০৪.০৪
যেদিন মেয়রের সময় হয়য়, মার্কো পোলো সেদিন তাঁর কাছে পৃথিবীর বৃত্তান্ত দিয়ে আসেন। মেয়র এক একদিন তাঁকে তলব করেন। আসুন এক দান দাবা হয়ে যাক। জয়িত্রী একদিন ছুটিতে যাক।
জয়িত্রী বলল, সে একা, ছুটিতে যাওয়া মানে একা ঘরে বসে থাকা। তার বান্ধবীরা রবিবারটিতে বেরয় বয় ফ্রেন্ড নিয়ে। কাফেতে যায়, অপেরায় যায়, পার্কে যায়, নদীর ধারে যায়, সেজান লেকে বোটিং করে, অথবা বাড়িতে জমায়েত করে, সকলেই কিছু কিছু নিয়ে আসে, কেউ বিরিয়ানি করে আনে, কেউ মাটন কিংবা বিফের একটা পদ, কেউ সব্জি, কেউ মিষ্টি নিয়ে আসে, আর ওয়াইন কিংবা হুইস্কিও কেউ নিয়ে আসে।
মার্কো বলেছে, এই রকম ঠিক নিউ ইয়র্কে দেখেছিলাম, কিন্তু এখন কি তা হতে পারে, এখন মানুষ কোথাও যায় না, ভয় পায়, কবে বেরবে ভ্যাকসিন, তার জন্য অপেক্ষা করছে, প্রতিদিনই কেউ না কেউ খবর দিচ্ছে , অমুক দেশে অমুক সময় বেরিয়ে যাবে ভ্যাকসিন, কিন্তু সমস্তটাই আশ্বাস ।
তাহলে ঐ সব শহরের অপেরা হাউস? জয়িত্রী বলল।
অপেরা হাউস, রঙ্গালয়, সিনেমালয়, শপিং মল… সব ভুতুড়ে বাড়ি হয়ে পড়ে আছে, আমি অবাক হয়ে ভাবি সেজান শহরে সেই ঘাতক প্রবেশ করেনি, এখানে কি ঈশ্বর বাস করেন ?
জয়িত্রী বলল, না মেয়র বসত করেন, জয়িত্রী বসত করে, আমি শনি রবি বাড়িতে বসে অপেক্ষা করব অ্যালেক্স যদি ফোন করে, চেষ্টা করব তার সঙ্গে যোগাযোগের, না হলে শুধু ঘুমোব, আপনি মেয়রের কাছে যান দাবা খেলতে খেলতে গল্প করবেন, মানে কোন শহরে কীভাবে মানুষ মরছে, সেই কথা শোনাবেন।
খবরিয়া পেনসিলিয়া কী লিখলঃ
দুপুরে টেলিভিশনে দেখলাম ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা গত ২৪ ঘন্টায় ৪০০-র কাছকাছি বেড়ে গেছে। মোট আক্রান্ত ২৯০০-র উপরে। মহারাষ্ট্রে আক্রান্ত বাড়ছে। ভয় মুম্বইয়ের ধারাবি বস্তি নিয়ে। সেখানে যদি এই ভাইরাস ঢুকে পড়ে ভয়ানক কান্ড হবে। কলকাতায় আমাদের বেলগাছিয়া, রাজাবাজার, মেটিয়াবুরুজে এমন ঘিঞ্জি বসতি আছে। তা নিয়ে ভয়। তারা বিমানে করে আনবে না। কিন্তু যদি সংক্রামিত হয়ে যায় অন্য কোনোভাবে, তা হয়ে উঠবে ভয়ঙ্কর। টেলিভিশন এও বলল, করোনা আক্রান্তর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হবে জুনের মাঝামাঝি নাগাদ। সেপ্টেম্বর অবধি লকডাউন চলতে পারে। এই অনুমানের সূত্র আমেরিকার গবেষকদের মতামত। কী জানি এসব খবর দিয়ে চ্যানেলটি মানুষের আতঙ্ক কেন বাড়াচ্ছে। যা হবে কি হবে না, তার নিশ্চয়তা নেই, তা টেলিভিশনে দেখিয়ে বুকে কাঁপুনি ধরান কেন? এর ফলে টেলিভিশনের ঐ চ্যানেল দেখা বন্ধ করতে হবে নাকি ? খবর না পেয়ে এসবও খবর ? খবরের আরো সূত্র স্যোসাল মিডিয়া। সেখানে এক দিগগজ লিখেছেন, ইতালিতে নাকি ৮০ বছরের উপর করোনা আক্রান্তদের হাতে প্যারাসিটামল ধরিয়ে দিয়ে গাছ তলায় বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। খবরের সূত্র কী? এমন ভয় দেখান পোস্ট করে তিনি ভাবলেন বড় কিছু দিলাম। তাতে একজন মত প্রকাশ করল, আমাদের এখানেও এমন হবে। হবে, তুমি জেনে বসে আছ ? ইতালিতে হয়েছিল এমন তা তোমাকে ইতালির সেই অসহায় বৃদ্ধ বলেছেন ? গাছতলায় বসিয়ে দেবে কেন পুজো হয়ে যাওয়া কার্তিক কী মা শেতলার মূর্তির মতো? তাঁর বাড়ি নেই। মিথ্যার সূত্র স্যোসাল মিডিয়া-- হোয়াটস আপ, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি। সকলেই বিদ্যা ফলাচ্ছেন। সকাল থেকেই তাঁদের কাজ হলো নানা রকম ভিডিও, গুড মর্নিং, মনে কর শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর ইত্যাদি আপনার কাছে পাঠানো। আর উপদেশ দিয়েই যাওয়া। প্রথম প্রথম উপদেশ ভালো লাগত। সত্যি হতে পারে, গরম জল, গরম দুধ নাকি করোনায় অব্যর্থ। এই মেসেজ হোয়াটস আপে কত পেলাম...। তবে গরম জল, চা খেলে কাশির প্রকোপ কমবে এ আর নতুন কথা কী।
এই আপতকালীন সময়ে মানুষের নির্বুদ্ধিতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। ফেসবুকে এক কবিতা ঘুরছে, কখনো সেই কবিতার নাম শঙ্খচিল, কখনো তার নাম ‘মহামারী’। কখনো তা জীবনানন্দের কবিতা, কখনো তা শঙ্খ ঘোষের, কোভিড-১৯ এর মতো সে মিউটেট করেই যাচ্ছে। প্রতিপাদ্য হলো ‘ আমাদের দেখা হোক মহামারী শেষে...আমাদের দেখা হোক জিতে ফিরে এসে...আমাদের দেখা হোক বীজানু ঘুমালে---ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁর কন্যা শ্রাবন্তী ভৌমিক জানালেন, এই কবিতা তাঁর বাবার নয়। বাবার নামে যা ঘুরছে তা কে লিখেছে কেউ জানে না। ঘরে বসে যে যা পারছে করছে। এত ভিডিও, এত কার্টুন, এত সব ভুয়ো সংবাদ আসার বিরাম নেই। সংবাদ ভুয়ো হয় জানি। গুজব রটিয়ে এক এক গোষ্ঠী এক একরকম স্বার্থ সাধন করে। কিন্তু কবিতার গুজব এই জাতিই পারে।
মার্কো বললেন, একজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল কলকাতায়। জয়িত্রী তার কথা শোনো। সে অমলেন্দু।
জয়িত্রী বলল, কিন্তু ঐ যে কে বলেছিল ইতালিতে বৃদ্ধদের চিকিৎসাই করা হচ্ছে না, সত্য ?
আমি তো আসিনি ইতালি থেকে, আমি তো যাচ্ছি ইতালির পথে।
আমি শুনেছিলাম বৃদ্ধদের জন্য এই ভাইরাসের সৃষ্টি, বৃদ্ধরা সমাজের বোঝা, পেনশনভোগী, তারা চলে গেলে দেশের ক্ষতি হবে না।
কে বলেছিল তোমাকে ?
হোয়াটস আপে মেসেজ পাঠিয়েছিল অ্যালেক্স, বলেছিল এই ভাইরাস তাকে মারবে না, তার স্যারকে মেরে দিয়েছে, তিনি জিনিয়াস ম্যাথমেটিসিয়ান ছিলেন, অলেক্সের গাইড।
কত তরুণ আক্রান্ত হয়েছে জানো।
অ্যালেক্স যা বলে আমি তাই জানি।
তুমি অমলেন্দুর কথা শোনো,
অমলেন্দু সরকার একা মানুষ। স্ত্রী নেই। পুত্র আমেরিকার ডেট্রয়েট শহরে থাকে। কন্যা বিবাহের পর বারাসতে থাকে। মস্ত ফ্ল্যাটে সে একা। খুবই সাধারণ জীবন তার। কাজের লোক সকালে রেঁধে দিয়ে যায়। কাচাকুচি, বাসন ধুতে আর একজন। এখন একজন আসছে না। রান্নার দিদি আসছে। বারণ করেনি। যদি আসে আসুক। না এলে ডাল আলু সেদ্ধ খাব। ওষুধ ছিল না। একদিন বেলায় বেরিয়ে অনেক ঘুরে পেয়েছে। অমলেন্দু সরকারকে আমি এটি এম থেকে টাকা তুলে দিয়েছিলাম একদিন ভোরে। সে এসব ভালো পারে না। এই একা থাকার ভিতরে অমলেন্দুর আনন্দ ছিল দুবেলা বেরোন। হাঁটা। অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে প্রাতঃভ্রমণের সময়। তাদের নিয়ে হেঁটে, ব্যায়াম করে, বাজারে গিয়ে, সকালের ঘন্টা দুই-আড়াই ব্যয় হয়ে যেত। বিকেলে তার ব্যানারজিদা আছেন। তাঁর সঙ্গে ঘোরে। এই লকডাউনের কালে অমলেন্দুর হয়েছে খুব বিপদ। দুবেলা হাঁটা বন্ধ। একেবারে একা। সকালে বেরতে পারলেই তার নিঃসঙ্গতা কাটে। সকালেই আমার সঙ্গে তার দেখা হয়। কথা হয়। আমরা একসঙ্গে চাকরি করতাম। অমলেন্দু সরকার আমার সিনিয়র ছিল। কদিন অমলেন্দুর ঘুম নেই। না হাঁটতে পারলে ঘুম হবে কী করে ? প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে। রাতে অনেকবার উঠতে হয়। অমলেন্দু ফোনে আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমার ঘুম হয় কি না, না হেঁটে ? হয়। অমলেন্দু বলল, তার হয় না। কিন্তু সে পরদিন আবার বেরবে। কেউ কেউ বেরচ্ছে। দূরে দূরে হাঁটছে। সে ও তা করবে।
কারো সঙ্গে কথা বলো না, কাছাকাছি যেও না। আমি উপদেশ দিলাম।
অমলেন্দু বলল, যাব না, গেলেই বা কী, ৭২ হয়ে গেছে...আমার নিজেকে নিয়ে চিন্তা নেই, ছেলে কতদূরে আছে সেই ডেট্রয়েট, আমার বউমার সন্তান হবে, মে মাসে ডেট, কী যে হবে, ঘুম আসে না রাতে, ছেলে মানুষ করলেই বিদেশ পাঠিয়ে দিতে হবে, এ কেমন দিন এল, আমেরিকায় কী আছে, আমেরিকা তো শেষ হয়ে যাচ্ছে। দুর আমার কী হবে। না হাঁটতে পারলে আমি ঘরে বসেই শেষ হয়ে যাব…, ভোরে আমি বেরবই, অন্ধকার থাকতে বেরিয়ে পড়ব না হয়…।
শুনতে শুনতে জয়িত্রী বলল, তুমি কত মানুষকে চেন মার্কো।
মার্কো বলল, তোমাকেও চিনতে হবে, সাংবাদিকতা করবে, মানুষ না চিনে কী লিখবে। একরাম আলির সঙ্গে কবে কোথায় দেখা হয়েছিল প্রথম মনে নেই, তিনি সাংবাদিকতা করতেন। কবিতা লেখেন। জীবন চরিত লেখেন, সেই একরাম আলি কলকাতাবাসী, কিন্তু লকডাউনের আগে গিয়েছিল দেশের বাড়ি বীরভূম জেলার প্রান্তদেশে প্রায়। সেখান থেকে সাঁওতাল পরগণা কাছে।
তারপরই লক ডাউন। একরামকে প্রতিদিন কতগুলি জীবনদায়ী ওষুধ খেতে হয়। সে তো পর্যাপ্ত ওষুধ নিয়ে যায়নি। অনির্দিষ্ট কাল বিনি ওষুধে গ্রামে পড়ে থাকবে কী করে ? রামপুরহাট থেকে দূরে, সাঁওতাল পরগণা সংলগ্ন এক গ্রামে ওষুধ মিলবে কীভাবে ? সে ফেসবুকে ওষুধের জন্য আবেদন করেছিল। খুব সাড়া না পেয়ে জেলা শাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর অনুমতি পত্র সঙ্গে নিয়ে একটি গাড়ি ভাড়া করে কলকাতার দিকে যাত্রা করে। ফোনে বলছিল একরাম। সমস্ত রাস্তা, রাজ্য সড়ক থেকে জাতীয় মহাসড়ক ধুধু। টোল ট্যাক্স নিতেও কেউ বসে নেই। সেই শক্তিগড়ের মিষ্টান্ন ভান্ডারগুলি সব শাটডাউন। রাস্তায় পশু পক্ষী, গাছ গাছালি আছে মানুষ নেই। মানুষ নজরে এসেছে ডানকুনি পেরিয়ে। কলকাতা যত কাছে আসে, মোড়ে মোড়ে জটলা। তবে কম। একরাম ফিরে এসে শ্বাস নিতে পেরেছে। ওষুধ পাবে তো।
০৫.০৪
মার্কো এসেছেন মেয়রের কাছে। সেই বড় জানালা। বহুদূর অবধি দেখা যায় পশ্চিম। মেয়র দাবার বোর্ড পেতে সৈন্য সামন্ত সাজিয়ে নিচ্ছেন, মার্কোর মনে পড়ছে সেই অ্যান আরবর শহরের কথা...। সেই হিমেল বাতাস, বাড়ির সামনে তুষার জমাট বেঁধে আছে, মেয়র শুনুন।
অমলেন্দুর পুত্র যেখানে থাকে সেই ডেট্রয়েটের কাছে অ্যান আরবরেই বিশ্বদীপ থাকে। বিশ্বদীপ চক্রবর্তী ডেট্রয়েটের মোটর কারখানার ইঞ্জিনিয়ার। খুব ভালো গল্প লেখে। তার কোম্পানি বন্ধ। শাটডাউন। কারণ এখন মোটরগাড়ি বিক্রি হচ্ছে না। অ্যান আরবর মিশিগান শহর সংলগ্ন। মিশিগানে সংক্রমণ হয়েছে ভালো। অ্যান আরবরে কম। জনবসতি কম। ছবির মতো শহর। বাড়িগুলো দূরে দূরে। আমেরিকায় সবচেয়ে আক্রান্ত নিউইয়র্ক, লসএঞ্জেলস এবং সিয়াটোল। চিনের উহান থেকে সরাসরি বিমান যোগাযোগ ছিল এই তিন শহরের। উদ্ভ্রান্ত হয়ে আছে বিশ্বদীপ। বন্ধুরা থাকে ঐসব শহরে। অর্থনীতি ধসে যাচ্ছে। কী হবে ভবিষ্যৎ অজানা। আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করতে লাগল বিশ্বদীপ। খোঁজ নিতে লাগল। বলল, তুষারপাত হয়েই যাচ্ছে। ডেট্রয়েটে কালো মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বেশি। তারা একসঙ্গে অনেকে থাকে। দারিদ্র তাদের সঙ্গী। বলতে বলতে বিষণ্ণ হয়ে গেল বিশ্বদীপ।
লস এঞ্জেলসের জীবন
যশোর ঝিনাইদহর ছেলে জীবন আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী। জীবনের পরিবার ঢাকায় থাকে। ঢাকায় থাকা অনেক সেফ। যাদের দ্বারা সে আক্রান্ত হয়েছিল ঢাকায়, তারা তার পরিবারকে চিহ্নিত করতে পারবে না। জীবন ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে আছে। গ্রিন কার্ডের জন্য অপেক্ষা করছে অনেকদিন। ভোরে ওদের দেশে যখন বিকেল তখন আমার ফোনে উল্লসিত হয়ে ওঠে গৃহবন্দি জীবন। লসএঞ্জেলস একটু উষ্ণ প্রকৃতির এলাকা। তাই হয়ত নিউইয়র্কের মতো অতটা হয়নি। জীবন লসএঞ্জেলস থেকে বলল, মরছে ইমিগ্রান্ট, হিস্পাহানিরা, গুয়াতেমালা, সান সালভাদর, পানামা, মেক্সিকোর মানুষ। তারা খুব পারিবারিক। তাদের অনেক ছেলেমেয়ে হয়। তাদের মেয়েরা বিয়ের আগেই সন্তান ধারণ করে ফেলে। তারা একসঙ্গে অনেকজন থাকে বলে তারাই মরেছে বেশি। বাংলাদেশি বা ভারতীয়রা কেউ মরেনি। তবে ব্ল্যাক আমেরিকানদের অবস্থা খারাপ। তারা আবার বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করে। তাদের মৃত্যুও তেমন হয়নি। সংক্রামিত হয়নি বলে। জীবন আগে চাকরি করত সেভেন ইলেভেন নামে এক বিক্রয় বিপনিতে। এখন করে আমাজনে সপ্তাহে দুদিন। আর এক জায়গায় তিনদিন। কিন্তু পনের দিন বিপনিতে যাচ্ছে না করোনার ভয়ে। ঐ শহরে সে একজনের সঙ্গে রুম শেয়ার করে থাকে। বাড়িতে বসে অনলাইন কিছু করতে চাইছে। করছেও। সে আমাকে বারবার বলল, দাদা, বাইরে যাবেন না, একদম না। কতবার এক কথা বলল জীবন। দুদিনের পরিচয়। সে বলল, একটা গাড়ি কিনতে পেরেছে। দাদা আর একবার আসুন। আমি শর্ট ফিল্ম মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িত এদেশে। আমার সঙ্গে লাতিন আমেরিকান ইমিগ্রান্টদের যোগাযোগ আছে। আপনি আসুন দাদা। আমরা লকডাউনে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি। কিন্তু আমরা আসলে যুক্ত হয়ে যাচ্ছি আরো আরো। কোভিড-১৯ ভাইরাস আমাদের আরো একাত্ম করে দিয়েছে। জীবন কতবার যে বলল, দাদা, আপনি বেরবেন না। ভোরেও না। ঘরে থাকুন দাদা, ঘরে থাকুন।
আজ খবর পেলাম দক্ষিণ কলকাতায় রাতে শিয়াল, ভাম বেরিয়ে আসছে। দিনেও দেখা যাচ্ছে তাদের। রবীন্দ্র সরোবর এলাকায় শিয়াল আছে অনেক। শব্দের ভয়ে তারা বেরোয় না। এখন সব নিস্তব্ধ। তারা নিশ্চিন্তে ঘুরছে ফিরছে। বন দপ্তর লক্ষ্য রাখছে। আজ হোয়াটস আপে নিউইয়র্কের টাইমস স্ক্যোয়ারের ছবি দেখলাম। খা খা করছে জায়গাটি। ওখানেই ব্রডওয়েতে নিউইয়র্কের বিখ্যাত নাট্যমঞ্চগুলি। সব বন্ধ। একজন ফেসবুকে তারাপদ রায়ের কবিতা পোস্ট করেছেন, একা মানুষ কতরকমে সময়কে পার করতে চাইছে। অনেকদিন পর তারাপদ রায়কে পড়ে বুক থম্থম করে উঠল।
এক জন্ম ~ তারাপদ রায়
অনেকদিন দেখা হবে না
তারপর একদিন দেখা হবে।
দুজনেই দুজনকে বলবো,
‘অনেকদিন দেখা হয় নি’।
এইভাবে যাবে দিনের পর দিন
বত্সরের পর বত্সর।
তারপর একদিন হয়ত জানা যাবে
বা হয়ত জানা যাবে না,
যে তোমার সঙ্গে আমার
অথবা আমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।
কী হবে জানি না। সামনে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। বন্ধু তোমার সঙ্গে দেখা হবে কি হবে না, যদি হয় কবে হবে তা জানা নেই। বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। হয়েই যায়।
খবরিয়া পেন্সিলিয়া লেখেন
০৫.০৪
দুপুরে দেবাঞ্জন চক্রবর্তী ফোন করেছিল। একটি খবর দিল, আমাদের এই এলাকায় কৃষ্ণমল্লিক লেনে তার বন্ধুর দাদা কোভিড ১৯-এ মারা গেছেন। মৃত্যুর পর তাঁর লালারস পরীক্ষার রিপোর্ট আসে পজিটিভ। তাদের পুরো পরিবারকে পুলিশ তুলে নিয়ে রাজারহাটে কোয়ান্টেরিনে পাঠিয়েছে। দেবাঞ্জনের ভাই খবর দিয়েছে দাদাকে। সে এখানে দেবাঞ্জনদের পুরোন বাড়িতে থাকে। আমি ভাবছিলাম ঐদিকে ডায়মন্ড টি সেন্টারে যাব চা আনতে। দেবাঞ্জনের কথায় কুঁকড়ে গেলাম। এত কাছে এসে গেছে ? দুপুরে আগাথা ক্রিষ্টির গল্প পড়তে পড়তে সব ভুলতে চাইলাম। পারলাম না। রেখে দিলাম আগাথা ক্রিস্টি। মহামারির ভয় চেপে বসছে। গত দুদিন ধরে পড়েছি গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেজ প্রণীত ‘ক্রনিকল অফ আ ডেথ ফোরটোল্ড’। প্রেম ও মৃত্যুর অভাবিত এক বিবরণ, যার সমস্তটাই বলে দেওয়া আছে, কিন্তু সমস্তটাই ক্রমশ অচেনা হয়ে যাচ্ছে। আজ ৫-ই এপ্রিল। আজ রাত ন’টায় ঘরের আলো নিভিয়ে আলো জ্বালাতে বলেছেন ভারতের প্রধান মন্ত্রী। এখন সমস্ত দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। নিজামুদ্দিনের জমায়েত হোক, রাম নবমী হোক, সবেতেই জমায়েত হচ্ছে ভালো রকম। ধর্মে মাথা মুড়িয়ে দিয়েছে মানুষ। জমায়েত থেকে কে কোথায় ভাইরাসে সংক্রামিত হয়ে লুকিয়ে পড়েছে তা খোঁজা হচ্ছে। কী দাঁড়াবে ভবিষ্যৎ অজানা। কতদিন গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হবে, জানি না। এখন এসব কেন বুঝতে পারছি না। সংকল্প, একাত্মতা কি এই ভাবে হয় ? মন বলছে এখন এই ধারাবাহিক মৃত্যর দিনে এসব ঠিক না। দুপুরে সিডনির তপনজ্যোতি মিত্রকে ফোন করলাম। আমার সদ্য যৌবনের বন্ধু তপনজ্যোতি বহুদিন ঐ দক্ষিণ গোলার্ধে। ছিল নিউজিল্যান্ডে বহুদিন। এখন অস্ট্রেলিয়ায়। আমাদের দুপুর তিনটেয় ওদের সিডনিতে রাত নটা। আগের দিন ২৪ ঘন্টা কাজ করেছে। ও ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাঙ্কিং সেকটরে কাজ করছে। সকাল দশটায় কাজ শেষ করে ঘুমিয়েছে। এখন ওদের কাজের চাপ বেশি। ইস্টার পরব সামনে। না, সিডনি খোলা নেই। সমস্ত পরব বন্ধ হয়ে গেছে সরকারি ফরমানে। দিন পনের আগে ও বলেছিল, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ফুরিয়ে যাচ্ছে মানুষের আতঙ্কের কারণে। আজ বলল, সব কিছু শান্ত হয়ে মেনে নিয়েছে মানুষ। প্রথম সকালে সিনিয়র সিটিজেনরা বেরবেন। তারপর অন্যরা। হ্যাঁ, ইস্টার পরব, ক্রিসমাস পরবে কেনাকাটা বেশি হয়। পরব বন্ধ হলেও অনলাইনে কেনাকাটা হচ্ছে। বেশ চাপ আছে। ঘরে থেকেই মানুষ উৎসব করবে। নানা কথা হতে লাগল। লকডাউনের সুফল ফলতে আরম্ভ করেছে। স্পেন, ইতালি, ব্রিটেনের মতো অবস্থা ভয়ানক হয়নি অস্ট্রেলিয়ায়। তাদের সিডনিতে। তপনজ্যোতি বলল, দেখ অমর, ভাইরাস, এই যমদূতের ঘুম ভাঙিয়েছি আমরা। এমন মহামারি কতবার হয়েছে পৃথিবীতে। আরো হবে। আরো। দূষণ, হিমবাহর গলন এসব শুনেছ তো, আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। তপনজ্যোতি হিমবাহর নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার কথা বলল আমাকে। নিউজিল্যান্ডে থাকার সময় আওরাকির মাউন্ট কুক ন্যাশানাল পার্ক দেখতে গিয়েছিল তারা। আওরাকি নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণের দ্বীপভূমি। নিকটেই একটি শহর আছে ট্যাইজেল। মাউন্ট কুক নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় পর্বতমালা। মাউন্ট কুক অঞ্চলেই গিয়েছিল তপনজ্যোতিরা। তারপর তাসমান হিমবাহ, হুকার হিমবাহ, লেক পুকাকি, লেক টেকাপো দেখেছিল। সবই হিমবাহ গলে জন্ম নিয়েছে। হেলিকপ্টার তাদের নামিয়ে দিয়েছিল হিমবাহর উপর। সে এক অনন্ত তুষার স্ম্রাজ্য। মাথায় অপূর্ব এক ঘননীল আকাশ। তার সঙ্গের গাইড বলেছিল, ছোটবেলায় তার ঠাকুরদার কাছে শুনেছিল, লেক ছিল না একশো বছর আগে, ঠাকুরদার ঠাকুরদা তাঁকে তাঁর বাল্যকালে বলেছিলেন তা। ছিল হিমবাহ, বরফের বিস্তার ছিল অসীমে। সেই বরফ গলে লেকের জন্ম হয়েছে। তপনজ্যোতি বলল, সেই প্রথম দেখার কুড়ি বছর বাদে আবার গিয়েছিল সেই লেক দেখতে। দেখেছিল লেকের বিস্তার বেড়েছে, আর সেই হিমবাহ দূরে সরে গেছে। কুড়ি বছরে অনেকটাই গলে গেছে তা। এই এক মাস, দেড় মাস, দু’ মাসের লকডাউন হয়ত কিছু দূষণ কমাবে। হিমবাহগুলির গলন কমাবে উষ্ণায়ন কমলে। তার বন্ধু এক জৈব বিজ্ঞানী তাকে বলেছে, আন্টারটিকায় হিমবাহর নিচে লক্ষ লক্ষ বছর যারা ঘুমিয়ে আছে, উষ্ণায়নে বরফ গলে গেলে, তাদের ঘুম ভাঙবে। সভ্যতার বিপর্যয় ঘটে যাবে তখন। তপনজ্যোতিকে ঘুমতে যেতে বললাম। ওদের ওখানে রাত অনেক। ঐ গোলার্ধে এখন শীতকাল আসছে।
কিছুই করার নেই। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছি ফোনে। বই পড়ছি। স্ত্রী পুত্রের সঙ্গে কথা বলছি। ভবিষতের কথা আন্দাজ করতে চাইছি। নেট অনুসন্ধান করছি। করতে করতে অনলাইন আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৮৯৮ সালের মহামারির কথা পেয়ে গেছি। প্লেগ মহামারি হয়েছিল। দলে দলে মানুষ পালিয়ে যাচ্ছিল কলকাতা থেকে, সেই বিবরণ রয়েছে ‘ অনুসন্ধান ‘ নামে এক পত্রিকায়। সেই বিবরণ না শুনিয়ে পারছি না। খবরটি বেরিয়েছিল ১৩০৫ সালের ২৫শে বৈশাখ। কবির জন্মদিনে।
“কলিকাতার লোকের আতঙ্ক ভয়ানক বৃদ্ধি পাইয়াছিল। সকলেই বৈভব দূরে ফেলিয়া পুত্রকন্যা সঙ্গে লহিয়া শহর ত্যাগ করিবার জন্য প্রস্তুত হইল। কী ধনী, কী নির্ধন, কী বৃদ্ধ, কী বালক, কী যুবক, কী যুবতী– সর্বসাধারণের সে আশঙ্কা, সে ভয়, সে ভাবনা সহজে বর্ণনা করা যায় না। কেহ রেলওয়ে স্টেশন অভিমুখে, কেহ স্টিমার ঘাটে, কেহ নৌকা সন্ধানে, কেহ গড়িতে, কেহ পদব্রজে- যে যেরূপে যেদিকে সুবিধা পাইল সে সেইরূপ সেইদিকে ছুটিতে লাগিল।...সহস্র সহস্র লোক ভাগীরথীর বক্ষে হাওড়া স্টেশন অভিমুখে ছুটতে লাগল। স্টেশনে দুই হাজার করিয়া লোক বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। টিকিট কিনিয়াও স্থান না পাইয়া সেদিন ৫০০ লোক ফিরিয়া আসিল। অবস্থা বুঝিয়া রেল কোম্পানি নিয়মিত ট্রেন ব্যাতীত অতিরিক্ত তিনখানি ট্রেনের বন্দোবস্ত করিলেন। সমস্ত ট্রেনই পরিপূর্ণ হইয়া গেল। শেষে মালগাড়িতে লোক লইতে বাধ্য হইলেন। স্টেশন হতে পোল পর্যন্ত লোকের ভিড়ে চলাফেরা বন্ধ হইয়াছিল। শেষে গাড়ি, পাল্কি, নৌকা মেলা ভার হইল। অনেক পুত্র-পরিবার লইয়া ব্যতিব্যস্ত হইয়া হাঁটিয়া পলাইতে আরম্ভ করিলেন’। তখন গুজব রটে যে কোয়ারেন্টাইন জারি হবে।”
না এখন কেউ প্রাণভয়ে পালাচ্ছে না। বরং গৃহে বন্দী হয়ে আছে। কিন্তু আতঙ্ক একই। এখন পালাবার পথ নাই, যম আছে পিছে।
রাত ন’টার সময় আলো নিভিয়ে অন্ধকারে প্রদীপ জ্বালাতে আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। আলো কেউ নেভাল, কেউ নেভাল না। প্রদীপ কেউ জ্বালাল, কেউ জ্বালাল না। কিন্তু ন’মিনিট অতিক্রান্ত হলে যেভাবে শব্দ বাজি পুড়ল, আকাশ ভরে গেল আলোর বর্ণালিতে তা আমাকে গভীর বিমর্ষতার ভিতরে নিয়ে গেল। আবার মোমবাতি, মশাল নিয়ে মিছিল বেরল। গো ব্যাক করোনা, শ্লোগান শোনা গেল। দেশটা কেমন আমাদের? দেশের মানুষ কেমন? শিক্ষা কেমন ? হায়! একি বাজি পুড়িয়ে আনন্দ করার সময়? প্রকৃতি দূষিত হলো যে। সারাভারতেই তা হলো।
দূর লন্ডন থেকে বন্ধু, লেখক নবকুমার বসু বললেন, ‘আমরাও দূর দেশের ভারতীয়। মরণের পাড় ধরে হাঁটছি। তখনই দেশের কিছু মানুষ আলোর উৎসব করলেন! হায়।’
০৭.০৪.২০২০
আজ সাতই এপ্রিল। গত দুদিন ধরে আক্রান্তর সংখ্যা বাড়ছে। টেলিভিশন দেখতে ভয় লাগছে। একটি চ্যানেল ক্রমাগত বলে যাচ্ছে, লকডাউন সেপ্টেম্বর অবধি চলবে। কোন মার্কিন সংস্থা বলেছে তা। এতে আমার প্রতিবেশি বিপন্ন পরিবারের গৃহিনী ফোনে জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি, খুব ভয় করছে যে। তাঁর বয়স ষাটের উপর। স্বামী অসুস্থ প্রায়। বাজারঘাট তাঁকেই করতে হয়। অনেক ওষুধ লাগে। আনতে যেতে হয়। চাল-আটা তাঁকে বয়ে আনতে হয়। ফোনে মিতালিকে বলতে লাগলেন, খুব ভয় করছে মিতালি, অতদিন, আমি কি পারব? কাজের লোক নেই, সব করতে হচ্ছে আমাকে। আমিই না অসুস্থ হয়ে পড়ি মিতালি। আমি শুনে বললাম, অতদিন হবে না। আর ওই চ্যানেল দেখতে বারণ কর, ওরাই শুধু এইসব কথা বলছে। যদি হয় তো হবে। ধীরে ধীরে হবে। মানুষ ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। এখন থেকে অনুমান ভিত্তিক খবর না করলে মানুষের আতঙ্ক কমে।
নবকুমার বসু ব্রিটেন থেকে লিখল।
England is mourning while PM is transferred to the Intensive Care Unit at the St Thomas Hospital in London. Corona death rate is still going high.
ইংল্যান্ড শোকগ্রস্ত হয়ে গেছে প্রধানমন্ত্রীকে লন্ডনের সেন্ট টমাস হাসপাতালে ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে স্থানান্তরিত করার খবরে। করোনায় মৃত্যুর হার ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে।
সিলেটের লেখক রুমা মোদক তার ভাসুরের মৃত্যু সংবাদ দিল। মিশিগানে তিনি প্রয়াত হয়েছেন কোভিড-১৯ এ। গত রাতে। কলকাতার এন আর এস হাসপাতাল প্রায় বন্ধ, এক হৃদরোগের ব্যক্তির প্রয়ানের পর দেখা গেল তাঁর ভিতরে এসে বাসা বেঁধেছিল করোনা ভাইরাস। চিকিৎসক, সেবিকা, স্বাস্থ্যকরমী মিলিয়ে ৭৯ জনকে কোয়ারান্টিনে পাঠানো হয়েছে। হাসপাতাল প্রায় বন্ধ। অনেক রাতে টেলিভিশন খবর দিল, ৩০জনের লালা রসের রিপোর্ট এসেছে, সবই নেগেটিভ। আশ্বস্ত হলাম।
আবার এও জানা গেছে পশ্চিমবঙ্গে আক্রান্ত, যাদের রিপোর্ট পজিটিভ, সেই ৬৬জন আক্রান্ত হয়েছে ৭টি পরিবার থেকে। গোষ্ঠী সংক্রমণ আরম্ভ হয়নি মনে হয়। মুম্বয়ের যশলোক এবং ওখহারড হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সকল ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকরমী কোয়ারান্টিনে।
এবারে শিরোনামে ফিরে এসেছে বাঙালির প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল কেমিক্যাল। বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস। বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ৭০০ টাকা পুঁজি নিয়ে একদিন এই সংস্থার প্রতিষ্ঠা করেন। উনিশ শতকের শেষ দিকে এই সংস্থার প্রতিষ্ঠা হলেও ১৯০১ সালে তা লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালসই ভারতের প্রথম ওষুধ নির্মাণকারী সংস্থা। এই লাভজনক সংস্থাকে বিলগ্নী করণে পাঠিয়ে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বহুদিন ধরে। কিন্তু করোনার সংকট কালে ফের খবরের শিরোনামে বাংলার এই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। মূলত ম্যালেরিয়ার জন্য ব্যবহৃত এই ওষুধ রোগ প্রতিরোধে সাহায্যকারী। করোনার মোকাবিলা করতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের দ্বারস্থ হয়েছেন। ভরত সরকার এই ওষুধ রপ্তানি করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। কিন্তু যাই হোক আমেরিকায় এই ওষুধ পাঠিয়েছে। আর্ত সাহায্য চাইলে দিতে হবে। ওই দেশে প্রচুর ভারতীয় বসবাস করেন। একটা দায় আমাদের আছে। সরকার বলছে আমাদের যা প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশিই আছে। ভারত পরে ইংল্যান্ডে প্যারাসিটামল পাঠিয়েছে। বাংলাদেশেও হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন পাঠিয়েছে।
মহামারি যুগে যুগে বহু মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়েছে। মহামারি কি মানুষের সংখ্যার ভারসাম্য রক্ষা করেছে ? মহামারি না হলে, পৃথিবীর প্রতি ইঞ্চি জমি কি ভরে যেত মানুষের পদচিহ্নে ? অত মানুষের খাদ্য কোথা থেকে আসত? দেখছি না, ধান জমি নষ্ট করে কীভাবে নগর পত্তন হয়েছে। হয়েই যাচ্ছে। হিমবাহ গলনের কথা তো আগেই বললাম। এখন হিশেব নিই মহামারি কীভাবে শেষ করেছে মানুষকে। সিন্ধু সভ্যতা, ব্যবিলনীয় সভ্যতা, বিলুপ্ত সভ্যতা কি মহামারিতেই বিলুপ্ত ?
মানব ইতিহাসে, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং টিউবারকিউলোসিস, যক্ষা এসেছিল বন্য প্রাণীকে গৃহপালিত করে তোলায়। অনেক মহামারি অনেক নগরকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। খ্রীস্ট জন্মের ৪৩০ সাল থেকে ৪২৬ সাল , গ্রিস এবং স্পারটার যুদ্ধের সময় এথেন্স নগরে প্লেগ এবং টাইফয়েডে এক চতুথাংশ মানুষ মারা যায়। ২০০৬ সালে এথেন্স নগরের গবেষকরা এথেন্স নগরের গণকবর খুঁড়ে মানুষের দাঁত বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা টাইফয়েড ব্যাকটিরিয়ার উপস্থিতি খুঁজে পেয়েছেন।
খ্রিস্ট পরবর্তী ১৬৫ থেকে ১৮০ সাল সময়সীমায় আন্তোনীয় প্লেগ নামে অভিহিত, আসলে যা ছিল গুটি বসন্ত, সেই মহামারিতে ৫ লক্ষ মানুষ মারা যায়। মহামারি সব সময় কেউ না কেউ বহন করে আনে। এখন এসেছে তা বিমান বাহিত হয়ে, তখন এসেছিল নিকট পুবের দিক থেকে ফিরে আসা রোম সম্রাটের সেনাবাহিনির সঙ্গে। প্রাচীন রোমক ঐতিহাসিক দিও ক্যাসিয়াস লিখে গেছেন, সেই মহামারিতে রোম নগরে প্রতিদিন ২০০০ মানুষ মরছিল। রোম সম্রাট লুসিয়াস ভেরাস এই মহামারিতে ১৬৯ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।
মার্কোর কাছে মেয়র মহামারীর কথা শুনছেন। মহামারীর কথা শুনতে শুনতে দাবায় মন বসে কি।
মার্কো জিজ্ঞেস করলেন, মাননীয় মেয়র, সেজান শহরে কোভিড-১৯ প্রবেশ করেনি কেন ?
আমরা বৃদ্ধদের সব সরিয়ে দিয়েছিলাম আগে, ফলে নগরে ঢুকে দিশাহারা হয়ে কোভিড মরে গেছে।
বৃদ্ধরা কেমন আছেন?
খুব ভালো, তাঁদের আইসোলেশনে থাকতে হবে যতদিন ভ্যাকসিন না বেরোয়।
আমাকে জয়িত্রী এসব কিছুই বলেনি।
জয়িত্রী আপনাকে কিছু বলবে না, আপনিই তাকে বলবেন, জয়িত্রী আপনার কাছ থেকে পৃথিবীর খবর নেবে যা তা লিখবে, সাংবাদিক খবর নেয়, খবর দেয় না।
মার্কো বলল, আমি কি একবার বৃদ্ধাবাসে যেতে পারি ?
মেয়র বললেন, না, আমাদের শহরে বৃদ্ধদের জন্য আলাদা উপনগর গড়া হয়েছে, প্রবেশ করা যায় না, তাঁদের সুরক্ষার জন্যই এই নিয়ম।
মার্কো চুপ করে থাকলেন। তাঁর কত বয়স তিনি জানেন না। তিনি দাবার চাল না দিয়ে উঠে পড়তে পড়তে জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে এতদিন বাদে আমি বিমর্ষ হচ্ছি, উদ্বিগ্ন হচ্ছি।
মেয়র বললেন, কোনো বিমর্ষতার কারণ নেই, আমরা নিয়ন্ত্রণ করেছি ভাইরাস, আর মার্কোর বয়স হয় না, মার্কো পোলো বুড়ো হয় না, উপনগরীতে যাদের রাখা হয়েছে, তাঁরা নড়বড়ে, যে কোনো সময়ে কিছু হয়ে যেতে পারে, তাঁরা আমাদের সম্পদ, এক সময় দেশকে দিয়েছেন অনেক, আমরা তাঁদের ভালো রেখেছি। ভালো রাখা আমাদের দায়িত্ব।
মার্কো পোলো সেদিন একটা শহরের স্বপ্ন দেখলেন। সেখানে শিশুরা সব চুপ করে বসে আছে পথের ধারে, বাগানে, পার্কে, লেকের ধারে। শিশু নয় তারা বৃদ্ধ। বৃদ্ধরা শিশু হয়ে গেছে অথবা শিশুদের গ্রাস করেছে বার্ধক্য। এই স্বপ্ন অনেকদিন বাদে দেখলেন ভূপর্যটক।
অপেক্ষায় ছিলাম। কবে এটা গুরুতে প্রকাশ হবে।
পুঁথিপত্রে যা লিখে রাখছি এক কথায় বেশ লাগলো। ফেসবুক থেকে গুজব, হিমবাহের গলন, সর্বোপরি করোনা সমাচারদর্পণ। কেবল ঐ অ্যান্টার্কটিকায় বরফের নীচে যারা ঘুমিয়ে আছে।
আগে কিছুটা পড়েছিলাম। আজ মন ভরে গেল।
এক জায়গায় অনেক কিছু ধরে রাখা হয়েছে। ভালো।