বিজয়া মুখোপাধ্যায় (১৯৩৭—২০২০) (ছবি: দেবর্ষি সরকার)
আমরা জানি। জানি, মানে সকলে নয়, কেউ-কেউ জানি, বিজয়া মুখোপাধ্যায় কবি। কেউ-কেউ শব্দটার ওপর আলো কিংবা অন্ধকার ঢেলে দিলাম খানিক। কারণ মেয়েদের লেখাপত্র সম্পর্কে, বিশেষ করে সামাজিক অভিমানবশত নিজের সৃজনের চারপাশে আলোকবৃত্ত তৈরি করতে অপারগ নারীদের অনেকেরই সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন করে উঠতে পারি না আমরা। উদাসীন থাকতে ভালোবাসি, পিতৃতান্ত্রিক গ্রুমিং-এর পুণ্যফলে।
যা বলছিলাম! বিজয়া মুখোপাধ্যায় চমৎকার গদ্য লিখতেন।
“মল্লিকার জীবনকাল মাত্র ৫১ বছর। গতবছর ওর জন্মদিনের সভায় আমাকে কে যেন যেতে বলল। আমি গেলাম হাতে একটা বই নিয়ে, কিছু বলেছিলাম নিশ্চয়—বলেছিলাম, অন্য অনেকের মতো ওর অসুস্থতাও সেরে যাবে। বিশ্বাস থেকেই বলেছিলাম। ওকে ‘অসুস্থ’ দেখতে দেয়নি আমাকে সুবোধ। তাই, ওকে আমাদের শেষ দেখা কাচের গাড়িতে—ওর মুখের দু-পাশে কয়েকটা গ্ল্যাডিয়োলি ফুল রেখে দিলাম—অল্প জল ছিল একটা ফুলের পাপড়িতে। হতে পারে, সেটুকু চোখের জলের ছদ্ম উপহার; আমার দিক থেকে, মল্লিকার জন্য।”
“এই সেদিন প্রণবের সঙ্গে আমরা দু-জন, গড়িয়ার ঢালাই ব্রিজের কাছে ‘রেমেডি নার্সিংহোম’-এ গিয়ে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুভ আর মিতিল এল। শুভ বলল, ‘তোমরা একজন একজন করে বাবাকে দেখে এসো। বাবা আইসিইউ-তে আছে। কথা বলার প্রশ্নই নেই। বিজয়াপিসি, তুমি প্রথম যাও। দরজা খুলেই বাবাকে দেখতে পাবে। দেরি কোরো না যেন।’ গেলাম, দেখলাম চোখ-বন্ধ-আপনি শুয়ে। চলে আসতে আসতে মনে হল, জাগ্রত আর সুষুপ্ত অবস্থার মাঝখানে যেন একটা সাঁকো, পার হয়ে যেতে পারবেন তো এই দীর্ঘদেহ মানুষটি! অনেকে তো সাময়িক ভেন্টেলেশনে গিয়েও ফিরে আসে। কিন্তু ‘এত ভালো স্বাস্থ্য’ ছিল না আপনার, গত কয়েক বছর ধরে। আর জাগলেন না। অথচ সেদিনও বুঝিনি আমি, এই আপনার শেষ শয্যা। এই জন্যই কি লিখেছিলেন অক্ষর প্রকল্প থামিয়ে, শয্যাকে ডেকে, নৌকো থেকে নেমে, শেষবার নীচে শোওয়ার কবিতা। কী করে লেখার সময় বুঝেছিলেন—আপনার সময় অল্প! আমাদের তিনজনের সঙ্গে আপনার আর দেখা হওয়ার কথা ছিল না। তাই দেখা হল না, শুধু দেখে এলাম। জানি না, আকাশে তাকিয়েছিলেন কি না অন্তত একবার।”
মৃত্যুমুখী এই গদ্য টুকরো দুটো দিয়ে শুরু করলাম ওঁর কথা। কবির গদ্যকবিতার মতো এ কথা বললে, সেই গদ্যের প্রতি কিছুটা অবিচার করা হল বলেই আমি মনে করি। কিন্তু এ-ও দেখেছি, কবির গদ্যে মায়াবী একটা ধরন থাকে। এখানেও আছে। অথচ আত্মজীবনীমূলক, মাত্র একটিই গদ্য বই ওঁর। ‘আমার লেখালেখি’ (প্রকাশক: বিভাব)। পাঠকের হাতে পৌঁছায়নি খুব একটা। ওঁর বাড়িতেই, স্তূপাকার, পড়ে আছে ধূলিধূসরিত হয়ে। এই বইটি পড়লে, পাতায় পাতায় বিদগ্ধ চয়নগুলি ছুঁতে পারলে, আমরা কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায় বলার আগে একটু থমকে থেমে, গদ্যকারও বলব কি না একই সঙ্গে সেটাও ভেবে নিতে পারব।
বিদগ্ধ শব্দটি উচ্চারণ করেই মনে হল, বিজয়া মুখোপাধ্যায় মেধাবী উজ্জ্বল এক নাম ছিলেন শিক্ষাজগতেও। ওঁর মতো সংস্কৃতজ্ঞ কম। শুনেছি, বুদ্ধদেব বসু যখন ‘মেঘদূত’ অনুবাদের কাজ করছেন, প্রয়োজনে বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের পরামর্শ নিয়েছিলেন কয়েকবার।
Linda Nochlim-এর একটি আর্টিকল নজরে এল, যার শিরোনাম ‘Why have there been no great women artists?’
একই সঙ্গে প্রায় কাকতালীয় ভাবে অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তীর একটা লেখার ক্লিপিংস দেখলাম।
‘আমি মিসেস আর পি সেনগুপ্ত—এঁটো পেড়ে, চায়ের বাসন ধুয়ে সোজা স্টেজে চলে যাব’।
এগুলো অপ্রাসঙ্গিক নয়। কেন-না যখনই একজন নারীকে লিখতে হয়, ছবি আঁকতে হয়, অভিনয় করতে হয় কিংবা এককথায় নিজের আইডেন্টিটি তৈরি করতে হয়, কী প্রাণান্তকর কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাঁকে। যেন সার্কাসের মাঠে ট্র্যাপিজের খেলা দেখাচ্ছেন! সেখানে কোনো তরুণ কবি যদি বলে ওঠেন, বিজয়া মুখোপাধ্যায়? একটাও লেখা পড়িনি তো... তখন বড়ো অপমান লাগে! বস্তুত তিনিও তো মিসেস শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়। প্রতিষ্ঠিত কবির ছায়ায় ঢাকা না পড়ার চেষ্টায় আমৃত্যু লড়াই করে যাওয়া নারী কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায়।
না। ওঁর চারপাশে নারীবাদের পাঁচিল তুলতে আমি নারাজ। কিন্তু লেখাপত্রগুলো তো নারীবিশ্বের উঠোনে দাঁড়িয়েই। যাকে ‘ফিমেল গেজ’ বললে ভুল বলা হবে না এতটুকু। ওঁর দু-একটি কবিতাকে লিখি বরং—
অনেক স্তর বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের কবিতায়। একটা বর্ণনা। সেটা ছাপিয়ে যাওয়া ব্যঞ্জনা। আর চিন্তনের নানা খোরাক, যা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পাঠেরও অপেক্ষা রাখে।
বিজয়া মুখোপাধ্যায়। আমার পূর্বনারী। ওঁর কবিতা ও গদ্যের আলোকবর্তিকা রেখে গেলেন আমাদের জন্য।
বিজয়া মুখোপাধ্যায়কে একজন মহিলা কবি হিসেবে উপস্থাপন না করলেই ভালো হতো। 'আমরা' জানি, 'কেউ কেউ' জানি, তাতে ক্ষতি কী! আজ যাঁকে নিয়ে মেতে উঠেছি কাল তাঁর কবিতা পড়ছি কি!
ভালো লাগলো। আরো একটু লেখা হলে আরো ভালো লাগত। কবিতা নিয়ে আলাদা করে উৎসাহ জাগানোর জন্য লেখাটা মনে থাকবে। পড়বো।