“Women have sat indoors all these millions of years,so that by this time the very walls are permeated by their creative force, which has, indeed, so overcharged the capacity of bricks and mortar that it must needs harness itself to pens and brushes and business and politics”
— Virginia Woolf
ওপরের উদ্ধৃতিটি সহজেই এল। কারণ এই মুহূর্তে আমার সামনে তিনখানা বই। তিন নারীকবির। মেয়েদের লেখাপত্র একই সঙ্গে কৌতুক ও কৌতূহলোদ্দীপক বলি যদি, মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি আগেভাগেই।
আমার যৎসামান্য লেখালিখির আবর্তে শুনতে পাই, কেউ প্রশস্তি গেয়ে বলছে, মেয়েদের মধ্যে আপনার লেখা বেশ নজর কাড়ে। কেউ-বা একটু অ্যাপোলোজেটিক গলায় বলছেন, আমার ওয়াইফ আপনার লেখা বেশ পছন্দ করে। কী ভীষণ কী ভীষণ সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা এসব। শুনতে শুনতে গলা শুকিয়ে যায়। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। মনে পড়ে, লাইব্রেরিগুলিতে, বড়ো বড়ো সভাকক্ষে, আলোকোজ্জ্বল মনীষার আরাধনা চলে যেখানে, নিজ নিজ ক্ষেত্রে ক-জন নারীর মহিমান্বিত ছবি, অয়েল পেইন্টিং শোভা পায় সেখানে? শিল্পনির্মাণে লিঙ্গবিভাজন হয় কি? পুরোটাই, চর্চিত ফসল। আচ্ছন্নতা, বা মেধাবি ঘোর-লাগা নশ্বর কিছু শব্দমালা। তবু, ছেলেতে মেয়েতে লেখালেখির তফাত হয় বই কী! হেমন্তের পাতা জড়ো করার মতো, মেয়েদের গোছানো একরকম। ছেলেদের, আর-একরকম। অন্ধকার, বিষাদের জন্ম দেয়। ধ্যান আর স্বপ্ন আনে। মৃত্যুচেতনা আনে। আবার, একটি মেয়ে অন্ধকার আঁকে যখন, ম্যাজিকবাস্তবতার পাশাপাশি হার্ড রিয়েলিটি যে তাকে গিলে খেয়ে নেবে টুপ করে, সে-আতঙ্ক, সে-লজ্জাও আছে তো!
মেমরিজ। শিল্পী ধারা মেহরোত্রা (সৌজন্য http://www.dharamehrotra.com)
প্রথমে তুলে নিচ্ছি জারিফা জাহান-এর ‘মন্দ সাইদাতি’। দেখুন, পেছনের মলাটে কী লিখছেন তিনি: সাইদাতি শব্দে ঘাবড়াবেন না প্রিয় পাঠক অথবা ভেবে ফেলবেন না নামের মতোই বোধগম্যহীন দুষ্পাচ্য একটি ভাষার নৈমিত্তিক কথক এ অধম। সামান্য ‘মহোদয়া’ সম্ভাষণ যথার্থ হতে পারতো এ বইয়ের শিরোনামে। তবুও এ চয়ন ইচ্ছাকৃত কারণ এই বিভেদী হাওয়ায় পরিত্যক্ত কুয়োঘরে মুখ লুকালো অবাঞ্ছিত পাপ।
নান্দনিকতা নয়, এটা পড়তে পড়তে বটের আঠার মতো বিভাজনমুখী ঘন আঁধার নেমে আসে যেন!
অসম্ভব সাহসী কবিতা। সাহসী বলতে বাধ্য হচ্ছি, কারণ দিনকাল আমাদের এই স্বাধীনতাটুকুরও প্রশ্রয় দেয় না। যাবতীয় মসৃণতাকে ভাঙতে ভাঙতে (শুরুতে মর্টারের উল্লেখ করেছিলাম, মনে আছে?) চাঁচাছোলা ভাষায় এগোয় এসব কবিতা। ‘এইসব মনে এলে সদ্যজাতাকে বুকে তুলে নিই উৎসাহী/ ডাইন; নামাই বৃন্ত, স্তনবৃন্ত, তার মুখে। ব্যর্থ/সিজদায় মস্তক ঝুলে থাকবার চেয়ে এই শ্রেয়/টিপে ধরা নবাগতা শ্বাস/দুই স্তনের ভেতর, পিষে ফেল শ্বাপদ জনম।’ এই চটি বইতে বারোটি কবিতা আছে। স্বগতোক্তির মতো ন্যারেটিভ। জ্বলতে জ্বলতে নামে। ভয় পাওয়াবে। অস্বস্তি দেবে। একটু অচেনা, আমাদের রোজকার কথাবার্তা ছাপিয়ে সামান্য ভারী, ভাষা। ‘হামিদুল্লা এসো, এই ধূসররঙা সন্ধের দিকে মুখ করে বসো, অবিন্যস্ত।/সিগারেটের গন্ধ ভেঙে ভেঙে একটি ত্রিমাত্রিক ধর্মযুদ্ধের সূচনা করতে পারো/ বরং এই নিদাঘ সংকটে।’ জারিফা একথা লিখতেও ইতস্তত করেন না, ‘পর্দা ও বস্তা উভয়েই সূর্য দৃশ্য হইতে বঞ্চিত।’ শিল্প, সংকেত দাবি করে। কবিতাগুলিতে তাই কথা বুনে বুনে তৈরি করা দৃশ্যকল্পের ভার একটু হালকা হলে হয়তো-বা ব্রিদিং স্পেস পেতাম আমরা। অবশ্য না পেলেও ক্ষতি নেই, সম্ভবত।
এবার, চিরশ্রী দেবনাথ-এর বই ‘বিশ্বাসের কাছে নতজানু’। এতক্ষণ দম চেপে রেখে যে লেখাগুলো পড়লাম, এখন এই ষোলো পাতার কবিতাদের হালকা চলন দেখে ভাবছিলাম হয়তো রিলিফ পাব একটু। কিন্তু, তা নয়। পড়ছি, ‘তবু মনে হয়, আমাদের ছেলেরাও একদিন তুলে নিয়ে যাবে/সব ফাটা গোড়ালির মেয়েদের,/আচ্ছন্ন শীতে সেই মেয়েরা বিবাহ তুলে দেবে ছেলেদের হাতে।’ পড়ছি, আর কেবলই ভাবনার জন্ম হচ্ছে। যেমন, ‘বেহালাবাদক’ নামের কবিতাটিতেই দেখুন না, ‘কবিতায় প্রতিবাদ হারিয়ে গেলে, জেগে ওঠো শ্লোগান/শ্লোগান হারিয়ে গেলে, আগুনের কাছে জখম নাও’, বর্ণনা পার হয়ে বিকল্প বর্ণনা তৈরি হচ্ছে। যেমন, ‘বড়দিন’ কবিতায় জীবনানন্দের ধানসিড়ি নদীকে অন্যতর মাত্রা দিচ্ছেন এই কবি। আঁতিপাঁতি করে এই ফুরফুরে চেহারার বইটিতে প্রেম খুঁজতে গিয়ে পড়ে ফেললাম, ‘ভালোবাসায় ছিলাম বলে কিছু লেখা হয়নি, লেখা যায়নি/সময় লাগবে, অনেক সময়, এই বিজন স্রোত বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে একা,/কেন যে জানি না... ’
বেবী সাউ-এর কবিতাবই পিতৃপরিচয়, শীর্ণকায়। একটিই কবিতা। চোদ্দোটি অংশ। পিতৃতর্পণ নাকি শিকড়ের সন্ধান! অদ্ভুত এক আচ্ছন্ন ভাব। মগ্নতা। বাবার কথা পড়তে গিয়ে পরিবার ও সংসারের খুঁটিনাটি খুলে যায় মনের সামনে। ‘বাবা আর আমি, আমি আর বাবা/দু’জনকে দু’জনে এড়িয়ে চলি... /যেন দুটো শত্রুজাত দেশ/সীমারেখা নিয়ে পরমাণু বোমা বানাতে শিখেছে/আমাদের সেই অমিমাংসিত, অপ্রয়োজনীয় ল্যান্ডলাইন মা/অসহায়/চুপচাপ দৃশ্য দেখেন’, কবিরই প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই যেন এই শিরোনামহীন একের পর এক কবিতায়। কখন যেন বেবী, অজান্তে, ঢুকে পড়ছেন বাবার খোলশে। লিখছেন, ‘পুতুলখেলাকে খুব ঘৃণা করতেন... /বাবা বাড়ি ফেরার আগেই, পুতুলের রান্নাপাতি, সংসার লুকিয়ে ফেলতাম/সব জেনেও কিছু না জানার ভান করতে করতে/বাবা নিজেই একটা বিরাট খেলার সংসারে ঢুকে পড়েছেন/নিজেই জানেন না’। শিকড় খুঁজতে খুঁজতে বেবী এই অসামান্য কবিতাটিও লিখে ফেলেন একসময়, ‘আমার বেচারা বাবা, আমাদের অঙ্ক শেখাতে বসতেন... /দেখতাম এক দিকভ্রান্ত মানুষ দুই প্লাস দুই মেলাতে গিয়ে/একটা আকাশ, একটা নদী এবং মাছের ছবি এঁকে ফেলেছে, অজান্তে... ’
তিনটি বইতেই যা নেই তা হল, প্রচলিত ছন্দ। ছন্দ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। যা আছে, তা হল, নিখাদ কবিতা। আত্মমগ্ন, নিজের সঙ্গেই কথন যেন। কবিতাগুলিতে শব্দকুশলতা আছে। মেধা ও আবেগের মিশ্রণে নেমে-আসা, তীব্র কর্কশ আর মরূদ্যান একই ক্যানভাসে নির্মিত হয়। আর হ্যাঁ, একটু ডার্ক। এই প্রজন্মের নারীকবিদের কালো কবিতা এসব। মুখ গুঁজে বসে থাকতে হয় মেয়েদের এই যাপনের মধ্যে।
অসাধারণ আলোচনা। কবিতাংশগুলো পাঠের ইচ্ছেকে জাগিয়ে তুলল।