এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • দেবেশ রায়ের লেখা যেভাবে পড়ি

    সৈকত চট্টোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৬ মে ২০২০ | ৫২০০ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • ১।
    ১৯৫৯ সালে পরিচয় পত্রিকায় দেবেশ রায় 'কলকাতা ও গোপাল' নামে একটি গল্প লিখেছিলেন । গল্পটির নামের মধ্যে একটা দ্বন্দ আছে, দ্বন্দটি কলকাতা ও গোপালের মধ্যে। গল্পটি কী নিয়ে প্রশ্ন তুললে একটি বাক্যে সেটি বলে দেওয়া যায়, যে কলকাতাবাসী একটি যুবক, যার নাম গোপাল তার দেড় বছরের অস্থায়ী চাকরিটি চলে গেছে এবং সেই ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার দু'দিনের মধ্যে সে আত্মহত্যা করে; এইটুকু বাস্তব তথ্য, গল্পের বাইরে, লেখার বাইরে যে তথ্য বা বাস্তব অনবরত তৈরী হচ্ছে, পঞ্চাশ বছর আগেও ঘটেছে, এখনও ঘটে চলেছে। কিন্তু এই লেখাটি - গোপালের অনবরত চিন্তাগুলি, পরিচিত বা অপরিচিতজনেদের সাথে তার দেখাসাক্ষাৎগুলি, রৌদ্রজ্জ্বল কলকাতা শহরে রাস্তায় তার ঘুরে বেড়ানো, পেচ্ছাপখানার সামনে মাথায় চলে আসা চিন্তাটি যে 'আমি আত্মহত্যা করব', ঘরে ফিরে এসে অন্ধকারে শুয়ে পড়া, ইঁদুর মারার বিষের সন্ধান বা একগাছা দড়ির সন্ধান যা নারকোলের না হয়ে পাটের হবে কারণ সেরকম না হলে দড়িটি ছিঁড়ে যেতে পারে, যেন ক্রমাগত ঘুম পাওয়া এবং শেষ পর্যন্ত বালীগঞ্জ রেল ব্রীজের ওপর থেকে নীচে পড়ে যাওয়ার আগের হ্রস্বতম মুহূর্তটিতে 'আমার মরে যাওয়ার কোন মানে নেই' ভাবনাটি সম্পূর্ন হওয়ার আগেই ট্রেনের ধাক্কায় চাকার তলায় চলে যাওয়া - এসবের অনুপূঙ্খ বাস্তবতা লিখিত শব্দের সাহায্যে ধরে রাখে। নিছক বাস্তবতা যা যেন মানুষের দৈনন্দিনে সয়ে যাওয়া, সেই বাস্তবতাকে শিল্পরূপের সাহায্যে পাঠকের সামনে এনে খবরের পেছনে মানুষের যে রক্তচঞ্চলতা, সেটি তুলে ধরাই যদি শিল্পের একটি উদ্দেশ্য বলে মনে করি,তাহলে এই গল্পটি সেটি ঘটিয়ে তোলে । গল্পটির মাধ্যমে গোপালের মনোজগতের বাস্তব্তা প্রকাশ করা হয় এবং মধ্যবিত্ত একটি যুবক চরিত্রর সাথে কলকাতা শহরের দ্বান্দিক সম্পর্কের যে বাস্তবতা সেই বাস্তবতা এখানে প্রকাশিত। গোপাল একাধিকবার ভেবেছিল যে কলকাতা একা ব্যক্তিকে চায়, সে যেন সংসার থেকে গোষ্ঠী থেকে ব্যক্তিকে আলাদা করে নিতে চায় কিন্তু গোপালের তো একটি সংসার আছে, বিবাহিত না হলেও সে একটি পরিবারের অংশ, সেরকম না হলে তো কোন সমস্যাই হত না, কিন্তু সেরকম না বলেই চাকরী চলে গেলে সেই জন্যই তার আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় নেই। আবারো, তথ্যটি এইটুকুই যে একজন ব্যক্তি আত্মহত্যা করে তার পরিজনদের কথা ভেবেই, সেই ভাবনাটা কেমন, কোন পরিস্থিতিতে পৌছে ব্যক্তিটি সেই সিদ্ধান্তে আসে, দু'শ বছরের পুরোন একটি ঔপনিবেশিক শহর যেখানে সেই কতদিন থেকে মানুষ আসছে, গোপালেরা এসেছে দশ বছর, সেই শহর তাকে লোভ দেখায় কিন্তু সে সেই শহরে বেঁচে থাকতে পারল না, সেই শহরের চাহিদা পূরণ না করলে যে বেঁচে থাকা যায়না, সেইটি এই গল্পের ভেতরের বাস্তবতা।

    এই গল্পটি যখন লেখা হয়েছে বা এর কাছের সময় জুড়ে দুপুর, পশ্চাৎভূমি, নিরস্ত্রীকরন কেন, পা, মৃত জংশন বা বিপজ্জনক ঘাট ইত্যাদি গল্পগুলি, যেগুলি লেখা হচ্ছে ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৫র দশ বছরের মধ্যে যখন কিনা দেবেশ রায় গল্প ছাড়া অন্য কিছু লেখার কথা ভাবতেই পারতেন না, তখন বাংলা গল্পের প্রকৃতি বদলে যাচ্ছিল। অনুভূতিময়, ইঙ্গিতময়, গাঢ় আবার রিয়েলিটির অনুসরণকারী গল্পগুলি মোটামুটি এই সময়কাল জুড়েই সন্দীপন - দেবেশ রায় – দীপেন্দ্রনাথ - মতি নন্দী - শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এরকম কতিপয় তরুণ লেখক লিখে ফেলছিলেন, কাছাকাছি কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ কমলকুমার ও অমিয়ভূষণ সহ। নিরীক্ষা আর গল্প বলা মিলিয়ে এইসব গল্পগুলি বাংলা গদ্যে একরকমের আধুনিকতা আনছিল যা বাংলা কবিতায় তিরিশের দশকেই এসে গেলেও বাংলা গল্প-উপন্যাসে তখনও অনুপস্থিত; একরকমের সমবেত সচেতনতা ছিল এইসব গল্পকারদের মধ্যে যা বাংলা গল্পের নামকরণ থেকে সংলাপ সবই বদলে দিয়েছিল। সমবেত ও সচেতনতা শব্দদুটি দেবেশ রায়েরই লেখা থেকে ধার করা, নিজের গল্প সংকলনের ভূমিকায় ঐ সময়ের গল্প সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে এই শব্দদুটি ব্যবহার করেছিলেন; এই দুটি ভাবই গড়ে উঠছিল বিভিন্ন পত্রিকাকেই ঘিরে, কৃত্তিবাস, পরিচয়, বিমল করের ছোটগল্প-্নতুন রীতি অথবা আরো পরের গল্পকবিতা-অধুনা ইত্যাদি কিন্তু শুধু তাই নয়, এইসব লেখকদের একে অপরকে খুঁজে নিতে হচ্ছিল যা ঘটছিল পত্রিকায় লেখা ছাপানো, তর্ক আর আড্ডার মধ্যে দিয়ে, অন্যরকম লেখা লিখতে চাইলে যে একে অপরের সাথে কথা বলা সাহায্য করে এসব হয়ত ঐ সময়ের তরুণ লেখকদের জীবনচর্যায় ধরা আছে,যেমন ধরা আছে দেবেশ - দীপেনের দীর্ঘকালের বন্ধুত্ব, পার্টি অফিসে দীপেন্দ্রনাথের 'ঘাম' গল্প লেখার পরে জবাবদিহি করতে যাওয়া, জীবনানন্দকে নিয়ে অনেক পরে একটি লেখায় উল্লেখ করা যে সেই যুবাবয়সে গল্প লেখার প্রথম দিকে কলেজ স্ট্রীটের রাস্তায় মতি নন্দীর সাথে হাঁটার সময়ে দুজনেরই বুঝে ওঠা যে দুজনেই বিষ্ণু দের কবিতা থেকে তাদের গল্পের উপকরণ যেন বা কিছু পান, নব্বইয়ের দশকে এসে গল্প সংকলনের দ্বিতীয় খণ্ডটি 'গল্প লেখার প্রাচীনতম, এখনও সক্রিয়, সহকর্মী সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে উৎসর্গ করা, সন্দীপনের মৃত্যুর পরে ছোট দশ পাতার সেই ক্রন্দনময় শোকগাথাটি লেখা যেখানে লেখকের কাজকে হাওয়ায় হাতুড়ি চালিয়ে যাওয়ার সাথে তুলনা করা, এসবের মধ্যে।

    ২।
    নব্বইয়ের দশকে 'অপর' পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে কোন লেখকের পক্ষে আদৌ পুরোপুরি বাস্তবতাকে জানা সম্ভব কিনা, এরকম একটি প্রশ্নের উত্তরে দেবেশ রায়ের বক্তব্য ছিল যে উপন্যাস হল সেই উপায়, ঔপন্যাসিকের একটি টুল যার মাধ্যমে রিয়েলিটির মধ্যে প্রবেশ করা যায় । বোধ করি এই রিয়েলিটিটি চরিত্রের অন্তর্মনের রিয়েলিটি হতে পারে এবং সেই সূত্র ধরেই তার পরিপার্শ্বের রিয়েলিটি হতে পারে। 'কলকাতা ও গোপাল' গল্পটিকে ঐ মতের সমর্থনে ব্যবহার করা যায়, একই সাথে যা দুই রিয়েলিটিকে বের করে আনছে । প্রশ্নটির মধ্যে এই তর্কটি হয়ত নিহিত ছিল যে বাস্তব যা বাইরে ঘটছে, চরিত্ররাও সেই বাস্তবে আসীন, ঔপন্যাসিকের কাজ যেন সেই বাস্তবতাকে লেখায় বিবরণ দেওয়া এবং সেটা পুরোপুরি আদৌ করা যায় কিনা; এসব হয়ত জ্ঞানচর্চা, পার্সেপশন, অবজেক্টিভিটি ইত্যাদির সাথে যুক্ত। দেবেশ রায়ের উত্তরটি যেন এইসব বিষয়ের সাথে তর্কে যায় না আবার অন্যদিকে বাস্তব আছে এবং তাকে ঔপন্যাসিক সহজেই লেখায় তুলে আনতে পারেন সেরকম অনায়াস কোন অবস্থান নেয় না, দুয়ের মাঝে এই অবস্থানটিতে থাকে যে ঔপন্যাসিকের কাজই উপন্যাসের মাধ্যমে বাস্তবকে খুঁজে বার করা কিন্তু এই বাস্তব নিছক তথ্যের বাস্তব নয়, সেই তথ্যের পেছনে মানুষের, স্থানের আর সময়ের যে বাস্তবতা যা সহজে চোখে পড়ে না সেই বাস্তব। এই উত্তরটির মধ্যে থাকা দেবেশ রায়ের উপন্যাস চেতনাটি, ধারণা করি ক্লাসিক উপন্যাসরীতি - যেভাবে ডস্টয়েভস্কি অথবা তাঁরও আগে স্তাঁদাল ক্লাসিক ঔপন্যাসিক - তার সখ্য। এর একটা উদাহরণ হল ১৯৬৩ থেকে ৬৫ সালের মধ্যে প্রথম খসড়াটি লেখা হয়ে যাচ্ছে যে উপন্যাসটির, 'মানুষ খুন করে কেন' সেইটি। অতিরিক্ত বনময় ও কুটিল একটি পাহাড়ী পথের মধ্যে দিয়ে দার্জিলিঙের দিকে যাচ্ছে একটি বাস, যে দার্জিলিঙে জ্বলে ওঠা আলো যেন তাকে রাজনর্তকীর রূপ দিয়েছে, এরকম একটি বর্ণনা দিয়ে উপন্যাসটি শুরু হয়েছিল। আকারে বড় উপন্যাস, যার মধ্যে দিয়ে অশ্বিনীর পরিবার, চা-বাগানে তার চাকরি, দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়া, বাগানের অফিসারদের কূট পদ্ধতির মধ্যে পড়ে যাওয়া, সাসপেন্ড হওয়া অশ্বিনী উপন্যাসের শেষে এসে তার স্ত্রী গোলাপকে সঙ্গমরত অবস্থায় গলা টিপে হত্যা করে। স্তাঁদালের জুলিয়েন সোরেলকে মনে পড়ে, রেড অ্যাণ্ড ব্ল্যাক উপন্যাসটি, যেখানে উনিশ শতকের ফরাসী সমাজ ও সেই সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে জুলিয়েন সোরেলের অস্তিত্ব, যার শেষ হয়েছিল গিলোটিনে। খুঁজে দেখলে হয়ত জানা যাবে স্তাঁদাল এই উপন্যাসটি লিখেছিলেন সেই সময়ে ঘটে যাওয়া কোন খুনের ঘটনাকেই উপন্যাসের বীজ হিসেবে ব্যবহার করে, যেমন ২০০৬-এরও পরে প্রকাশিত দেবেশ রায়ের একটি লেখা থেকে জানতে পারি যে 'মানুষ খুন করে কেন' লেখা হয়েছিল জলপাইগুড়িতে থাকাকালীন এবং সেই শহরে ঘটে যাওয়া একটি খুনের ঘটনাকেই কেন্দ্র করে । কিন্তু উপন্যাসটি দার্জিলিঙের চাবাগানের খণ্ডচিত্র লেখায় তুলে আনার চেষ্টা করেনি, ধরে নেয়নি যে একটি বাস্তবতা আছে এবং সেই বাস্তবকে লেখায় দেখানোই উপন্যাসের কাজ, উপন্যাসের শুরুতে যেভাবে বাসটি বনময় পর্বতপথ পেরিয়ে দার্জিলিঙের দিকে এগোয় সেভাবেই যেন ঔপন্যাসিক অশ্বিনীকে নিয়ে সে যে পরিবেশে ঢুকবে, অন্য্ লোকের সাথে কর্মসূত্রে সম্পর্কে আসবে সেই বাস্তবতাসন্ধানী হয় । সেই পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে কীভাবে একটি চরিত্র যেন তার সঠিক ভূমিকা খুঁজে না পেয়ে নিজের স্ত্রীকেই খুন করে ফেলে, অন্তর্মন আর বাইরেটা কিভাবে ক্রিয়া করে সেই ঘটনাই উপন্যাসে প্রকাশ করাই যেন দেবেশ রায়ের উদ্দেশ্য । এই উপন্যাসটি লেখার মধ্যে দিয়ে এবং সেই সময়ের আরো কয়েকটি উপন্যাস যেমন যযাতি বা 'বেঁচে বততে থাকা' এসবের মধ্যে দিয়ে উপন্যাস ঠিক কীভাবে লেখা হয় সেই ধারণা করে নিতে চাইছিলেন, যদিও পরে দেখা যাবে এইসব উপন্যাসে প্রতিষ্ঠিত উপন্যাসের ধারণাকে দেবেশ রায় সচেতনভাবে এড়িয়ে যাবেন।

    ১৯৭৩ সালে 'আপাতত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে' উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল। 'মানুষ খুন করে কেন' যদি হয় সেই অনুসন্ধানটির বিবরণ যার দ্বারা জানা যায় একটি চরিত্র কীভাবে অস্বাভাবিক আচরণ করে ফেলে, তাহলে এই উপন্যাসটি সত্তর দশকের যে মৃত্যুমুখর অস্বাভাবিক সময় তার বিবরণ ধরে রেখেছিল। করুণা নামে একটি চরিত্রের বাড়ী না ফেরা থেকে শুরু হয়ে কাহিনিটি অনুসন্ধান করে তার মৃতদেহের , সেই অনুসন্ধান খুঁজে বার করে একটি গণকবরক্ষেত্র যেখানে পাওয়া যায় আরো এগারোটি মৃতদেহ, সেই মৃতদেহগুলি কাদের সেই অনুসন্ধানের সূত্রে উঠে আসে রাজনীতি, মুক্তাঞ্চল, খতম আর পাল্টা খতম, ইউনিয়ন, ম্যানেজমেন্ট, হাসপাতাল আর প্রশাসন, রাতের অন্ধকারে ডেডবডি খুঁজে বড়ানোর সময়ে কথাগুলো হয়ে ওঠে যেন কোরাস, মিশে যায় গানের কলি আর হিন্দী সিনেমার গান, ফুলে ওঠা একটি মৃতদেহকে করুণা বলে চিনে নেওয়ার জন্য তার স্ত্রী আর মায়ের চেষ্টা, চিনে উঠতে না পারা কিন্তু সেই মৃতদেহকে করুণা জ্ঞানেই তার পরিচিতদের দ্বারা সৎকার, একটা ত্রাসিত সময়ে যা ঘটে চলেছে তার বিবরণ, মানুষগুলো কী কথা বলে, ভয় পায় কীভাবে, হারিয়ে যাওয়া লোক আর মৃতদেহ নিয়ে কীভাবে বিভিন্ন মত আর তর্ক তৈরী হয়, কীভাবেই বা সেই ত্রাসময় সময়ে অনেক মা আর বৌরা তাদের স্বামীপুত্রদের বাড়ী না ফেরা ভুলে যেতে পারে, ভুলে গিয়েই বেঁচে থাকার যে বাস্তব তার তদন্তমূলক উপন্যাসায়ন ছিল এই ছোট লেখাটি।

    ৩।
    উপন্যাসের ইতিহাস বা সাহিত্যের ইতিহাস মূলতঃ বাস্তব্তা অনুসন্ধানের ইতিহাস; যত সাহিত্য আন্দোলন বা লেখার রকমফের, রিয়ালিজম, ন্যাচারালিজম, সুররিয়ালিজম হয়ে ম্যাজিক রিয়ালিজম সবই শেষ পর্যন্ত যাপিত জীবন আর সমসাময়িকতাকে কীভাবে লেখার মাধ্যমে বইয়ের পাতায় বাস্তব করে তোলা যায় তার ইতিহাস। মনে করি দেবেশ রায়ের সব লেখাই বাস্তবতার ইতিবৃত্ত লেখার চেষ্টা, উপন্যাসের ফর্ম নিয়ে চিন্তাভাবনা সেই জায়গা থেকেই। আশির দশকের শেষের দিকে 'বিজ্ঞাপন পর্ব' পত্রিকাতে দেবেশ রায়ের একটি বড় সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল; সাক্ষাৎকার না বলে কথাবার্তা বলাই ভাল, দেবেশ রায়ের সাথে ছিলেন শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় । বেশ বড় এই সাক্ষাৎকারটি যার মধ্যে ধরা আছে দেবেশ রায়ের উপন্যাস ভাবনা, সেখানে দেবেশ রায়ের একটি কথা ছিল যে লেখক জীবনের প্রথম দশ বছরের গল্পগুলির কোন মূল্যই থাকত না যদি তিনি পরবর্তীকালের উপন্যাসগুলি না লিখতেন, যদি না তিস্তার সাথে জড়িয়ে যেতেন; এরকমও যেন মত ছিল যে ঐসকল লেখাগুলিতে বাস্তব অভিজ্ঞতার যেন অভাব ছিল, সেই অভাব ভরিয়ে তোলার জন্যই লেখার সঙ্কেত আর কৃৎকৌশলের সাহায্য নিতে হয়েছিল। মোটামুটি এই সেই সময় যখন দেবেশ রায়ের লেখায় দুটি জিনিস ঘটছে বলে মনে করি। প্রথমতঃ উপন্যাসের ফর্ম নিয়ে, পশ্চিমী নভেলের সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন আর দেশীয় ফর্মের মধ্যে এমন কিছু আছে কিনা যাকে উপন্যাসে ব্যবহার করা যায় সেই নিয়ে ভাবছেন যেগুলো ধরা থাকছে বিবিধ প্রবন্ধে আর ছোট লেখায় যা অনেকদিন ধরে চলতে থাকবে আর সেই সূত্রেই পশ্চিমী নভেলের চরিত্র আর পরিবেশ আশ্রিত জানা গড়ন থেকে বেরিয়ে এসে নিজের উপন্যাসকে বৃত্তান্ত বা প্রতিবেদন হিসেবে নাম দিচ্ছেন। এই প্রতিবেদন আর বৃত্তান্তর মধ্যে দিয়ে সমসাময়িক বাস্তবতাকে ক্রমাগত উপন্যাসের বিষয় করে তোলেন, বিষয়গুলো সব সময়ে ছোট আকারে সীমাবদ্ধ থাকে না, অনেক রকমের রিয়েলিটি উপন্যাসের মধ্যে ঢুকে আসে, কোন প্রধাণ চরিত্র থাকেনা, অনেক চরিত্রর বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়ার কথা বলা হয় উপন্যাসগুলিতে

    'মফস্বলী বৃত্তান্ত' লেখা হচ্ছে সত্তর দশকের প্রথ্মার্ধে, বই আকারে প্রকাশ হচ্ছে ১৯৮০ তে, 'তিস্তাপারের বৃত্তান্ত' লেখা হচ্ছে আশির দশকের প্রথম কয়েক বছর জুড়ে, বই আকারে প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৮৮ তে, 'সময় অসময়ের বৃত্তান্ত' লেখা হচ্ছে ১৯৮৩-র পরবর্তীতে, বই হচ্ছে ১৯৯৩ তে,'একটি ইচ্ছামৃত্যুর প্রতিবেদন' বা 'শিল্পায়নের প্রতিবেদন' লেখা হচ্ছে নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে যখন এদেশে শুরু হয়েছে নয়া অর্থনীতি, 'দাঙ্গার প্রতিবেদন' লেখা হচ্ছে ১৯৯২-র পরে। মফস্বলী বৃত্তান্ত শেষ হচ্ছে রাজনৈতিক মিছিলে ল্যাজ উঠিয়ে চ্যারকেটুর গরুটির লাফ দেওয়ার মধ্যে আর রাতের বেলা ধানের মধ্যে যখন দুধ জমা হচ্ছে তখন চ্যারকেটুর আরো দীর্ঘতর ক্ষুধার দিকে চলে যাওয়ার মধ্যে; 'তিস্তাপারের বৃত্তান্ত'-র শেষাংশটি ছিল 'মাদারির মায়ের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র' যেখানে ক্রমশঃ বাঘারু আর মাদারি এই রাষ্ট্র আর তার ডেভলেপমেন্ট ছেড়ে জঙ্গল থেকে আরো গভীরতর জঙ্গলের দিকে চলে যায়; 'সময় অসময়ের বৃত্তান্ত'-তে ধরা থাকছে ১৯৮৮ সালের বিহারে গনধর্ষণের ঘটনা,আশির দশকে নকশালপন্থী বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর বিপ্লবের স্বপ্ন, নিজের দেশকে খুঁজে পাওয়ার স্বপ্ন আর জেলে খাটা , কলকাতায় বিষ তেল খেয়ে মানুষের মৃত্যু, স্টোনম্যানের উপদ্রব। এই উপন্যাসগুলিতে কাল্পনিক যেন কিছুই নেই, ঔপন্যাসিকের বানানো যেন কিছুই নেই। সত্তর দশকের বামপন্থী-জোতদার-্কংগ্রেসের সংঘাত পস্চিমবঙ্গে তো সত্যি হয়েই থাকছে; সত্তর দশকের শেষ থেকে রুদ্র তিস্তার ওপর তিস্তাব্যারেজ তো পাথুরে প্রমাণ হিসেবে সত্যি হয়ে উঠছে তিস্তার বান আর জঙ্গলকে নিয়ন্ত্রন ও হ্রাস করে; গণধর্ষনের ঘটনা, নকশাল নেতার জেল খাটা বা বিষতেল খেয়ে মানুষের মৃত্যু বা ফুটপাথে পাথরের আঘাতে সেসব তো পুলিশের খাতায়, আদালতের প্রমান আর কোর্ট কেসের কাগজে সত্যি আর স্থির হয়েই আছে, খুব সহজেই এসব খুঁজে পাওয়া যাবে । ফলে দেবেশ রায় বাস্তবতার সন্ধানে যেন আর কাল্পনিক গল্প বানাচ্ছেন না, গল্প বানানোর দরকার হচ্ছে না, গল্প বানিয়ে রিয়েলিটির মধ্যে প্রবেশের দরকার হচ্ছে না। বহির্বাস্তব যা হয়ে আছে সেসবের মধ্যে বড়জোর সংযোগগুলো দেখিয়ে দিচ্ছেন, যেমন জাতীয় -আন্তর্জাতীয় ডেভলেপমেন্টের স্থির সংজ্ঞা কীরকম, কীভাবেই বা সেই সজ্ঞা কনস্ট্রাকশনে পৌছয়, কনস্ট্রাকশনের কাহিনি কীভাবে ধর্ষণের কাহিনির দিকে এগোয়, ডেভলেপমেন্টের কাহিনি কীভাবে মানুষকে তার সীমানা থেকে বের করে দেয়, মানুষের সৎবিচার আর সুবিচার কীভাবে হয়, সত্যি সেই বিচারব্যবস্থা নিরপেক্ষ কিনা, কলকাতার ফুটপাথে কীভাবে মানুষ মরে আর বাঁচে, কেলু আর বিশ্বনাথ কীভাবে নিঃসঙ্গ একক হয়ে যায়, কীভাবেই বা তারা নিজের দেশ খুঁজে বেড়ায়, কীভাবেই বা উপন্যাসের পাতায় তাদের একে অপরের দেখা হয়ে যেতে পারে, কীভাবেই বা বাঘারুর মত মানুষের নেংটি ছাড়া আর কিছুই থাকে না, জঙ্গলে থেকে জোতদারের কাজ করতে করতে কীভাবেই বা সে প্রাণীবৎ হয়ে উঠে জঙ্গলেরই অংশ হয়ে যায়, কীভাবেই বা প্রশাসন আর রাষ্ট্রব্যবস্থা কাজ করে তার অনুপূঙ্খতা, এইসব ঘটনা যা ঘটে চলেছে অনবরত আমাদের চারিদিকে, ঔপন্যাসিক হিসেবে সেসবের মধ্যে দিয়ে পাঠককে নিয়ে যাওয়া, আপাত অসংলগ্ন কাহিনিগুলির মধ্যে সংযোগগুলো দেখিয়ে দেওয়াই যেন ঔপন্যাসিকের কাজ হয়ে থাকছে এই পর্বের লেখাগুলিতে । এইসব ঘটনাগুলিকেই উপন্যাসের আকর করে তুলছেন, নথিপত্রের স্থির স্বাতন্ত্রর মধ্যে নেমে গিয়ে উপন্যাস নিষ্কাশন করছেন, এমনই সেই আকর যেন কেউই এইসব উপন্যাসের যাথার্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না কারণ সবই খবরের কাগজের পাতায় আর প্রশাসনের কাগজে রয়ে যাচ্ছে আবার অন্যদিকে কাল্পনিক কাহিনি হিসেবে পড়ে পাঠক কিছু পরেই সেই উপন্যাস ভুলে যেতেও পারবে না।

    এই সময় জুড়ে লেখাগুলিতে দেবেশ রায় সচেতন ভাবে প্রচলিত উপন্যাসের মডেলকে প্রত্যাখান করছেন। মৌসুমী বায়ুর বয়ে যাওয়ার বিবরণ কেন উপন্যাস নয়, ভূগোল আর ভূপ্রকৃতি কেন উপন্যাসের বিষয় নয়, বাংলা উপন্যাস শুধুই চরিত্র আর ঘটনার মধ্যে রয়ে যাবে কেন, কেনই বা বৃষ্টির বিবরণ উপন্যাসের অংশ হয়ে উঠবে না, আর এসব মিলিয়ে যা হয়ে উঠবে সেই উপন্যাস উপন্যাসের প্রচলিত সংজ্ঞা ('মানুষ খুন করে কেন' যে সংজ্ঞাকে প্রায় অনুসরণ করে কিন্তু 'আপাতত শান্তিকল্যান হয়ে আছে' উপন্যাসের তদন্তমূলক আখ্যানে যার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত ছিল) থেকে নিজের মুক্তি ঘটাতে পারবে, বোধ করি এই উপন্যাসভাবনা প্রতিষ্ঠার জন্যই দীর্ঘদিন ধরে তাঁর এক একটি উপন্যাস লিখে যাওয়া। কিন্তু এই এতকিছুকে উপন্যাসের মধ্যে নিয়ে আসার মধ্যে তো দেবেশ রায়ের রাজনীতি আর দেশ খুঁজে বেড়ানোটাও রয়ে যাচ্ছে যেমন 'একটি ইচ্ছামৃত্যুর প্রতিবেদন' অথবা 'শিল্পায়নের প্রতিবেদন' নামে দুটি ছোট আখ্যানেও। প্রথম লেখাটির অর্ধাংশ জুড়ে ছিল পশ্চিমবঙ্গের ভূপ্রকৃতির বিবরণ, পুরুলিয়া অঞ্চলে অনাবৃষ্টি, সেখানকার মাটি কেন জল ধরে রাখতে পারে না তার বিশ্লেষণ অতএব জলের আকাল আর অন্য অংশতে ছিল কলকাতা শহরে এক বৃদ্ধা জৈন মহিলার জল না খেয়ে প্রায়োপবেশনের পথে নিজের মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া; উপন্যাসের এই দুই রূপের মধ্যে যোগ হিসেবে ছিল জলের অকুলান ব্যবহার যা তৈরী করে ঠান্ডা পানীয় তৈরীর শিল্প তাকে প্রশ্ন করা। 'শিল্পায়নের প্রতিবেদন' যা লেখাও হচ্ছে নব্বই দশকে যে উপন্যাসের শুরুতে একটা বছরের মধ্যে একটি ইঁদুর ঢুকে গেছে, বাঁশগাছে ফুল দেখা দিচ্ছে অতএব যেন খারাপ সময় আসন্ন, আর অগাস্টাস টোপনো মুন্ডা যেখানে কাজ করে সেই চা-বাগান বন্ধ হয়ে গেছে। সমসাময়িকতা থেকে লেখাগুলো সরে যায়না, সেই সময়ের মধ্যেই চরিত্রদের স্থাপন করে আর উপন্যাসের বিবিধ তৈরী করা রূপ ব্যবহার করে সেই সময়ের সাথে কথা বলা আর তর্ক করে চলেন।

    ৪।
    'বরিশালের যোগেন মণ্ডল' আমি পড়িনি, এখনও পড়া হয়ে ওঠেনি 'কর্ণেল মজিদ আলির বেজোড় আখ্যান' নামে ক'মাস আগে প্রকাশিত উপন্যাসটি। 'সাংবিধানিক এজলাস' নামে শেষ ছোট লেখাটি পড়েছিলাম যাতে ধরা আছে বর্তমান ভারতের বড় গ্রাম, মান্ডি, রাস্তা আর চাষীদের যাতায়াত, কলকাতার বাসে পকেটমারি, বড় কোর্টে মামলার শুনানী, তার সাথে যুক্ত সংবিধান আর রাষ্ট্রব্যব্স্থার চিত্র। মোটামুটি এ সব লেখাই হয়ত দেবেশ রায়ের গত তিরিশ বছরের লেখালেখির সাথেই সম্পর্কিত যেখানে লেখার মধ্যে দিয়েই বর্তমানের সাথে কথা বলছেন, যদিওবা কোন লেখা ইতিহাস আর ইতিহাসের চরিত্রদের আশ্রয় করে অনতিঅতীতে চলে যাচ্ছে। সেই প্রথম যুগের লেখা থেকেই শেষ দিকের লেখা অবধি লেখাকে চীরকালীন করে তোলার জন্য কোন দায় দেবেশ রায়ের ছিল না, কোন লেখকেরই থাকে না বিশেষ বলেই মনে করি, সমসাময়িকতাকেই লেখায় ধরে রাখাই উপন্যাসের উদ্দেশ্য কিন্তু দেবেশ রায়ের লেখা ঢের বেশী করে বহির্বাস্তব আর সমাজের সাথে যুক্ত, প্রথম দিকে লেখা কিছু গল্প বাদ দিয়ে মগ্নচৈতন্য বা অস্তিত্বের দিক উন্মোচন করছে এরকম চরিত্র লেখায় বিশেষ পাওয়া যায় না, বিশেষ কোন দার্শনিক অবস্থানও লেখার মধ্যে অনুপস্থিত, সরাসরিভাবে বামপন্থী লেখাও এসব নয়, রাজনীতি ছিল কিন্তু গল্প-উপন্যাস লেখার সময়ে রাজনীতির বাইরের মানুষ হিসেবে লেখার চেষ্টা করেছেন, উপন্যাসকে সমাজ - ইতিহাসের শিল্পরূপ বলেই বোধ করি মনে করেছিলেন - দীর্ঘদিন ধরে জীবনানন্দের গদ্য সম্পাদনা সেই বোধ থেকেই হয়ত - আর সেই বোধই বাধ্য করেছে নিজের লেখাকে বাংলা উপন্যাসের ধারা থেকে আলাদা করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে। লেখার কতখানি কী থাকবে, কুড়ি বছরের পরে কোন লেখা পড়া হবে সেসব ব্যাপারে চিন্তিত থাকার কোন প্রমাণ নেই,উপরন্তু এইরকম স্পষ্ট বক্তব্য ছিল যে একজন লেখকের সেই সাহস থাকা উচিত যা দিয়ে সে পাঠককে প্রত্যাখান করতে পারে, একজন পাঠকেরও সেই ক্ষমতা থাকা উচিত যা দিয়ে সে নিজের লেখককেই বেছে নিতে পারে। দেবেশ রায়ের লেখা পড়ার সময়ে এই মন্তব্যটি মাথায় রাখা ভাল।

    ছবি: ব্যক্তিগত সূত্র থেকে সংগৃহীত
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৬ মে ২০২০ | ৫২০০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • o | ১৭ মে ২০২০ ১০:৪৯93418
  • লেখাটার জন্য অনেক ধন্যবাদ। :-) দেশীয় উপন্যাসের ফর্ম ব্যাপারটা যদি তিস্তাপারে দেখি, কালীপ্রসন্নর মহাভারতের ছাপ আছে তো তাই না? পর্বভাগ, পরিচ্ছেদগুলির শিরোনাম ইত্যাদি। বাংলা উপন্যাস যদি বঙ্কিমি ধারায় না বইত, তাহলে কোনদিকে যেত সেইটে মনে হয় পরীক্ষা করতে চাইছিলেন।

  • সিএস | 2405:201:8803:bff6:125:aa54:917f:***:*** | ১৭ মে ২০২০ ১৭:৩৫93421
  • o-এর মন্তব্য নিয়ে দুটো কথা -

    সতীনাথের ঢোঁড়াইয়ের গল্পেও শিরোনাম ব্যবহার আছে যেটা কিন্তু শুধুই ফর্মের প্রয়োজনে আসেনি। সতীনাথের ভিশন ছিল যে তিনি একজন নিরক্ষর সাধারন চরিত্রকে, তার দৈনন্দিন আর জীবনকে পুরাণপ্রতিম করে তুলবেন। রাজা-মহারাজারা পুরাণের চরিত্র হয়ে ওঠে তাদের বীরত্ব আর মহত্বর জন্য, রামকথাও সে জন্য কিন্তু সতীনাথের উদ্দেশ্য হল ঢোঁড়াইয়ের জীবনটাকে ব্যবহার করে একটি আধুনিক পুরাণ লেখা। যেমন পুরাণ লিখতে গেলে পুরাণের চরিত্রের জীবনকে ভেঙে ভেঙে পর্বভাগ করে করে লিখতে হয়, যাতে যারা পড়ছে বা শুনছে তারা যেন সহজে চরিত্রটিকে মনে রাখতে পারে, তেমনই ঢোঁড়াইয়ের জীবনটাও ঐভাবে ভাগ ভাগ করে লেখা হয়েছে, শিরোনাম দেওয়া হয়েছে।

    দেবেশ রায়ের লক্ষ্য আরো বড় ও জটিল। সতীনাথের লেখা অনেকটাই কিন্তু নায়ক কেন্দ্রিক কিন্তু তিস্তাপারই যদি দেখি, তাহলে দেখব এই লেখাটা কোন নায়ককেন্দ্রিক গল্প তো নয়ই, বরং কোন কেন্দ্রীয় গল্প বা চরিত্রও নেই; বাঘারুও প্রধান চরিত্র নয়, সে কখনো ফ্রেমের বাইরে থকে, কখন ফ্রেমের ভেতরে, কখনো নিজের শরীরটা দিয়ে অন্যের অস্বস্তি তৈরী করে কিন্তু তার কোন বিশেষ কথা নেই, সে উপন্যাসের অংশ, মূল চরিত্র নয়। গয়ানাথের জোত-জমি, সার্ভেয়র, বাঘারুর দৈননদিন, কামতাপুরী রাজনৈতিক সভা, তিস্তা, তিস্তা ব্যারেজই শুধু নয়, আপলচাঁদ ফরেস্ট, নদী-জঙ্গল-্ঝোরা সবই এই উপন্যাসের সমান প্রধান বিষয়। মূল গল্প, প্রধান চরিত্র, শাখা গল্প ও চরিত্র সমেত উপন্যাসের যে ধাঁচ সেটা এখানে নেই আবার দৈনন্দিনের সুখ - দুঃখ, হাসি - কান্না, হীরা - পান্না সমেত বেশ কিছু নদী কেন্দ্রিক উপন্যাসের মত সরল গঠনও এর নয়। পর্বভাগ, শিরোনাম তো আছেই, যেমন হাতের ম্যাপটা উড়ে গিয়ে গাছে লটকে গেলে সেই পরিচ্ছেদের নাম হয় 'গাছের ডগায় মৌজা ম্যাপ', নদীতে গরু পার করা, পার করে অন্য পারে ওঠা, সেসব ঘটনারও আলাদা পরিচ্ছেদ, আলাদা শিরোনাম, বাঘারু শিকারের জন্য একটা পাথর পেয়ে গেলে সেইপরিচ্ছেদের নাম হয় 'বাঘারুর অস্ত্রলাভ'। এখন এইসব পরিচ্ছেদ কখনই ম্যাজিক নয়, কমিক বা সিম্বলিকও নয়। সেই প্রথম যুগের লেখার সময় থেকেই ডিটেলের পর ডিটেল চাপিয়ে, বাক্যর মধ্যে বাক্য ঢুকিয়ে সেই ডিটেলকে ধারণ করে রিয়েলিটিকে দেখানোই দেবেশ রায়ের লেখার একটি প্রধান ধাঁচ যা এই উপন্যাসের পুরোটা জুড়ে; বাঘারু কীভাবে হাঁটে, কীভাবে পাখিটার দিকে তাকিয়ে পাথরের ওপর বসে থাকে সেই বর্ণনা বিস্তারে না দিলে যেন বাঘারু পাঠকের কাছে বাস্তব হয়ে উঠবে না। আবার এত বিস্তারে ও বর্ণনায় কোন চরিত্র বা দৃশ্যকে দেখালে সেই চরিত্র বা দৃশ্য সাধারন নাও থাকতে পারে, অ-সাধারণ হয়েও উঠতে পারে, ঢোঁড়াই যেমন হয়ে উঠেছিল। তখন শুধু একটি চরিত্রই নয়, একটি ভৌগলিক অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই উপন্যাসটি তার পুরো স্থান-্কাল-্পাত্র জুড়ে বিশেষ হয়ে উঠতে পারে, যেন পুরাণ হয়ে উঠতে পারে। বোধ করি দেবেশ রায়ের লক্ষ্যই ছিল তাই, উপন্যাসটা যা কিছু নিয়ে, বর্তমানের সেই সব কিছুকেই এক আধুনিক পুরাণের অংশ করে তোলা। পর্ব ভাগ, শিরোনাম সেই উদ্দেশ্য সাধনের উপায় বলে মনে করি।
  • একলহমা | ১৮ মে ২০২০ ১০:০৩93433
  • সিএস | 2405:201:8803:bff6:125:aa54:917f:2ba3 | ১৭ মে ২০২০ ১৭:৩৫

    চমৎকার হয়েছে। তিস্তা ... ... পাঠে আমার নিজের তৃপ্তি-টা অনুভব করলাম।
    93421

  • অমর মিত্র | 202.8.***.*** | ১৮ মে ২০২০ ১৩:৫৩93437
  • বিশ্লেষণ চমৎকার। লেখক দেবেশ রায়কে অনেকটাই উপলব্ধি করতে পেরেছেন। পড়ে সমৃদ্ধ হলাম  অনেক আগে পড়া উপন্যাসগুলির কথা মনে পড়ে গেল। ভারতে মৌসুমি বায়ুর প্রবেশের এক দীর্ঘ অসামান্য বিবরণ কি ইতিহাসের লোকজন উপন্যাসে ছিল?      

  • সিএস | 103.99.***.*** | ১৮ মে ২০২০ ১৭:৩৩93443
  • ধন্যবাদ তাঁদের, যাঁরা এই লেখাটি পড়লেন। দীর্ঘদিন ধরে দেবেশ রায়ের লেখা পড়েছি, কোন কোন লেখার অভিঘাত আমি এখ্নও ভুলিনি, কোন লেখা অত পছন্দের হয়নি, কোন উপন্যাস হয়ত আমি যেরকম উপন্যাস পড়তে চাই সেরকম নয়। কিন্তু উপন্যাসগুলো এটা প্রমাণ করে যে উপন্যাস বহুধা-বিস্তৃত হতে পারে, নানা কিছু তার মধ্যে ধারণ করতে পারে এবং উপন্যাস নিয়ে ওনার বিভিন্ন মন্তব্যও হয়ত আমাকে উপন্যাস পড়তে শিখিয়েছে; এই লেখাটাতে হয়ত সেসবের প্রমান রয়ে গেছে।

    অমরবাবু,

    ইতিহাসের লোকজন আমি পড়িনি, বইয়ের দোকানে পাতা উল্টে দেখেছি। মনে হচ্ছে যেন উপন্যাসটির প্রথম অংশে এরকম বর্ণনা ছিল, সঠিক মনে নেই।
  • বিপুল দাস | 117.2.***.*** | ১৮ মে ২০২০ ২১:০১93447
  • এই প্রজন্মের তরুণ গদ্যলেখকদের অবশ্যপাঠ্য। ভালো লাগল সময় ও ঘটনাকে উপন্যাসে দেবেশ রায় কী ভাবে ধরেছেন, সেই বিশ্লেষণ।

    -- বিপুল দাস

       

  • সম্বিৎ | ১৯ মে ২০২০ ০৪:১৬93456
  • সৈকতের লেখাটা অসামান্য। 

  • Prativa Sarker | ১৪ মে ২০২১ ১৬:২০105965
  • খুব সহমত। বহুবারই ভাবি বস্তুবাদই দেবেশ রায়ের খুঁটি।  সমসাময়িকতা, রাজনীতি, অবশ্যই তা বাঁদিক ঘেঁষা। মানুষ খুন করে কেন পড়তে পড়তে আমার মাথায় প্রায়ই এই প্রশ্নটা গজাতো যে পরিষ্কার দুটো ভাগে আমাদের ঔপন্যাসিকদের ভাগ করতে পারি কিনা। বস্তুবাদী আর ভাববাদী। 


    অথচ নিজেই জানি তা পারি না, পথে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে ঢোঁড়াইরা। বাঘারুও কী তাই নয় ? তাঁর সম্বন্ধে যা ভাবাভাবি তাতে তিষ্ঠোতে না দিয়ে এই দেবেশ রায় চিরকালই আমার কাছে বিরাট ধাঁধার মতো রয়ে গেলেন।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন