশী, চেনা লোকজনের সাথে দেখা করার সময়ও হত না, কিন্তু ভাবছেন এখন কলকাতায় যাবেন, চেনা লোকজনের সাথে দেখা করবেন, কিন্তু সেটাও হয়ত ঘ্টে উঠবে না, পেনসন পাওয়া অবধি তাকে বাসমতীতেই থাকতে হবে, পেনশন পাওয়ার পরেও সেখানেই !

    কলকাতা নিয়ে এই তিনজনের মনোভাবের চেয়ে সিদ্ধার্থ ঢের বেশী সন্দেহ করেছিল শহরটাকে । সে রমার সাথে কথায় বলেছিল যে কলকাতা এককালে, আঠারো-উনিশ -বিশ শতক জুড়ে যেন এথেন্সের মত হয়ে উঠেছিল, অনেক দিন ধরে সেই শহরের যেন এক মর্যাদা ছিল কিন্তু এখন বাসমতী তিরিশ বছর আগের তুলনায় সরলতা হারিয়ে কলকাতা শহরটার মত সেয়ানা হয়ে উঠছে, কলকাতা যেন সেয়ানাদের পীঠস্থান আর বাসমতী যেন তাদের আখড়া! মাড়োয়ারি - ভাটিয়াদের সাথে বুদ্ধিফন্দি আর পরিশ্রমে পেরে না উঠে কলকাতায় বাঙালীর ফন্দিবুদ্ধি কয়েকটা গোয়াল সামলাচ্ছে শুধু, সেই গোয়ালগুলোই তাদের ইস্কুল-কলেজ, চাঁদা তুলে দুর্গোপুজো, কালীবাড়ি, জমিদারি, লগ্নীর কারবার, যাকে যেরকম ভাবে বাগাতে পারে তার জন্য সেরকম মাইনের ব্যবস্থা করে কলেজগুলো চলছে, পঞ্চাশ-ষাট থেকে একশো-শোয়াশ দুশ-আড়াইশ, কলকাতায় চলা বাঙালীর সেয়ানাগিরির খতিয়ান দিয়েছিল যেন সিদ্ধার্থ। যদিও কলকাতা বিদ্বেষী সে নয়, ভালবাসে সে শহরটাকে, জীবনের কয়েকটা দিক নিয়ে আশ্চর্য একাগ্রতা আছে সেই শহরের আর কিছু মানুষের যার সংস্পর্শে থাকা দরকার এরকম সিদ্ধার্থের বোধ হয়েছিল, ভাল কাজ পেলে সে চলেও যেত সেখানে কিন্তু স্বাধীনতা এসে গেলেও তার মতো মানুষের সেই শহরে কোন জায়গা হবে না, স্বাধীনতার ভিড়ে সে চাপা পড়ে যাবে সেখানে। মিলিটারিতে চেষ্টা করলেও কমিশন পাওয়া যেত হয়ত কিন্তু তার বয়স হয়ে গেছে, অন্য কাজ পাওয়া যাবে না, যেসব ছেলেদের পরীক্ষার খাতা দেখে তার ঘেন্না ধরে গেছে, চাকরি ও ব্যবসার বাজারে তারাই উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, জোর করে পথ কেটে নিতে যারা জানে, স্বাধীন ভারতে তাদেরই সুবিধে হবে, তাদের মত ছোকরা আর বুড়োদের। কিন্তু সিদ্ধার্থর মতো যারা তাদের কোন মীমাংসা হবে না, মীমাংসার ভার যাদের ওপর বাংলাদেশের সেই সব অন্ধরা রাতারাতি ভোল বদলে টাকা-চাকরি-ব্যবসা সবই নিজেদের করে নেবে, বাসমতীতে থাকলে তবু খেয়ে পরে বাঁচতে পারে কিন্তু কলকাতায় গেলে সপরিবারে না খেতে পেয়ে অথবা টিবি হয়ে মরে যেতে পারে, সেরকম হলেও স্বাধীনতার সেবকরাও তাদের দিকে ফিরেও তাকাবে না ! দেশভাগের দিনগুলিতে কলকাতা হয়ে উঠেছিল পূর্ববঙ্গের মানুষের কাছে আশা, কোনক্রমে সেখানে চলে যেতে পারলে সুরাহা ঘটবে সেই মনোভাবের বিপরীতে রয়েছে সিদ্ধার্থের যুক্তিগুলি, রাজনীতি - সমাজ - অর্থনীতি নিয়ে কলকাতা শহরের যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তাকে সে খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছিল ও মন্তব্য করেছিল । এই উপন্যাসের কাছাকাছি সময়ে লেখা জলপাইহাটি উপন্যাসেও যখন জীবনানন্দ লিখবেন পার্টিশন আর তার মধ্যে পথ খোঁজার চেষ্টা করা কিছু মানুষের কথা, সেই উপন্যাসেও নিশীথ কলকাতায় চাকরির অনেক চেষ্টা করেও না পেয়ে পূর্ববঙ্গের জলপাইহাটিতেই ফিরে যাবে,পার্টিশনের অল্প পরের দিনগুলিতেই ! নিরুপম যাত্রা ও বাসমতীর উপাখ্যান, জীবনানন্দের এই দুই গদ্যতেই কলকাতা তার বরাভয় রূপটি হারায়, চরিত্ররা প্রশ্ন করে এই শহর আর সেখানে গড়ে ওঠা ব্যবস্থা নিয়ে।

    কলকাতায় 'আত্মন ' / সুধাময়

    প্রভাত, ​​​​​​​বিন্দু ​​​​​বা ​​​​​​​সিদ্ধার্থ ​​​​​​​তো কলকাতার ​​​​​​​বাইরের ​​​​​​​মানুষ ​​​​​​​আর ​​​​​​​কলকাতা ​​​​​​​তো ​​​​​​​এক ​​​​​​​আধুনিক ​​​​​​​শহর ​​​​​​​যেখানে ​​​​​​​সরবরাহের ​​​​​​​সুর ​​​​​​​সারা দিনমান ঘুরতে থাকে, কিছু ​​​​​​​লোক ​​​​​​​সোনা, ​​​​​​​তেল ​​​​​​​আর ​​​​​​​কাগজের ​​​​​​​খনি ​​​​​​​নিয়ে ভেবে ​​​​​​​​​​যায়, ​​​​​​​তারা ​​​​​​​তিনজনেই ঐ ​​​​​​​শহরের ঐসব ​​​​​​​কাজকারবারকে ​​​​​​​চেনেনি ​​​​​​​যেন, ​​​​​​​তাদের সাথে কলকাতার ​​​​​​​দুরত্ব ​​​​​​​রয়ে ​​​​​​​গেছে, ​​​​​​​কলকাতার ​​​​​​​সাথেও ​​​​​​​যেন ​​​​​​​গ্রাম ​​​​​​​আর বাংলাদেশের ​​​​​​​দুরত্ব ​​​​​​​ও ​​​​​​​দ্বন্দ ​​​​​​​রয়ে ​​​​​​​গেছে। স্বাধীনতার ​​​​​​​এক ​​​​​​​দশক ​​​​​​​পরেও ​​​​​​​যখন দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা চর্যাপদের হরিণী গল্পে সুধাময়ের কথা বলা হবে তখন সুধাময়ের চেতনাতেও কলকাতা শহর আর বাংলাদেশ ক্রমাগত ঘা মারতে থাকবে, তাকে ব্যতিবস্ত করে তুলবে, স্থিরতা হারিয়ে সুধাময় সেই শহরে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করবে,শুধু নিজেকেই নয়, প্রাণান্তকর ভাবে কলকাতা শহর এবং বাংলাদেশকেও, ​​​​​​​তাদের ​​​​​​​অতীত ইতিহাস ​​​​​​​ও ​​​​​​​বর্তমান ​​​​​​​সুদ্ধ।

    সুধাময়কে নিয়ে লেখা ​​​​​​​কাহিনিটি গঠনগত ভাবে জটিল, সেই ​​​​​​​লেখায় চরিত্র শুধুই ​​​​​​​সুধাময় ​​​কিনা সেও যেন সহজে বুঝে নেওয়া যায় না। ডায়েরী এন্ট্রি আকারে যা লেখা হয়েছে সেই এন্ট্রিগুলির মধ্যে দিয়ে দুটি চরিত্রর কথা বলা হয়েছে বলে বোধ করি, একজন সুধাময় যার অন্তর্জগতের বিবরণ আর কলকাতা শহরে তার বিচরণের বর্ণনা কয়েকটি এন্ট্রিতে দেওয়া হয়, অন্যজন আমি যে একটি লেখা বা স্কেচ শেষ করার কথা ভাবছে এবং ডায়েরীর কিছু এন্ট্রির মধ্যে দিয়ে আমি -র লেখার বিষয় কী সেসবই জানানো হয়েছে । আবার এও বোধ করি যে যেহেতু তারিখ অনুযায়ী ডায়েরী এন্ট্র্রিগুলি এক মাসের সময় জুড়ে এবং এইগুলির মধ্যে দিয়ে একইসাথে সুধাময় ও আমি -র কথা লেখা হয়, অতএব যেন আমি অর্থাৎ লেখক চরিত্রটি আর সুধাময় একই ব্যক্তি, লেখক চরিত্রটিই সুধাময়ের কথা লিখছে, লেখক আর তার সৃষ্ট চরিত্র একই সময়ে বাঁচছে, যেন সুধাময়ের চিন্তা আর গতিবিধি একই সাথে আমি বা লেখকের চিন্তা ও গতিবিধি, লেখক আর তার সৃষ্ট চরিত্র যেন এক হয়ে গেছে। কাহিনিটিতে রিফ্রেইনের মতো ব্যবহৃত হয় চর্যাপ্দের হরিণের কথা, হরিণের হরিণী খুঁজে যাওয়ার কথা যে হরিণীর নিলয় জানা নেই। আমি লিখেছিল সমালোচকরা যেমন মনে করে যে চর্যাপদের কবিতায় হরিণ - হরিণীর বিষয়টি সাধক আর বৌদ্ধ শূন্যতাবাদের সাংকেতিক রূপ, ব্যাপারটি ঠিক সেরকম নয়। সে হরিণ আর হরিণীকে মনে করেছিল symbol of life আর love হিসেবে, সিদ্ধান্তে এসেছিল সভ্যতার আদি থেকেই জীবনতৃষ্ণা বা শিল্পতৃষ্ণা মানুষের মধ্যে রয়ে গেছে। এই মর্মে সে পরীক্ষার খাতায় লিখেও এসেছিল কিন্তু চর্যাপদের সেই বিশ্লেষণ পরীক্ষকদের পছন্দ হয়নি, ফলে রেগে গিয়ে সে সিদ্ধান্ত নেয় দেড় হাজার পাতার উপন্যাস লেখার, লিখবে এক যুবাকে নিয়ে যে কামু পড়েছে এবং যার আত্মার তৃষ্ণা ছিল। এই উপন্যাসটির স্কেচ বা অংশই যেন সুধাময়কে নিয়ে সুধাময়ের কাহিনিতে যা লেখা হবে সেসবই। ফলে সুধাময়ের সচেতন ভাবনায়, আচরণে আর স্বপ্নে খুঁজে যাওয়া আছে, সে খুঁজে যাওয়ার মধ্যে এলিজা ইম্পে-ওয়ারেন হেস্টিংস থেকে আওরঙ্গজেব, বিদ্যাসাগর - মাইকেল - মাণিক বাড়ুজ্যে - জীবনানন্দ - তারাশংকর অনেকেই এসে যায়, সুধাময় কোর্ট চত্ত্বরে গিয়ে বসে থাকে যেখান সে দেখে পাপের বাহার , ঘুরে বেড়ায় ময়দান আর পার্ক স্ট্রীটে কলকাতার চিত্র, শব্দ আর বর্ণের মধ্যে, রাতের বেলা তার বাড়ি আর পাড়াটা যেন ঐতিহাসিক হয়ে ওঠে। সুধাময়ের চেতনায় মঞ্জুশ্রী নামে একটি মেয়ের কথা আসে (লক্ষ্য করি যে বৌদ্ধ দর্শনে মঞ্জুশ্রী জ্ঞানের প্রতীক, যেন এই নামটি বা ইমেজটি ইঙ্গিত করে ইতিহাস আর বর্তমানের প্রেক্ষিতে নিজের সত্তাকে জানার চেষ্টা ), আবার ঘোরের মধ্যে, চেতনার বিপর্যয়ের মধ্যে যেন সে শুনতে পায় কালো জিপের আওয়াজ, কাঁচ ভেঙে যাওয়ার শব্দ , যেন বর্গীদের ঘোড়ার আওয়াজ, যেন কলকাতা শহরের সমসাময়িক রাজনীতির শব্দসকল। সুধাময়কে নিয়ে অংশটিতে যেন সুধাময়ের স্নায়বিক বিপর্যয় ঘটে গেছে, ছিঁড়ে যাওয়া চেতনার মধ্যে দিয়ে আর স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে, লেখাটির সর্বৈব নন-লিনিয়ারিটির মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ আর কলকাতার অতীত ও বর্তমান মিলিয়ে বিংশ শতকে এক যুবা যেন স্ব-আইডেন্টিটি খুঁজছিল, নিজেকে স্থিরভাবে দাঁড় করাবার চেষ্টায় রত যে।

    গল্পটির শেষ অংশটি বা আমি-র স্কেচের শেষ অংশটি সুধাময়ের এক স্বপ্নদৃশ্য, সেখানে সে মঞ্জুশ্রীকে কাছে আসতে দেখে (যেন তার জ্ঞানলাভ স্বপ্নেই হতে পারে, বাস্তবে নয় ! ) আর শেষ বাক্যটিতে লেখা হয় আর সুধাময় দেখে যে বাংলাদেশ হরিণ হয়ে গেছে। কলকাতা সেই হরিণী । সুধাময় রিনাইসেন্সের কথা ভেবেছিল, ভেবেছিল যে বিদ্যাসাগরের চেলা হয়ে আবার সেই অসমাপ্ত কাজকে মাটিতে প্রোথিত করবে, যেন রিনাইসেন্সের সময় থেকে বাংলাদেশ আর কলকাতার মধ্যে যে ফাঁক, সুধাময় বা তার মতো আরো অনেকেই যেন সেই ফাঁকের ফসল, শেষ বাক্যের বাংলাদেশ আর কলকাতা যে হরিণ - হরিণী ইমেজ দিয়ে জুড়ে দেওয়া হয় তার কারণ ঐ দুই স্থানের মধ্যে দুরত্ব যেন সমাজে আর ব্যক্তিতে ফাটলই তৈরী করছে । সুধাময়ের কাহিনি জটিলতা আক্রান্ত কারণ সেই কাহিনি অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎও ছুঁয়ে থাকে (যেহেতু স্বপ্নপ্রসঙ্গ ), এগুলোকে জুড়ে থাকে প্রাচীন বাংলা কাব্য আর বৌদ্ধধর্মের থীম, অতীত ইতিহাস থেকে ভবিষ্যৎ অবধি বিচরণ করা হয়, সেই ইতিহাসে কলকাতা আর বাংলাদেশের মধ্যে যে দুরত্ব বা ফাটল ছিল, সেই ফাটলের সাথেই যে কলকাতা শহরের এক যুবাচরিত্রর বর্তমান যুক্ত, তার স্খলিত চেতনা আর মগ্নচৈতন্য যে ঐ দ্বন্দ থেকেই তৈরী, সেই দ্বন্দর নিরসন হলেই একই সাথে সুধাময়ের, কলকাতার আর বাংলাদেশের 'আত্ম ' খোঁজা সফল হবে কাহিনিটি যেন সেরকমই বলে, শেষ পর্যন্ত সেই দুরত্বের নিরসনই যে কাঙ্খিত লক্ষ্য, কাহিনিটি অন্তিমে সেই স্বপ্ন দিয়ে শেষ হয়।

    কলকাতা ভক্ষণ / নিরুপম

    শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা হৃদয়পুর নামক গদ্যটিতে নিরুপম চরিত্রটির কলকাতা ভক্ষণের বর্ণনা ছিল। আগের রাতে নিরুপম কবিতা লিখে ফেলে এবং সেই কবিতার ওপরেই ঘুমিয়ে পড়ার পরে, যে কবিতায় ছিল জেব্রা, জ্যোৎসনা আর মহীনের ঘোড়াগুলি, পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতেই নিরুপম অনুভব করেছিল যে গতরাত্রে সে কিছুই খায়নি । সকালের আলস্য ছেড়ে উঠে পাঁউরুটি খাওয়ার চেয়ে কাগজটা মুখে ঠেকায় এবং সে জেব্রাগুলি, ঘোড়াগুলিসুদ্ধ কবিতাখানি খেয়ে ফেলে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে মুখশ্রী নামে মেয়েটির কাছে গিয়ে তাকে বেনারসী পরে তার কাছে সেজে আসতে বলে তাকে নিজের পাশে শুইয়ে মুখশ্রীর কানের ওপরে গল্প আর ভাষার আঘাত করে তাকে ঘুম পাড়িয়ে পিঠের চাপা জায়গা থেকে বেনারসীর আঁচল তুলে একমুঠো মুখে পুড়ে চিবোতে থাকে নিরুপম। ক্রমশঃ পুরো বেনারসীখানা, শায়া-জামা, চোখ - কান - ঠোঁট উপরন্তু স্বপ্ন ও স্মৃতিগুলি খেয়ে থাবায় মুখ মুছে নিরুপম ঘর থেকে বেরিয়ে কলকাতার বিষন্ন স্রোতে নেমে গিয়ে গলির মুখের ইঁদুরের মত একটি লাল অটোমোবাইল গিলে ফেলে। ক্রমশঃ নিরুপম সকল দৃশ্য, মানুষ আর স্থাপত্য সমেত সম্পূর্ণ কলকাতা শহরটিকেই খেয়ে ফেলতে থাকে; বাসের জানলার কাঁচ, দোকানের সামনের বিশাল নমুনা পেন, মদের দোকানের শো-আলমিরা থেকে নিয়ে বোতল সমেত মদ, বুটজুতো দুটো বাদ দিয়ে এক সিপাহীকে, কাগজের অফিসে ঢুকে গুদাম থেকে গুদামে রাখা কাগজের রীল, মহীন্দ্র তার কবিতার নিন্দে করেছিল বলে তাকে, দোকানের এক মাদ্রাজী বেয়ারা, মনুমেন্টের তলায় গিয়ে যে রেলিং ভেঙে পড়েছিল তারই দুটো তুলে নিয়ে দাঁতের ফাঁকের ময়লা তুলতে থাকে, মল্লিকানাম্নী বেশ্যার কাছে গিয়ে তার দালালটিকে খায়, ডালহৌসী পাড়ায় ব্যাঙ্ক অফ চায়নাকে গিলে ফেলে ঘড়ি কোম্পানীর সামনে গিয়ে তাদের ওপরে অত্যাচার না করে নিজের ঘড়িটিকেই গালের ভেতরে রেখে রসাক্ত সময় খেয়ে ফেলে, টুরিস্ট অফিসে ঢুকে কুতুবমিনার, তাজমহল, দাল লেকের জল , অজন্তা-ইলোরার ভাস্কর্য এসব ছবিসুদ্ধ অনেকগুলি ম্যাপ - পোস্টার চিবিয়ে খেয়ে সেখান থেকে বের হয়ে সম্পূর্ণ রাইটার্স বিল্ডিং গিলে ফেলে। কংগ্রেসী মন্ত্রী যারা বক্তৃতা করছিল তাদের গিলে ফেলে লাল ঝাণ্ডা ও পোস্টার সমেত কমিউনিস্টদের মিছিলটিকে খেয়ে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে ইডেন গার্ডেনের কাছে এসে যার নাম গার্ডেন তাকে গিলে ফেলা যাক ভেবে ইডেন গার্ডেনকে খেয়ে হাওড়া ব্রীজের দিকে হাঁটতে থাকে। একটানে হাওড়া ব্রীজের খোলা ছড়ানো পাঁজরগুলো হাতের মুঠোয় ভরে ফেলে এবং তারপর হাড়গুলো চিবোতে থাকে, এইভাবে সম্পূর্ণ হাওড়া ব্রীজটিকে উদরস্থ করে নিরুপম গঙ্গাতীরে দাঁড়িয়ে পশ্চিমপানে তাকায়। তার পেছনে কলকাতা শহরের শূন্যতা, সামনে একটি জাহাজ, যে জাহাজটিকে খাওয়ার চেষ্টা করেও সে পেরে ওঠেনা বরং জাহাজটি তাকে অবসানের দিকে, পশ্চিমের দিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে ।

    কলকাতার কেন্দ্রের থেকে দূরে উল্টাডাঙা অঞ্চলে, যেখান থেকে শ্যামবাজার রিক্সায় মিনিট কুড়ি, এরকম একটি জায়গায় নিরুপম ১৯৬২ সালে নিঃসঙ্গ, নিরাত্মীয়, সমাজহীন এবং কলকাতা শহরে যেন ক'দিনের জন্য বেড়াতে এসেছে সেইভাবে বেঁচে ছিল। মা মারা গেছে কয়েকদিন আগে, তজ্জনিত শোক, স্ত্রী মিনতির কলকাতা থেকে দূরে রাঁচিতে থাকা, শৈশবের আত্মীয়দের সবাইকেই ক্রমশঃ হারিয়ে ফেলা, চাকরি বা বাড়ির মধ্যে নিয়ত যাতায়াত শুধু, এইসব মিলিয়ে নিরুপম স্বাধীন এক জীবন কাটালেও সে যেন ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিল জীবনে আরো কিছু পাওয়ার জন্য। সেইরকম ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লে মানুষ হয়ত প্রতিক্রিয়া হিসেবে তার পারিপার্শ্বিক ভক্ষণ করতে শুরু করে -সৌন্দর্য (কবিতা ও নারী) থেকে শুরু করে শহর জোড়া কর্মঠ মানুষের কর্ম ও চিন্তার চিহ্নগুলি, সবই। গদ্যটির তিনটি অংশ ছিল, প্রথম অংশে নিরুপমের কলকাতা ভক্ষণের ফ্যান্টাসি যা নিরুপমের অন্তর্জগতেরই বিবরণ, মধ্যাংশে তার অতীত জীবন আর বর্তমানের দৈনন্দিনের কাহিনি আর শেষ অংশে নিরুপমের জীবনে অতিনিরুপম নাম নেওয়া হুবহু আর এক আগন্তুক নিরুপমের উপস্থিতি যে নিরুপমকে কর্মঠ করে তুলতে চায় ও অন্তিমে অসুস্থ নিরুপমের চেতনায় প্রথম অংশের সেই জাহাজটি মৃত্যুপ্রতীক হয়ে ফিরে আসে তাকে চরম নিশ্চেতনের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। একাকী নিরুপমের কলকাতা শহরের কিনারায় মৃত্যুই ঘটে গেছিল ! নিরুপমের জীবনের পরিস্থিতির জন্য কলকাতা শহরটিই দায়ী হবে কিনা নাকি তার নিঃসঙ্গ জীবনের জন্য তার নিজের মুদ্রাদোষ, শোক আর আত্মীয় মানুষদের থেকে বিচ্ছেদবেদনাই দায়ী সেটা ঠিক যেন সাব্যস্ত হয়না কিন্তু এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে কলকাতা শহরে থেকেও নিরুপমের হৃদয় বেঁচে থাকার জন্য শান্তি ও সঙ্গ পেয়ে উঠতে পারেনি। একাধিক দশকের ​​​​​​​ব্যবধানে ​​​​​​​লেখা নিরুপম যাত্রা আর এই ​​​​​​​হৃদয়পুর ​​​​​​​গল্প দুটির ​​​​​​​মধ্যে, ​​​​​​​প্রভাত ​​​​​​​ও ​​​​​​​নিরুপমের ​​​​​​​মধ্যে আশ্চর্যজনক ​​​​​​​কিছু মিল খুঁজে পাই; দুইজনেই তাদের দৈনন্দিনে বেদনা আক্রান্ত ও পরিজন থেকে দূরে, দুইজনেই কলকাতা শহরটিকে অনেকখানি দেখে ঘুরে প্রশ্ন ​​​​​​​করে, বেদনা ​​​​​​​কাটিয়ে ​​​​​​​নিজেদের কর্মঠ ​​​​​​​করে ​​​​​​​তোলার ​​​​​​​চেষ্টা ​​​​​​​করে, প্রভাতে ​​​​​​​সেই চেষ্টা ​​​​​​​নিজের ​​​​​​​সাথেই নিজের ​​​​​​​কথা বলা ​​​​​​​আর ​​​​​​​ভাবনার ​​​​​​​মধ্যে, ​​​​​​​নিরুপমের ​​​​​​​ক্ষেত্রে স্ব-আমি সাংকেতিকভাবে রূপ পায় অতিনিরুপম নামে আগন্তুকের মধ্যে, আর শেষে দুজনেই মৃত্যুসম্মুখীন হয়ে শহরের কিনারায় ঝরে পড়ে, প্রভাতে যা সাতিশয় বাস্তবভাবে চিত্রিত নিরুপমের ক্ষেত্রে সেই মৃত্যুই ভেসে যাওয়া জাহাজের রূপ নিয়ে আসে !

    কলকাতা ও অবদমন / তারক ও মুকুন্দ

    মতি নন্দীর গল্প আর উপন্যাসের যেসব চরিত্র তারাই কলকাতা শহরটা তৈরি করেছে না শহরটাই তাদের তৈরি করেছে সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিধা আছে। বাতিল কাগজের মতো এইসব মানুষগুলোর সাথে - তারক, মুকুন্দ, গিরি, শিপ্রা বা অমিয়া - কলকাতা শহরের যেন কোন বিরোধ নেই, শহরটি নিয়ে আলাদা করে কোন বক্তব্যও নেই, কলকাতাকে প্রশ্ন করা অথবা সেখান থেকে চলে গিয়ে মুক্তির আশা করা সেরকম কিছুই নেই, আলো অন্ধকার নিয়েও চিন্তিত নয় তারা, এরা আট টাকা ডি এ বাড়লে ফুটপাথ থেকে তিন টাকা দামের ব্লাউজ কেনে বৌয়ের জন্যে, মিছিলে গিয়ে হিসেব করে ইউনিয়নের সুবাদে মাইনে বাড়লে ইউনিয়নকে আট টাকা দিতে হবে, এরা সবাই কলকাতা শহরের পেটের ভেতরের বাসিন্দা যেন সব, উত্তর কলকাতার নিসর্গ যেন এদেরই আত্মার বর্ণনা - বাড়িগুলো কলিচটা; বালি বেরিয়ে পাণ্ডুর বর্ণ। .... বৃষ্টি -জলের পাইপগুলো শিরার মত দেওয়াল বেয়ে রাস্তা পর্যন্ত নামান, কিন্তু রবারের বল খেলার ধকল সইতে না পেরে তলার অংশ অধিকাংশরই ভাঙা। জানালাগুলো লটপটে বুকপকেটের থেকেও অর্থহীন, ঝড় বৃষ্টিতে কাজে আসেনা। গলিতে দাঁড়িয়ে আকাশে তাকালে প্রথমেই মনে হবে চিরকুট শাড়ি ফেঁসে গিয়ে বিব্রত কোন গৌরাঙ্গীর দেহ । জীবনানন্দ দাসের কবিতায় এইসব মানুষদের বেঁচে থাকতে দেখা গেছিল পাথুরেঘাটায়, মাণিকতলায়, শ্যামবাজারে, গ্যালিফ স্ট্রীটে, এন্টালিতে, মনে করা হয়েছিল কোথাকার কেবা জানে; / জীবনের ইতর শ্রেণীর মানুষ তো এরা সব; / ছেঁড়া জুতো পায়ে বাজারের পোকাকাটা জিনিসের কেনাকাটা করে; মতি নন্দীর লেখায় হাতিবাগান,আহিরিটোলা, উত্তর কলকাতার রাস্তা ও গলি দিয়ে এদের প্রবেশ ও প্রস্থান - রিপুতাড়িত, স্মৃতিহীন, রক্তমাংসের শরীরে বন্দী এই সব মানুষগুলো আলোকিত ও নৈর্ব্যক্তিক দক্ষিণ কলকাতা বা আরো পরের পুবের দিকে বৃদ্ধি পাওয়া কলকাতার অধিবাসীই হতে পারে না - সেই উত্তর কলকাতা যার কৃষ্টি আর সংস্কৃতি নিয়ে কলকাতার অনেক গর্ব, অনেক ফুলমালা এককালে যেখানে দেখা গেছিল, কিন্তু মতি নন্দীর লেখায় শুধুই সেই স্থানের হাড় – পাঁজরের উপস্থিতি, ক্ষতচিহ্নিত বর্তমান, আভরণস্বরূপ শুধু সংসারের বাতিল ফেলে দেওয়া দ্রব্যাদি ও অবদমিত মানুষেরা যাদের গন্তব্য শেষ হয় গলি থেকে কানাগলিতে !

    যেমন দ্বাদশ ব্যক্তি উপন্যাসটিতে তারক সিনহাকে অনুসরণ করে জানা গেছিল যে এগারো বছর আগের ইডেন গার্ডেনের পীচে বাংলার হয়ে রঞ্জি টীমে ঢোকার ট্রায়াল ম্যাচে বোলার এগিয়ে আসার সময়ে তারকের মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল তার সামনে পীচের ওপরে একটা কাঁকর, তুলবে কি তুলবে না, বোলারকে থামাবে কি থামাবে না এই দ্বিধা থেকে বেরোতে না পারলে বোলারের বল শ্যুট করাতে তারক বোল্ড আউট হয়েছিল, সেকেন্ড ইনিংসের সুযোগ আর সে পায়নি, প্রথম একাদশ থেকে বাদ পড়েছিল, টুয়েল্ফ্থম্যান সে হয়েছিল কিন্তু মাঠে নেমে ক্যাচ ফেলার ফলে দর্শকদের ব্যারাকিং-এ তাকে মাঠ ত্যাগ করতে হয়েছিল, ক্রিকেট খেলা আর তার হয়নি। বাস্তবিক উপন্যাস জুড়ে তারকের সমস্যা এটাই যে তার মাথার ভেতরে যেন একটা কাঁকর ঢুকে গেছে, খচখচ করে, একটা অসুখ তার, খুঁটে তুলতে চায় কিন্তু পারে না বিবেকের এই কামড় এড়াতে, আর অন্যদিকে তাকে প্রশ্নহীন মেনে নিতে বলা হয়েছে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলিকে। ফলতঃ সমাজ - সংসারে- শহরে অন্যরা নিয়ত যে খেলা খেলে চলেছে ঐ কাঁকরটি তুলে ফেলে, সেই খেলা খেলে প্রথম একাদশের সাফল্যে সে ঢুকতে পারে না, নিজের ভূমিকা খুঁজে পায়না, দ্বাদশ ব্যক্তি হয়ে অন্যের কথা শুনে সব সহ্য করে বেগার খেটেও সে যে দলে কোনক্রমে থেকে যাবে সেরকম নাও ঘটতে পারে, অন্যমনস্ক হয়ে কখনও ইজি ক্যাচ ফস্কে যেতে পারে। মাথার ভেতরের কাঁকরটি ছাড়াও তারক গনোরিয়া নামক ব্যাধিটিতে আক্রান্ত হয়ে চাপের মধ্যে, শহর সে ঢুঁড়ে ফেলে পেনিসিলিন ইঞ্জেজকশনের জন্য যাতে সে কোর্সটা শেষ করে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। উপন্যাসটির শেষ অংশে শহরের রাস্তায় পুলিশ-মিলিটারির টহল, আগুন ও বোমা, ক্ষুধার্ত মানুষের ওপরে গুলি, কিন্তু তারক মনে করে অজস্র মানুষের সমস্যার সাথে জড়িত যে বিপ্লব আর রক্তপাত তার সাথে তার সম্স্যার কোন তুলনাই হয় না, সে কথা ভাবলেই তার হাসি পায়, ফলে সে রেহাই পেতে চায়, পালাতে চায়, সরে যেতে যেতে একটি পাড়ায় বাড়ির গা ঘেঁষে দাঁড়ালে বাসিন্দারা তাকে ইঁট ছুড়ে তাড়ায় (না হলে তারকের জন্য পুলিশ পাড়ায় ঢুকবে, ঝামেলা করবে), তারক বড় রাস্তা থেকে আরো সরে গিয়ে একটা জনহীন রাস্তায় বস্তির সামনে তিনটি স্ত্রীলোকের দেখা পেলে তারা তাকে ডাকে, তারক পকেটে রাখা তার নিরাময় বা পেনিসিলিনের টাকাটা হাত দিয়ে স্পর্শ করে সেই ডাকে সাড়া দিয়ে তাদের ঘরে ঢুকে যায়।

    শবাগার গল্পে পঞ্চাশোর্ধ মুকুন্দ ক্রমাগত ভয়ের আবহে বাস করতে থাকে - সকালে খবরের কাগজে করোনারি থ্রম্বসিসে মৃত্যুর খবর পড়ে, নকশাল সময়ে বাসে পুলিশ পেটানোর আতঙ্কের কথা শোনে , অফিসের যূবক সহকর্মীর ভয় পাওয়া দেখে ও শোনে যে পাঞ্জাবী পড়ে বয়স্ক সাজাই সেফ, তা না হলে শুধু ডাঁটো বয়সের জন্যই পুলিশ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে মেরে হাঁটু ভেঙে দিচ্ছে, অফিস থেকে ফেরার সময়ে পাড়ার গলিতে ঢুকে বুশশার্ট পড়া পুলিশের পিস্তলের খোঁচা খেয়ে গলাকাটা মৃতদেহ শনাক্ত করতে বাধ্য হয়, মুহূর্তের জন্য মনে হয় যে দেহটি তারই যূবক সন্তান মনুর! পুলিশ খবর জানার জন্য মনুকে থানায় নিয়ে গেলে মুকুন্দ থানায় যায়, ছেলেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে, ভয় পেয়ে মনুর ঠকঠক করে কাঁপার দিকে তাকিয়ে মনে করে মনু হয়ত তার শরীরের জন্যই ভয় পাচ্ছে, গলিতে যে দেহটি পড়ে ছিল সেও তার শরীরটিকে ভালবাসত সে কথাও সে ভাবে, মনুর জন্য থানার বাইরে বসে থাকে, ছেলেকে ছেড়ে দিলে নিশ্চিন্ত হয়। পরে ক্রমশঃ মনু মুকুন্দকে অভিযূক্ত করে, থানায় মনুর দিকে মুকুন্দর তাকিয়ে থাকা দেখে মনুর মনে হয়েছিল সে যেন এক মরামানুষ, নিজেকে ঘেন্না করেছিল ও ভয় পেয়েছিল সে, ফলে থানায় পুলিশকে সব কথা বলে দেয় সে , মনু অভিযুক্তই করে মুকুন্দকে যে সেই তাকে কোরাপ্ট করেছে না হলে কোন কথাই সে থানায় বলত না। মনুর বয়সী ও বন্ধু তাজু পুলিশের হাতে খুন হওয়ার খবর মুকুন্দ বাড়িতে নিয়ে এলে মনু নিজেকে সামলাতে না পেরে মুকুন্দ যখন কলতলায় তখন তার গায়েই হড়হড় করে বমি করে দেয় ! ভয়ের পরিবেশ আর ছেলের কাছে অভিযূক্ত হওয়ার ক'দিনের মধ্যে মুকুন্দ নীচের তলার ভাড়াটে সদ্যস্নাতা শিপ্রার চিবুক ও বগলের কেশ থেকে ঝরে পড়া জল দেখে উপভোগ করে, শিপ্রার স্বামী গৌরাঙ্গ ক্যান্সারে মারা যাচ্ছে, বড়জোর এই মাসটা বাঁচবে, শরীরের মৃত্যু তারও ঘটে যাবে, গৌরাঙ্গর চোখের কোণে জমে থাকা জল মুকুন্দ দেখেছিল, শিপ্রার পাছায় হাত দিয়ে টেনে আনার চেষ্টা করলে পেছনে মনুর উপস্থিতিতে মুকুন্দ চমকে ওঠে। গল্পের শেষে যে সন্ধ্যেতে মনু মুকুন্দর গায়ে বমি করে, সেই রাতেই শিপ্রার ঘরে নেমে গিয়ে মুকুন্দ গৌরাঙ্গর সামনেই যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হতে চায়, মুকুন্দ খাটে শুয়ে থাকা মৃত্যুসম্মুখীন গৌরাঙ্গকে পাত্তাই দেয় না কারণ "ও তো মরে যাচ্ছেই। তাহলে আবার ভয় কিসের।"

    বস্তুত প্রতিনিধিত্বমূলক এই দুটি লেখায় আমি লক্ষ্য করি মতি নন্দী উত্তর কলকাতাকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করে তারক ও মুকুন্দকে অনুসরণ করে মানুষের সম্ভাব্য পরিণাম বিষয়ে মন্তব্য করেন। তারক মাথার ভেতরের অস্বস্তিকে অগ্রাহ্য করতে না পেরে যখন রোগমুক্তি আর উপশমের পাথেয় পকেটে করে নৈশ সড়ক ধরে বস্তির ঘরে ঢুকে যায়, যেরকম কোন ঘর থেকেই হয়ত সেই রোগটি তার শরীরে এসেছিল, তখন বোঝা যায় সেই শহরে বা সেই সময়ে তারক সিনহা বা তার মতো অন্যরা অবদমনমুক্তির সহজ সমাধান পাচ্ছে না; বদলে যা ঘটছে তাকে বলতে পারি নেতির নেতি, স্বাভাবিক থেকে অসুস্থতার অস্বাভাবিকত্বে পৌছে অস্বাভাবিকত্বর সহজ নিরাময় ঘটিয়ে আবার স্বাভাবিকত্বে পৌছন যাবে না বলে তারক যে পথে গেল সেই রাস্তা সম্পর্কবহির্ভূত হয়ে নিজেকেই ভেঙে ফেলা, সেই দ্রোহ না করলে সভ্যতা অগ্রসর হয় না বলে ! অন্যদিকে মুকুন্দর শিপ্রাকে বলা গৌরাঙ্গর মরে যাওয়া সম্বন্ধে নির্মম, নিষ্ঠুর ও ক্ষমাহীন মন্তব্যতে ক্রমাগত ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশে টিঁকে থাকতে থাকতে একটি জনপদের চরিত্ররা বোধহীন অসাড় হয়ে গিয়ে কলকাতা শহরটিকে মরচুয়ারিতে ডেকে নেয়। সেই পরিবেশে টিঁকে থাকতে থাকতে মানুষ তাদের মৌল চরিত্র হারিয়ে ফেলতে পারে, সমাজ কাঠামোটাই বদলে যেতে পারে, শরীরটা শেষ হয়ে যাওয়ার ভয় কাটাতে, পরবর্তী প্রজন্মের দৃষ্টি থেকে পালাতে সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে শরীরের উত্থানকেই ভয় নিরসনের উপায় ভাবতে পারে কিন্তু সেই ক্রিয়াটিও অন্ধকারের স্তন আর যোনির মধ্যে ঢুকে যাওয়ারই প্রকারান্তর শুধু; মুকুন্দর ও তৎসহ শহরটির পাতাল প্রবেশ ঘটে, রেজারেকশনের আশা নিঃশেষে মুছে দিয়ে।

    কলকাতায় ভয় বৃত্তান্ত / বীরেন

    মতি নন্দীর দৃষ্টি ছিল উত্তর কলকাতা জুড়ে, বড় রাস্তা থেকে ভেতরে ঢুকে দেখেছিলেন মানুষ কী আর কেন, কোন পরিস্থিতিতে কী করে সবই লক্ষ্য করেছেন উত্তর কলকাতার গলি আর পাড়াগুলোতে, কী করেই বা কলকাতা শহর সেইসব গলিগুলোকে কানাগলি করে ফেলে সেসব সুদ্ধ। নবারুণ ভট্টাচার্যর কলকাতা অন্যদিকে, দক্ষিণে, যদিও সে দক্ষিণ গড়িয়াহাট, ভবানীপুর বা এলগিন রোডের চওড়া রাস্তার কলকাতা খুব একটা তো নয়, সেইসব রাস্তা থেকে ভেতরে ঢুকে পাড়া আর মহল্লার কলকাতা যেখানে ছড়িয়ে আছে, হয়ত চেতলা বা নাকতলা-বাঁশদ্রোণী, টালিগঞ্জের ভেতরের দিকটা অথবা আরো সরে গিয়ে বেহালার দিকেই হয়ত বা। নতুন শতাব্দী এসে গেলে নবারুণ দেখলেন বীরেনের মতো কেউ না কেউ সব পাড়াতেই থাকত, রোজই তাদের সাথে দেখা হত কিন্তু দেখাটা ফুরিয়ে গেলে তাদের সম্বন্ধে আর কিছু মনে থাকে না, ক্রমশঃ বীরেনের কথা লোকে ভুলে যায়। নোংরা শার্ট, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, একগাদা চুল, ফ্যাকাশে চোখ, তোবড়ানো গাল, সেফটিপিন দিয়ে আঁটকানো চটি, কর্পোরেশনের চাকরি একটা ছিল কিন্তু সেটাও ছেড়ে দিল এক সময়ে, তো সেই বীরেন যাকে তাকে যখন তখন ধরে ভাট বকত, ফলে লোকে পাত্তাও দিত না। মতি নন্দীর উত্তর কলকাতার নিম্নমধ্যবিত্ত চরিত্রগুলোর মতই বীরেন যেরকম ঠিক সেরকম ভাবেই ছিল, কোন রকম পরিবর্তনের চেষ্টা বা উপায় ছিল না, চিন্তাও করত না সেসব নিয়ে। জোরালো আলোযূক্ত পোকা ধরার কলগুলো যখন আলোর টানে পোকামাকড় বা প্রজাপতি টেনে টেনে নেয়, টেনে নিলে সেগুলো কখনও ফট করে আওয়াজ করে মরে যায়, এরকম দৃশ্য দেখলে বীরেনের কথা মনে পড়ত, এও মনে পড়ত যে বীরেন মরে গেছে সে কথাও লোকে ভুলে গেছে। আমার কোনও ভয় নেই তো গল্পটিতে নবারুণ ভট্টাচার্য বীরেনের ভয় পাওয়া আর মরে যাওয়ার কথা নথিবদ্ধ করেছিলেন। পার্টির সাথে খাতির আছে সেরকম প্রমোটার হরি দত্তের অফিসে বোম চার্জ আর গুলি চললে, এরপর একটা মার্ডার হয়ে যাবে পাড়ায় এরকম রটতে থাকলে, রাতের অন্ধকারে পাড়ার মধ্যে টাটা সুমো দাঁড়িয়ে থাকলে, গাড়ির ভেতরে মেশিন ছিল নিশ্চয় সেরকম কথা চলতে থাকলে বীরেন যাকে তাকে ধরে আমার কোন ভয় নেই তো, এই কথাই শুধু জিজ্ঞাসা করত। তো বীরেনের ভয় পাওয়ার কথা লোকে জানত বলেই পাড়ার ভেতরেই হরি দত্তের সাগরেদ সালমান ম্যাগাজীন খুলে নেওয়া চাইনীজ রিভলবার দেখিয়ে তাকে আরো চমকাতে চেয়েছিল। গুলি যখন নেই তখন ট্রীগার টানলে আর কী হবে এই ভেবে সালমান বীরেনকে তাক করে ট্রীগার টানলে যেহেতু সেই মডেলের রিভলবারে ম্যাগাজীন খুলে নিলেও একটা গুলি চেম্বারে থেকে যেত, ফলে সেই গুলি লেগে বীরেন আলো দিয়ে পোকা ধরার ইনসেক্ট ফ্ল্যাশারের পোকাগুলো আঁটকে গিয়ে মরে যাওয়ার মতো ফট করে মরে গিয়েছিল। মতি নন্দীর গল্পে মুকুন্দকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল শবাগারের শহর, সে ছিল যুগপৎ শিকার ও শিকারী কিন্তু আরো বদলে যাওয়া কলকাতা শহরে তার থেকেও সামান্য এক জীবন বীরেনের, শহর ও সভ্যতার দায়ভার মুকুন্দর মতো বীরেনও নিতে পারে না, শহরের কাছে মূল্যও নেই তার, অতএব সে কলকাতা শহরের একটা হাঁ-মুখ, চাপা ও স্বাভাবিক সন্ত্রাস, পার্টি - পলিটিক্স - মাফিয়া - অস্ত্র দিয়ে তৈরী যে হাঁ-মুখ, সেই হাঁ-মুখের টানে অথবা এইসব মিলিয়ে অনেকদিন ধরেই শহর জুড়ে যে জালটা তৈরী হয়ে যাচ্ছিল তার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। বুঝতে পারছিল সে, কিছু একটা এগিয়ে আসছে তার দিকে যার মধ্যে সে ধরা পড়ে যেতে পারে, কিন্তু না পড়ে গিয়ে উপায় ছিল না বীরেনের, আলোর সামনে পোকাগুলির মতই সেই জালে ধরা পড়ে যাওয়াও বীরেনের মতো মানুষের কাছে পূর্বনির্দিষ্ট, সেই জালটির স্বাভাবিক কাজই হল সময়ে সময়ে বীরেনের মতো মানুষদের তার ভেতরে গ্রাস করে নেওয়া।

    কলকাতার গ্রাম দখল / নিউ ক্যালকাটা

    কৃষ্ণকান্ত যেমন ভেবেছিল যে কলকাতা এক রাক্ষসের মত যে গ্রাম গ্রাস করে তিলোত্তমা হয়ে উঠছে, এও ভেবেছিল কলকাতা ক্রমাগতই নিজেকে ভাঙছে আর গড়ছে, দেখা যাবে নতুন শতকের একটু আগে থেকে কলকাতা শহরটা নজর দিয়েছে পূর্ব দিকে রাজারহাটে যেখানে নিজের অপরিকল্পিত, ঘিঞ্জি ও পুরোন রূপের বিপরীতে চাষে-মাছে মাখামাখি জল -জমির বিশাল ভূখণ্ডটির ওপর বিল্ডিংয়ে বিল্ডিংয়ে, চওড়া রাস্তায়, কমপ্লেক্স, টাওয়ার আর মলে কলকাতা তার জাল বিস্তৃত করে যেন এক স্বপ্ননগরী গড়ে তুলতে চাইছে । সেই নতুন স্বপ্নশহরটি - নিউটাউন না বলে অমিয়ভূষণ মজুমদারের একটি উপন্যাসের নাম নিয়ে নিউ ক্যালকাটা-ও বলতে পারি - সবাইকে নানাভাবে জড়িয়ে নিয়েছিল; সমাজ - অর্থনীতির মাথা, রাজনীতির পাণ্ডা, পুঁজির হোতা, কৃষক সমিতি ও মজুর ইউনিয়নের পালের গোদা, বীরেন যাদের বানানো জালের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল তারা, আমাদের মতো উচ্চাকাঙ্খী লোকেরা এবং এদেরই সাথে রাজারহাটের জমি, অজস্র ভেড়ি, পোকামাকড়, প্রাণী থেকে খাটিয়ে মানুষজন। সবাই যেন ফেঁসেছিল একটা স্বর্ণতন্তুজালে, যে জালের মধ্যে পাখি সর্দারের মতো একজন যাকে চাষী বউয়ের আর্কিটাইপের মধ্যে ধরিয়ে ফেলা যায় এবং আরো অনেকে তাদের স্মৃতি - সত্তা -ভবিষ্যত আর গোষ্ঠীচেতনা সহ নিজেদের হারিয়ে ফেলবে, সেই হারিয়ে যাওয়ার বেদনা আর শোকের গল্প লেখা থাকবে রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপারেশন রাজারহাট ডকু-উপন্যাসটিতে। নিউ ক্যালকাটা গড়তে গিয়ে কিছু মানুষ খুন হয়ে গেছিল, তাদের কথা খুব বেশী প্রকাশ হয়নি, কলকাতা শহরের হাঁ-মুখ নতুন সময়ের উপযোগী পুঁজি, মিডিয়া, রাজনীতির কারবারী আর দেওয়া-থোওয়া দিয়ে সেই সব মরণগুলিকে গিলে ফেলতে পেরেছিল; পাখি সর্দার তাদের মতই বাস্তবের চরিত্র হয়ত অথবা সেকরম না হয়ে এই লেখাটিতে হাজির করা চরিত্রদের মতই সেও ঔপন্যাসিকের মানসসৃষ্ট, কিন্তু কাল্পনিক চরিত্র হলেই তাকে যে বাস্তব চরিত্র বলে মেনে নেওয়া যাবে না সেরকম যেহেতু নয়, অতএব পাখি সর্দার কাল্পনিক হয়েও সাতিশয় বাস্তব চরিত্র, কলকাতা শহর যেরকম বাস্তব অথবা নিউ ক্যালকাটা তৈরী করার কূটবুদ্ধি যেরকম বাস্তব ছিল। ১৯৯০-এর দশকের কোন এক সময়েই পাখি সর্দার রাজারহাটে আসতে দেখেছিল রাজনীতিওয়ালা, পুলিশকর্তা, সরকারি অফিসার আর ফিতেবাজ সার্ভেয়রদের, বুঝতে পেরেছিল যে এরা সবই মিলে রাজারহাটে এমন একটা কিছু বানিয়ে তুলতে চাইছে, এমনভাবে সেখানকার সব কিছুই বদলে দেবে যে পাখির পক্ষে সেখানে থাকাটা অসম্ভব, তাকে লুকিয়ে পড়তে হবে। পাখির এবং তার মতো সেই অঞ্চলের আরো অনেকের কাছে কিছু জিনিস দৈনন্দিনের অংশ ছিল যেমন কাতু নামে একটি বেড়াল, দাঁড়াশ শিবে নামে বাস্তুসাপটি, মেছো বেজি চুন্নি, যেমন ভেড়ির আলে ভুলু নামের নেড়ি কুত্তা, ভগবতীর সন্তান বাছুর, জবাইয়ের জন্য হাট থেকে তাড়িয়ে আনা এঁড়ে সকল, যেমন ছিল হাজারো পোকামাকড়-মাছ- পাখি অথবা রোদে শুকোতে দেওয়া বা বুনে চলা জাল, তারই সথে শ্বশুরের নামে পরচা নেওয়া চাষের জমি ও বসতজমি। সেই জমি বেচে দিয়ে তারা যাতে সেখান থেকে উঠে যায় সেই জন্য প্রাক্তন কংগ্রেসী গুন্ডা থেকে লালঝাণ্ডাবাহী হয়ে ওঠা রবিদাস মন্ডল ওরফে র‌্যাবিজ পাখিকে কপালে দানা ছাড়া কিছুই জুটবে না এই বলে হুমকি দিয়ে দানা কী দেখানোর জন্য ফট করে কাতু বেড়ালটির কপালে লাল গর্ত করে দিলে পাখি সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। পরে অবশ্য শরীরের ভেতরের যাবতীয় ভয় কাটিয়ে উঠেছিল সে, তার মতো অরো অনেকেই জমি বাঁচানোর উপায় খোঁজার চেষ্টা শুরুর প্রথম দিকে সেই ভয় কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল, কিন্তু তারা বুঝতে পারছিল একটা নরম থাবা সন্তর্পণে তাদের দিকে এগোচ্ছে আর এক বৃষ্টির বিকেলে পরভিনের স্বামী ইকবাল তার মোনাজাতের মধ্যে, প্রার্থনার মধ্যে টের পেয়েছিল যে একটা শব্দ তার কান আর দিমাগ তাক করে খানাখন্দ মাঠ পেরিয়ে এল এবং সেই আসার পথে সেই শব্দের গতি ক্রমশঃ মরে যাওয়াতে একটা শুকনো পাতা ঝরে পড়ার শব্দে ইকবাল শুনতে পেয়েছিল 'মা' ধ্বনিটুকু শুধু ।এই ধ্বনি বা গোঙানীর উৎস খুঁজতে গিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় মাথার পেছনে লোহার রডের বাড়ি খেয়ে পড়ে থাকা পাখি সর্দারের দেহ। ১৯৯৭ সালে ঘটে যাওয়া এই হত্যার ফলে পাখি সর্দার পরিণত হয় রাজারহাটে নতুন কলকাতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত প্রথম শহীদ, একটি শহরের আর সভ্যতার চাহিদা পূরণের জন্য মানুষকে তার কামনা বাসনা সহ ক্রমাগতই যে তার গ্রাসের মধ্যে ঢুকে যেতে হয় তার প্রমাণ হিসেবে। উপন্যাসটি এও জানিয়েছিল যে হত্যার ষড়যন্ত্র, হিংসা ও রক্তপাত পাখিকে স্বতন্ত্র করেছিল, সে হয়ে উঠেছিল গোষ্ঠীস্মৃতির অংশ, শ্রদ্ধার সাথে, গর্বের সাথে ও গভীর দুঃখের মধ্যে তলিয়ে গিয়ে উচ্চারণ করার মতো একটা নাম হয়ে উঠেছিল, রাজারহাটে একুশ শতকে এক দেবীই হয়ে উঠেছিল যেন।পাখির এক শিল্পী পরিচয় ছিল, সে অবিশ্বাস্য আলপনা ও জাদুচিত্র আঁকতে পারত, আঙুলের ডগা থেকে পশুপাখি, গাছ, লতাপাতা, ছোটো মেয়ের দুটি পা, শঙ্খ, ফুল ফুটে ওঠা ছাড়াও পাখি একবার ভুলক্রমে বক্ররেখা ও হাতল সমেত একটি ছুরিও এঁকে ফেলেছিল; রাজারহাটের মাটিতে কল্পনার চাষ ছিল ব্যাপক যাকে সংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ইত্যাদি বলা হয়, তার দ্বারা সাত গ্রামের মানুষ মনে করেছিল পাখি যেন দূরের আক্রমণ দেখে ফেলেছিল ! তত্ত্বতালাশ করলে জানা যেত পাখির মতো গ্রামের কৃষক রমণীদের মধ্যে আরো অনেক ঐশ্বর্য, আরো অনেক রহস্য ছিল, সেসবের সুক্ষ্ম ও জটিল ভাঁজ হাঁসের সাদা পালকের মতোই পরবর্তী সময় জুড়ে ঝরে যাবে ক্রমশঃ, কলকাতা শহরের বাড়বৃদ্ধি আর সভ্যতার পেটে যাবে সেইসব গোষ্ঠীচেতনা, পরিবেশ, প্রকৃতি, মানুষ, তার দৈনন্দিন ও স্মৃতি।

    অন্তিমে, লেখা প্রসঙ্গে

    দীর্ঘদিন ধরে একটি লেখার কথা ভেবেছি যে লেখায় নিজের বলে বিশেষ কিছুই থাকবে না, লেখাটি হবে কলকাতা শহরকে নিয়ে কিন্তু সেটি তৈরী হবে বাংলা গল্প-উপন্যাসকে ব্যবহার করে, বিভিন্ন লেখা থেকে অংশ নিয়ে ও জুড়ে; এই লেখাটি ঐ পরিকল্পিত লেখাটি হয়ে ওঠার চেষ্টা, রিভিউ তো বলাই যাবে না, প্রবন্ধও কীনা সন্দেহ থাকতে পারে। যথেচ্ছভাবে অন্য লেখাকে ব্যবহার করা হয়েছে , সেইসব লেখা থেকে শব্দ,বাক্য, ভাব সম্পূর্ণ নিজের করে নিয়ে এই লেখাটি লেখা হয়েছে, ফলে স্বকীয়তার বিশেষ দাবী এই লেখাটির নেই। উপরন্তু মতি নন্দীকে নিয়ে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের একটি প্রবন্ধ ও রবিশংকর বলের একটি উপন্যাস এই লেখাটির বীজ হিসেবে কাজ করেছে।

    ব্যবহৃত গদ্যগুলিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সময়ের বিচারে সর্বপুরোন লেখাটি ১৯৩২-৩৩ সালে জীবনানন্দ দাসের ​​​​​​​লেখা নিরুপম যাত্রা গল্পটি আর সর্বনতুন লেখাটি রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপারেশন রাজারহাট উপন্যাসটি যেটি প্রকাশিত হচ্ছে ২০১৬ সালে। এই দুই সময়ের মাঝে বিন্দুর কথা মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুলনাচের ইতিকথা-য় বলা হচ্ছে ১৯৩৬ নাগাদ,বাসমতীর উপাখ্যান লেখা হয়ে ট্রাঙ্কবন্দী থাকছে ১৯৪৮ সালে, চর্যাপদের হরিণী গল্পটি দীপেন্দ্রনাথ লিখছেন ১৯৫৯ সালে (ঐ একই সময়ে দেবেশ রায় লিখবেন কলকাতা ও গোপাল গল্পটি, যে গল্পটিতে কলকাতা শহরে এক যুবকের আত্মহত্যার বিবরণ ছিল ), শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের হৃদয়পুর বই হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে কিন্তু আমার ধারণা লেখাটি ষাটের দশকের প্রথম দিকের, মতি নন্দীর দ্বাদশ ব্যক্তি প্রথম ছাপা হচ্ছে ১৯৬৭ সালে আর শবাগার গল্পটি ১৯৭০-এ , উদয়ন ঘোষের গল্পটি লেখা হয়েছে ১৯৮২-৮৩ সাল নাগাদ, নবারুণ ভট্টাচার্যর গল্পটি ২০০৪-এ প্রকাশিত হয়েছে আর শুভ্র ​​​​​​​বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠিকানিয়া উপন্যাসটি বই হয়ে প্রকাশ ২০১৩ সালে। অর্থাৎ এই লেখাটি বাংলা গল্প-উপন্যাসের একটা দীর্ঘ সময়কে সচেতন ভাবে ব্যবহার করে কলকাতা শহরের একটি বিশেষ ধরণ দেখার চেষ্টা করেছে এবং ​​​​​​​সেটা ​​​​​​​করতে ​​​​​​​গিয়ে ​​​​​​​ দেখা যাচ্ছে অনেক দশকের ​​​​​​​তফাতেও ​​​​​​​এক লেখার​​​​​​​​ ​​​​​​​সাথে ​​​​​​​অন্য লেখার ​​​​​​​কিছু ​​​​​​​মিল ​​​​​​​রয়ে ​​​​​​​যাচ্ছে, ​​​​​​​কলকাতা ​​​​​​​যেভাবে ​​​​​​​এইসব ​​​​​​​লেখায় ​​​​​​​এসেছে ​​​​​​​সেই দিক ​​​​​​​দিয়ে, যেমন ​​​​​​​ঠিকানিয়া উপন্যাসে তিন বন্ধু কলকাতাকে ​​​​​​​যেভাবে ​​​​​​​দেখে ​​​​​​​তার ​​​​​​​সাথে ​​​​​​​প্রভাত ​​​​​​​জীবনানন্দের ​​​​​​​গল্পে ​​​​​​​যেভাবে ​​​​​​​শহরটিকে ​​​​​​​দেখে ​​​​​​​তার ​​​​​​​মধ্যে ​​​​​​​মিল ​​​​​​​আছে ​​, সেই শহর-মফস্বলের ​​​​​​​দ্বন্দ, শহরের মধ্যে চরিত্রদের নুয়ে পড়া, শহরটিকে প্রশ্ন করা; উপস্থাপনায় আর ইমোশনের প্রকাশে যদিও তফাত রয়ে গেছে।

    একথাও বলার, এইসব গদ্যগুলিতে কলকাতাই আপাতভাবে একমাত্র বিষয় নয়, বিভিন্ন দিক দিয়েই লেখাগুলিকে পড়া যায় কিন্তু কলকাতা সম্বন্ধে একটি বিশেষ ধারণার ওপর ঝোঁক দেওয়ার জন্যই গদ্যগুলিকে বেছে নেওয়া হয়েছে ; সরাসরি বা ইঙ্গিতে কলকাতা শহরটি এই সব লেখার একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে। এরকম ভাবা যায় যে ইঁট - পাথরের শহরটিকে তার কংক্রীট রূপের মধ্যেই বোঝা নাও যেতে পারে, সেই বোঝার জন্য তার সম্বন্ধে ধারণা বা আইডিয়া তৈরী করতে হয় আর সেই আইডিয়া (শহরটি এমন কিছু যার মধ্যে অনেকে হারিয়ে যায়) তৈরী করার জন্যই গদ্যগুলিকে ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যদিকে, শহরটিকে আইডিয়ায় পরিণত করে এই শহরের অধিবাসীদের ওপর তার প্রভাব বোঝার জন্য বাস্তবের মানুষের পরিবর্তে কল্পনার চরিত্রদের উপস্থিত করা হয়েছে যারা রক্তমাংসে কোন দিনই এই শহরে উপস্থিত ছিল না, যদিও, কাল্পনিক চরিত্র বলে কিছু হয় না, সেইরকম চরিত্রকে যতক্ষণ না রক্তমাংসের বলে বুঝে নিতে পারছি ততক্ষণ সেই ব্যক্তিটিকে বোঝা যায় না। অক্ষরসাধকদের কাজই হল কাল্পনিক চরিত্রদের রক্তমাংসে পরিণত করা। ফলে এরকম বলা যেতে পারে, যতক্ষণ না কলকাতা শহরটি পরিণত হয় তার আইডিয়াতে আর আইডিয়ার চরিত্ররা বাস্তবিক হয়ে ওঠে ততক্ষণ শহরটিকে আর তার বসবাসকারীদের বুঝে ওঠা যায় না।

    উপরন্তু যেহেতু এইসব করার চেষ্টা করা হয়েছে এই লেখায় আর লেখা তৈরী হয় শব্দ দিয়ে, পরপর শব্দ বসিয়ে একটি জাল তৈরী করে, যাতে জালের মধ্যে ধরে রাখা যায় বিষয়কে, ফলে যতক্ষণ না সেই শব্দজালটি উপযুক্তভাবে তৈরী হচ্ছে ততক্ষণ কলকাতা শহরটির বৈশিষ্ট্য বা চরিত্রদের সম্বন্ধে স্বচ্ছভাবে জানা যায় না।

    যাঁরা লেখাটি পড়লেন এবং এই অবধি পৌছলেন, তাঁরাই বুঝতে পারবেন শব্দজালটি কতখানি উপযোগী হয়েছে। তাঁদের উদ্দেশ্যে নমস্কার।


    লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত ছবিটি লালু প্রাসাদ সাউয়ের আঁকা।

    পড়তে থাকুন, শারদ গুরুচণ্ডা৯ র অন্য লেখাগুলি >>
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ৩১ অক্টোবর ২০২০ | ৩৪৮০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ramit Chatterjee | ৩১ অক্টোবর ২০২০ ২১:৩১99466
  • অসাধারণ

  • Ranjan Roy | ০১ নভেম্বর ২০২০ ০০:১১99472
  • এই লেখাটি কয়েকবার পড়া উচিত।

  • সম্বিৎ | ০১ নভেম্বর ২০২০ ০১:২৯99475
  • এবং এক সিটিঙে নয়। আমার বার দুই সিটিং হয়ে গেছে। তবে মূলগুলো পড়া থাকলে অনেক বেশি মজা হত।

  • সিএস | 49.37.***.*** | ০১ নভেম্বর ২০২০ ১৬:৫৭99519
  • ধন্যবাদ, রমিত, রঞ্জনদা ও সম্বিৎবাবু। 

  • সায়ন্তন চৌধুরী | ০৩ নভেম্বর ২০২০ ০৪:৪৬99581
  • কলকাতার মুখ থেকে মনুমেন্টের থার্মোমিটার তুলে নিয়ে আমি দেখে নেব কত জ্বর। তার ডিলিরিয়ামের ভাষা একমাত্র আমিই বুঝতে পারি।


    এবং আমি ব্যারিকেড হয়ে যুগ যুগ বেঁচে থাকব।


    এটা মনে পড়ল; খুব ভালো লেগেছে পড়ে।

  • i | 220.245.***.*** | ০৮ নভেম্বর ২০২০ ০৪:৫১99744
  • খুবই ভাল লাগল।

    ভাবছিলাম, মূল লেখাগুলির উল্লেখমাত্র না করে, শুধু অংশ জুড়ে জুড়ে নিজেই আস্ত আখ্যান হয়ে যেতে পারত এ গদ্য-

  • সিএস | 2401:4900:104b:a767:d08b:4913:53fa:***:*** | ০৮ নভেম্বর ২০২০ ১২:৫৪99760
  • সায়ন্তনকে বলার ছিল যে একটা শহর ডিলিরিয়াম তৈরী করতে পারে, আবার শান্তিও এনে দিতে পারে। শহরের মধ্যেই  এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায় এই দুই বিপরীত দিক খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।

    i, লেখাটি অন্যভাবেও লেখার কথা ভেবেছিলাম, অনেকটা আপনি যেমন লিখলেন। মূল লেখাগুলোর নামোল্লেখ না করে, পর্বগুলোরও নাম না দিয়ে, শুধু চরিত্রগুলো এনে, লেখাগুলির অংশ এনে, চরিত্রগুলো নিজেদের মধ্যে কথা বলছে সেরকমভাবে। কিন্তু জটিল হয়ে যাচ্ছিল, সময়েও লেগে যাচ্ছিল, অতএব একটু সরল পথে গেছি। পরে কোনদিন অন্য লেখায় নিয়ে আসতে পারি। 

  • বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত | 2405:201:8008:c01e:a911:e4b:99b7:***:*** | ০৯ নভেম্বর ২০২০ ১৮:৫৭99811
  • অপূর্ব লেখা হয়েছে। ঠিক যে ভাবে লেখা হয়েছে সেটাই ভালো হয়েছে। কোন প্রশংসাই যথেষ্ট না। অনেক অভিনন্দন  ও ধন্যবাদ জানাই গুরু।  নিজেদের ভাষার শিল্পী দের , নিজেদের ভাষার ঐতিহ্য কে, যদি এইভাবে শ্রদ্ধা না জানাই, কি ভাবে আর জানাব। অসম্ভব ভালো লাগলো। 


    আমি ভেবে দেখছিলাম, যে লেখাগুলির কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে কোন কোন টা পড়ি নি। মতি নন্দী ও শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা গুলি পড়িনি। উদয়ন ঘোষের এটা পড়েছি কিনা মনে পড়ছে না। নিশ্চয়ী পড়িনি। আর আগে পড়িনি, কিনতু পরে পড়েছি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। এবং হালে দীপেন্দ্রনাথ। উদয়ন, দীপেন্দ্রনাথ, এদের সোমনাথ o তোমার কাছ থেকে শিখেই পড়েছি। একেবারে কৃতজ্ঞ রইলাম।


    কলকাতা আমার কাছে বিশেষ কোন জায়্গা না। কোনদিন ই না। কল্পনার একটা কলকাতা ছিল, মূলতঃ বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ , সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সমর সেন দের তৈরী করা। কিন্তু সেটা একটা অ্যানালিটিকাল বা পোলিটিকাল একটা কিছু।  কবিতা বা যৌবন কোনোটি র জন্যেই আমার কলকাতা কে লাগে নি :-) কলকাতায় এই হালে আমি টানা থাকছি। aar কোনদিন বৌদ্ধিক ঐতিহ্য র দিক থেকে কলকাতা কে কখনৈ একমাত্র মনে করিনি। ট্রেনিং ও অভিজ্ঞতা এরকম ই ছিল। এক শহর ভর্তি বাংলা এটা ভালো লাগে যদিও। এখন একটু একটু করে এই সব বই পত্তরের জন্যই হচ্ছে। যদি কলকাতাকে কোন দিন ভালোবাসি, তাতে নবারুণ , রাঘব, দীপেন , শক্তি বাবু দের সংগে তোমার আর শাক্যর আর অ্যাকচুয়ালি উর্বীর বইটার এবং সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় এর একটা ভূমিকা থাকবে।  


    এই লেখাটার জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা জানাই।


    বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত

  • সিএস | 2405:201:8009:7024:ed6a:a5fd:b4f7:***:*** | ১০ নভেম্বর ২০২০ ১৪:১৫99848
  • বোধি, লেখাটা ভালো লেগেছে শুনে খুশী হলাম !


    ঠিকই ধরেছ, লেখাটার একটা উদ্দেশ্য ছিল যাঁদের পড়েছি বা প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে বিভিন্ন কারণে, এই লেখায় তাঁদের কয়েকজনকে নিয়ে আসা। লেখাটির শিরোনামে আর শেষে অক্ষরসাধক শব্দটির মধ্যে সেই ইঙ্গিত আছে, যদিও এই শব্দটিও আমার নিজের নয়, পেয়েছি রাঘববাবুরই একটি লেখা থেকে ! 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন