এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  গপ্পো

  • উড়ান

    রোদ্দুর মিত্র লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ২১ জুলাই ২০২০ | ১৫৪১ বার পঠিত
  • বাতাসের বুঝি ভাষা আছে!

    যে ভাষায় বৃষ্টি উচ্চারিত, গাছের মগডাল থেকে যে ভাষায় দুর্যোগ তার পদ্য শোনায়। ভাতের হোটেলের ছাউনি উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে ওরা কথা বলে। স্বাধীন। ঝোড়ো। প্রথম সাঁতার দেওয়া বালিহাঁসের মতো উচ্ছৃঙ্খল।

    পাড়ায় পাড়ায় মাইকিং হচ্ছে, এত কিলোমিটার বেগে ঝড় আসছে, ঝড়ের আঁচ পেলেই সতর্ক হোন, অমুকের পার্টি সারারাত খোলা রাখবে তাদের অফিস, প্রয়োজনে আমাদের ডাকুন এই নাম্বারে... দুমদাম জানলা বন্ধ করার শব্দ পাওয়া গেল।

    বাতাসের ভাষা শিখতে কেউ আগ্রহী নয়। রাজনৈতিক দলের ছেঁড়া ছেঁড়া পতাকাটা একমাত্র মাথা নেড়ে নেড়ে তীব্র সমর্থন জানাচ্ছে, যেন বলছে—আমি শিখতে চাই। সে উড়ে যেতে চায় এই তুচ্ছ পাটকাঠির বাঁধন ছিঁড়ে। যেখানে রঙের বিভেদ নেই। যেখানে হিংসা উচ্চারিত হয় না। মসজিদ ভেঙে মন্দির তৈরি হবে না যেখানে কোনোদিন। ক্ষমতাকে মাঝরাস্তায় উলঙ্গ করে মানুষ চিৎকার করে। একদিন ওরা ঠিক ডানা পাবে। ভাবতে ভাবতেই একেবারে ঝেঁপে বৃষ্টি শুরু হল। অতএব, হাওয়া ক্রমশ ঝোড়ো হবে। খানিকটা বিধ্বংসীও হতে পারে। নির্জন পাড়াঘরের মধ্যে শোনা যাবে দুর্যোগের পদ্য। সর্বনাশ!

    সর্বনাশই বটে। তাই, এত হাওয়ার রাতে একা একা ছাদের দিকে ছুট দিয়েছে হারু। কোনো বারণ শোনেনি।

    বারণ করবেই বা কে! বাবা মারা গেছেন, যখন হারুর সামনে উচ্চমাধ্যমিক। মায়ের অবস্থা ইদানীং খুব একটা ভালো নয়। আজ প্রেশার হাই, কাল হাঁটুতে ব্যথা, পরশু মাথা ঘুরে পড়ে যায়। ডাক্তার দেখাতে গেলে অনেক টাকার ঝক্কি। পাঁচটা-ছটা টিউশান পড়িয়ে, না এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকা যায়, না এই জীবনের সমস্ত অসুখ সারে। চৌকির এক কোণে হারুর মা ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে। আজকে বোধহয় আবার জ্বর আসছে। হালকা কাঁপুনি দিচ্ছে শরীর জুড়ে।

    “ও হারু, জানলাটা বন্ধ কর না বাবা। নতুন কাঠের জানলা এই সেদিনই লাগিয়ে দিয়ে গেল হারান মিস্ত্রি, এতক্ষণে হয়তো ভিজে গেছে”, হারুর কোনো উত্তর আসে না।

    তার মানে নির্ঘাত ছাদে উঠেছে। ছেলেটাকে নিয়ে পেরে উঠছে না বুড়ি। কী দরকার ছিল অতগুলো টাকা নষ্ট করে পাকা ছাদ বানানোর! টালির চালের তলাতেই তো হারু কাঁদতে শিখল, অঙ্ক বুঝল, বাবার শূন্যস্থান ভরতি করার জন্যে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিতে দু-বার ভাবল না। থাকত টালির ঘর। তার চেয়ে বরং সেই টাকাটা ব্যাংকে রেখে দিয়ে আসলে, হারুর বিয়ের সময় অনেকটা নিশ্চিন্ত মনে খরচাপাতি করে বুড়ি মরতে পারত। যত বড়ো হচ্ছে, ভেতরের শিশুটাকে অযথা লাই দিয়ে বড়ো করে তুলছে ছেলেটা।

    টলোমলো শরীরে সে জানলা বন্ধ করতে ওঠে। হারুর চাদরটা নিজের গায়ে জড়িয়ে নিয়ে চোখ বোজে। কিন্তু অত সহজে ঘুম আসে নাকি! মায়ের মন ছটফট করতেই থাকে। মায়েদের স্বভাব। মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ইতিমধ্যেই ঢুকে পড়েছিল খানিকটা সোঁদা হাওয়া। বৃষ্টির ছাটে ভিজে গেছিল হারুর বালিশের একাংশ। মশারির গায়ে তখনও দু-একটা রক্তাপ্লুত মশা চুপ করে বসে আছে। ওদের আর ওড়ার ক্ষমতা নেই। কিন্তু এসব খেয়াল করার মানুষ হারু নাকি? তাই দ্দে ছুট।

    ২.

    “হারু, এই হারু? কোথায় রে, ঘুমোচ্ছিস নাকি? আরে এই, জলদি বেরো না, জলদি জলদি। বৃষ্টি নামল বলে। শিগগির চল। মাঠে সবাই এসে গেছে”, বাঁশের বেড়া দেওয়া ছোট্ট ঘরটা থেকে হাওয়াই চপ্পল পরে, চোখের পিচুটি না মুছে, নাক খুঁটতে খুঁটতে বেরিয়ে আসে হারু, এ পাড়ার, মানে আমবাগানের মেসি।

    বয়স খুব বেশি না, ইলেভেনের অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ করে উচ্চমাধ্যমিকের সামনে, তাতে কী আসে যায়, পেনাল্টি বক্সের সামনে সে অর্জুন, সে অপ্রতিরোধ্যে। তিনকাঠির অমোঘ শূন্যস্থানের মধ্যে বল ঠেলে দেওয়ার পরেও হারু যেন আরও কিছু খোঁজে। মনে হয়, ওর দৌড় জাল ছিঁড়ে বেরোনোর, ওর কিছুতেই খিদে মেটে না।

    মাঠের দিকে যেতেই বৃষ্টির গন্ধ সারা শরীরে খেলা করতে শুরু করেছে আজ। আহ! গোলপোস্টের মধ্যে অদ্ভুত গন্ধ, কাদা মেশানো গোলের স্বাদ। বৃষ্টিটাও অল্প অল্প করে পড়তে শুরু করেছে। গেঞ্জিটা খুলে নিয়েই মাঠের মধ্যে দৌড়।

    ভোলা, বাচ্চু, কেতো, নানু, হুলো, হুলোর ভাই সবাই মোটামুটি এসে গেছে। কলোনির ছেলেগুলোর শুধু মাঠে নামার অপেক্ষা। বলাইদা বারমুডাটাকে যতটুকু গুটিয়ে লজ্জা নিবারণ সম্ভব, ঠিক ততটুকু গুটিয়েই নেমেছে। নিজে একসময় দাপিয়ে বেড়িয়েছে কলকাতার মাঠ। মিডফিল্ডার ছিল। মাঠের মধ্যিখানে যেন নিজের ঘর-সংসার সাজিয়ে বসত। গোটা দলটাকে নিজের পায়ে চালনা করতে পারত বলাইদা। ইস্টবেঙ্গলের জুনিয়ার টিমে খেলেও ছিল এক মরশুম, কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্তের অত স্বপ্ন না দেখাই ভালো। বাড়িতে চাল বাড়ন্ত, বিয়ের বয়স পেরোনো বোন, সব মিলিয়ে মাঝমাঠের সংসারে ইতি টেনে বলাইদা চাকরিতে ঢুকল। কিন্তু, সবুজ ঘাসের গন্ধ ভুলে যাওয়া কি অতই সহজ! তাই বলাইদা আজকের রেফারি। শুধু আজকের বলে নয়, অন্যান্য পাড়ায় বলাইদাকে ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া হয়, এই রেফারিং-এর জন্যই।

    বৃষ্টিটা একটু ধরে এসেছে। মাঠের চারপাশে অল্প অল্প করে লাল-নীল-সবুজ ছাতার ভিড় জমতে শুরু করবে এবার। একসময় তিল ধারণের জায়গাটুকু থাকবে না। আর একটু পরেই হয়তো চেঁচিয়ে উঠবে সবাই, “গোওওওওল!”

    অসামান্য চেস্ট ট্র্যাপ করে বলটা নামিয়ে এনে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে ডান দিকে ঘুরে তাকিয়েছিল হারু। ওপাশ থেকে তখন খ্যাপা ষাঁড়ের মতো তেড়ে আসছে লেফট ব্যাক মনোদা। বয়স, চেহারা, অভিজ্ঞতা সমস্ত দিক থেকেই হারুর চেয়ে বড়ো। কিন্তু হারুর চোখে তখন ওই তিনকাঠি। মুহূর্তের মধ্যে একটা ছোট্ট টোকায় মনোদাকে ডজ করে, একরকম মাটিতে শুইয়ে দিয়ে হারু ছিটকে বেরিয়ে গেল। হারু ছুটছে। হারু ছুটছে। ছুটতেই হবে, সামনে গোল, সামনে তখন শুধুমাত্র ওই তিনটে কাঠিই। সারা মাঠ জুড়ে লাল-নীল-সবুজ ছাতার চিৎকার উঠেছে, উত্তেজনার বশে বাঁশের বেড়া টপকে মাঠে নেমে পড়ার উপক্রম, মেঘের গর্জনকে টেক্কা দিয়ে শুধুই, “হারুউউউউ, হারু!”

    পেনাল্টি বক্সের মধ্যে হারু যখন সেই স্বপ্নের ডান পা মেলে ধরার জন্যে গোলপোস্টের সাথে একাত্ম হয়ে পড়েছে, যখন হারুর চোখে মুখে এক ধরনের আদিমতা ঘুরপাক খাচ্ছে, বোধকরি আকাশ ফাটিয়ে এক মারণ বজ্রপাত কেবলমাত্র হারুকেই স্পর্শ করে গেল। গোললাইনের ইঞ্চিখানেক দূর থেকে হারু বলটা যে এভাবে থামিয়ে দেবে কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়। কারণ অসহায়তার কান্না সবার কানে পৌঁছোয় না। যদি পৌঁছে যেত, তাহলে এত কৃষক বিষ খেত না। শুধুমাত্র অপুষ্টির অভাবে হাজার হাজার শিশু মারা যেত না এই দেশে।

    তাই, ডান দিকের বাঁশের বেড়া টপকে হারুর কানে, শুধুমাত্র হারুর কানেই ভেসে এল, “চোপ শুয়োরের বাচ্চা। একদম চুপ। বেশি চোপা দেখালে এইখানেই পুঁতে দেব। কারখানার মালগুলোকে উসকানি দেওয়ার বেলায় মনে ছিল না...”

    ৩.

    —এত রেগে যাওয়ার কী হল নিবারণ? আমি যেটা বলছি, সেটা কি এমনি এমনি বলছি? কত প্রমাণ লাগবে বলো, আমি দিচ্ছি। একেবারে নিজের কানে শোনা। এই তো, আগের শনিবারই, যখন তোমরা চলে গেছো...
    —শনিবারের প্রমাণ নিয়ে আমি খই ভাজব দত্তদা? মাইনে তো এমনিতেই বাড়ছে না, উলটে কমছে, তার ওপর তোমার প্রমাণ। শালার প্রমাণ দিয়ে কিছু ছেঁড়া যাবে বলে তোমার মনে হয়? এই কানাই, ওঠ তো, মেশিন চালু কর।
    —আমি নিজের কানে শুনেছি, পার্টির ছেলে ঢোকাবে। তারপর এক এক করে এই আমি, তুমি, কানাই, রাজু, সব্বাইকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করবে। কোম্পানি বেচে দিচ্ছে কোন্‌ মারওয়াড়ি ব্যবসায়ীর হাতে। একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখো নিবারণ। একবার সরকারের হাত থেকে কোম্পানির মালিকানা চলে গেলে আমাদের...
    কথাটা শেষ না করেই নিবারণকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন স্নেহাশিস দত্ত। এই কারখানার প্রতিটা মেশিন, প্রতিটা অ্যালুমিনিয়ামের উচ্ছিষ্টের সঙ্গে তার সখ্য। তাই তিনি পেরেছেন, তিনিই একমাত্র বুঝতে পেরেছেন পার্টির ধান্দা মোটে ভালো নয়। নইলে সেদিন ম্যানেজারের ঘরে হঠাৎ চেঁচামেচি শুরু হল কেন! কপালে তিলক কাটা, মুখে জর্দা-পান, বিচ্ছিরি দেঁতো হাসির লোকটার ছায়া তো এই এত বছরে একবারও পড়েনি কারখানায়।

    —শোনেন ম্যানেজারবাবু, আমরা শুধু প্যায়সা বুঝি। মানি মানি। কোর্ট-কাছারির জন্যে আমার লোক আছে তো। সে সব সমঝে নেবে। আন্ডারস্ট্যান্ডিং! তো বলেন, আজকে কত অ্যাডভান্স করছেন?
    —এত তাড়াহুড়ো করলে তো হবে না প্যাটেলজি। আপনি আপনার লোক নিয়ে আসুন, আমি এদিকে পার্টির সাথে কথা বলছি অ্যাডভান্সের বিষয়টা নিয়ে। এরপরে তো ওদের ছেলেরাই কোম্পানি চালাবে। মাসের পয়লা দিনেই টাকা পৌঁছে দেবে আপনার ফ্ল্যাটে। হোয়াট আ লাইফ!
    —আপনার কথা রাখেন তো ম্যানেজারবাবু। পিছলে পাঁচ মাস ধরে একই ভাবে রিফিউস করেন। আজ ফ্যায়সালা করুন। অ্যাডভান্স আমার এই উইকের মধ্যেই লাগবে।
    —গলা নামিয়ে কথা বলুন, এ কী! আমি যদি এক্ষুনি সবাইকে পুরোটা জানিয়ে দিই, তাহলেই খেলা শেষ। তারপর ঘেরাও, লাথি, ঝ্যাঁটা, আমাদের বড়োবাবু, পুলিশ, মিডিয়া... আপনি বরং আপনার লোকটিকে নিয়ে আসুন। আন্ডারস্ট্যান্ডিং আন্ডারস্ট্যান্ডিং খেলাটা এগোবে।
    —প্যাটেলকে থ্রেট করছেন ম্যানেজারবাবু? হে, ভাগওয়ান! এই দিনও দেখতে হল? তো শোনেন ম্যানেজার বাবু, পার্টির লোকও আপনার ওপর গুস্‌সা আছে। কালকেই ওদের সাথে কথা হয়েছে আমার। টাকা নিয়ে ওরা রেডি। আপনিই নাকি বলেছেন এত ফাস্ট করতে না। কিন্তু প্যায়সা তো আমি এই উইকের মধ্যেই নেব...

    দুই পক্ষই জোর গলায় কথা বলেছিল। টেবিলে চাপড় মারার শব্দও কানে এসেছিল বেশ কয়েকবার। তারপর আবার সব শান্ত, স্থির। গোপনে সমঝোতা করতে হলে মধ্যরাতের মতো নীরব হতে হয়, সমস্ত সইসাবুদ হাতিয়ে নিয়ে সক্কাল সক্কাল একটা বাঁকা শিরদাঁড়া, খানিকটা এই ম্যানেজার বাবুর মতো করে বলেন, “এবার থেকে নাইট শিফটে আর কাজ হবে না। ওই স্লটে কিছু নতুন ছেলে ঢুকছে। ওরাই কাজ করবে। নিবারণবাবু, বয়স তো হল। কোম্পানি আপনাকে নিয়ে ভীষণ টেন্সড!”

    টিফিন আওয়ার শেষ হয়ে গেলেও মেশিন চলল না। অ্যালুমিনিয়ামের বড়ো বড়ো চাকতি গোডাউনের মধ্যেই ঘুমিয়ে রইল। না, ঘুমিয়ে পড়লে তো বিদ্রোহ হবে না, তাই ওরাও জেগে থাকবে। এক পৃথিবী অপদার্থের মধ্যে ওরাই যা পদার্থ। বাকি সবের মধ্যেই তো খাদ।

    ম্যানেজারের ঘরটাকে সবাই গোল করে ঘিরে ফেলল আধঘণ্টার মধ্যেই। চিৎকার, গুঞ্জন, ফিসফাস, শোরগোল অর্থাৎ ম্যানেজার ঘেরাও। তিনি যতক্ষণে খেয়াল করেছেন, তার আগেই মেশিনিস্ট কানাই খেপে উঠেছে। একটা উটকো পাথর ততক্ষণে ভেঙেও ফেলেছে কাঁচের একটা জানলা। বিদ্রোহ এভাবেই আসে। কাউকে না জানিয়ে। স্লোগান এভাবেই তৈরি হয়। যেমন একইভাবে জ্বলে ওঠে আগুন।

    স্নেহাশিস চায়নি এমনটা হোক, কিন্তু একটা ধাক্কা দেওয়া জরুরি। ওই যে ‘আমরা এখনও বাঁচি’, কথাটা মাঝে মাঝে বলা খুব প্রয়োজন। নইলে বাঁচতে ভুলে যাবে হাজার হাজার মানুষ। মিথ্যে আশ্বাসে জিইয়ে রেখে দেশটাকে একটু একটু করে বাপের সম্পত্তিতে পরিণত করবে প্যাটেলের মতো মূর্খেরা। আর ম্যানেজার অন্ধ, বধির হয়ে বসে থাকবে দিনের পর দিন। রাতের পর রাত। এদিকে একটা চিরস্থায়ী রাতের বন্দোবস্ত করতে যে তারাই অগ্রজ, এটা মস্তিষ্কহীন শরীরে কোনোদিন প্রবেশ করবে না। তাহলেই অনুপ্রবেশ, অনুপ্রবেশ রব উঠবে।

    —তাহলে আপনারা অবস্থান তুলবেন না? ঠিক আছে। আমি দেখছি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে হয়তো ওরা ঢুকবে। মার, দাঙ্গা, চোরাগোপ্তা ছুরি, হকি স্টিক, রক্ত, গুমখুন... আচ্ছা, এই বলুন তো, আপনাদের নেতাসাহেবটি কে? মানে কার ফুসলানিতে আপনারা একত্রিত হলেন? কে, রাজু বলেছে না এইসব? জানতাম। ও ব্যাটা কদিন ধরেই উড়ু উড়ু করছে। কি রাজু, তুই তো?

    সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে শুরু করে। একটু ইতস্তত। চোখে মুখে উদ্‌বেগ। রাজু মুখটা গামছায় মুছে নিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে, ঠিক তক্ষুণি দত্তবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, “আমি ফুসলেছি। স্নেহাশিস দত্ত ফুসলেছে ওদের। হয়েছে? শান্তি?”

    ৪.

    বাবা মারা গেছেন, প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল। ফুটবল মাঠে হারুকে খুব একটা দেখাও যায় না ইদানীং। ফুটবল দেখলেই একটা ভয়, কতগুলো হায়না, আর ওর বাবার মুখটা বারবার চোখের সামনে ভাসে। মাঠের মধ্যে গেঞ্জি খুলে সেই দৌড়টাকে কিছুতেই আর মনে পড়ে না। ক্লাবের সবাই কেমন এড়িয়ে চলে। বলাইদা মাঝে মধ্যে ডেকে কথা বলে, মায়ের খোঁজখবর নেয়। প্রয়োজনে কিছু টাকাও গুঁজে দেয় হারুর হাতে। উচ্চমাধ্যমিকের আগে হারুকে তো বলাইদাই সামলেছে। পাক্কা সাড়ে তিন মাস স্কুল যেতে পারেনি ছেলেটা। ঘুমের মধ্যে চোখটা সামান্য লেগে এলেই, “চোপ শুয়োরের বাচ্চা। একদম চুপ। বেশি চোপা দেখালে এইখানেই পুঁতে দেব। কারখানার মালগুলোকে উসকানি দেওয়ার বেলায় মনে ছিল না...”

    স্নেহাশিসবাবু তখনও দমে যাননি। নিজের ছেলের সামনে অতগুলো কাঁচা খিস্তি শুনে লজ্জা পেয়েছিলেন বটে, তাই পরদিনই একেবারে ওপরমহলে খবরটা জানিয়ে দেন। রাজুকে সঙ্গে করে অফিসারের ঘরে পুরো ঘটনাটা খুলে বলেন। পলিটিক্যাল ইস্যুগুলোকেও তুলে ধরেছিলেন। এও বলেছিলেন, “আমাদের অস্তিত্বের সংকট। চাকরি গেলে বাঁচব কী করে? আসছে বছরে ছেলেটার স্কুল ফাইনাল দেবে। এর মধ্যে এত কিছু... ”, রাজু সামলায় দত্তবাবুকে। রুমাল বাড়িয়ে দেয় তার দিকে। দত্তবাবু অল্পেতেই কেঁদে ফেলেন কেন, সেটা বুঝতে পারে না রাজু। যুদ্ধ করতে নেমে অত সহজে কাঁদলে চলে? সবাই তো প্রথমেই ভেবে বসবে তুমি দুর্বল, হেরো। ইত্যাদি ইত্যাদি আরও অনেক কথা রাজু বলতে চেয়েছিল, পারেনি। অফিসারের কথায় চমকে উঠেছিল দুজনেই, “চাকরি গেলে যাবে। আমাদের কী দত্তবাবু? আমাদেরও প্রফিট দেখতে হবে, কি রাজু তাই তো? বাঙালি ইমোশান নিয়েই মরল। বাস্তবটা বুঝতেই পারে না।”

    কাজটা আর বেশিদিন নেই তার মানে। এ অনুমান স্নেহাশিস অনেক দিন আগেই করেছিলেন, ভেবেছিলেন এমনটাই হবে। তাদের খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দেওয়া হবে। বদলে আসবে নতুন সব ছেলে। যারা কোম্পানিকে সম্মান করবে না, মায়ের মতো করে ভালোবাসবে না, কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করবে না, ‘কী হে, আজ মুখ ভার কেন? বউদির সাথে আবার বাঁধল নাকি? চলো এক কাপ চা খেয়ে আসি...’

    এক সপ্তাহ কারখানা বন্ধ থাকল। এক সপ্তাহ স্নেহাশিস, নিবারণ, রাজু, কানাই, সবাই গেটের সামনে বসে থাকল। চিৎকার, স্লোগান, টায়ার জ্বালিয়ে দেওয়া, প্ল্যাকার্ড, সবই হল। এদিকে এক সপ্তাহ হারুর মা ঠাকুরের ছবি ছেড়ে উঠলেন না। তারপরেও পুলিশ, লাঠি চার্জ, হাসপাতাল, নাইট শিফটে নতুন ছেলে ঢুকল। ম্যানেজারবাবু একদিন স্নেহাশিসকে ডেকে বললেন, “আপনার রিটায়ারমেন্টের চিঠি এসেছে দত্তবাবু। আজকালের মধ্যেই পেপার ওয়ার্ক সেরে ফেলুন। পরশু থেকে বাড়ি বসে খাবেন। হোয়াট আ লাইফ!”
    —মানে? মাথার ব্যামো হয়েছে নাকি আপনার? আমার তো এখনও একবছর তিন মাস চাকরি আছে।
    —চাকরি ছিল। এখন আর নেই। এই যে চিঠি।
    ভাঙা কাচের জানলা দিয়ে তখন দিব্যি দেখা যাচ্ছে নিবারণ ক্যাবলার মতো পুরোটা শুনছে। খুব ঝড় উঠলে বটগাছে গাছের দেহে যেমন কাঁপুনি দেয়, সে ঠিক তেমন করেই কেঁপে কেঁপে উঠছে।

    ম্যানেজারের ঘর থেকে বেরিয়ে স্নেহাশিসকে উথালপাথাল ঢেউয়ের মতো দেখাচ্ছিল। এই সময় নিবারণ গেল কোথায়? আসলে নিবারণও কান্না লুকোনোর জন্যে পালিয়ে গেছিল। দত্তদাকে চিরটাকাল যে ছেলেটা সাহস জুগিয়ে এসেছে, আজকে এই এক চোখ নোনতা জলের পসরা নিয়ে দত্তদার সামনে দাঁড়াবে কোন্‌ সাহসে? আকাশ ভেঙে পড়েছে মাথার ওপরে। প্রত্যেকটা দরজা, প্রতিটা জানলা এই এক্ষুনি একসাথে বন্ধ হয়ে গেল। অন্ধকার। দারুণ অন্ধকার। হারু উচ্চমাধ্যমিকটা দিতে পারবে তো ঠাকুর? টলতে টলতে মেশিনের ঘরে ঢুকতে গিয়েই কয়েকজন ছেঁকে ধরল স্নেহাশিসকে। গায়ে হাত দেয়নি বটে, চশমাটা খুলে নিয়ে কোথায় যেন ভ্যানিশ করল। তারপর শুরু হল লুকোচুরি খেলা। জীবনের লুকোচুরিতে ধরা পড়ে যাওয়া ক্লান্ত স্নেহাশিস দত্তর এক সময় হাঁপুনি উঠল। মাথাটা ক্রমশ নীচু, আরও নীচু হয়ে যেতে যেতে বাড়ির বেলগাছে সজোরে ধাক্কা খেলেন।

    ৫.

    বাড়ি থেকে বেরোনো প্রায় বন্ধই হয়ে করে দিয়েছিল হারু। টিউশন পড়তে যা বেরোয়, কখনও আবার বেরোয় না। সকাল হলেই উঠোনের মধ্যে চাটাই পেতে বসে পড়ে। রোদ মাখে, রোদ বিলিয়ে দেয় ঘাসেদের, পাখিদের গল্প শুনে শুনে মনে হয়, একটা ডানা পেলে বেশ হত! একগুঁয়ে বাবাটাকে নিয়ে উড়ে যেতে পারতাম অনেক অনেক দূরে। কোনো বাধ্য নদীর ধারে বসে গলা ছেড়ে গান গাইতে পারত বাবা। ম্যানেজার, কোম্পানি, অবস্থানের পর অবস্থান, ভয়, মৃত্যুচেতনা, নিরুদ্দেশ, সমস্তটা ধুয়ে চলে যেত পলির গর্ভে। তাই একটা ডানা পেলে বেশ হয়!

    ঝড়জলের রাতে সবার সব রকমের বাধা কাটিয়ে আজকে ছাদে এসেছে সে। ছোটোবেলায় তো আর ছাদ ছিল না, টালির চালে কতক্ষণই বা পাছা ঠেকিয়ে বসে থাকা যেত! তবুও, সুযোগ পেলেই মই বেয়ে লাউগাছের মতো টালির চালে উঠে পড়ত সে। রোদের কিশোরী হয়তো এক্ষুনি তার ডানা দুটো হারুকে দিয়ে দেবে। কিংবা ঝড়ের মধ্যে দুটো অবাধ্য ডানা হয়তো উড়ে এসে পড়বে হারুদের চালে। এমনি এমনিই। তারপর হারু পাখি হয়ে যাবে। এক দেশ থেকে আর-এক দেশ, এক রূপকথা থেকে অন্য রূপকথা... উড়তে উড়তে কখন যেন ন্যাড়া ছাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছিল হারু। খেয়াল করেনি। দু-হাত ডানার মতো মেলে ধরে নিজের অন্তরেই হয়তো উড়ছিল সে। সেটুকুই বা কজন পারে। একটা দমকা হাওয়া ছাদের মধ্যে ফেলে দিল তাকে। আর-একটু হলেই তো...

    বৃষ্টির তেজ প্রচণ্ড রকমের বেড়ে গেছে এই কয়েক মিনিটে। ঝোড়ো হাওয়ার সাথে শিরশিরে শব্দ, হুড়মুড় করে নেমে এসেছে হারুর ছাদে। বুকটা ক্ষণে ক্ষণেই কেঁপে উঠছে, একটু ভয় ভয়ও লাগছে বটে, কিন্তু ছাদ থেকে হারু কিছুতেই নামবে না আজকে। ওর সব স্বপ্ন, ছেলেবেলায় অঙ্ক খাতার পিছনে সুপারহিরোদের ছবি, ব্যাটম্যানের স্কার্ফ, এক এক করে নষ্ট হয়ে যাবে। বেলগাছের ডালে ঝুলে থাকা বাবার মুখটাও অস্পষ্ট হয়ে যেতে পারে। এই সুযোগ। চোখ বন্ধ করে ঝড়ের মধ্যে শরীরটা ভাসিয়ে দিলেই কেল্লাফতে। একজোড়া ডানা ঠিক খুঁজে নেবে হারুকে। সে ভিজছে, অনবরত ভিজবে অসময়ের বৃষ্টিতে। মায়ের থেকে লুকোনো কান্না, ওষুধের দোকানে ধার, অপমান, চড়া সুদে ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। আর তারপর ম্যাজিক!

    এতক্ষণে একটু হলেও সামলানো গেছে ডানা দুটোকে। কিছুক্ষণ আগে তো বটগাছে জড়িয়ে পড়ে সে কী কাণ্ড! চেঁচালেও এই ঝড়ের রাতে কেউ শোনার নেই। একবার লাইটপোস্টে গায়ে দুম করে বাড়ি খেয়েছে বাঁ পাশের ডানাটা। হারুর মাথাটা ঝিম ধরে গেছিল। কাক ভেজা হয়ে গেছে অল্প সময়েই। এখনও তো সে ঠিক মতো উড়তেই পারল না। তার আগেই হাঁপিয়ে গেলে চলবে নাকি? বাবার মতোই তাকেও সবাই বলবে হেরো, হেরো। কিন্তু এবারে, এই এতক্ষণে, এতক্ষণে আয়ত্তে আনা গেছে।

    গোল দেওয়ার পরে সারা মাঠ জুড়ে হারু যেমন দু-হাত মেলে দৌড়ে বেড়াত। নিজেকে কখনও মনে হত এরোপ্লেন, কখনও দুরন্ত চিল, কখনও বা মাছরাঙা, কখনও ক্রিশ্চিয়ানো! আর সে কী চিৎকার! গোল গোল করে মাঠে ঘুরে, ডিগবাজি খেয়ে একেবারে যাচ্ছেতাই! কিন্তু আজকে চিৎকার করা যাবে না। তাই আগে একটু ইচ্ছেমতো উড়ে নিতে হবে। নিজের ক্ষমতার মধ্যে সবটুকু ঢুকে পড়লে তখন না হয় যাওয়া যাবে কোম্পানির নতুন কারখানার দিকে।

    মাঝরাতের দিকে বৃষ্টিটা ধরে গেলে, হারু উড়তে উড়তে এসে নামল কারখানার ছাদে। পুরোনো যা কিছু ছিল, সমস্তটাই ভেঙে ফেলে নতুন করে সেজেছে এই কারখানা। নিষ্প্রাণ, নিথর একটা কারখানা। কারখানা নাকি মৃত্যুপুরী! দেখে মনেই হয় না যে সৃষ্টিতে সক্ষম। বাঁজা সবেদা গাছের মতোই রাত হলে একা একা কাঁদে। বৃষ্টির শিহরণ শরীরে মাখলেও জন্ম হয় না প্রাণের।

    ৬.

    লোহার গেট টপকে কারখানার মধ্যে পা রেখে, যদি কোনো পুরোনো অনুভূতি বেঁচে থাকে, সেগুলোকে মন দিয়ে খুঁজে দেখছিল। যদি পেয়ে যায়, যত্ন করে তুলে রাখতে হবে। বাবার ভাঙা চশমাটা, নিবারণ কাকার চুরি যাওয়া হাতঘড়ি, যদি পেয়ে যায়! সকাল হলেই মায়ের মাথার কাছে সাজিয়ে দেবে।

    আজকে বোধহয় নাইট সিফটে কাজ হচ্ছে না। দুর্যোগের ভয়ে সবাই গুটিগুটি পায়ে বাড়ি চলে গেছে। স্নেহাশিসদের সময়ে এমনটা হত নাকি! প্রয়োজনে রাত জেগে পাহারা দিয়েছে দুজন দুজন করে, কিন্তু কারখানার কোনো ক্ষতি হতে দেয়নি। কিন্তু আজ হবে। দুটো ডানাকেই উন্মাদ বানিয়ে তুলতে হবে। একটা হিংস্রতায়, একটা ক্ষোভের সেলোফেনে মুড়ে ফেলতে হবে তাদের। কিছুক্ষণের জন্যে তারা শুধুই আঘাত হানবে। হিংসা ছড়াবে। প্রতিশোধের আদলে নিজেদের মতো করে বদলে বদলে যাবে তারা।

    কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়ের তেজ আরও বেড়ে গেল। বৃষ্টির উদ্দামতার কাছে নিষ্প্রাণ কারখানাটা মাথা নোয়াল। গোটা কারখানায় এখন তাণ্ডব। এখন ঝড়। প্রথমে লোহার গেটটা ভেঙে বেশিদূর উড়ে যেতে পারল না। টিনের চাল ফুটো করে ঝরে পড়ছে বৃষ্টি। দেয়ালে দেয়ালে ভাঙনের আনন্দে মেতে উঠল কারখানার অন্তর, অন্দর। এভাবেই ঝড় আসে। কাউকে না জানিয়ে।
    তারপর হারু দুটো ডানা মেলে সেই ছোটোবেলায় এরোপ্লেনের মতো উড়তে শুরু করে কারখানা জুড়ে। উন্মাদ দুটো ডানার সামনে অ্যালুমিনিয়াম, লোহা, কিছুই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল না। মেশিনের হাতল ভেঙে গেল, জেনারেটরের খোলস উধাও হল, ঝুলে থাকা যত ল্যাম্প, সব্বাই নিজেদের দৃষ্টি হারাল। টানা আধঘণ্টা ধরে গোটা কারখানাটাকে ছারখার করে দিয়ে বেরিয়ে এল হারু। কাচের ঘর, হিসেবের খাতা, লকারের চাবি, কাঠের দরজা, কিচ্ছু বাকি থাকল না। বিধ্বংসী ডানা দুটো এখন কী দারুণ ভাবে উড়ছে। মৃত্যু কী, ধ্বংস কাকে বলে, ওরা তো জানেই না। জানে শুধু উড়তে। ফুল হয়ে ফুটতে। প্রজাপতির গায়ে রং হয়ে খেলতে।
    ওপর থেকে দেখলে মনে হয় দত্তবাবু, নিবারণ, রাজুদের দাঁত বের করা হাসি মুখগুলো এতদিনে ফুটে উঠেছে। এবার সবাই শান্তিতে ঘুমোতে পারবে। হারু উড়ছে, হারু হাসছে, হারু আরও হাসছে, আরও কাঁদছে, আরও উড়ছে।
    ধুম জ্বর নিয়ে ঘুম ভাঙল হারুর। বৃষ্টি এখনও থামেনি। ছাদের পাঁচিলে ঠেস দিয়েই সারারাত ভিজেছে। সকালের আলোটাও যেন অজানা, অচেনা আনন্দে ছুটি নিয়েছে। সারারাত যে তারাই আলো হয়ে জ্বলেছিল হারুর সারা শরীরে। তাই সারা শরীরে অদ্ভুত ব্যথা। হাত দুটো টানটান করতে গেলেই প্রচণ্ড লাগছে। পিঠের দু-পাশে কী বেশ যেন খোঁচা মারছিল, হারু উঠে দাঁড়াতেই খসে গেল।
    মা বোধহয় এতক্ষণে ভেবে নিয়েছেন, তার ছেলেটা বুঝি... ছাদ থেকে জ্বর গায়ে নেমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে হারু। কাল রাতে একবার মনে হল যে, সে উড়ছে, উড়তে উড়তে কারখানায় ঢুকে সমস্ত... না থাক। ওই ছেলেমানুষি আর মানায় না। অনেকদিন তো হল। কিন্তু মা কোথায় গেল? সকালের ওষুধটাও খায়নি কেন? নিজের শরীরে এত ব্যথা, হাতে পায়ে এত যন্ত্রণা, হারু ডাকতেও পারে না। কাল রাতে আবার বাবাকে স্বপ্নে দেখেছে। মুখটা কিছুতেই ভুলতে পারে না কেন সে? কেন বারবার বেলগাছটা চাইলেও কেটে দিতে পারে না? ভুলে গেলেই যে এত ব্যথা, এত কষ্ট, এত স্বপ্ন, কিচ্ছু থাকত না। কিচ্ছু না। ছেলেমানুষিটাও হয়তো থাকত না। রোদ মেখে, রোদ বিলিয়ে দিয়ে দিব্যি চলত।

    “হারু, ও হারু, শিগগির ওঠ না বাবা। বুলাজেঠিমারা বলাবলি করছে কাল রাতের ঝড়ে কারখানা নাকি লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। সব জলে ভেসে গেছে। ঠাকুর এতদিনে মুখ তুলে চেয়েছেন। এই হতভাগা, তুই ঘুমোচ্ছিস এখনও? কী রে, ও হারু, হারুরে, শুনতে পাচ্ছিস মায়ের কথা?”, বলতে বলতে হারুর বিছানায় এসে বসে পড়ে বুড়ি। মাথাটা কোলের মধ্যে নিয়ে চুলে বিলি কাটতে কাটতে অনেক কিছু বলতে চায়। গলাটা ধরে আসে।

    এদিকে হারু উপুড় হয়ে মায়ের কোলের মধ্যে মাথা বেশি করে গুঁজে দেয়। জ্বরমাখানো গলায় বলে, “পিঠের এই দু-পাশটা ভীষণ ব্যথা করছে, একটু টিপে দাও তো!”
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • গপ্পো | ২১ জুলাই ২০২০ | ১৫৪১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন