সম্ভবত, বছর দুয়েক আগে চলচ্চিত্র উৎসবে শুনেছি মাণ্টোকে নিয়ে একটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল| বিদেশি পরিচালকের নির্মাণ| দেখে উঠতে মন করেনি| দেশভাগের ক্ষত ও দংশন, পাগল-করা দারিদ্র্য, তলিয়ে-যাওয়া নৈরাজ্য, সাহিত্যসৃষ্টির কারণে কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর অপমান আর অসহায় ও প্রখর অভিমান, যতই প্রতিভাব আর মেধা থাক, একদম বিদেশি পারবেন কী করে এইসব বহুস্তর আলো-অন্ধকার ফুটিয়ে তুলতে| আমাকে মার্জনা করবেন, সেই চলচ্চিত্রটি নিশ্চয়ই অসাধারণ ছিল, নাহলে উৎসবে আনা হত না, এ আমার ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা, যা কিনা সদাসর্বদা বলবে, মাণ্টো ইজ মাই রাইটার| অন্যের বেঁধে-দেয়া ফ্রেমে ওঁকে আমি দেখব না| পড়ে নেব, আমার মনে তলিয়ে-যাওয়া টেক্সট-যে|
অথচ কী আশ্চর্য, মাণ্টোকে প্রথম চিনলাম আমি ইসমত চুঘতাইয়ের অনুভূতিতে চোখ ডুবিয়ে আমার| মিথ্যে বলব না, খুব পিতৃতান্ত্রিক, খুব এলোমেলো, এ-ও মনে হয়েছিল আমার, একটা স্তরে| তারপর মাণ্টোর জীবনের বহুমাত্রিকতা, বদগন্ধ গলিপথে ভেসে-চলা নদীর মতো যে-যাপন তা একটু-একটু করে পান করলাম আমি| মাণ্টো অনুবাদের কাজে হাত দিলাম| হ্যাঁ, সংকোচবশত তো বটেই| আর হাতে লেগে গেল কাঁচা রক্ত, পুঁজ, অসুস্থের কাশি, যৌনকর্মীর হাসি, নির্যাতন ও অশ্রুচিহ্ন, তা আজও মুছল না|
ও! সে ছিল রবি| রবিশংকর বল| আমাকে ঘাড় ধরে মাণ্টো চিনিয়েছিল! যেভাবে মানুষ ডেকার্স লেন, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, চাঁদনি চক, চিৎপুর.....কোলকাতার লেন, বাই-লেন চেনে আর নেশায় বুঁদ হয়ে যায়| আমার হাতে ইসমত চুঘতাইয়ের জলছবি সেঁটে দিয়েছিল সে|
তাই, নন্দিতা দাসের শিল্পসম্মত ভাবনার আদর করি বটে আমি, কিন্তু ওই যে, মাণ্টোর জীবনের চড়ারঙের শেডস পারবেন উনি ফুটিয়ে তুলতে! পারবেন মাণ্টো আর চুঘতাইয়ের মাঝখানের সেতুটিকে ঠিকমত দুলিয়ে দিতে!
ক্রমাগত স্ববিরোধে জর্জরিত মাণ্টোর রাগি, অসহায়, শিল্পের কারণে বিন্দুমাত্র আপোষহীন অহংকারী চেহারা, যিনি নিজের এপিটাফে নিজেই লিখবেন- Here lies Saadat Hasan Mnto, and with him lie buried all the secrets and mystries of the art of short-story writing....
তাকে জাগিয়ে তুলবেন নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকি.... সম্ভব? কিংবা সফিয়া? মাণ্টোর স্ত্রী| যিনি নির্জনে সজনে ওঁর পাশে থেকেছেন| ঘৃণা করে, ভালোবেসে, চলে গিয়ে, বিচ্ছেদের ভান বুনেছেন শুধু| রসিকা দুগাল পারবেন তো?
‘মাণ্টো’ দেখা শেষ হল| হলের শেষতম (আমি বাদে) দর্শকটিও চলে যাওয়ার পর স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম আমি| ছবি এগিয়েছে| ঠোঁট নড়ে গেছে আমার| আমি তো চিনি ওঁর গল্পের চরিত্রগুলোকে| চিনি, ওঁর তর্ক, ক্রোধ ও বিদ্যুতসম্বল ছিঁড়েখুঁড়ে-যাওয়া, তবু না-নুয়ে-পড়া চাবুকটিকে| নন্দিতা দাস তুলে ধরেছেন সবচেয়ে কঠিন সময়টিকে, মাণ্টোর জীবনের| একটা মস্ত ঝুঁকির কাজ| আর ফ্রেম টু ফ্রেম স্তব্ধ হয়ে বসে থেকেছি আমি| আমার নিজস্ব দুর্বলতা থেকে আমি চাইতেই পারতাম, ইসমত চুঘতাইয়ের সঙ্গে মাণ্টোর বন্ধুতা-শত্রুতার আরও বিস্তৃত বিবরণ| নন্দিতা একটু নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন সেই নিভৃতি| ভালই করেছেন হয়তো-বা|
“I was filled with trepidation as we climbed the wooden stairs of Adelfi Chambers. The kind of trepidation that one feel while entering the examination hall. I usually had apprehensions while meeting strangers. But here the ‘strangers’ was Manto, whom I was going to meet for the first time. My apprehensions soon turned into worry, and I said to Shahid, ‘Let’s go back. It seems Manto is not home’. But Shahid would have none of it.”
মাণ্টোর সঙ্গে দেখা করার, প্রথম দিনের পূর্ব-অভিজ্ঞতা লিখেছেন ইসমত চুঘতাই| টিকিট কেটে হলে বসে, জাতীয় সংগীতের পর আবার বসে পড়ে, আমারও কেমন নার্ভাস লাগছিল| ‘ফিরে যাই’ মনে হচ্ছিল| নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকি এলেন| অভিনয় দেখালেন| জয় করলেন| তেমনই চুটিয়ে অভিনয় করলেন রসিকা দুগাল| রাজশ্রী দেশপান্ডে|
এ-মুভিতে কোনও কমফোর্টের জায়গা নেই| মর্বিডিটি যাঁদের শ্বাসকষ্ট ঘটায়, তাঁরা ইনহেলার ব্যাগে পুরে সিনেমাটি দেখতে আসবেন প্লিজ! অতবছর আগের সময়কে সমসময়ের সঙ্গে জুড়ে নিয়ে একবার দেখে যাবেন, অবক্ষয়, ভাঙন, অনুভূতিহীন ভোঁতা মানুষদের সঙ্গে সহবাস এক সৃষ্টিশীল মানুষকে কীভাবে কুরে-কুরে খায়| তবু ওই সর্বস্বান্ত ধনী মানুষটিই বলতে পারবেন, মৃত্যুর পরেও যেন হেঁটে যেতে পারি, বলে, একবারও ফিরে না তাকিয়ে হেঁটে চলে যাবেন|
নন্দিতা দাস, আপনি পেরেছেন| মাণ্টোর বায়োপিক এমনটাই হবার কথা| হিমশীতল আগুনের মতো|