এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  কূটকচালি

  • একটি কল্পবিজ্ঞান গল্প

    শমীক মুখোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    কূটকচালি | ২০ এপ্রিল ২০০৭ | ৯১৭ বার পঠিত
  • ২০০৭ সাল। মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকায়, কচ্ছ থেকে ইটানগরে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। কোনও খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন বেরলো না, টিভি রেডিওর কোনও চ্যানেলেই সম্প্রচারিত হল না সেই খবর, তবু এক কী আশ্চর্য ইথার তরঙ্গে অসমুদ্রহিমচলের তাবৎ যুবাকূলের কর্ণপটহে প্রবেশ করিল সেই বার্তা। আকূল করিল প্রাণ। পনেরো থেকে পঞ্চান্ন সমস্ত ভারতীয় যুবকের দল এক নিমেষে চার্জড হয়ে গেল। দীর্ঘ দু মাসের উপোসের দিন শেষ। শালা, ভাগ্যিস মাঝের ফেব্রুয়ারি মাসটা আঠাশ দিনের ছিল!

    এই মাঝের দুটো মাস কী নিদারুণ উদ্বেগেই না কেটেছে তাদের। লিটারেট ইল্লিটারেট বুর্জোয়া প্রলেতারিয়েৎ সমস্ত যুবককূলের মধ্যে এক স্পষ্ট বিভাজনরেখা তৈরি হয়ে গেছিল দেশব্যাপী। একটা কমিউনিটি, যারা হ্যাভস, অর্থাৎ কিনা, ব্যান হবার পূর্বে অ্যাকশন টিভির সেই কুখ্যাত অনুষ্ঠান রেলার দেখে এসেছে, আরেকদল, অবভিয়াসলি হ্যাভনট্‌স, তারা কখনও দ্যাখেই নি, মানে, দেখবার মত বলে ভাবেই নি, রাত্তির এগারোটায় এফটিভির মিডনাইট হট বা জি ক্যাফের বিকিনি ডেস্টিনেশন ছেড়ে যে অ্যাকশন টিভিতে বিনোদন খোঁজা যেতে পারে, তা তারা ভাবেই নি জাস্ট। ফলে, ব্যান হবার পরে হায় হায় পড়ে গেছিল তাদের মধ্যে। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মত হ্যাভস্‌দের কাছ থেকেই তাদের জানতে হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানের কথা, যা তাদের আদৌ তৃপ্ত করে নি। দুনিয়ার মোস্ট সেক্সুয়াল কমার্শিয়াল দেখানো হয় যে প্রোগ্রামে, সেই প্রোগ্রামে আদৌ এক ইঞ্চিও সেক্সি চামড়া না দেখিয়ে যে কেন্দ্রীয় সরকারের কোপদৃষ্টিতে পড়া যায়, এটা হ্যাভনট্‌সদের দল আদৌ বিশ্বাস করতে রাজি হয় নি। অসহায়ভাবে তাদের তৃপ্ত হতে হয়েছিল বন্ধ বাথরুমের অন্ধকারেই। কল্পনাবিলাসে। তারা ভেবে নিয়েছিল, হ্যাভ্‌সরা আসলে হেব্বি স্মার্ট, তাই অমন হট অনুষ্ঠানও তাদের কাছে 'কিচ্ছু না' মনে হত, অথবা তারা জেনেশুনেই বলছে না কিছু, ক্রুয়েলের মত উপভোগ করছে হ্যাভনট্‌সদের এই আকুলিবিকুলি। যেন তাদের ভাবখানা এই : যা শালারা, ওমুক চ্যানেলে বিকিনি দেখেই পেট ভরা, যা পেয়েও দেখিস নি, তা তোদের সাথে শেয়ার করব কেন? চেষ্টা করে দ্যাখ ল ভিডিও বা ইউটিউবে দু একটা ক্লিপ পেতে পারিস যদি।

    কিন্তু হায়! সে মোলাসেসেও স্যান্ড। কোনও ইন্টারনেট সাইট সার্চ করেও বেরলো না ওয়ার্ল্ডস সেক্সিয়েস্ট কমার্শিয়ালের একখানি ভিডিও-ও। অতএব ফ্রাস্টুতে ভর করে আবার সেই বাথরুম, আবার সেই অন্ধকার, সেই কল্পনাবিলাস।

    ইতিমধ্যে রাজনীতিতেও অনেক পালাবদল ঘটেছে, তাবড় মিডিয়াকূলের অপ্রিয়রঞ্জন সেই বিতর্কিত মন্ত্রী এখন তথ্য-সম্প্রচার ছেড়ে পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রকে যোগ দিয়েছেন, পুরনো কংগ্রেসি ভাবধারা অনুসরণ করে রায়গঞ্জে একখানি ফ্যাক্টরি উদ্বোধন করেছেন, যেখানে পরিবার নিয়ন্ত্রণের উপকরণ তৈরি করা হয়, খাদির সাহায্যে। দেশে তো বটেই, বিদেশেও আস্তে আস্তে পপুলার হচ্ছে সেই সব উপকরণ।

    তো, রাজনীতির কচকচি থাক, সুশীল পাঠক, সুশীলা পাঠিকা, আসুন আমরা ফিরে যাই প্রসঙ্গে। হ্যাঁ, সেই প্রসঙ্গ, দুই মাস নিষিদ্ধ থাকার পরে আপেল গাছে আবার ফল ধরতে চলেছে আজ রাত বারোটায়। দু মাস ধরে ঝিরঝির করতে থাকা সাঁইত্রিশ নম্বর চ্যানেলে আবার ফুটে উঠবে সেই অ্যাক্‌শন চ্যানেল, তার যাবতীয় সেক্সিয়েস্ট কমার্শিয়ালসহ। এবার আর মিস করার কোনও সিন নেই। সমস্ত হ্যাভনট্‌সদের দল সেঁটে বসে গেছে নিজ নিজ ড্রয়িংরুমের সোফায়। হ্যাভ্‌সরাও অবশ্যই, নিজেদের পুরনো অভ্যেস অনুযায়ী, একই ভাবে সেঁটে গেছে।

    কেবল অপারেটরের কাছ থেকে আশ্বাস পাওয়া গেছে, আজ রাত থেকেই সম্প্রচার শুরু হবে। বারোটার ঘরে কাঁটা প্রায় ছুঁইছুঁই। তবু চলে না কেন? উদ্বেগ চেপে রাখতে না পেরে জনৈক হ্যাভন্‌ট আরেক হ্যাভনট্‌কে ফোন করে ফেলল, কী বে শালা, চলে না কেন? সেই শালা হ্যাভনট্‌ উদ্বেগ ট্রান্সফার করে দিল কেবল অপারেটরের ফোনে, সুমধুর বচনে।

    বারোটা বেজে দুই মিনিটে আচমকা সমস্ত এলাকা জুড়ে একটা স্পষ্ট অস্পষ্ট মিশিয়ে হইহই শোনা গেল, সাথে সাথে চ্যানেলের ঝিরঝির মুছে গিয়ে ফুটে উঠল অ্যাকশন টিভি। এইবার। এইবার শিওর আবার দেখা যাবে সেক্সিয়েস্ট কমার্শিয়াল, সেক্সিয়েস্ট মিউজিক ভিডিও, সেক্সি সেক্সি আরও কত কী!

    কিন্তু ... এ কী? নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না! এ কি অ্যাকশন টিভি? চোখ ধাঁধানো এক উজ্জ্বল সমুদ্রসৈকতে পায়চারি করে বেড়াচ্ছেন বাবা শ্যামদেব, সঙ্গে হন্টনরত পুরনো ব্রিটিশ ঢংয়ের টেইলকোট পরা এক সাহেবকে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন; কীভাবে তিনি ক্যানসার আর এইডস রোগ নিরাময় করেন তাঁর স্বপ্নাদ্য জড়িবুটি আর যোগ-প্রাণায়ম দিয়ে। অনুষ্ঠানের নাম ওয়ার্লডস হটেস্ট মেডিসিন্‌স। শ্যামদেব বলছেন, এইডস আটকাতে কন্ডোম নয়, তাঁর যোগব্যায়ামই বেস্ট।

    সমস্ত রাতজাগা ভারতীয় তখন হাঁ। এ কী হল? এটা অ্যাকশন টিভি তো? এক ফচকে হ্যাভনট্‌ মাস এসএমএস পাঠিয়ে দিল, সেই এসএমএস ফরোয়ার্ড হয়ে গেল সারা ভারতে, junta, w8 til 12-30. nxt slot has lotta hot stuff । কোত্থেকে যে খবর পাওয়া গেল, কে যে কনফার্ম করল, কিছুই জানা গেল না, কিন্তু বুভুক্ষু জনতা বেশ খেয়ে নিল ব্যাপারটা। বাকি সময়টা এফটিভি দেখে কাটিয়ে সাড়ে বারোটায় আবার দলবদ্ধ চ্যানেল চেঞ্জ টু অ্যাকশন টিভি।

    অচিরাৎ, হায় হায় ধ্বনি ঠিকরে পড়ল আকাশে বাতাসে। পরের অনুষ্ঠানের নাম, ওয়ার্লড্‌স কুলেস্ট রেসিপিস। সেখানে সাউথ ইন্ডিয়ান স্টাইলে রাজমা রান্না শেখাচ্ছেন এক বাঙালি মহিলা, এক গলা ঘোমটা টেনে।

    ফ্রাস্ট্রেশনের চূড়ান্তে পৌঁছে টিভি অফ করতে বাধ্য হল দর্শককূল, এবং দেশের আসন্ন দুরবস্থার কথা ভাবতে ভাবতে বিমর্ষ চিত্তে বিছানায় ফিরে গেল ভারতবাসী, হ্যাভস এবং হ্যাভনট্‌স।

    পরেরদিন খবরের কাগজে বড় করে খবর বেরলো, অ্যাকশন টিভি রাতারাতি আবার ব্যন, এ বার দশ মাস দশ দিনের জন্য। স্টেপ নিয়েছে স্বাস্থ্য এবং পরিবারকল্যাণ মন্ত্রক। এইডস নিয়ন্ত্রণে কন্ডোমকে কার্যকরী না বলার জন্য শ্যামদেব এবং অ্যাকশন টিভির ডিরেক্টর দুজনকেই শো কজ করেছেন সেই অপ্রিয়রঞ্জন মন্ত্রী। সঙ্গে সামুদ্রিক হাওয়ায় শ্যামদেবের ধুতির নিম্নাংশ হাঁটুর ওপর উঠে গেছিল বলে দেখা গেছিল আগের রাতের অনুষ্ঠানে। এইভাবে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের রোমশ পা এবং অনাবৃত হাঁটু দেখানো ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের পরিপন্থী, তাই এ বার শাস্তি আরও কড়া।

    সাঁইত্রিশ নম্বর চ্যানেলে এখন কেবলই ঝিরঝির, কেবলই হতাশার দীর্ঘশ্বাস।

    এক মাস বাদে কেবল অপারেটর সেখানে আস্থা চ্যানেল ঢুকিয়ে দিল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • কূটকচালি | ২০ এপ্রিল ২০০৭ | ৯১৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন