আমি একটা কালো বসন্তের কিসসা লিখেছিলাম এক সময়ে। আর সেটা ছিল এরকম-
ঘরে আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।
আমি ঘড়ির কাঁটা ধরে
রোজ রক্তবমি করি।
‘কেন, প্রেম ছিল না পাশে?’
কুয়োর ব্যাঙগুলি জিজ্ঞাসে,
শুনে, ঘুম কামড়ে মড়ি।
মৃত পতঙ্গেরা ওড়ে।
আমার স্বপ্ন দেখার ঘোরে
ভাবি, বিরহ ভাবব।
ফিকে রাগিনীটি বাজে,
গলায় মটরমালা সাজে,
এবার প্রেমিকা হব’
আমায় বাদ সাধল কে?
থুতু ছুঁড়ল যে চোখে।
সেও বাঁচতে চেয়েছিল!
পোকায় কাটা মেয়ের মুখ-
নখে ছিন্ন দুটো বুক –
আমার সবটা নেড়ে দিল
বসন্তকাল পড়ে গেছে। গোটা একটা বসন্ত জুড়ে উৎসব আর উৎসব। এই তো চুকল ভ্যালেন্টাইনস ডে, তার উৎসকথা জলাঞ্জলি দিয়ে সবাই মেতে উঠল আনন্দে। কেমন সে আনন্দ? পুরুষ একটা প্রেম প্রেম আবহ গড়ে তোলে নারীসঙ্গের উত্তেজনায়। আর মেয়েরা, বোকা মেয়েরা, শিকার ধরার ফাঁদে পা দিয়ে নিজেকে পপাত ধরণীতল করে, বিজয়িনী ভাবার নকল স্ফূর্তিতে। খুব নিষ্ঠুর, একবগগা শোনাচ্ছে, না? কী করব বলুন! পাড়ার চতুর্দশী, পঞ্চদশী, অষ্টাদশী... কন্যাদের মা-বাবার চোখমুখ যখন দেখি এই ১৪ ফেব্রুয়ারি এলেই আতঙ্কে শুকিয়ে গেছে। মেয়ে পার্টিতে গেল এক কিংবা কয়েকজন ছেলে বন্ধুর সঙ্গে। বিপদ আপদ ঘটবে না তো? কবি সাহিত্যিকদের আদিখ্যেতাজনিত শরীরের যে অংশটুকু তার ‘রোমাঞ্চিত যমুনা’, তা অক্ষত থাকবে তো? সব চেয়ে জরুরি কথা, ১৪ ফেব্রুয়ারি যে মেয়ে ড্যাডং-ড্যাডং নাচতে নাচতে বন্ধুদের সঙ্গে প্রেম উদযাপন করতে ছুটল, সে মেয়ে প্রাণে বেঁচে ফিরতে পারবে তো? এ কোন অবান্তর রূপকথা নয়, ভয়ানক সত্যি কথা ও মাংস কেটে বসা বাস্তবকথা। (এখানে সাবভার্শান-এর মতো চকিতে আরেকটি ছায়া খেলে যাবে। কৌমার্য, অর্থাৎ বাস্তবে, গল্পে, উপন্যাসে, কবিতায় রোমাঞ্চিত যমুনা, সদ্য-ফোটা-ফুল যেভাবেই বর্ণনা করা হোক না কেন, তাকে অক্ষত রাখার দায় বুঝি শুধু মেয়েদের! পুরুষের লিঙ্গটি যে কতবার যোনিপথে বীর্যবিসর্জন করল, কই, সে-হিসেব তো চরিত্রের কলঙ্ক মাপার মাপকাঠি হল না। আজও। থাক এসব উৎসববিমুখ প্রসঙ্গান্তর!) আমি তো ইদানিং ভাবছি , মানুষের প্রেমহীন রক্তাক্ত, ক্লেদাক্ত জীবনে ভ্যালেন্টাইনস ডে পালন এমনি এক উন্মাদনার পর্যায় পৌঁছল, যে, গিফটের সাথে সাথে মূল্য ধরে দিলে, সঙ্গিনীও দেয়া হবে হয়তো ভ্যালেন্টাইন প্যাকেজে। এক সন্ধের জন্য। এই ব্যবস্থা অনেক যথাযথ। এ-ও মনে হয় আমার। এতে, এই একটা দিনের জন্য, অন্তত মুখে, মেয়েদের পণ্য না ভাবার দ্বিচারিতার হাত থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে পুরুষমানুষ।
এরপর এল গিয়ে হোলি উৎসব। মানে, দোলযাত্রা। আহা! রঙে রঙে রাঙা হয়ে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা চলেছিল সেদিন। আজও চলে। শুধু ভয়ে কাঁটা হয়ে যেতে হয় মেয়েদের। পুরুষের রঙিন হাত কখন ক্রমশঃ হয়ে উঠবে কালো। রঙের সৌন্দর্য থেকে অনেক দূরে সরে গিয়ে, কিশোরীর শ্লীলতাহানি করবে সে, রং মাখানোর মস্ত অজুহাতে।
এ সবই দৈনন্দিন চিত্র। আমি শুধু বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে আলোকসম্পাত না করে, আরও একটু অন্ধকার ঢেলে দিচ্ছি মাত্র। এর মাঝে মাঝেই চলে মেয়েদের নিন্দামন্দ। কোন মেয়ে বিয়ে করে আবার বিচ্ছেদের হিম্মত দেখান নিগ্রহ না সয়ে, জীবনকে নতুন দিগন্ত দেবে বলে। শ্রীদেবীর আয়ুষ্কাল বিয়ে কাঁটাছেঁড়া। বৌ কেন রাঁধে না ইত্যাদি তো আছেই। আর আছে ধর্ষণ, বধূহত্যা, বরপণ... নারী হিংসার নতুন নতুন ধরণ।
পুরুষ ছুঁয়েছে সব আভিজ্ঞান। শুধু নারী অলীক কুহক।
এইমতো বর্ণসমারোহে আঁশ ও ধাতুর ঘর গড়ে উঠল।
আমার ভূমিকা হল ছিদ্রান্বেষণ আর রোজ আড়ি-পাতা। সেই
যে মেয়েটি রাতে বাথরুমে গিয়ে কাঁদত , সবাইকে বলে
দিয়েছি। ছেলেটি পাথর। আর, ওদের রান্নাঘর, বুঝলে না
স্রেফ খেলা-খেলা! লুকোন কেরোসিনও ছিল সিঙ্ক-এর
তলায়, আমি টের পাই নি। লাফিয়ে উঠব আঁচ, ছেলেটি
ফেরার হল যে সন্ধেয়। কে জানে কোথায় পড়েছিলাম
আ! ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারীদিবস, হা! হা! এই হা-হা আমার নয়। ‘বেটি বঁচাও’ শ্লোগানেরই তলানিটুকু এই হাসি। পুরুষ যেদিন ঘুম থেকে উঠেই তাঁর অধিকৃত নারীর প্রতি কটাক্ষ ছুঁড়ে বলতে পারে, আজ তো তোমাদের দিন ! ওয়েল, সেই দিনটিকে উপভোগ করার জন্য নারী তার প্রাত্যহিক কর্মযজ্ঞের কোটা মিটিয়ে হয়তো-বা কোনও এক টেবিলের একপ্রান্তে লিখতে বসবে তার নিজস্ব লেখা, হ্যাঁ সেলফ-সেন্সরশিপ সমেত। নারী যাবে কোনও সভায়, মেয়েদের চোখের তলার ক্লান্তি তথা দৈনন্দিনতার সাতকাহন গেয়ে একচিলতে স্বস্তি পেতে। নারী, ছোট-ছোট কন্যাসন্তান্দের নিয়ে অনুষ্ঠান বানাবে আর ঘন ঘন ঘড়ি দেখবে, সূর্য ডোবার আগেই এই শ্বাপদসংকুল শহরে কিংবা গ্রামে, এদের নিরাপদে বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করতে হবে তো! যদিও আন্তর্জাতিক নারীদিবসে, বাৎসরিক শ্রেষ্ঠ রসিকতা এই এইটেই যে, সাত থেকে সত্তর বছর বয়সের রমণীরা, তাদের নিজেদেরকেই নির্বিঘ্নে, রেপড না হয়ে, ঘরে ফেরানোর গ্যারান্টি কি দিতে পারছে, আজকের এই উত্তর-আধুনিক সভ্য পিতৃতন্ত্রের দিনকালে?